নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আমি রইসউদ্দিন গায়েন। পুরনো দুটি অ্যাকাউন্ট উদ্ধার করতে না পারার জন্য আমি একই ব্লগার গায়েন রইসউদ্দিন নামে প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছি এবং আগের লেখাগুলি এখানে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য আবার প্রকাশ করছি।

গায়েন রইসউদ্দিন

গায়েন রইসউদ্দিন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দানবের পেটে দু\'দশক (মূল গ্রন্থ- IN THE BELLY OF THE BEAST) পর্ব-২১

০৭ ই জানুয়ারি, ২০২২ রাত ৮:৩৪


আরএসএস, বিজেপি, বি-এম-এস-এর “স্বদেশী”
১৯৮০-র দশক থেকে রাজীব গান্ধী ও পি ভি নরসিমহা রাও-এর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার মুক্ত বাজার অর্থনীতির পক্ষে জোরালো সওয়াল করে এবং মার্কিন ও অন্যান্য বিদেশী বিনিয়োগকে স্বাগত জানায়। উগ্র জাতীয়তাবাদী ও দক্ষিণপন্থী ভোটারদের মন রাখতে এই প্রবণতাকে অন্তত ওপর-ওপর বিরোধীতার উদ্দেশ্যে বি-এম-এস-এর সাহায্যে বিজেপি “স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ” গড়েছে। এই মঞ্চ সব ধরনের বহুজাতিক পুঁজির কড়া বিরোধিতা করে ও একটি বন্ধ ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে সওয়াল করে।
[আজ ২০২০ সালে অবশ্য সে মঞ্চ একটি ঠুঁটো জগন্নাথ প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত হয়েছে—মোদী সরকার লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ করে ভারতীয় অর্থনীতি ও শিল্প-কৃষিকে পুরোপুরি কর্পোরেট ইন্ডিয়া ও বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর হাতে তুলে দিয়েছে।]
১৯৯৪ সালে ২০ ডিসেম্বর বিএমএস নেতা শ্রী ঠেঙাড়ি কলকাতায় এক বক্তৃতা দেন। তার শিরোনাম ছিল: “এই লড়াইয়ের অস্ত্র হল স্বদেশী”। এই বক্তৃতায় তিনি মার্কিন অর্থনীতিকে একটি ডুবন্ত জাহাজের সঙ্গে তুলনা করেন এবং বলেন যে পুঁজিবাদের শেষ আগত। তার মতে—“এই গ্রহের সম্পদ সীমিত, কিন্তু ভোক্তাদের চাহিদা অপরিসীম”—এই দ্বন্দ্বে পুঁজিবাদ বিলোপ পেতে বাধ্য। তিনি ভবিষ্যৎবাণী করেন যে ২০১০ সালের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের উন্নত দেশগুলির মধ্যে প্রথম স্থানটি হারাবে”।
পূর্বতন এবিভিপি নেতা ও বর্তমানে আরএসএস-এর সহ-কার্যাবহ মদন দাস লিখেছেন—“আজ উদারীকরণ ও বিশ্বায়ণের নামে, “বৈশ্বিক গ্রাম” তৈরির প্রচেষ্টায় পশ্চিমা শক্তিগুলি তৃতীয় বিশ্বের সংস্কৃতি, তাদের জাতি পরিচয়, তাদের নীতি ও মূল্যবোধ এবং বিশ্বের সংস্কৃতি বৈচিত্র—মানবজাতি ভালভাবে টিকে থাকতে গেলে যা অবশ্য-প্রয়োজনীয়—সেসব ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করছে”।
আরএসএস-এর তৈরি ‘স্বদেশী জাগরণ মঞ্চ’ জোর দেয় দেশ নিয়ে গর্বের ওপর, ভারতীয় বাজারে প্রস্তুতকারী ও ভোক্তা হিসেবে তথাকথিত অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরশীলতার ওপর। পূর্বোক্ত বক্তৃতায় ঠেঙাড়ি বলেছেন, অন্য কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের কোনও বাজারি সম্পর্কের প্রয়োজন নেই। বিএমএস, বিজেপি ও আরএসএস-এর মূল কৌশল হল “ভারতীয় অর্থনীতিকে কিনে নেওয়ার মার্কিন চক্রান্ত্র” রোখার জন্য সরাসরি সংঘাতের পথে চলা। আত্মসমর্পণ করা চলবে না। বিএমএস যদিও কিছু কিছু উচ্চ-প্রযুক্তির শিল্পে ও প্রতিরক্ষা শিল্পে কিছু বিদেশী বিনিয়োগের কথা বলেছে। মেক্সিকোর কৃষকরা ও কানাডার মানুষ গ্যাট ও নাফটা-র বিরুদ্ধে যেরকম তীব্রভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে, বিএমএস নেতারা তার প্রশংসা করছেন ও এদেশেও একই রকম প্রতরোধের ডাক দিয়েছেন।
