![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৫ সালের অভ্যুত্থান—বাংলাদেশের ইতিহাসের এই দুটি ক্রান্তিকালীন ঘটনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক ও বিশ্লেষকের মতে, ওয়াশিংটন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল, আবার ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পেছনেও যুক্তরাষ্ট্রের গোপন সমর্থন বা ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত মেলে। এই প্রবন্ধে ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা, তাদের ডীপ স্টেট নেটওয়ার্কের কার্যক্রম এবং বাংলাদেশে নব্য-উপনিবেশবাদী আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
১. ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তান-সমর্থন ও নীরবতা
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করলে বিশ্বজনমত বাংলাদেশের পক্ষে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জানায়। এর পেছনে কয়েকটি কারণ কাজ করেছিল:
ক. জিওপলিটিক্যাল স্বার্থ ও চীন-মার্কিন সম্পর্ক
• নিক্সন প্রশাসন তখন চীনের সঙ্গে গোপন কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করছিল, আর পাকিস্তান ছিল সেই যোগাযোগের মাধ্যম।
• পাকিস্তানের পতন হলে চীন-মার্কিন সম্পর্কে বিঘ্ন ঘটতে পারে—এই আশঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে সমর্থন দেয়।
খ. সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রভাব বিস্তার
• ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের মিত্র ছিল, তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে যুক্তরাষ্ট্র সোভিয়েত প্রভাব বৃদ্ধির হুমকি হিসেবে দেখেছিল।
• যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে "ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ" হিসেবে ফ্রেম করেছিলেন, যাতে পাকিস্তানের ভূমিকা হ্রাস পায়।
গ. ডীপ স্টেট ও সিআইএর গোপন অপারেশন
• কিছু গবেষক দাবি করেন, সিআইএ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে গোপন সহায়তা দিয়েছিল, যদিও এটি সরাসরি প্রমাণিত নয়।
• যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ও কূটনৈতিক সমর্থন পাকিস্তানকে গণহত্যা চালাতে উৎসাহিত করেছিল।
২. ১৯৭৫: শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভূমিকা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সেনাবাহিনীর একদম জুনিয়র অফিসারদের হাতে নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন হস্তক্ষেপের অভিযোগ রয়েছে।
ক. শেখ মুজিবের সমাজতান্ত্রিক নীতি ও মার্কিন বিরোধিতা
• মুজিবের রাষ্ট্রীয় নীতি (যেমন: বাকশাল গঠন, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি) যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদী স্বার্থের বিরোধী ছিল।
• যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি পশ্চিমাপন্থী সরকার চেয়েছিল, যা তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে।
খ. অভ্যুত্থানে সিআইএর সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ
• কিছু গোপন নথি ও সাক্ষাৎকারে দাবি করা হয়েছে যে, সিআইএ বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে অসন্তোষ তৈরি করতে গোপন অর্থায়ন করেছিল।
• হত্যাকাণ্ডের পর যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত খন্দকার মোশতাক আহমেদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়, যা সন্দেহের জন্ম দেয়।
গ. নব্য-উপনিবেশবাদী নীতির প্রসার
• মুজিবের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সামরিক শাসন ও পশ্চিমা মডেলের অর্থনৈতিক নীতি প্রাধান্য পায়, যা যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সুবিধাজনক ছিল।
• বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বৃদ্ধি পায়।
৩. ডীপ স্টেট থিওরি: যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নেটওয়ার্ক
"ডীপ স্টেট" বলতে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে একটি অদৃশ্য শক্তিকাঠামোকে বোঝায়, যা সরকারের বাইরে থেকে নীতি নির্ধারণে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, যুক্তরাষ্ট্রের গোপন হস্তক্ষেপকে ডীপ স্টেট তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়:
• সেনাবাহিনীতে প্রভাব: ১৯৭১ ও ১৯৭৫ উভয় ঘটনাতেই সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট হতে পারে।
• মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী নিয়ন্ত্রণ: যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে পশ্চিমাপন্থী মতাদর্শ ছড়িয়ে দিতে মিডিয়া ও বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছিল।
• অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর ঋণের শর্তাবলীর মাধ্যমে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার।
৪. যুক্তরাষ্ট্রের ডীপ স্টেট ষড়যন্ত্র: ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শেখ হাসিনা সরকার উৎখাতের গোপন পরিকল্পনা
৪.১ ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের ডীপ স্টেট কৌশল
