নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

জামায়াত-শিবিরের সত্য, ন্যায়ভিত্তিক ও আদর্শ সমাজ গঠনের দাবির অসারতা: একটি সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ

১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৪



ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জামায়াত-শিবির এবং অন্যান্য ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান একটি জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। এই দলগুলো নিজেদেরকে সমাজের নৈতিক ও আদর্শিক পুনর্গঠনের একমাত্র হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করে এবং অন্যদিকে ধর্মনিরপেক্ষ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে সমাজের সকল অনৈতিকতা ও অবক্ষয়ের জন্য দায়ী করে। তবে তাদের দাবির সাথেই রয়েছে গভীর স্ববিরোধিতা, যা তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক ইতিহাস ও সামাজিক প্রভাব পর্যবেক্ষণ করলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এই প্রবন্ধে আমরা জামায়াত-শিবিরের ন্যায়ভিত্তিক ও আদর্শ সমাজ গঠনের দাবিকে সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানভিত্তিক তাত্ত্বিক কাঠামো ব্যবহার করে মূল্যায়ন করব, যাতে তাদের নৈতিক একচেটিয়াত্বের (Moral Exclusivism) ধারণা, হেজিমনি নির্মাণের কৌশল এবং বাস্তব কর্মকাণ্ডের সাথে আদর্শিক দাবির দ্বন্দ্ব উন্মোচিত হয়।
১. নৈতিক একচেটিয়াত্বের তত্ত্ব ও বাস্তবতা
জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক বয়ান নির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো নৈতিক একচেটিয়াত্ববাদ (Moral Exclusivism)। তারা নিজেদেরকে নৈতিকতার একমাত্র অধিকারী হিসেবে উপস্থাপন করে, অন্য রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে নৈতিকভাবে নিকৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করে এবং ইসলামী শরিয়াকে একমাত্র ন্যায়নিষ্ঠ সমাজব্যবস্থা হিসেবে প্রচার করে।
ম্যাক্স ওয়েবারের (Weber, 1978) রাজনৈতিক কর্তৃত্ব তত্ত্ব অনুযায়ী, জামায়াত তিন ধরনের কর্তৃত্বের দাবি করে:
1. ঐতিহ্যগত কর্তৃত্ব: ধর্মীয় ঐতিহ্যের দাবিদার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ।
2. ক্যারিশম্যাটিক কর্তৃত্ব: ধর্মীয় নেতাদের বিশেষ ক্ষমতা ও বৈধতার দাবি।
3. আইনগত-যৌক্তিক কর্তৃত্ব: শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার দাবি।
তবে বাস্তবে দেখা যায়:
• ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকার ইতিহাস তাদের নৈতিকতার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
• রাজনৈতিক সহিংসতা, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ততার অভিযোগ।
• নেতাদের মধ্যে দুর্নীতি ও নৈতিক স্খলনের দৃষ্টান্ত।
• মাদ্রাসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের অভিযোগ।
ফলে তাদের নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবি ভিত্তিহীন বলে প্রতীয়মান হয়।
২. হেজিমনি নির্মাণের কৌশল: গ্রামশিয়ান বিশ্লেষণ
অ্যান্টোনিও গ্রামশির (Gramsci, 1971) হেজিমনি তত্ত্ব অনুযায়ী জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক কৌশলকে বোঝার জন্য তিনটি বিষয় বিবেচ্য:
ক. সাংস্কৃতিক হেজিমনি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা
• ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে নিজস্ব আদর্শে শিক্ষার্থী তৈরি।
• মাদ্রাসা শিক্ষায় রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি রোপণ।
• ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ে আনা।
খ. নৈতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কৌশল
• নৈতিক ও অনৈতিকের বিভাজন তৈরি।
• নিজেদেরকে নৈতিক পুনর্গঠনের নেতা হিসেবে উপস্থাপন।
• বিরোধী মতকে রাজনৈতিক ও নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য হিসেবে চিত্রিত করা।
গ. বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যের লড়াই
• ইসলামী বুদ্ধিবৃত্তিক ধারা তৈরি।
• প্রগতিশীল ধারণাকে পাশ্চাত্য প্রভাব হিসেবে উপস্থাপন।
• বিকল্প জ্ঞানকাণ্ড নির্মাণের প্রচেষ্টা।
তবে এই হেজিমনি নির্মাণ প্রচেষ্টা অভ্যন্তরীণ সংকট দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়:
• নেতৃত্বে আদর্শিক দ্বন্দ্ব।
• ক্ষমতা কেন্দ্রীভূতকরণ।
• তৃণমূলের সাথে নেতৃত্বের দূরত্ব।

