নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি রইসউদ্দিন গায়েন। পুরনো দুটি অ্যাকাউন্ট উদ্ধার করতে না পারার জন্য আমি একই ব্লগার গায়েন রইসউদ্দিন নামে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছি এবং আগের লেখাগুলি এখানে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আবার প্রকাশ করছি।

গায়েন রইসউদ্দিন

গায়েন রইসউদ্দিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

স্মৃতির পথ ধ\'রে আন্দামানে (দ্বিতীয়পর্ব)

০৯ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:৫৯

১৯৮৩-র ১লা অগাস্ট।‘এম.ভি.আন্দামান’ জাহাজে সেই প্রথম পাড়ি দেওয়া আমার স্বপ্নেগড়া স্বপ্নপুরী সবুজ দ্বীপের সন্ধানে। কূল-কিনারাহীন ঘন নীল(‘কালাপানি’,প্রচলিত লোক কথায়) মাঝসমুদ্রে এসে,ফেলে আসা মা-ভাই-বোন-আত্মীয়স্বজনের করুণ মুখশ্রী—সেই ছায়ায় ঢাকা গ্রামের মেঠোপথ, সবুজ বনানী, সোনালি ধানক্ষেত, বাঁশবন, বটের ছায়া, বহুদূরবিস্তৃত খোলা মাঠ (যাকে আমি তেপান্তরের মাঠ কল্পনা করতাম!), সেই পুকুরঘাট, শান্ত সমাধিক্ষেত্র, নিঃসঙ্গ সন্ধ্যা, রাতের আকাশ, এক মুহুর্তে জীবন্ত হয়ে ওঠে আমার মনে, স্মৃতিপটে, ভাবনায়! আমি পাগলপ্রায় হয়ে যাই! বুকের মাঝে একটা ব্যথা অনুভব করি! সবার অলক্ষ্যে চোখের পানি মুছে ফেলি। জাহাজের দোল খেতে খেতে কখন যে দুচোখে ঘুম জড়িয়ে আসে বুঝতে পারিনা। সকালের ঘনঘোর আকাশে, সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গমালার আঘাত সজোরে আছড়ে পড়ে জাহাজের গায়, আমার দেহে, মনে! দিন যায়, রাত আসে পালাবদলের খেলায়।
৬-ই অগাস্টের সকাল। স্বর্ণালি রোদের ঝিলিমিলি আমার স্বপ্নে দেখা সেই সবুজ দ্বীপের ঘনসবুজ পাতায় পাতায়। দূর থেকে দেখি যেন আমার কল্পনায় গড়া মানস-প্রকৃতি আমার শুভাগমনের প্রতীক্ষায় অপলক দৃষ্টিতে প্রতীক্ষমাণা’ রূপসী আন্দামান তার সোনার জাদুকাঠির স্পর্শে ঘুম পাড়িয়ে, আমাকে বিশ্রামের অবকাশ দিয়েছে!
জেগে ওঠার সাথে সাথেই গান এসে ধরা দিল আমার মনে। প্রাণভ’রে আমি সেই রূপরাজ্যের জলপরী আর ফুলপরীকে শুনিয়েছিলাম:”সুনীল সাগর যেথা নীল আসমান / রূপের রানী আমার দ্বীপ আন্দামান!”
না, এখন আর ভুলে যাইনা, আমার গাওয়া গান। সব লিখে রাখি পাছে ভুলে যাই ভেবে। কল্পনার রঙে কত গান যে হ’ল গাওয়া, তবু যেন সাধ মেটেনা! উদাসী মনের এ যেন এক অসম্পূর্ণ চাওয়া; যদিও সে জানে: ”জীবনের পথে স্বপ্ন-বিভোর পথিকের কত চাওয়া--/ জানি একদিন শেষ হয়ে যাবে তার এই চাওয়া-পাওয়া!”
মুখ্যভূমির এক পূর্বপরিচিত ভদ্রলোক (যিনি আন্দামানে সরকারি চাকরী করতেন) আমাকে আশ্রয় দিলেন। স্থানীয় খবরের কাগজে শিক্ষক নিযুক্তির খবর পেয়ে আবেদন জানাতেই, এক সপ্তাহের মধ্যেই নিয়োগপত্র পেলাম।এত সহজে যে চাকরী হতে পারে তা’ কখনও ভাবিনি। জীবনের প্রথম চাকরী, তাই কৌতুহলোদ্দীপক আনন্দে রাতে ঘুম হ’লনা। নিয়োগপত্রের শর্তসাপেক্ষে যেতে হবে উত্তর আন্দামানের ‘তালবাগান’ নামে এক গ্রামের স্কুলে। পোর্টব্লেয়ার থেকে ‘চোলুঙ্গা’ নামে এক যন্ত্রচালিত বোটে চ’ড়ে ‘এরিয়াল বে’ জেটিতে নেমে, আনুমানিক পাঁচ কি.মি. দূরে সুভাষ বাজার, সেখান খেকে ৩ কি.মি.বাসে চেপে সীতানগর, তারপর শুরু হ’ল পায়ে হেঁটে পাহাড়ি পথ চলা। ১৯ কি.মি.দূর্গম পাহাড়-জঙ্গল পার হয়ে, সেই গ্রামে পৌঁছনোর পর, আমার সঙ্গী (ওই গ্রামেরই একটি ছেলে) বলে ফেললো, ”বাবু আপনার সারা শরীর জোঁকে ধরছে, জামা-কাপড় খুইল্যা ফ্যালান, মা-রে কইছি এহুনি গরম নুন-জল দিয়া ছাড়াইতে হইবো”। মা ও ছেলে সযত্নে আমার শরীর থেকে লবণ-জল দিয়ে জোঁক ছাড়িয়ে দিচ্ছে, আমার সারা শরীর বেয়ে রক্ত ঝরছে, যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে উঠছি। ঘন জঙ্গলের পথে আসার সময়, নিকুঞ্জ(আমার সঙ্গী) জংলী হাতির উপদ্রব সত্ত্বেও কিভাবে তারা এই পাহাড়ি পথ দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে বাধ্য হয়, সে ঘটনার কথা শোনাচ্ছিল। জংলী হাতির ভয়ে, জোঁক আক্রমণের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বৃষ্টি হচ্ছিল; নিকুঞ্জের মাথায় বোঝা। পাহাড়ের মাঝপথ পেরিয়ে হঠাৎ গাছপালা ভাঙার শব্দ।ও বললো,”বাবু, চুপচাপ বইয়া পড়েন, কওয়া যায়না, হাতি হইলে হইতে পারে”। নিকুঞ্জের কথা শুনে, আমি তখন ভয়ে কাঁপছি! বাড়িতে আরবী পড়ানো বাকিবুল্লা ওস্তাদজীর শেখানো দোয়া-দরুদ পড়া শুরু করেছি মনে মনে! কিছুক্ষণ পরে নিকুঞ্জ বললো: ‌"বাবু চলেন আর ভয় নাই! হাতি অন্যদিকে চইল্যা গেছে”। আমার তখন ‘যেন প্রাণ আসলো ধড়ে’!