[আজ ২০২০ সালে অবশ্য অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে। মুক্ত বাজার ও মার্কিনি ও আম্বানি পুঁজিপতিরা আজ ভারতের অর্থনীতির আসল মালিক।]
আরএএস-এর বরিষ্ঠ নেতা শ্রী ঠেঙাড়ি তাঁর এই বক্তৃতায় বিপথগামী মার্কিন সংস্কৃতির প্রতীক হিসেবে মার্কিন পপ-গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের তীব্র নিন্দা করেছেন এবং চীন ও কোরিয়ায় যে মাইকেল জ্যাকসনের ভ্রমণ বাতিল করা হয়েছে তার প্রশংসা করেছেন। অবশ্য তাঁর এই নিন্দাবাদের পর পরই আরএসএস-এর মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক সঙ্গী শিবসেনার পক্ষ থেকে বম্বেতে অনুষ্ঠানের জন্য মাইকেল জ্যাকসনকে সাদর অভ্যর্থনা জানানো হয়।
সঙ্ঘের আরও কিছু ফ্রন্ট
সঙ্ঘের আরও কিছু ফ্রন্ট সারা ভারত ছেয়ে ফেলেছে। যেমন ‘ভারতীয় কিসান সঙ্ঘ’। শ্রী ঠেঙাড়ি রাজস্থানের কোটায় ১৯৭৯ সালের মার্চে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘বনবাসী কল্যাণ আশ্রম’—মধ্যপ্রদেশের যশপুরে এটি প্রতিষ্ঠা করেন রামকান্ত কেশব দেশপান্ডে। এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করা হয় “পরাবর্তন” বা “মিশনারিদের চক্রান্তে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত” আদিবাসীদের হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্য। সঙ্ঘ সবসময়েই মিশনারিদের তীব্র সমালোচনা করে আসছে। তাদের মতে, মাদার টেরেসা-সহ সব মিশনারিরাই আসলে ভারতকে খ্রিস্টান দেশে পরিণত করার আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। এভাবে “পতিত” হওয়া খ্রিস্টান আদিবাসীদের উদ্ধার করে তাদের “আদত” হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনাটা সঙ্ঘের পবিত্র দায়িত্ব। এই ধরনের প্রচার ও কাজের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্রিস্টান কোয়ালিশন বা বাংলাদেশের জামাত-এ-ইসলামি-র মিল পাওয়া যাবে।
শিক্ষকদের মধ্যে সঙ্ঘের সংগঠনের নাম “ভারতীয় শিক্ষণ মন্ডল”। তারাও নিজেদের অ-রাজনৈতিক বলে দাবি করে। আরও আছে “ইতিহাস সংকলন সমিতি”— তারা সঙ্ঘের পছন্দমত ভারতের ইতিহাসের পুনর্লিখন করতে ব্যস্ত। আছে ‘সংস্কার ভারতী’—এরা ভারতের এই “পরিমার্জিত” ইতিহাস ও সংস্কৃতি প্রচারের কাজ করে। আছে ‘বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি’—এরা কাজ করে হিন্দু উদ্বাস্তুদের মধ্যে। ‘পূর্ব সৈনিক সেবা পরিষদ’ কাজ করে সামরিক বাহিনীর প্রাক্তন কর্মীদের মধ্যে—এর মধ্য দিয়ে এরা সেনাবাহিনীতে নিজেদের শক্তি বাড়াতে সমর্থ হয়। সঙ্ঘের আর এক সংগঠন ‘বিদ্যা ভারতী’ শয়ে শয়ে ‘সরস্বতী শিশু মন্দির’ ও ‘মাতৃচ্ছায়া’ প্রতিষ্ঠা করেছে শিশু ও অনাথদের লেখাপড়া শেখানো ও আশ্রয় দেওয়ার ঘোষিত উদ্দেশ্যে। এছাড়া আছে ‘ভারতীয় কুষ্ঠ নিবারক সঙ্ঘ’, বলা হয় যে এরা কুষ্ঠ আক্রান্ত লোকদের মধ্যে কাজ করে। ‘বিদ্যা ভারতী’ ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে হিন্দুকেন্দ্রিক ও বিজ্ঞানবিরোধী শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে বদ্ধপরিকর। তাদের শাখা এখন দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে।