৩. আদর্শিক দাবি ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের বৈপরীত্য
জামায়াত-শিবিরের আদর্শ ও বাস্তব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সুস্পষ্ট বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়:
আদর্শিক দাবি বাস্তবতা
ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন যুদ্ধাপরাধ, সহিংসতা, দুর্নীতি
ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদী আপস, বিকল্প নীতি অনুপস্থিত
গণতন্ত্রের প্রতি আস্থার দাবি গণতান্ত্রিক কাঠামোর প্রতি অবিশ্বাস
নারী ও সংখ্যালঘুর অধিকার বৈষম্যমূলক ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি

৪. বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক অবস্থান তিনটি দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ:
1. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম জামায়াতের অবস্থান: ১৯৭১ সালের গণহত্যায় জামায়াতের ভূমিকা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টা।
2. ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি: সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সাথে সাংঘর্ষিক অবস্থান।
3. গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভূমিকা: নির্বাচনে অংশগ্রহণ সত্ত্বেও গণতান্ত্রিক নীতি অমান্য এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় সম্পৃক্ততা।

৫. বিকল্প পথের সন্ধান: ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের শর্ত
সত্যিকারের ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন:
• সকল নাগরিকের সমান অধিকার ও মানবিক মর্যাদা রক্ষা।
• ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সুযোগের সমতা।
• গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের প্রতি অঙ্গীকার।
• সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা।
• জবাবদিহিমূলক ও স্বচ্ছ রাষ্ট্র ব্যবস্থা।
এগুলো বাস্তবায়ন ব্যতীত কেবল ধর্মীয় আবেগের উপর ভিত্তি করে কোনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়।

৬. উপসংহার
জামায়াত-শিবিরের ন্যায়ভিত্তিক ও আদর্শ সমাজ গঠনের দাবি মূলত রাজনৈতিক কৌশল ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তাদের কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়:
1. নেতাকর্মীদের নৈতিক স্খলন ও যুদ্ধাপরাধে সম্পৃক্ততা।
2. রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সহিংসতা ও গণতন্ত্রের প্রতি অসংগতি।
3. নারীর অধিকার ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।
4. ইসলামী অর্থনীতির নামে প্রকৃত নীতির অভাব ও ক্ষমতাকেন্দ্রিক আপস।
ফলে জামায়াত-শিবিরের এই দাবির অসারতা প্রমাণিত হয়।
সত্যিকার ন্যায়ভিত্তিক ও প্রগতিশীল সমাজ গঠনের জন্য প্রয়োজন অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক এবং মানবিক মর্যাদা ও অধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা। জামায়াত-শিবিরের রাজনৈতিক মডেল নয়, বরং এই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক মডেলই বাংলাদেশের জন্য উপযুক্ত বিকল্প পথ হতে পারে।
________________________________________
তথ্যসূত্র (নমুনা)
1. Weber, M. (1978). Economy and Society. University of California Press, p.215-217.
2. Gramsci, A. (1971). Selections from the Prison Notebooks. International Publishers, p.12-19.
3. Bourdieu, P. (1991). Language and Symbolic Power. Harvard University Press.
4. Gellner, E. (1983). Nations and Nationalism. Cornell University Press.

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.