নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শিউলীর চোখের সামনে হাজার হাজার ডিজিটাল কলাম আর সারি। ওর হাতে একটা ফোন, আর কানে গোঁজা হেডফোন। ওর সামনে বিশাল লক্ষ্যমাত্রা। আজকের দিনে, এই কলসেন্টারে বসে সে কমপক্ষে একশটি কল করেছে, কিন্তু একটিতেও আশানরূপ ফল পায় নি। আজ মাসের ২৮ তারিখ। ফেব্রুয়ারি মাসে দিন কম কেন এটা নিয়ে তার খুব আফসোস হচ্ছে। কারণ এই মাসে সে তার টার্গেটের ধারেকাছেও যেতে পারে নি। টেলিমার্কেটিংয়ের কাজটা খুব আনন্দদায়ক কিছু না। প্রতিদিন সেই গঁঁৎবাঁধা একই কথাবার্তা। রূঢ় আচরণ, গালাগালি, যৌন হয়রানি সবকিছুরই সম্মুখীন হতে হয়। তার মধ্যে আবার আছে ঊর্ধতনদের চোখ রাঙানি। কত টাকার কল করা হলো, কত বিক্রি হলো, রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট ঠিক থাকছে কি না এসব নিয়ে প্রতিদিনই সবাইকে শাসানির ওপর রাখা হয়।
সে এখানে এই নিয়ে মাস তিনেক হবে। প্রবেশন পিরিয়ড চলছে। প্রথম দুই মাসের পারফরমেন্স গড়পড়তা। প্রথম মাসে কোম্পানি তার পেছনে যে খরচ করেছিলো তার বিপরীতে লাভের অংক দেখাতে পারে নি। দ্বিতীয় মাসে খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলো। আর এই মাসে তো ধারেকাছেও নেই! অফিস শেষ হতে আর এক ঘন্টা। এর মধ্যে আর কী এমন হবে! হয়তো আর কয়েকদিনের মধ্যেই এইচ আর থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে, তাকে আর রাখা সম্ভব হচ্ছে না। এই দুঃসময়ে চাকরিটা হারালে কী হবে ভাবতেও ভয় লাগে।
শিউলীর প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি, চেহারা, কণ্ঠস্বর, কথাবার্তা, কোনটাই আহামরি নয়। কে তাকে চাকুরি দেবে? এখানেই বা কী মনে করে তাকে চাকুরি দেয়া হয়েছিলো সে ভেবে পায় না। নিজেকে নিয়ে ভালো কিছু ভাবতে তার বড় অনীহা। সে যেন জীবনের সৎ মেয়ে। তাই তার প্রতি খালি অবিচার হয়। সংসারে অভাব, প্রেমিকেরা চতুর, আশেপাশের মানুষেরা লোভী, বসের মেজাজ খারাপ, পেটে আলসার, এর মধ্যে জীবনে যদি ভালো কিছু ঘটে থাকে, তাহলে সেটা হলো এই চাকুরিটা পেয়ে যাওয়া। কিন্তু মনে হয় না আর এখানে স্থায়ী হওয়া যাবে!
হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে পাঁচ মিনিট কাটিয়ে দিয়েছে। আর বাকি পঞ্চান্ন মিনিট। তারপরেও সে আশার আলো দেখে। জানুয়ারি মাসে একবার শেষ মুহূর্তে সে বড় একটা প্রাতিষ্ঠানিক অর্ডার পেয়ে গেছিলো। এবারও যদি এমন হয়? হতেও তো পারে, নাকি? দরকার হলে আজকে ওভারটাইম করবে। রাত দশটা পর্যন্ত অফিস করবে। এর মধ্যে কিছু একটা করতেই হবে। গতকালকের মিটিংয়ে তার বস তাকে সতর্ক করে দিয়েছে এমনিতেই। “শুনুন শিউলী, একটা প্রতিষ্ঠান ব্যক্তির মত চিন্তাভাবনা করে না। প্রতিষ্ঠান হলো একটা যন্ত্র। একটা সিস্টেম। সে দেখবে ইনপুট কী দেয়া হচ্ছে, আর আউটপুট কী পাচ্ছে। সম্পর্কটা এর মাঝেই আমরা সীমাবদ্ধ রাখার কথা ভাবি। আর তাই মাঝেমধ্যে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আপনি দেখেন, ট্রাই করেন এই মাসের টার্গেট এ্যাচিভ করতে। অন্যেরা পারলে আপনি পারবেন না কেন?”। তার বস তাকে সরাসরি বরখাস্তের কথা বলে না। কে জানে, হয়তো তাকে আরো এক মাস সুযোগ দিতেও পারে। কিন্তু না দিলেই বা কী করার আছে! “শক্ত হও শিউলী, সবসময় ভাগ্য তোমার বিপক্ষে থাকবে না। আজ কিছু একটা হবেই! এই চাকুরিটা যে করেই হোক বাঁচাও!” নিজেকে অটোসাজেশন দেয় সে। স্প্রেডশিটে চোখ বুলায়। ফোনটার কিপ্যাড জ্বলে ওঠে। শিউলীর কড়া পড়া আঙ্গুলগুলি সংকোচে ছুঁয়ে দেয় বাটনগুলি। ওপাশে রিং হতে থাকে। আর এপাশে শিউলীর বুক ধুকপুক করে।
-হ্যালো স্লামালিকুম, ইয়াকুব আলি স্যার বলছেন?
-হ্যাঁ, কে বলছেন?
-স্যার আমি গার্ডিয়ান কার সিকিউরিটি থেকে শিউলী বলছি। ভালো আছেন স্যার?
-কী কাজে ফোন করছেন সেইটা বলেন।
শিউলী বুঝে যায়, এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। গত তিন মাসে কম তো অভিজ্ঞতা হয় নি! বুঝতে পারে এর সাথে কথা বলে খামোখা ফোনের বিল বাড়বে, সময় নষ্ট হবে। তাই সে আর খাতিরের আলাপ না করে সরাসরি বেচাবিক্রির প্রসঙ্গে চলে যায়।
-আমাদের একটা ভেহিকেল ট্র্যাকিং ডিভাইস আছে। আপনি কি ইন্টারেস্টেড?
-না।
বলে লোকটা ফোন রেখে দেয়। হ্যাঁ, এই তো হবার কথা ছিলো! এই দুঃসময়েও নিজের ধারণা মিলে যাওয়ায় নিজেকে বাহবা দেয় সে।
আরো একটা কল। আরো একবার হতাশ হতে হয়। ভদ্রলোক ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। আরো একটা কল, এবার কেউ ধরলোই না শেষ পর্যন্ত! আরো একটা কল। নাম্বার বন্ধ। ওদিকে তার পাশে বসে থাকা আজহার আর রিন্টি ধুমিয়ে বেচাবিক্রি করছে! আজহারের চাকরি গতমাসেই পার্মানেন্ট হয়ে গেছে। রিন্টির আগামী মাসেই হয়ে যাবে নিশ্চিত। বসেরা তাকে পছন্দ করে। না, সে দেখতে সুন্দর, তার দেহখানা সুন্দর বলে না, সে কাজ ভালো করছে বলেই। ওদের দেখে খুব হিংসা হয় শিউলীর। ওকে উশকে দিতেই যেন আজহার একটা গা জ্বালানো হাসি দেয়।
-আজকে ১০টা কনফার্ম করলাম আপা। আজকের দিনটা ভালো। আপনার কী অবস্থা?
শিউলীর কী অবস্থা সেটা আজহার খুব ভালোভাবেই জানে, তবে তার নিজের মুখ থেকে দুরবস্থারবর্ণনাটা শুনলে সে একটু বেশি শান্তি পাবে, এই আর কী! ঠিক আছে, তার ইচ্ছাই পূর্ণ হোক!
