নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি রইসউদ্দিন গায়েন। পুরনো দুটি অ্যাকাউন্ট উদ্ধার করতে না পারার জন্য আমি একই ব্লগার গায়েন রইসউদ্দিন নামে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছি এবং আগের লেখাগুলি এখানে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আবার প্রকাশ করছি।

গায়েন রইসউদ্দিন

গায়েন রইসউদ্দিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির পথ ধ\'রে আন্দামানে (প্রথম পর্ব)

০৮ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৫:২৯

আমাদের আদিনিবাস ছিল পূর্ববঙ্গে(অধুনা বাংলাদেশ)। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে বর্তমান ভিটে-মাটি,দঃ ২৪ পরগনার,চুনফুলি গ্রামে।অভিজাত জমিদার পরিবারে আমার জন্ম হলেও—‘জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’।পুরোনো বাসভবন জরাজীর্ণ, বৈঠকখানার ফাটলে ফাটলে, অযাচিত বটগাছের নবজন্মের ধারা শুরু হয়েছে। ভাঙা ছাদের ওপর রঙিন ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে, মনে মনে কত যে গানের কলি, অন্তরা বাদ দিয়ে সঞ্চারী, আভোগের কথা টেনে এনে আস্থায়ীতে সংযোজন করেছি, তার হিসাব কে রাখে! কালের চক্রাবর্তে সব যায় হারিয়ে! সৃষ্টি আর ধ্বংস প্রকৃতির চিরন্তন লীলা খেলা!
আমার তখন কৈশোরের গন্ডি ছাড়িয়ে, প্রথম বসন্তের উপলব্ধি। রাজনীতির শিকার হলেন আব্বা।রাজবন্দী অবস্থাতেই নিভৃত কারা-কক্ষে তাঁর অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটে।তাই বাস্তব ঘাত-প্রতিঘাতের সাথে সহজ সখ্যতা লাভের সুযোগ ক’রে দিল অনাকাঙ্খিত আর্থিক অস্বচ্ছলতা। আমি অপেক্ষাকৃত ছোট ব’লেই(৭ম সন্তান,তিন বড় ভাই-বোনের পরে)সাংসারিক/পারিবারিক ভাবনার দায়-ভার প্রায় ছিলনা বললেই হয়। তবুও নানান অশান্তির পরোক্ষ প্রভাবে, আমার মন চঞ্চল হয়ে উঠত। আব্বা বেঁচে থাকতে, আমাদের পরিবারে অপরিসীম আনন্দের স্রোত বয়ে যেত! সন্ধ্যা হ’লেই প্রশস্ত বৈঠকখানায়, কাঠের বড় বাক্সের মতো রেডিও ঘিরে, চেনা-অচেনা মানুষের ভিড়। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কত সুরের গান প্রায়ই আমাদের কানে এসে বাজতো। পড়ার ঘরে দরজা-জানালা বন্ধ ক’রে গুণধর পন্ডিতমশাই শুদ্ধ বৈদিক উচ্চারণে সংস্কৃত পড়াতেন। কামালহোসেন ইংরেজি পড়াতেন সাহেবী ঢঙে বিলেতি কায়দায়। গণেশচন্দ্র হালদার মাস্টারমশাই, ছড়ি হাতে তর্জন-গর্জন ক’রে শেখাতেন অঙ্ক-শাস্ত্র। বাকিবুল্লা ওস্তাদজী পড়াতেন আরবী, মোটা বেত হাতে, বাকযন্ত্রের ১৭ টা মাখরেজ্ বা উচ্চারণস্থলের সঠিক/উচিত ব্যবহারে ডাঁয়ে, বাঁয়ে, সামনে, পিছনে হেলেদুলে। মাঝে মাঝে দাদাজী গোলাম কাদের গায়েন, আমাদের পড়াশুনা কেমন চলছে দেখতে আসতেন। তখন