নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি কেউ নই।কোথাও কেউ নাই। শুধু শূন্য। মহাশূন্য।\n

রেফায়েত প্রধান

পরিচয় খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি । খুঁজে পেলেই জানিয়ে দেব।

রেফায়েত প্রধান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প

০৫ ই মে, ২০১৫ রাত ১০:০৩

"ধূসর জীবন "

,১। সারাটা দিন কেটে গেল সূর্য-
মেঘের লুকোচুরি খেলাতেই। ব্যাপক
গর্জন করেও শেষ পর্যন্ত কিছুই বর্ষণ
করেনি গোমরা আকাশ টা। গত কয়েক
দিন ঢাকার গড় তাপমাত্রা ছিল
৩৮°সে।
,
,ইলেকট্রিসিটি নেই, বাস করার মত
পর্যাপ্ত জায়গা নেই, পান করার মত
বিশুদ্ধ পানি নেই, হাজারো নেই এর
মিছিলে যোগ হয়েছে বৃষ্টি নেই। ।
,
,
২। মোবাইলের বেসুরো এলার্মের
কারণে শেষ পর্যন্ত জাগতেই হল।
বরাবরই আমার একটা কথা মনে হত,সেই
মেডিকেল লাইফের প্রথম দিন
থেকেই,অবশ্য গত কয়েক দিন ধরে খুব
বেশি মনে হচ্ছে "মেডিকেল লাইফ টাও
তো মোবাইলের মত যন্ত্র ছাড়া আর
কিছুই না "
,
সকাল ৭ টা থেকে শুরু দুপুর ২.৩০ পর্যন্ত
ক্লাশ,ওয়ার্ড, প্র্যাক্টিক্যাল, কত কি!!!
,
এরপর হলে ফিরে নাকে মুখে দু-
চারটা ভাত গিলে বিছানায়
এলিয়ে পরা। ।
,
,৩। দ্রুত তৈরী হয়ে সন্ধ্যার আগে আগেই
night duty 'র জন্য ওয়ার্ডের
দিকে রওনা দিলাম ।কোন মানে হয় এই
" robotic life " এর?? একটি শব্দের
কাছেই আবারো হার মানা " DOCTOR "
রাস্তায় নেমেছি, বলা নেই, কওয়া নেই
হুট করে শুরু হল মুষুল ধারে বৃষ্টি ।বহু
কাংখিত ,স্বস্তির বারি বর্ষণ।
,
,
৪। মৃত্যু দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি।মৃত্যু, দু:খ-কষ্ট, এই ব্যাপার গুলোকে মনে হয় ডাইনিং এর ডাল-ভাতের মত। এ ব্যাপার গুলো না ঘটলেই বরং মনে হয় দেশটা ঠিকমত চলছে তো???
,
,জরুরী বিভাগের সামনে দেখালাম ছোট-খাট একটা জট্লা। হবে হয়ত কেউ,হাজারো অভাব-অভিযোগে ভরপুর এই দেশ থেকে মুক্তি নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে না ফেরার দেশে।
.
ওয়ার্ডে ঢুকে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল,দেখি বেডে শুয়ে মৃত্যু যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে এক হতভাগা। ক্যান্সারের প্রবল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে তার জীবন তরীর প্রতিটি তক্তা। চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া কারো কিচ্ছু করার নেই। সর্দি-জ্বর, ডায়রিয়ার মত মামুলি অসুখে যেখানে মানুষ মারা যায় কেবল সমাজের প্রতিটি রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্ণীতির কারণে সেখানে ক্যান্সারের বিরুদ্ধে সাতার কাটা তো অসম্ভব ব্যাপার।
,
নিজেকে বড় অসহায় মনে হচ্ছে। ব্যাথায় চিনচিন করতে লাগল গোটা মন-শরীর। যেন একটা ওয়ার্নিং। এভাবে আর কত দিন ,,,,
,
,
৫। রাত ১১ টা। যাচ্ছি ক্যান্টিনে খাবার খেতে। দেখতে পেলাম জরুরী বিভাগের সামনে দেয়ালে হেলান দিয়ে লাশটার দিকে তাকিয়ে আছেন মহিলাটি। পলকহীন চোখে।
,
খাবার শুরু করার পর আর শেষ করতে পারি না। চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠতে লাগল অসহায় নারী মুর্তির নিষ্পলক চাহনী?যাতে নেই কোনো আশা,নেই ভালোবাসা। আছে শুধু হতাশা আর ধোঁয়াশা।
,
,
৬। বৃষ্টি ঝড়ছে তো ঝড়ছেই ।ঢাকা শহরের সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে বুড়িগঙ্গার পেটে ঢেলে দিয়ে তবেই ক্ষান্ত হবে বোধহয়। অবশ্য ঢাকা শহর ভেসে যাবার জন্য এত বৃষ্টির দরকার নেই।
,
কাছে গিয়ে মহিলাটি কে ডাক দিলাম, ,
এই যে শুনছেন??
কোনো জবাব নেই। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। আবারো ডাকলাম কিছু প্রশ্ন করলাম। উত্তরে যা বললেন তা অনেকটা এ রকম, ,,
"লাশটা তার স্বামীর। বাড়ি রংপুর। আত্নীয় -স্বজন খুব একটা নেই। "
,