-আমার অবস্থা আর কী! ভাগ্যটাই খারাপ। অল্পের জন্যে সব ফশকে যাচ্ছে। আজ একটাও হয় নি।
ম্লানমুখে বললো সে।
-আহা! ভেরি স্যাড। সময়ও তো আর বেশি নেই। এর মধ্যে আর কতটুকু কী করবেন?
আজহার চিন্তিত এবং প্রসন্ন মুখে আশঙ্কা প্রকাশ করে।
-আজ রাত নয়টা পর্যন্ত থাকবো। দেখি যদি কিছু হয়!
-নয়টা পর্যন্ত থাকবেন? আপনার বাসা না মিরপুর? এত রাতে এতদূর যাবেন কীভাবে?
আজহারকে দেখে মনে হচ্ছে সে বেশ উদ্বিগ্ন। সত্যি কি না কে জানে!
-যাবো, সমস্যা নেই। আমার অভ্যেস আছে।
-ঠিক আছে আপা, সাবধানে যায়েন। আমার আবার একটু তাড়াতাড়ি বের হতে হবে আজকে। বিশেষ কাজ আছে। যাই, আচ্ছা?
আজহার বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এখন কল সেন্টারে শুধুমাত্র সে আর রিন্টি। রিন্টি কথা বলে কম। শিউলীর এখন আর কাস্টমারদের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিছুক্ষণ রিন্টির সাথে কথা বলে নেয়া যাক!
-আমি মনে হয় আর বেশিদিন এখানে নেই আপা, বুঝলেন?
-টার্গেটের অবস্থা ভালো না?
-নাহ। হাজার পঞ্চাশেক টাকার কমতি আছে। একটা ফ্লিট অর্ডার যদি পেয়ে যেতাম!
-পেয়ে যাবেন আপা, আল্লাহর ওপর ভরসা রাখেন।
রিন্টির কন্ঠে মমতা আছে। সে হয়তো আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তাকে সান্ত্বনা যোগাতো। কিন্তু টেলিমার্কেটিংয়ের চাকুরিতে সেই সুযোগ সহসা আসে না।
-আপা, আমাকে কাস্টমার কল করেছে। একটু ধরে নেই, কেমন?
রিন্টি সময় চেয়ে নেয়। শিউলীও ব্যস্ত বার চেষ্টা হয়ে ওঠার চেষ্টা করে ফোনকলে।
পেরিয়ে যায় আরো আধাঘন্টা। এরমধ্যে রিন্টি আরো একটা অর্ডার বাগিয়ে নেয়। শিউলীর হিসাববইয়ে কিছুই যোগ হয় না!
রিন্টিও চলে যায় খুশিমনে। আজ তার দিনটাও ভালোই গেছে।
-যাওয়ার সময় লাইট আর এসি অফ করে দিয়েন।
মনে করিয়ে দেয় সে।
হঠাৎ করে শিউলীর ভেতর একটা রাগের শোঁ শোঁ বাতাস বইতে থাকে। ইচ্ছে করে সব ভেঙে ফেলতে। এই সুন্দর অফিস, এসির বাতাস, এল ই ডি লাইট, আর মাস শেষে কিছু টাকা, কিছুই থাকবে না তার! তাকে ফিরে যেতে হবে তার খুপরি ঘরে। সেখানে বাতাস ঢোকে না সহজে। বাতি নিভে গেলে জ্বলার নাম থাকে না। বাবা কাতরায়। মা চিল্লায়। ভাইটা এর মধ্যেও কী কী সব যেন ঔষধ খেয়ে ঘুমায়। সেই বরং ভালো আছে বেশ। চাকুরিটা যখন চলে যাবে, তখন সেও এরকম প্রচুর ঔষধ খেয়ে ঘুমোবে, ঠিক করে।
সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত এক নাগারে কল করে গেলো সে। সবার একই কথা। পরে ফোন করবেন। এখন ব্যস্ত আছি। আহারে, ভদ্দরলোকগণ! মুখের ওপর না করে দিতে একেকজনের কী কষ্ট! মাঝেমধ্যে ইচ্ছে করে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে কলার চেপে ধরে, “শুয়োরের বাচ্চা, গাড়ি কেনার টাকা আছে, আর সামান্য একটা ভেহিকেল ট্র্যাকার কিনতে পারিস না?”।
