নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নারীশক্তি (মহিলা পরিচালিত সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি’র সৌজন্যে)
/ রইসউদ্দিন গায়েন (১৬৪০, আশীর্বাদ অ্যাপার্টমেন্ট, নয়াবাদ মেন রোড)
কলকাতার নিউ গড়িয়া এলাকায় নয়াবাদ এখন আমার নতুন ঠিকানা। একদিন আলো-আঁধারের সন্ধিক্ষণে পরিচ্ছন্ন প্রশস্ত রাস্তা ধ’রে চলতে চলতে চোখে পড়ল ছোট্ট একটা বোর্ডে লেখা ‘মহিলা পরিচালিত সার্বজনীন (যদিও শব্দটি ভুল, সঠিক শব্দ ‘সর্বজনীন’) দুর্গোৎসব কমিটি’। কৌতুহল হ’ল। বাড়িতে ফিরেই আমার মেয়ে ‘পাখি’ ও তার মায়ের সঙ্গে বোর্ডে লেখা কমিটি’র কথা বললাম। তারাও একটু অবাক হ’ল। অবাক হতে হ’ল এজন্যই যে আমাদের এই উপ-মহাদেশে এখনও পুরুষ-শাসিত সমাজব্যবস্থা রয়ে গেছে। ‘রাঁধার পরে খাওয়া, খাওয়ার পরে রাঁধা / বাইশ বছর এক চাকাতেই বাঁধা’—রবীন্দ্রনাথের ‘অন্তঃপুরের মেয়ে’-র এ সমাজব্যবস্থা এখনও সমানে চলেছে।...দুর্গোৎসব, সাধারণত পুরুষ-পরিচালিত হয়। নারীরা তাঁদের অনুসারিণী হয়ে থাকেন। কিন্তু নারীরা দুর্গোৎসবে অগ্রণী ভূমিকা নিতে পারেন, এ কথা পুরুষরা বিশ্বাস করতে পারেন না। সর্বজনীন পুজো করার অধিকার যেন শুধু পুরুষের। নারীর ক্ষেত্রে আজও প্রশ্নচিহ্ন (?) থেকেই গেছে।...
‘নয়াবাদ’ আমাদের কাছে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, তাই সবকিছু বুঝতে একটু সময় লাগছে। দীর্ঘ ৩৪ বছর আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ’র আঁকা-বাঁকা পাহাড়ি-বন পথের অভিজ্ঞতা থেকে কলকাতার সমতলপথে হেঁটে বেড়ানো, আমাদের কাছে অনেক রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল। ‘নয়াবাদ মেন রোড’ অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। রাস্তার দু’পাশে সুরম্য অট্টালিকার সারি। তারি মাঝে ঘন সবুজের নির্মল প্রতিশ্রুতি। অদূরে শান্ত ঝিল। এখানে পূবের প্রথম সূর্যালোক আর পাখির ডাকে ঘুম ভেঙে যায়। এ যেন আমার কাছে পরমা প্রকৃতির করুণাধারায় সিক্ত আশীর্বাদ।
আমার বাসা বাড়ির নামটিও ‘আশীর্বাদ’। সেদিন কবি নজরুল মেট্রো স্টেশনে নেমে বড়াল এলাকা ঘুরে আবার কবি সুভাষ মেট্রোতে নেমে টোটোতে চেপে বাসায় ফিরেছি। একটু পরে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষীর ছেলে এসে বললে-- একদল মহিলা এসেছেন পুজোর চাঁদা চাইতে। নীচে নেমে এলাম। সত্যিই তাই। দলের কয়েকজন ছাড়া সবাই মহিলা। বললেন যে তাঁরা ‘মহিলা পরিচালিত দুর্গোৎসব কমিটি’ থেকে এসেছেন। এ যেন মেঘ না চাইতে জল। মহিলা পরিচালিত এই কমিটি নিয়ে যে প্রশ্ন আমার মনে ছিল, তা’ এখন জানার সুযোগ হ’ল। তাঁরা আমার হাতে বাংলা হরফে ছাপানেো একটা ছোট্ট কাগজ দেখিয়ে আমাকে পড়তে বললেন। আমি প’ড়ে সত্যিই অবাক হলাম এবং ‘মহিলা পরিচালিত দুর্গোৎসব কমিটি’ তৈরি করতে হ’ল কেন, তার সদুত্তর পেয়ে গেলাম।