স্ট্রেচারটি বৃষ্টি থেকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে রেখে এলাম।ভদ্র মহিলাকে ওয়াশ রুম দেখিয়ে দিলাম -পরিষ্কার হবার জন্য।
আমি গেলাম ক্যান্টিনে খাবারের ব্যাবস্থা করা যায় কিনা দেখতে।
,
,৭।মহিলাটি খাবারের চেয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছেন বেশি।আলাপ করার চেষ্টা করলাম তার সাথে, ,
- দুর্ঘটনাটা ঘটল কিভাবে?
= বিপরিত দিক থেকে আসা একটা বাস চাপা দিয়ে চলে গেল।
,
লাশটা দেখেছি আমি, মাথা একেবারে থেঁতলে গেছে। বললাম
- আপনার আত্নীয় -স্বজন কেউ কি নেই ঢাকায়?
= একটা মেয়ে আছে শুধু।
- কোথায় সে?
প্রশ্ন শুনে যেন বোবা হয়ে গেলেন। চোখের দিকে তাকিয়ে দেখি রাজ্যের শূন্যতা। মনে হল বিশাল শূন্যের মাঝে অন্ধের মত কিছু হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। বললাম, - কোথায় আপনার মেয়ে?
= কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে। দুটো কিডনিই নষ্ট হয়ে গেছে ওর।
আমি আঁতকে উঠলাম, ,,
- বলেন কি?
তিনি বলতে লাগলেন,,,
" মেয়েটার জন্যই আমাদের ঢাকায় আসা।তিনজনের ছোট্ট, সুখি একটা সংসার ছিল আমাদের। সব শেষ হয়ে গেল আমার।"
তাকে সান্তনা দেবার চেষ্টা করলাম। জানি তার ভিতর কষ্টের যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে সেটা থামানোর সাধ্য আমার নেই। তারপর ও বললাম, ,
- আপনার মেয়ের জন্য আপোনাকে শক্ত হতে হবে, বাঁচতে হবে।
= আমি এখন কি করব? কিভাবে বাঁচাবো আমার মেয়েকে?
- আপনার মেয়ের এই সমস্যা ধরা পড়েছে কবে?
= মাস ছয়েক আগে । একদিন হঠাৎ করে তানহা বললো ওর কমরের একটু উপরে ব্যাথা করতেছে
- তারপর?
= কিছুদিন পর আবারো একই কথা বললো।আরো বললো প্রস্রাব করতে কষ্ট হয়।তাকিয়ে দেখি হাত-পা ফুলে গেছে।
- ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন তারপর?
= হ্যাঁ। টেষ্ট করার পর ডাক্তার বললেন দুটো কিডনিই নষ্ট। ঢাকায় নিয়ে যেতে হবে। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে হবে।
- তারপর?
= আমাদের মাথায় তো আকাশ ভেংগে পড়ল।ডাক্তার কে বললাম কত টাকা লাগতে পারে?
ডাক্তার বললেন লাখ চারেক।
- তারপর??পরদিন তানহার বাবা আমাদের বাড়ির উত্তর পাশের বড় জমি দুইটা চেয়ারম্যান সাহেবের কাছে তিন লাখ টাকায় বিক্রি করল।ওটাই ছিল আমাদের একমাত্র সম্বল।
- ঢাকায় আসার পর কি করলেন?
= ওর বাবা ট্যাক্সি চালানো শুরু করল আর আমি গার্মেন্টসে কাজ করা শুরু করি।খেয়ে না খেয়ে টাকা জমাতে থাকি।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার মহিলাটি আবার বলতে লাগলেন, ,
"তানহার বাবা আজ টাকা নিয়ে ডাক্তারের কাছেই যাচ্ছিল। পথেই এই দুর্ঘটনা।
বললাম,,
- টাকা গুলে কি পেয়েছেন?
= না,পাইনি।
,
ভাবছি আমরা কত নিচে নেমে গেছি,,!!মানবতাবোধ আজ কোথায়??
নিশ্চয় ভিরের ভিতরে কোনো ইতর টাকা টা নিয়ে কেটে পড়েছে ।
,
মহিলাটি কেঁদেই চলেছেন। এখন যেন তার চোখের পানি আর কিছুতেই বাঁধ মানছে না।
,
আর আমি ভেবেই চলেছি কি হবে এখন মা-মেয়ের জীবনের??
,
,
৮।মহিলার দু:খের কাহিনী শুনতে শুনতে ভোর হয়ে গেছে। রাতেই আমি আন্জুমান মৃফিদুল ইসলামে ফোন করে বলেছিলাম সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসতে।
,
ওরা চলে এসেছে ।
আমি তাদের বললাম, লাশটা আপনারা দাফন করে তারপর ফিরবেন। এই ভদ্র মহিলার আপন বলে কেউ নেই।
আর মহিলাটি কে বললাম, আপনি চিন্তা করবেন না। দেখি আপনার জন্য আমরা কিছু করতে পারি কিনা।
,
,
৯। লাশবাহী গাড়ি চলে গেল ধুলো উড়িয়ে, ,,
আর আমি ভাবছি আমরা কি কিছুই করতে পারি না ছোট্ট এই বাচ্চাটির জন্য যার দুটো কিডনিই আজ নষ্ট।
আমাদের পাড়তেই হবে, কারণ আমরা ডাক্তার ,এভাবে মানবতার মৃত্যু, মনুষত্বের মৃত্যু আমরা হতে দিতে পারি না। ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.