ইশ! শেষের কলটায় অল্পের জন্যে ফশকে গেলো! ভদ্রলোককে ভালোই ফুঁসলিয়েছিলো সে, হয়তো বা কিনেও ফেলতো, কিন্তু সে আবার প্রিমিয়াম ফিচার ছাড়া কিনবে না। এদিকে তাদের প্রিমিয়ার ফিচারটা যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে কিছুদিন বন্ধ আছে। এটা নিয়ে কারো তেমন একটা গা নেই। কারণ, বেশিরভাগ মানুষ বেসিক অথবা স্ট্যান্ডার্ড প্যাকেজটাই নেয়। “শালার বালের কোম্পানিতে চাকরি করি” মুখ খারাপ করে উঠলো সে বিড়বিড় করে।
তবে অনেকক্ষণের মধ্যে কোন এক জায়গা থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়াতে সে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। এবার হয়তো বা কিছু একটা হবে! হতেই হবে, আজকে একটা হেস্তনেস্ত না করে ছাড়বে না তুমি শিউলী! নিজেকে সে সাহস দিলো।
হবে। এই কলেই হবে। এখনই হবে। হতেই হবে!
-হ্যালো।
শ্লেষ্মাজড়িত কণ্ঠে কেউ ওপাশ থেকে বললো।
-হ্যালো, মতিউর রহমান স্যার বলছেন?
গলায় চিনি ঢেলে প্রশ্ন করলো শিউলী।
-হ্যাঁ বলছি। কে আপনি?
লোকটা একটু কেশে গলা পরিস্কার করে নেয়।
-স্যার আমি গার্ডিয়ান কার সিকিউরিটি থেকে শিউলী বলছি। ভালো আছেন স্যার?
-গার্ডিয়ান কার সিকিউরিটি? এটা কোথায় যেন?
-স্যার, এটা আরামবাগে।
-ও আচ্ছা। এটা কি জুবায়ের আহসানের কোম্পানি?
-এক্সাক্টলি স্যার! তিনি আমাদের কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর। আপনি কি তাকে চেনেন?
-হ্যাঁ, আমরা একসময় একসাথেই থাকতাম মেসে। কিছুদিন আগে তার সাথে কথা হলো, সে তাদের এই ব্যবসার কথা বলেওছিলো। তা আপনি কীজন্যে ফোন করেছেন?
-স্যার, আমাদের একটা ভেহিকেল ট্র্যাকার আছে। এটা দিয়ে আপনি গাড়ির লাইভ ট্র্যাকিং দেখতে পারবেন, ইঞ্জিন অন/অফ করতে পারবেন, এছাড়া আমাদের আছে থেফট প্রোটেকশন…
-দেখেন, আমি জানি এসব। আমি আমাদের কোম্পানির ফ্লিট ম্যানেজমেন্টে আছি। অনেক কোম্পানিই আমাদের এইসব ডিভাইস দেয়ার জন্যে ঝুলাঝুলি করতেছে। আমি কাউকে হ্যাঁ বলি নাই। তবে যেকোন সময় হ্যাঁ বলে ফেলবো। হাহাহা! আপনি ফোন করাতে ভালো হয়েছে। বন্ধুর কোম্পানি থেকে ফোন। যদি ভালো কমিশন দেন তো আজকেই কনফার্ম করে দিবো, অত ঝামেলার কিছু নাই। আপনাদের ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের সফটওয়্যার আছে না? আমার গোটা বিশেক ডিভাইস লাগবে।
গোটা বিশেক ডিভাইস। আট হাজার টাকা করে মূল্য। ডিসকাউন্টে ছয় হাজার টাকা করে দিলেও এক লাখ বিশ হাজার টাকা। চাকরিটা কি তবে বেঁচেই যাবে? আসলে এমনটাই তো হওয়া উচিত। সে তো কাজে ফাঁকি দেয় নি। কঠোর পরিশ্রম করেছে। অন্য সবাই কম কষ্ট করেও কত ডিভাইস বিক্রি করছে, তাহলে তার ক্ষেত্রে বারবার কেন এই অবিচার হবে? খোদা এইবার তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছেন।
-স্যার, আমি কি আপনার ডিটেইলস নিয়ে নিবো?
