নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রস্তাবনা
ওদের নিয়ে আমার সমস্যাটা ঠিক কী?
অনেক বছর আগের কথা। তখন আমি খুব ছোট। আমার বাবা আমাকে আমাদের উত্তর কলকাতার গোয়াবাগানের “সঙ্ঘ শাখা”য় নিয়ে যান। তার পর থেকে আমার জীবনের অনেকগুলি মূল্যবান বছর আমি সঙ্ঘ বা আরএসএস-এর কাজে ব্যয় করেছি। ওখানে বছরের পর বছর খেলা করেছি, গান গেয়েছি, রাস্তায় নেমেছি আলোচনায় অংশ নিয়েছি, বক্তৃতা দিয়েছি, আরো অনেক কিছু করেছি। ওখানে আমার অসংখ্য বন্ধু হয়েছে। বাঙালি বন্ধু, অবাঙালি বন্ধু। কিন্তু শেষকালে ওই সংগঠন থেকে বেরিয়ে আসার পর তা নিয়ে আমার একটুও অনুতাপ হয়নি, বরং শেষ পর্যন্ত যে ওদের থাবা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পেরেছি, সেজন্র আমি খুশি। তবে আমার অনেক পুরনো ভাল বন্ধুকে চিরদিনের মতো হারিয়েছি, তার জন্য আমার গভীর দুঃখ আছে। ওদের হারানো মানে জীবনের একটা বিরাট অংশকেই হারানো।
কিন্তু আজ আমাকে বলতেই হবে যে আমি সন্ত্রস্ত। যখন আমি সঙ্ঘের কথা ভাবি, সেটা একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হয়। সঙ্ঘকে আমি দেখি প্রাচীন এক খোলসের মধ্যে ক্রমশ বেড়ে চলা অশুভ এক দানব হিসেবে, যে নিজেকে পাল্টে ফেলে দিন দিন বড় হচ্ছে, সবকিছু গিলে খাচ্ছে। কিন্তু খোলস ছেড়ে বেরোচ্ছে না। এমনভাবে সবার চোখের আড়ালে ধীরে ধীরে কিন্তু নিয়মিতভাবে সে বেড়ে চলেছে, সবকিছু গিলে খাচ্ছে, যে সেটা কত বড় একটা বিপদ তা কেউ বুঝছে না। এর একটা কারণ হলো কেউ তাকে সম্পূর্ণরূপে দেখতে পায় না। কেউ দেখে, রঙিন উদ্যানের এক কোনে বড়োসড়ো একটা গুটির মধ্যে সবসময়ে সে নিজের মনে কিছু চিবিয়ে চলেছে। কেউ দেখে একটা অদ্ভুত দর্শন, বিকট জিনিস, যা নিয়ে তারা মজা করে। আবার কেউ তাকে একটা ইন্টারেস্টিং বিষয় হিসেবে, যা নিয়ে তারা অ্যাকাডেমিক মহলে নানা আলোচনা করে। কিন্তু ইতিমধ্যে এই জীবটি দিন দিন বড় হতে থাকে, নিজেকে পাল্টাতে থাকে। তার সামনে থাকা সবকিছুকে গিলে খায়। চারপাশের জীবনের তারুণ্য থেকে, যৌবন থেকে, নিজের রসদ সংগ্রহ করে দিন দিন আরো বড়, আরো শক্তিমান ও আরো কুৎসিত হয়ে ওঠে সে।
তারপর একদিন লোকে দেখে যে একদা-সুন্দর সেই বাগানে আর কোনো সবুজ নেই। সবকিছু মরা, ধূসর, বিষন্ন আর বিগত-যৌবন। নানা ধরনের প্রাণে ভরা সেই উদ্যান থেকে সব শক্তি গিলে নিয়ে জীবটি এখন বিশাল এক দানব। এখন সে যা করতে চায় তা থেকে তাকে রুখবার সাহস নেই কারো। সে এখন এক দৈত্য, যে বোতল থেকে ছাড়া পেয়েছে। আর তাকে বোতলের মধ্যে পোরা যাবে না।
আমাকে হতাশ শোনাচ্ছে? তার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু যখন আমি আমার সময়ের বা তার আগের আরএসএস-এর সঙ্গে এখনকার আরএসএস-এর তুলনা করি, তখন এই সংগঠন ও তার বেড়ে ওঠা নিয়ে আমার এরকমটাই মনে হয়।