পরদিন সকালে বিছানা ছেড়ে আর উঠতে পারছিনা; সারা গায়ে ব্যথা। নিকুঞ্জ আমাকে ডাক দিয়ে বললো: ’বাবু আপনারে গেরামের পেরধান, মানুষজন সব দেখতে আইছে, উইঠ্যা পড়েন, বেলা প্রায় ৯ডা বাজে”।
অমূল্য রায় গ্রামের মাতব্বর। আমাকে প্রণাম জানিয়ে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন: "মাস্টার মশাই, আপনি আমাগো এই পেরথম মাস্টার।এহানে কোনও স্কুল নাই, বাঁশের চাটাই ঘেরা পাতার ছাউনি একখান গির্জাঘর আছে। যোগেন মন্ডল কয়ডা বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া ওহানে নন্ ফরম্যাল স্কুল চালায়। সরকার আপনারে পাঠাইছে শুইন্যা গেরামের লোকজন ভারি খুশি। পাকিস্তান(বর্তমান বাংলাদেশ) ছাইড়া এদেশে আইয়াও সুখ নাই! আগে ভাগে যারা আইছিল জমি-জমা পাইছে, আমরা কিছুই পাই নাই। দুকখের কথা আর কারে কমু?এহন আপনি আমাগো ভরসা, উপর মহলে যোগাযোগ করলি হয়তো সরকার নজর দিলি দিতি পারে”। সংগে আসা বেশ কয়েকজন লোকের সঙ্গে আলাপ হ’ল। গ্রাম্যজীবনে সহজ সরল মানুষদের প্রতি আমার যেন কেমন একটা মমত্ববোধ জেগে উঠলো। পরপর দু’দিনের বিশ্রামে আমি অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলাম। তৃতীয় দিনে গির্জাঘরে গিয়ে দেখি, চাটাই পেতে, কিছু ছেলেমেয়ে বসে পড়ছে, কাঠের একটা পুরনো চেয়ারে ব’সে যোগেন মাস্টার। আমাকে দেখে ছাত্রছাত্রীসহ যোগেন মাস্টার উঠে দাঁড়িয়ে প্রণাম করলেন। আমি সবাইকে বসতে বলে, একটি ছেলেকে প্রশ্ন করলাম: ‘আচ্ছা তুমি বলতো, কত দিনে এক সপ্তাহ হয়? ছেলেটি উত্তর দিল: ‘জানে কে ডা!’ উত্তর শুনে আমি হতবাক হলাম, নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখে আমি এবার জিজ্ঞেস করলাম ‘তোমার বাড়ি কোথায়?’ছেলেটি দরজার দিকে তর্জনী দেখিয়ে বললো—‘সো—ই কাঁচা বাদার ধারে’। আমি একটু বিব্রতবোধ করলেও অবাক হইনি এজন্য যে এরা তো শিক্ষা বলতে কিছু পায়নি! বাঁচার তাগিদে এদের পূর্বপুরুষ দেশ ছেড়েছে, এক কলঙ্কময় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এসব শিশুরা জানেনা, সভ্যজগতের দৃষ্টির অন্তরালে কেন তাদের আশ্রয় নিতে হ’ল!(?)
গ্রামের মানুষদের সহযোগিতায় কিছুদিনের মধ্যে গ’ড়ে উঠল, বন্যকাঠ-পাতায় তৈরি স্কুল-ঘর, সামনে খেলার মাঠ, শিক্ষকাবাস ইত্যাদি। সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৩টে পর্যন্ত স্কুলের পর খেলাধুলা, সন্ধ্যায় নানা মানুষের সমাগম, হারানো দিনের কত কথা। বসন্তের প্রারম্ভে পৌরানিক/ঐতিহাসিক যাত্রাভিনয়ের নিয়মিত আখড়াই, ঘরে ঘরে সান্ধ্য কীর্তনের আসর; সবকিছু মিলিয়ে এই সবুজ পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট গ্রামটি যেন এক স্বপনপুরীর দেশ।
বাৎসরিক ক্রীড়ানুষ্ঠান হবে, সান্ধ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ছেলেমেয়েদের অধীর আগ্রহ। অভিভাবকদের উৎসাহ প্রবল। সকলে সমস্বরে সায় দিলেন: “খুব ঘটা করেই হোক, আনন্দোৎসব! সাহায্যার্থে আমরা সবাই আছি! "গ্রামবাসীদের আগ্রহে প্রতিবেশী পাঁচটি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ এই অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সারাদিনের ভোজনান্তে সবাই সাধুবাদ জানিয়ে বিদায় নিলেন।
অবশেষে একদিন এলো আমার বিদায় নেবার পালা। স্থানান্তরকরণ সরকারি কর্মসূত্রের প্রাথমিক শর্ত। বিদায়ের প্রাকমূহুর্তে, নিজের হৃদয় দিয়ে গ’ড়ে তোলা, সবুজ বনভুমির এই সরলপ্রাণ মানুষদের ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, কিন্তু নিয়মের সেই নিষ্ঠুর খেলা মেনে নিতে হ’ল। অশ্রুসিক্ত নয়নে বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপূঞ্জের রাজধানী শহর পোর্টব্লেয়ারে। ……..( চলবে...)