মহিলা শক্তিই যে সৃষ্টির আধার তা আমরা অনেক ক্ষেত্রে ভুলে যাই। দুর্গোৎসব আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অসুর দমনে দেবতাদের (পুরুষ) অক্ষমতার জন্য দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার (নারী) প্রয়োজন হয়েছিল। প্রতিটি নারী দেবী দুর্গারই আর এক রূপ। নারী শুধু দুর্গারূপে নন, লক্ষ্মীরূপে স্নেহ-মায়া-মমতা দিয়ে আমাদের লালন-পালন করেন। সরস্বতীরূপে আমাদের বিদ্যা দান করেন। আরও অনেক দেবীমাহাত্ম্য আছে যা’ বর্ণনা করা এখানে নিষ্প্রয়োজন। নারীর সমস্ত রূপের সমাহারে সৃষ্টি হয় একটা সুন্দর সমাজ, দেশ, মহাদেশ, পৃথিবী। এই সহজ কথাগুলি আমরা সহজে মানতে চাই না। তাই নারী জাতির প্রতি অবমাননার ইতিহাস দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। সর্বপল্লী ডঃ রাধাকৃষ্ণণের একটি উদ্ধৃতি তুলে ধরছি—‘Give me good ladies and I’ll give a good Nation’. ডঃ রাধাকৃষ্ণণ দেশের জন্য আদর্শ নারীই প্রত্যাশা করেছেন। কিন্তু নারীকে যদি সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করার অপচেষ্টা চলতে থাকে, তবে আমরা একটা সমৃদ্ধ দেশ ও জাতি কিভাবে প্রত্যাশা করতে পারি?
খুব অল্প কথায় আমাকে কিছু লেখার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সেকথা ভেবেই হয়তো এখানেই শেষ করতে হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে সদ্যফোটা ফুলের মতো একটা সুন্দর কবিতা লিখতে ইচ্ছে হচ্ছে। কবিতাটির নাম দেওয়া যাক ‘নারী’।
‘নারী’
‘মা’ নামে প্রথম তোমাকে ডেকেছি—
চিনেছি জগত, দেখেছি আলোছায়ার খেলা।
আদরে সোহাগে স্নেহের পরশে
শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে যাওয়া।
শুরু হয় জীবন-যৌবনের নতুন পথ—
আসে প্রকৃতির প্রণয়ীরূপ, এক ‘নারী’।
নানা রূপ-রস-গন্ধ নিয়ে বসন্ত আসে দ্বারে।
বাসন্তীর নানা রঙে সাজানো ঘর
দেশ থেকে দেশান্তর—
সময়ের স্রোতে একদিন
আমার ঘরে এল এক কন্যারত্ন,
আগামী পৃথিবী-সৃজণা ‘নারী’।
জন্ম-মৃত্যুর পালা অবিরাম—
নানারূপে ‘নারী’।
তুমি আসবে বলেই আকাশ আরও নীল
নানা সাজে মেঘের আনাগোনা।
কাশের বনে উঠেছে দোল দোলানো
শুভ্রতার ঝলক, আনন্দরাশি।
নদীর বুকে পালতোলা মাঝির কন্ঠে গান,
ঘর-ভোলানো সুর রাখালিয়া বাঁশিতে,
নতুন সুর ও ছন্দ বাউলের একতারায়,
পাড়ায় পাড়ায় ঢাকের বাদ্যি।
ঘরে ঘরে শঙ্খধ্বণি তোমার প্রতীক্ষায়
উমা—আসবে মা মেনকার ঘরে।
পরমা প্রকৃতি, আরাধ্যা আর এক ‘নারী’—
দেবী দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী।।
.................................................................
©somewhere in net ltd.