-তার আগে বলেন কত করে দিতে পারবেন ডিভাইস।
-স্যার, ফ্লিট ম্যানেজমেন্টের জন্যে আমাদের তিনটা প্যাকেজ রয়েছে…
-সবচেয়ে কমদামী কোনটা? সেইটা দেন।
-কমের মধ্যে আছে স্যার বেসিক প্যাকেজ। এটা আট হাজার করে মূল্য, আপনাকে সাড়ে ছয় হাজারে দিতে পারবো।
আসলে সে ছয় হাজারেই দিতে পারতো, কিন্তু কিছুটা হাতে রেখে দেয়া ভালো।
-সাড়ে ছয় হাজার? আচ্ছা ঠিক আছে টোটালের ওপর আর পাঁচ হাজার টাকা কমায়ে দিয়েন।
-এটা আমাদের জন্যে টাফ হয়ে যায় স্যার। তবুও আপনার অনারে এটা আমি করে দিচ্ছি। আপনার একটা এপয়ন্টমেন্ট নিতে হবে ইনস্টলেশনের জন্যে। কবে আপনার সময় হবে?
-উমম, আপনাকে আমি আরেকটা ছেলের নাম্বার দিচ্ছি। ওর নাম সোহেল। ওর কাছ থেকে আপনি শিডিউল নিয়ে বাকি কাজগুলি করে ফেলেন।
মতিউর রহমান সাহেব সোহেলের নাম্বার দিয়ে ফোন রেখে দিলেন।
ফোন রাখার পর জোরে করে একটা শ্বাস ছাড়লো শিউলী। কাজ তো প্রায় হয়েই গেছে! আর একটু বাকি। তার মনের মধ্যে খুশির ঝিরিঝিরি হাওয়া বইতে লাগলো। মনের বনে ডেকে উঠলো নীলকণ্ঠ পাখি। এখন শুধু সোহেলের নাম্বারে কল করে শিডিউলটা নিয়ে ফেলা। তাহলেই তার কাজ শেষ।
সোহেলের নাম্বারে সে ফোন করে ওয়েটিংয়ে পেলো। কারো নাম্বারে কল করলে ওয়েটিংয়ে পেলে সাথে সাথেই আবার কল না করাটা ভদ্রতা। যদিও এখন শিউলীর এসব ভদ্রতা মানতে ইচ্ছা করছে না একদমই। যত তাড়াতাড়ি চুক্তিটা হয়ে যাবে ততই ভালো। তার বুক থেকে একটা ভার নেমে যাবে। এরকম একটা বড় দাঁও মারতে পারলে চাকুরিটা স্থায়ী হবে নিশ্চিতই। আচ্ছা, না হয় একটু পরেই হোক! অপেক্ষা করো শিউলী, ধৈর্য ধরো। নিজেকে প্রবোধ দিলো সে। এত তাড়াহুড়োর কিছু নেই। সারাদিন অনেক চাপ গিয়েছে। এখন একটু নিজেকে বিনোদন দিয়ে পুরস্কৃত করা যাক!