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১০ ই জুন, ২০১৬ রাত ১১:২১

সোজোন বাদিয়া বলেছেন: আন্দামান আমার কাছেও এক নস্টালজিক স্বপ্নের দেশ; খুব সম্ভবত বৃটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস পড়ার কারনেই। আপনার বর্ণনায় আমি বিমুগ্ধ। ওদেশেও যে এমন বাঙালী আছে, আমাদেরই দুর্ভাগা প্রতিবেশীরা গিয়ে জঙ্গলের গভীরে মানুষের আবাস গেড়েছে - এসবের কোনো ধারনাই ছিল না। ইচ্ছে করছে এখুনি পাখী হয়ে উড়ে গিয়ে ঘুরে আসি।

অশেষ শুভ কামনা রইলো।

২| ১১ ই জুন, ২০১৬ ভোর ৪:৫৭

গায়েন রইসউদ্দিন বলেছেন: প্রিয় পাঠক-বন্ধু সোজন বাদিয়া,
আপনি একজন ভাল লেখক বুঝতে পারছি।এত সুন্দর মন্তব্য করার জন্য শুধু ধন্যবাদ নয়, প্রশংসারও দাবি রাখে। সঙ্গে থাকুন, আপনার কথা আরও শোনার অপেক্ষায় থাকবো।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.