অনেক বন্ধুরা আমাকে বলেন, আমার জীবনের সবচেয়ে মুল্যবান পনের-কুড়ি বছর সঙ্ঘে কাটানোর পর, কেন আমি বেরিয়ে এসেছিলাম তার কারণগুলি যেন লিখি। এক কথায় বললে বলতে হয় যে ওদের মিথ্যেগুলো আমি বুঝে ফেলেছিলাম, আর তাতে আমি নিজেই খুব আঘাত পেযেছিলাম। আমি যে ওদের সম্পর্কে কতটা আশাহত সেটা বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লেগেছিল। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম, এবং নিজেকে ওদের থেকে মুক্ত করেছিলাম। মিথ্যে আর আত্মপ্রতারণার সঙ্গে আমি আর থাকতে পারছিলাম না।
তথাকথিত “সঙ্ঘ পরিবারের” অন্য অনেক বিষয়ের মধ্যে কয়েকটি নিয়ে আমার সমস্যা হচ্ছিল। সেগুলোকে আমার অনৈতিক মনে হচ্ছিল। যেমন, (১) তাদের অরাজনৈতিক হওয়ার ভান; (২) যে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক তীব্র পক্ষপাত—একমুখিনতা—তারা প্রচার করে ও মেনে চলে; (৩) “অন্য রকম সংগঠন” হওয়ার দাবি, যে ভন্ডামির এখন মুখোশ খুলে গেছে; (৪) খেলাধুলার মধ্য দিয়ে সামরিকীকরণের প্রচেষ্টা; (৫) কমবয়সীদের তারা যেভাবে খেলাধুলা ও সংস্কৃতির ছুতোয় ধরে ও নিয়ন্ত্রণ করে; (৬) নারী ও পুরুষকে আলাদা রাখা; (৭) তাদের ফ্যাসিবাদী, আধিপত্যবাদী, সাম্প্রদায়িক ও অপরকে বাদ দিয়ে চলার সামাজিক, রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক মতবাদ।
আমার মতে, ওগুলো হল সঙ্ঘ পরিবারে “সাতটি পাপ”। কোনোক্রমেই এগুলি গ্রহণযোগ্য নয়। এখনই যদি অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে, তীব্র বিরোধীতার মাধ্যমে সবাই মিলে একে প্রতিহত না করা যায়, তবে এইসব পাপ ভবিষ্যতে ভারতের ভয়ানক ক্ষতি করবে, এবং আমাদের দেশের ধ্বংস ডেকে আনবে।
এই বইয়ে আমি দেখাবো যে সঙ্ঘের তথাকথিত “অরাজনৈতিক” মুখটি কীরকম মিথ্যেয় ভরা। দেখাবো যে কেমন করে তারা তাদের সদস্যদের সবাইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। সাম্প্রতিককালে তাদের এই মুখোশ খসে পড়ছে, আসল মুখ বেরিয়ে পড়ছে। বিশেষ করে ১৯৮০-র দশকে ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরির পর থেকে ও দুনিয়া জুড়ে সমাজতন্ত্রের পিছিয়ে যাওয়ার পর আরএসএস-এর ভিতরে যে হিন্দুত্ববাদী জোয়ার আসে তা তার সমস্ত ফ্রন্টের মধ্য দিয়ে তাদের যুবক এবং বয়স্ক সব কর্মীদের রাজনীতিকরণ করেছে। মূল সংগঠন আরএসএস, বিজেপি’র ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলি—যেমন, যুবমোর্চা ও মহিলামোর্চা;বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভি.এইচ.পি) এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের শাখা বজরং দল, দুর্গা বাহিনী এবং ভারত বন্ধু সমাজ; এবিভিপি অর্থাৎ অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ; বিএমএস বা ভারতীয় মজদুর সংঘ; রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি (মেয়েদের আরএসএস) এবং সঙ্ঘের তৈরি অন্য নানা সংগঠন স্থানীয়, রাজ্য স্তরে ও কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করার