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে একটি সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাতের চেষ্টা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোচনা ও বিশ্লেষণ হয়েছে। অনেক বিশ্লেষক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, এই অস্থিতিশীলতার পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ডীপ স্টেট নেটওয়ার্কের ভূমিকা রয়েছে, যা বাংলাদেশে একটি পশ্চিমাপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ক. যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ ও বাংলাদেশ
• ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল (IPS): যুক্তরাষ্ট্র চায় বাংলাদেশ তার ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হোক, যা চীনকে রোধ করতে সাহায্য করবে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি (চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সুসম্পর্ক) যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অসুবিধাজনক।
• চীনের প্রভাব হ্রাস: বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ (যেমন: বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ) ও সামরিক সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। তাই একটি পশ্চিমাপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা তাদের লক্ষ্য।
খ. অভ্যুত্থানের জন্য গোপন ডীপ স্টেট অপারেশন
যুক্তরাষ্ট্রের গোপন নেটওয়ার্ক (সিআইএ, USAID, NED) বাংলাদেশে নিম্নলিখিত কৌশল প্রয়োগ করতে পারে:
• সেনাবাহিনীতে বিভাজন তৈরি: সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গোপন অর্থায়ন ও প্রোপাগান্ডা। "মিশ্রিত সরকার" (হাইব্রিড রেজিম) প্রতিষ্ঠার জন্য সামরিক-বেসামরিক জোট গঠনে উৎসাহিত করা।
• অর্থনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি: ডলার সংকট ও মুদ্রাস্ফীতিকে কাজে লাগিয়ে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধি। আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি ও মিডিয়াকে ব্যবহার করে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল হিসেবে চিত্রিত করা।
• মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়া প্রোপাগান্ডা: আল-জাজিরা, বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকার মতো পশ্চিমা মিডিয়াকে ব্যবহার করে সরকারের ভাবমূর্তি ধ্বংস করা। ফেসবুক, টুইটার, টিকটকে ভুয়া খবর ও বিভ্রান্তিকর কন্টেন্ট ছড়িয়ে দেওয়া।
• সিভিল সোসাইটি ও এনজিওদের ব্যবহার: USAID ও ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (NED)-এর অর্থায়নে কর্মরত এনজিওগুলোকে বিক্ষোভ ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার। ছাত্র সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করা।
গ. অভ্যুত্থান পরিকল্পনার সময়রেখা (জুলাই-আগস্ট ২০২৪)
• জুলাই ২০২৪: অর্থনৈতিক সংকটকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ শুরু, মিডিয়ায় সরকারের ব্যর্থতা নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন।
• আগস্টের প্রথম সপ্তাহ: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সেনাবাহিনীর "অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ" সম্পর্কে গুজব ছড়ানো।
• আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ: বিচ্ছিন্ন সামরিক অভ্যুত্থান বা "শক্তি প্রদর্শন" এর চেষ্টা, সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য চাপ দেওয়া।
৫. যুক্তরাষ্ট্রের নব্য-উপনিবেশবাদী লক্ষ্য ও বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ
যুক্তরাষ্ট্রের ডীপ স্টেট নেটওয়ার্ক যদি ২০২৪ সালে সফল হয়, তাহলে বাংলাদেশে নিম্নলিখিত পরিবর্তন আসতে পারে:
ক. পশ্চিমাপন্থী সরকার প্রতিষ্ঠা
• শেখ হাসিনার স্থলে একটি মার্কিন-সমর্থিত সরকার ক্ষমতায় আসবে।
• চীনের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করবে।
• ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করবে।
• IMF ও বিশ্বব্যাংকের কঠোর শর্ত মেনে নেবে।
খ. অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর
• রপ্তানি ও আমদানিতে যুক্তরাষ্ট্রের কর্পোরেট আধিপত্য বৃদ্ধি।
• গ্যাস-বিদ্যুৎ খাতে বহুজাতিক কোম্পানির কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা।
গ. ভূরাজনৈতিক পুনর্বিন্যাস
• বাংলাদেশ ন্যাটো বা কোয়াডের মতো পশ্চিমা জোটের সঙ্গে যুক্ত হতে বাধ্য হবে।
• মিয়ানমার ও দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি পেতে পারে।
৬. উপসংহার: ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় বাংলাদেশের করণীয়
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ১৯৭১ ও ১৯৭৫ সালের ঘটনাবলিরই ধারাবাহিকতা। যুক্তরাষ্ট্রের ডীপ স্টেট নেটওয়ার্ক বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে তাদের নব্য-উপনিবেশবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়। এর মোকাবিলায় প্রয়োজন:
• সেনাবাহিনীতে জাতীয়তাবাদী চেতনা জোরদার করা।
• মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব নিয়ন্ত্রণ।
• রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক সুদৃঢ় করা।
• অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন করে IMF-এর চাপ মোকাবেলা।
"ইতিহাস বারবার পুনরাবৃত্তি হয়, কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ এবার ষড়যন্ত্রের শিকার হবে না।" —এই প্রত্যয় নিয়েই বাংলাদেশকে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।
©somewhere in net ltd.