ফেসবুকে কিছুক্ষণ হাসির ভিডিও দেখে মনটা চনমনে হয়ে গেলো তার। এখন সে তার কর্মসূত্রে সৃষ্টি হওয়া একটা নতুন অভ্যাস চর্চা করবে। দিনের মধ্যে ফোন করা বিভিন্নজনের নাম্বার সে প্রায়ই ফেসবুকে খুঁজে দেখে আসল মানুষটাকে পাওয়া যায় কি না। বিশেষ করে কারো সাথে ইতিবাচক কথাবার্তা হলে, বা বিক্রির সম্ভাবনা তৈরি হলে তাদেরকে সে খুঁজে দেখবেই। কাউকে কাউকে পাওয়া যায়, কাউকে কাউকে পাওয়া যায় না। সে প্রথমেই খুঁজলো আজকের বড় দাঁও মতিউর রহমানের নাম্বারটি। নাহ, কিছুই পাওয়া গেলো না। হয়তো বা অন্য নাম্বার দিয়ে ফেসবুক খোলা। এবার সোহেলের নাম্বারটা দেখা যাক। এবার ঠিকঠাক পাওয়া গেলো। কিন্তু যাকে পাওয়া গেলো, তাকে দেখার জন্যে শিউলী মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। তার হাত পা ঝিমঝিম করতে লাগলো। মাথা ঘুরতে লাগলো। মনে হতে লাগলো, এই বুঝি পড়ে যাবে! বোতল থেকে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিয়ে ধাতস্থ হবার চেষ্টা করলো সে। সোহেল নামক এই ঝলমলে চেহারার ছেলেটি তার পরিচিত। শিউলীরা যখন মুগদাপাড়ায় থাকতো, তখন তার পেছনে ঘুরতো ছেলেটা। ঘুরতো বলতে যেমন দুষ্টু, মিষ্টি, রোমান্টিক ব্যাপার বোঝায়, ব্যাপারটি মোটেও সেরকম ছিলো না। সোহেল ছিলো তখন ছিলো চোঁয়ারে চেহারার বখাটে ছেলে। শিউলীকে উদ্দেশ্য করে প্রায়ই কটু কথা বলতো, অশ্লীল গান গাইতো, গা ঘেঁষে দাঁড়াতো। শিউলী সবসময়কার মত তখনও ছিলো দুর্বল আর ভীরু। সে প্রতিবাদ করার সাহস পেতো না। বাসায় বলেছিলো অবশ্য একবার। শোনার পর মা গনগন করতে করতে তার বাড়ন্ত শরীরকে অভিশম্পাত করে পেঁয়াজ কাটা শুরু করেছিলেন, আর বাবা অস্ফুট স্বরে একটা বেদনার্ত শব্দ করে পাশ ফিরে শুয়েছিলেন। পরিবার থেকে কী ব্যবস্থা নেয়া হবে তখনই বুঝে গেলো সে। বারবার বিরক্ত করে তাদের শান্তি সুখের জীবনে ব্যাঘাত ঘটানোর কোন মানে হয় না! লড়াইটা তাকে একাই লড়তে হবে। মানে ঠিক লড়াই তো না, বঞ্চনাগুলি চোখকান বুঁজে সয়ে নিতে হবে যতদিন পারা যায়। তাই প্রতিদিন কটুকাটব্য আর অযাচিত স্পর্শকে অগ্রাহ্য করে চলাটাকেই সে নিয়তি হিসেবে মেনে নিতে চাইলো। এভাবে চললেও হতো।
কিন্তু একদিন! একদিন ভয়াল দিন। সেদিন প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরতে একটু রাত হয়ে গেছিলো তার। সন্ধ্যের অন্ধকারে নির্জন রাস্তায় নির্বিকার ল্যাম্পপোস্টগুলির সামনে সোহেল এবং তার দলবল মিলে উঠিয়ে নিয়ে গেলো তাকে একটা গাড়িতে করে। তারপর, সে কী অসহ্য যন্ত্রণা! এতদিন ধরে খবরের কাগজে যে ভয়াবহ সংবাদগুলি পড়েছে, তা ঘটতে লাগলো নিজের সাথে। রক্ত ঝরলো। চিৎকার হারিয়ে গেলো নিষ্ঠুর ক্ষয়া দেয়ালের মাঝে। ঐ সময়েও তার বাঁচার তৃষ্ণা কমে নি একটুও। ওরা যখন তাকে কুঁড়ি থেকে কাষ্ঠখন্ডে পরিণত করছে তখন প্রাণপণে শুধু একটাই আর্তি করেছে, “আমাকে কষ্ট একটু কম দেন, আর মেরে ফেলেন না!”। ওরা তার কথা রেখেছিলো।
ফলাফল? এখন সে বেঁচে আছে, এসির বাতাসে গা এলিয়ে দিয়ে আছে আরামদায়ক চেয়ারে। প্রচুর ব্যালান্সঅলা একটা ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জীবনের চরমতম অপমানকারীকে ফোন করতে।
শিউলী এখন কী করবে?