মাস্টারমশাইদের কড়া শাসন, রক্তচক্ষু আর তর্জন-গর্জন থেকে রেহাই পেতাম। বেশ মজার মজার গল্প শুনিয়ে সাহিত্যরসবোধ জাগিয়ে তুলতেন। কবিতা ও গল্প লেখার উৎসাহ দিতেন। কোনো বইয়ের সাহায্য নিতেননা; নিজেই যেন এক গ্রন্থাগার। আগ্রহী পাঠক তাঁর সুদর্শন মুখমন্ডল দেখে পড়ে নিলেই হ’ল। তাঁর মুখনিঃসৃত বাণী সংগ্রহে যত্নশীল হ’লে আজ হয়তো আমার সাহিত্যজগতে প্রবেশের নৈতিক সাহস ও দক্ষতা থাকতো।
বড়ভাই ও মেজভায়ের কন্ঠে একটা গান প্রায়ই শোনা যেত—‘বন্দেমাতরম’। আমাদের শান্ বাঁধানো ঘাটে ছিপ ফেলে মাছ ধরতে ব’সে প্রায়ই এ গান গাইতে শুনেছি তাঁদের কন্ঠে। শুনে শুনে গানের সুর ও বাণী একেবারে মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
জমিদারি উচ্ছেদ হ’লেও,বহুকাল ধ’রে আমাদের কোনো অভাববোধ হয়নি।দহলিজের পাশের কামরাতে পাল্কী বওয়া ঊড়ে(উড়িষ্যার লোক)বেহারারা থাকতো। বৈঠকখানার পিছনে, পুকুরপাড়ে ছিল স্যাকরাদের(স্বর্ণকারদের) থাকার ঘর।পাল্কিতে চ’ড়ে আমি একবার মায়ের সাথে, নানার বাড়ি গিয়েছিলাম। বেহারাদের হেঁইয়ো হেঁইয়ো বুলিতে, গ্রামের মেঠো পথ ধ’রে যাওয়া সে কি আনন্দ, তা’ আমি কোনো ভাষায় বুঝিয়ে বলতে পারবনা। ঐ একই গ্রামে(উলুর ডাঁড়)আমার মেজদি’র বিয়ে হয়েছিল। বর্ষা থেকে হেমন্তকাল পর্যন্ত ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা খালপথে কাঠের ডোঙা চলে। সেই ডোঙায় ব’সে যেতে যেতে সুর-তাল-লয় বিহীন কত গান যে আপন মনে রচনা ক’রে গেয়েছি, তা’ আজ আর আমার স্মৃতির পাতায় নেই। শুধু মনে আছে,গান গেয়েছিলাম।
এক সময় পাল্কী বওয়া বেহারারা বিদায় নিল। স্যাকরারাও চলে গেল।ধোপা পাড়া থেকে ধোপারা আগের মতো জামা-কাপড়ের বড় গাঁঠরী মাথায় নিয়ে আর আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করেনা। কলুর হাট থেকে কলুরা আর তেল দিয়ে যায়না। পাথরবেড়িয়ার পানের বরজ থেকে আসেনা, পানের ঝুড়ি মাথায় নিয়ে পানুয়া। ফুলবাগানের মালী চলে যাওয়ায়, বেলফুল, কাঁঠালিচাঁপা, রজনীগন্ধা, গোলাপ, হাসনুহানা আর ফোটেনা। আর নেই প্রজাপতি, ভোমরা, মৌমাছিদের আনাগোনা। শুধু রাতের অন্ধকারে মৃদু-মন্দ হাওয়ায় ভেসে আসতো বকুল ফুলের গন্ধ! খুব ভোরবেলায় স্নানের ঘাটের পাশে গিয়ে দেখতাম পড়ে আছে অসংখ্য ঝরা বকুলের ফুল।
লালচাঁদ নামে একটা গরু(তার কপালে শুভ্র চাদেঁর মতো আঁকা ছিল, তাই তার নাম রাখা হয়েছিল লালচাঁদ) যেদিন বিক্রি হয়ে গেল, আমি তার অশুসিক্ত দু’চোখ দেখেছি! হরিণডাঙার পুরকাইত পরিবারের লোকজন, তাকে গলায় মোটা দড়ি বেঁধে জোর ক’রে টেনে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। তবে, পরদিন সে পালিয়ে এসেছিল। আব্বা আর তাকে পাঠায়নি। কিন্তু যেদিন আবুজেহেল চাচা, বাড়ির চাকর হরমুজ মিঞা ও মসজিদের ইমাম সাহেব বকর্-ঈদের দিন ক্কোরবানি করতে নিয়ে গেল, আমি আমার চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। আমি কাঁদছি কেউ যদি দেখে ফেলে, সেই ভয়ে ভাঙা ছাদের চিলেঘরে ঢুকে, একা একা কেঁদেছি।