জন্য তাদের সদস্যদের অক্লান্তভাবে মন্ত্র দিয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরএসএস-পন্থী গোষ্ঠীগুলি, যেমন হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল(এইচএসসি),ভিএইচপি-আমেরিকা, ওভারসিজ ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি, হিন্দু বিবেক কেন্দ্র ও গ্লোবাল হিন্দু ইলকেট্রনিক নেটওয়ার্কও এই প্রচারে অংশ নিয়েছে। অবশ্য হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল বা ভিএইচপি-আমেরিকা ভেবে-চিন্তেই ওপর ওপর আরএসএস-এর সঙ্গে একটা দূরত্ব বজায় রাখে। কারণ, আমেরিকাতে সাংবিধানিক নানা বিধিনিষেধ রয়েছে, যা তাদের মেনে চলতে হয়।
১৯৯৭ সালে আমেরিকা থেকে দেশে গিয়ে আমি যখন ভারতের বিভিন্ন আরএসএস কেন্দ্রে ঘুরছিলাম তখন সঙ্ঘের মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতার জন্য কী পরিমাণ লোভ দেখা দিয়েছে, তা দেখে অবাক হয়েছিলাম। আরএসএস এখন বিজেপি’র যেসব রাজনৈতিক কৌশলগুলিতে মদত দেয়, তাতে সেই লোভের পরিচয় মেলে—দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসের মতই নিজেকে “অন্যরকম দল” বলে দাবি করা বিজেপিও ভয়ানক সব অপরাধী ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর সঙ্গে একসাথে চলেছে। উদ্দেশ্য একটাই। কেন্দ্রে ক্ষমতা দখল করা। (এই বাংলা বইটি প্রকাশিত হওয়ার সময়ে যা তারা বিশালভাবে দখল করে আছে)
আরএসএস, বিজেপি ও ভিএইচপি-র শ্রেণিচরিত্র যে কংগ্রেসের থেকে আলাদা কিছু নয়, সেটা তাদের কাজকর্ম থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে। তাদের নেতারা প্রায় সবাই উচ্চবর্ণের রক্ষণশীল পুরুষ—ধনী জমিদার, ব্যবসায়ী, আমলা, পুরোহিত—চিরাচরিতভাবে যারা ভারতে রাজা তৈরি করে এসেছে। কংগ্রেসের অভিজ্ঞতা থেকে এরা জানে যে ক্ষমতা, শুধুমাত্র ক্ষমতাই, তাদের এতদিন ধরে বোনা জাল টিকিয়ে রাখতে পারবে। ক্ষমতা না থাকলে তা ভেঙে পড়বে। সেজন্যেই বিজেপি এখন এত মরিয়া হয়ে উঠেছে। সেজন্যেই বিজেপি’র অনৈতিক রাজনীতিকে আরএসএস এত মদত যুগিয়ে চলেছে।...(ক্রমশঃ)
০২ রা নভেম্বর, ২০২১ রাত ৯:৫৬
গায়েন রইসউদ্দিন বলেছেন: ধন্যবাদ, আপনাকে সঙ্গত প্রশ্নটি করার জন্য! খুব সহজ উত্তরে বলতে হয়- সজ্ঞান-সচেতন মানুষ এদের সমর্থন করেন না। তবে, দুর্ভাগ্য এই ধর্মান্ধ মানুষের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনেকেই এদের অন্ধভক্ত। তাই, এরা ক্ষমতায় আসতে পেরেছে। গত সাত বছরের বিভিন্ন ঋণাত্মক কার্যকলাপে সাধারণ মানুষের জীবন স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। মানুষ আর আগের মতো সেভাবে সমর্থন করছেন না। বিগত পশ্চিমবঙ্গ'র বিধানসভা নির্বাচন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জনসমর্থন এখন অনেকাংশে কমে এসেছে।
©somewhere in net ltd.
১| ০২ রা নভেম্বর, ২০২১ রাত ৮:১৬
সাড়ে চুয়াত্তর বলেছেন: এদের প্রকৃত জনসমর্থন কেমন?