বিদেশী সঙ্ঘের নানা সংগঠনের মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখের দাবি রাখে ‘হিন্দু স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ’ (এইচএসএস), বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ফ্রেন্ডস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল (ইউকে), হিন্দু সেবিকা সমিতি, ন্যাশনাল হিন্দু স্টুডেন্টস ফোরাম (ইউকে), হিন্দু স্টুডেন্ট কাউন্সিল (ইউএসএ), ওভারসীজ ফ্রেন্ডস অফ বিজেপি, হিন্দু ইন্টার ন্যাশনাল মেডিক্যাল মিশন (এইচআইএমএম), সেবা ইন্টারন্যাশনাল ও ভারত বিকাশ পরিষদ ইন্টারন্যাশনাল (ইউকে)।
বলাই বাহুল্য, আরএসএস এখন অনেক ধরণের কাজকর্মের একটি বিশাল ছত্র-সংগঠন—এদের অনেকের কাজই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এইসব কাজকর্মের পেছনে আছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, আর এইসব কাজ চালিত হয় রক্ষণশীল হিন্দুদের ঘিরে। নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে সাহায্য করা কখনোই এইসব কাজের প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়; আসল উদ্দেশ্য হল নিজেদের মতাদর্শে দীক্ষাদান। বন্যা, দুর্ঘটনা ইত্যাদিতে ক্ষতিগ্রস্তদের তাদের “নিঃস্বার্থ” সেবার কথা সঙ্ঘ বার বার তুলে ধরে। কিন্তু আমরা জানি যে এইসব সেবা সবই কৌশলগত—তাদের পক্ষের সামাজিক ও রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে এমন কিছু সঙ্ঘ কখনও করবে না। যেমন ধরা যাক, সঙ্ঘের শক্তিশালী এলাকা দিল্লিতে প্রচুর বধূহত্যা ও পণজনিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। এই দক্ষিণপন্থী গোষ্টীটি সেখানে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির হাতে অত্যাচার ও মৃত্যু থেকে ভারতীয় নারীদের বাঁচানোর জন্য কিছুই তেমন করে না। সঙ্ঘপন্থী নারীবাদী নেত্রী মধু কিশোয়ার ও তার “মানুষী” গোষ্ঠীর সঙ্গে এই বিষয়ে আমার তীব্র মতবিরোধ হয়েছিল। তিনি সঙ্ঘের প্রগৈতিহাসিক নারীর আদর্শের মডেলকে কখনোই তীব্র সমালোচনা করেননি। বরং নানা প্রকারে আরএসএস-এর সামাজিক পলিসিকেই সমর্থন জানিয়ে এসেছেন। এরকম ব্যক্তি আরও আছেন। স্মৃতি ইরানি তাঁদের মধ্যে একজন। অথচ প্রগতিশীল অনেক নারী সংগঠন এই এলাকায় তাদের সীমিত ক্ষমতা সত্ত্বেও এই অসহায় নারীদের সাহায্যের চেষ্টা করে।
তাছাড়া আমাদের মনে রাখতে হবে যে অন্যান্য ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলি, যেমন বাংলাদেশের জামাত-এ ইসলামী, মার্কিন দেশের খ্রিস্টান কোয়ালিশন বা তুরস্কের নুরচুলুকও “মানবিক” কাজকর্ম করে থাকে—আরএসএস কিন্তু তাদের নিন্দা করতে কখনই ক্ষান্ত হয় না।... (ক্রমশ)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.