দিন ফুরোলো। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে একটু একটু বড় হওয়া। গৃহবাসের গন্ডি ছেড়ে, বাইরের শিক্ষাগ্রহণ-বিদ্যার্জন। বিদ্যাশিক্ষা যা’ হ’ল, তা’ জীবনের প্রতিযোগিতায় অচল। পড়ন্ত বিকেলে বহুদূরবিস্তৃত খোলামাঠের মাঝে, কবরস্থানের আশেপাশে, ঘুরে ঘুরে আমি অতীতের হারিয়ে যাওয়া সেই দিনগুলো, সেই মানুষগুলোকে খুঁজে বেড়াতাম। সবুজ ঘাসের ওপর ব’সে. খোলা আকাশে, অসীম শূন্যের দিকে চেয়ে খুঁজে ফিরতাম সারাটা বিকেল, সন্ধ্যা, রাতের গহন অন্ধকারেও! দূর থেকে আলো-আঁধারে কেউ আমায় দেখে ফেললে, আমার ভাবনায় ছন্দপতন ঘটতো। এক অতৃপ্ত মনে ফিরে যেতাম সেই জীর্ণ-পুরাতন ঘরের কোণে। বিপুল ঐশ্বর্যের অকল্পনীয় শূন্যতার মাঝে সবচেয়ে বেশি মনে পড়তো আমার আব্বাকে। কারাগারের অন্তরালে তাঁকে হারানোর ব্যথা আমার অসহনীয় ছিল। এই দূঃসহ যন্ত্রণা ভুলে থাকার উদ্দেশ্যেই এক অজানার পথে পাড়ি দেবার কথা ভেবেছিলাম।
রবি ঠাকুরের “তাসের ঘর’-এ নিবদ্ধ একটা গান আমাকে এক রূপরাজ্যের সন্ধান দিয়েছিল:-
“যাবই আমি যাবই,ওগো বানিজ্যেতে যাবই।
লক্ষীরে হারাবই যদি,অলক্ষীরে পাবই।
সাজিয়ে নিয়ে জাহাজখানি বসিয়ে হাজার দাঁড়ি-
কোন্ পুরীতে যাব দিয়ে কোন্ সাগরে পাড়ি।
কোন্ তারকা লক্ষ্য করি কূল কিনারা পরিহরি
কোন্ দিকে যে বাইবো তরী বিরাট কালো নীরে-
মরবনা আর ব্যর্থ আশায় সোনার বালুর তীরে।।
নীলের কোলে শ্যামল সে দ্বীপ প্রবাল দিয়ে ঘেরা
শৈলচূড়ায় নীড় বেঁধেছে সাগর বিহঙ্গেরা।
নারিকেলের শাখে শাখে ঝোড়ো বাতাস কেবল ডাকে
ঘন বনের ফাঁকে ফাঁকে বইছে নগনদী।
সাতরাজার ধন মানিক পাবো সেথায় নামি যদি।।‌”
এই গানে, কথা ও সুরের অপূর্ব মেলবন্ধনে, আমার মনে তখন এক কল্পরাজ্য বিরাজ করছে। মনে হয় যেন আমার বহুযুগের স্বপ্নে ঘেরা সবুজ দ্বীপ, এক রূপকথার দেশের সন্ধান আমি পেয়েছি।(ক্রমশঃ)

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:০৮

সোজোন বাদিয়া বলেছেন: আপনার জীবনের ঘটনা এবং বর্ণনা দুটোই প্রাণস্পর্শী।

২| ১১ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৪:৪৩

গায়েন রইসউদ্দিন বলেছেন: ধন্যবাদ পাঠক-বন্ধু সোজন বাদিয়া, আপনার সহানুভূতিপূর্ণ মন্তব্য করার জন্য। সঙ্গে থাকুন, আরো অনেক কথা বলবো। আপনিও বলবেন।...আন্দামান, ভারত থেকে রইসউদ্দিন।

৩| ০৩ রা জুলাই, ২০১৮ রাত ৩:৩৯

রাকু হাসান বলেছেন: এই পর্বও পড়া শুরু করলাম । ...

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.