মতিউর সাহেবকে ফোন করে বলে দেবে, যে সে সোহেলের সাথে কথা বলতে পারবে না? তার মত এমন উচ্চপদস্থ ব্যক্তির কাছে এমন অনুনয় নিশ্চয়ই হাস্যকর বাহানা মনে হবে? তার কি পুরোটা শোনার মত সময় হবে? শিউলীর চোখের সামনে সাপের মত কিছু সমীকরণ এঁকেবেঁকে চলছে। যদি সে সোহেলকে ফোন না করে, এই অর্ডারটা সে পাবে না। অর্ডারটা না পেলে তার মাসের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না। চাকুরিটাও চলে যাবে। গত মাসেই দুইজন ইন্টার্নকে বাদ দেয়া হয়েছে তিনমাসে প্রত্যাশিত পারফরমেন্স দেখাতে পারে নি বলে। চাকুরিটা চলে গেলে কী হবে ভাবতেই পারছে না সে। মহামারির সময়ে তার মায়ের বাটিকের কাপড়ের ব্যবসাটা লাটে উঠেছে। বাবার ঔষধের পরিমাণ দিনদিন বেড়ে চলেছে। সঞ্চয় বলতে তেমন কিছু নেই। চাকুরিটা আছে বলে শাক-পাতা দিয়ে ভাত খেতে পাচ্ছে দুবেলা। নইলে আক্ষরিক অর্থেই না খেয়ে থাকতে হবে।
কিচ্ছু করার নেই। মতিউর রহমান সাহেবকে সহৃদয় মানুষই বলে মনে হয়েছে। তাকে একবার ফোন করে বুঝিয়ে বললে সে বুঝবে না? দুরুদুরু বুকে সে ফোন করেই ফেললো।
মতিউর রহমান ফোন ধরলেন। এবার তেমন সহৃদয় কণ্ঠ না। খুব বিরক্ত।
-কে? কেন ফোন করেছেন?
-স্যার আমি আধ ঘন্টা আগে আপনাকে ফোন করেছিলাম, ভেহিকেল ট্র্যাকারের ব্যাপারে।
-অ। আচ্ছা। আপনাকে একটা নাম্বার দিছিলাম। ফোন করছিলেন?
-না স্যার, আসলে হয়েছে কী…
-হয়েছে কী আবার কী? ফোন করেন, তার সাথে ব্যাপারটা ডিল করে ফেলেন। আমাকে এর মধ্যে আর টানবেন না। বুঝলাম না আপনি আমাকে কী মনে করে ফোন করলেন আবার। আপনাকে তো খুব ইনএফিসিয়েন্ট মনে হচ্ছে। আমার বন্ধুর কাছে আপনার ব্যাপারে রিপোর্ট করার কথা ভাবতে হবে আমাকে।
গনগনে আগুন ঢেলে সে ফোনটা রেখে দিলো।
ঠিক আছে, ফোনটা তাহলে করতেই হবে? ফোন করে তাকে মিষ্টিমধুর কন্ঠে ভাই সম্বোধন করে চুক্তিটা সম্পন্ন করে ফেলতে হবে, এই তো? কী আর এমন কঠিন কাজ, তাই না? এর চেয়ে সেদিন তার মৃত্যু হলো না কেন! তার এই মৃত্যুমুখী দোনোমনার মধ্যেই হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। চমকে উঠলো সে। সোহেল কল ব্যাক করেছে নাকি? তিরতির করে ঠোঁট কাঁপছে তার। মনে পড়ছে চরমতম গঞ্জনার কথা। মনে পড়ছে সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঘর আর বুনো উল্লাসের দুঃস্মৃতি। একটা অশ্লীল গান বাজছিলো উচ্চস্বরে। “দুনিয়াটার মজা নাও না দুনিয়া তোমার আমার”। রিংটোনের শব্দটাকে অবিকল সেই গানটার মতই লাগছে। শিউলী ভীত হরিণীর মত নাম্বারটার দিকে তাকালো। অচেনা নাম্বার। সোহেলেরই।
সেই রাতে একটা মেয়ে একা একা হেঁটে যাচ্ছিলো বহুপথ। আকাশ থেকে তারারা খসে পড়ছিলো তার গায়ে। রাতটা ছিলো সুন্দর। পথটা ছিলো নির্জন। মাঝেমধ্যে মোটরদানবেরা বিকট শব্দ করে ধোঁয়া ছেড়ে চলে যাচ্ছিলো। তাকে যেতে হবে অনেক দূরে। শহরের শেষ প্রান্তে। বাসগুলি ছেড়ে যাচ্ছে একের পর এক। কন্ডাক্টররা বাজখাঁই গলায় তার বাসস্থানের নাম ধরে ডেকে যাচ্ছিলো। কিন্তু তার বাসে উঠতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। হাঁটতেই ভালো লাগছিলো। একটা অন্ধ ভিখিরী তার পথরোধ করে দাঁড়ালো। টাকা চায়। মেয়েটা তার সস্তা ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে ঝেড়েমুছে যা আছে সব বের করে দিলো। বাস ভাড়াটাও তার আর থাকলো না। সে অন্ধ ভিখিরীর সাথে পথ চলতে লাগলো। এই মুহূর্তে তার জীবনের দিক নির্দেশনা দেয়ার এর চেয়ে যোগ্য আর কারো কথা তার মনে পড়ছে না।
মেয়েটা হাঁটে…
৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:২০
হাসান মাহবুব বলেছেন: ধন্যবাদ হাবিব। শুভকামনা।
২| ২৯ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:৪৩
চাঁদগাজী বলেছেন:
সমসাময়িক প্লট, শেষটা কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন, গন্তব্যহীন।
৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:২১
হাসান মাহবুব বলেছেন: শেষটা পাঠকের ভাবনার জন্যে উন্মুক্ত করে রেখেছি।
৩| ২৯ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:৪৪
সেলিম আনোয়ার বলেছেন: সুন্দর।
তবে তলানি থেকে উঠে আসার গল্প প্রেরণাদায়ক হয়। আপনি না ব্লগে প্রবেশ করার প্রেরণা খুজছিলেন হাসান মাহবুব।
বহুদিন পর ব্লগে সুস্বাগতম ।
৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:২১
হাসান মাহবুব বলেছেন: ধন্যবাদ কবি সেলিম আনোয়ার!
৪| ৩০ শে জুলাই, ২০২১ বিকাল ৫:১৩
মোস্তফা সোহেল বলেছেন: ভালই লিখেছেন।
৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:২১
হাসান মাহবুব বলেছেন: ধন্যবাদ মোস্তফা সোহেল!
৫| ৩০ শে জুলাই, ২০২১ রাত ১১:১২
কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: হামা ভাই, এতদিন পরে এসে এইভাবে শুন্যতায় ফেলে দিলেন? নির্মম মনস্তাত্বিক দন্দে অন্ধ ভবিষ্যতের ছবি। শেষ দৃশ্যটা মনে হয় চোখে দেখলাম।
০২ রা আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৪:৪৩
হাসান মাহবুব বলেছেন: পড়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ জাদিদ!
©somewhere in net ltd.
১| ২৯ শে জুলাই, ২০২১ রাত ৯:৩৬
হাবিব বলেছেন: অনেক দিন পর আপনার পোস্ট পেলাম। ভালো লাগলো ্