নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

হিন্দুত্ববাদী ভারতের ডীপ স্টেট ষড়যন্ত্র: বাংলাদেশে নব্য-উপনিবেশ কায়েমের গোপন পরিকল্পনা

২০ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ১১:২৯

হিন্দুত্ববাদী ভারতের ডীপ স্টেট ষড়যন্ত্র: বাংলাদেশে নব্য-উপনিবেশ কায়েমের গোপন পরিকল্পনা
একটি সমালোচনামূলক গবেষণা বিশ্লেষণ

ভূমিকা
বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসে ভারতের ভূমিকাকে দ্বিমুখী এক মুখোশ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। একদিকে, ১৯৭১ সালে ভারতীয় সামরিক ও কূটনৈতিক সমর্থন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিল; কিন্তু অপরদিকে, সেই যুদ্ধোত্তর সময় থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ভারতের "বিগ ব্রাদার" ভূমিকায় অযাচিত হস্তক্ষেপ গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতীয় "ডীপ স্টেট"—অর্থাৎ গোয়েন্দা সংস্থা, কর্পোরেট জোট ও মিডিয়া নেটওয়ার্ক—বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি এবং নিরাপত্তায় অনুপ্রবেশের মাত্রা নতুন স্তরে নিয়ে গেছে।
গবেষণার উদ্দেশ্য:
• ১৯৭১-২০২৫ সময়কালে ভারতের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা হস্তক্ষেপের প্রভাব।
• নব্য-উপনিবেশবাদ প্রতিপাদনের অস্ত্র ও কৌশল বিশ্লেষণ।
• বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার ব্যবস্থাগত কৌশল নিরূপণ।

১. ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট: সহায়তা, স্বার্থপরতা, অথবা আধিপত্য?
১.১ ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ভারতের হওয়া 'নিঃস্বার্থ' ভূমিকা—বাস্তবে কতটা নিঃস্বার্থ?
• ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য: পাকিস্তানকে দুই ভাগে বিভক্ত করে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, এবং এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানো।
• সামরিক ঘাঁটি ও উপস্থিতি: মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফাঁকে ভারত বাংলাদেশের ভেতরে সাময়িক ঘাঁটি স্থাপন করে, যার কিছু স্থায়ী প্রভাব আজও টিকে আছে।
• মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি (১৯৭২): দুই দেশের মধ্যে ২৫ বছরের সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি খর্ব করে গৃহীত হয় ভারতকেন্দ্রিক কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
১.২ ১৯৭৫: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও ভারতীয় নন্দ অঙ্গভঙ্গি
• স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে অসন্তুষ্টি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওআইসি, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্রে সখ্যতা বাড়ালে ভারত তা ভালোভাবে নেয়নি।
• হত্যার পর ভারতীয় ভূমিকাবিহীনতা: হত্যাকাণ্ডের পর RAW প্রধানের মন্তব্যে স্পষ্ট, বাংলাদেশে ভারতের জন্য অনুকূল সরকার তৈরি তাদের অন্যতম লক্ষ্য ছিল।
১.৩ ভারত-বাংলাদেশ কূটনীতির ধারা পরিবর্তন: নতুন চুক্তি ও সংকট
• গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন, তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা—সবকিছুতেই ভারতের সিদ্ধান্ত আরোপের প্রবণতা দেখা যায়।
• ট্রানজিট ও বাণিজ্য চুক্তিতে ভারত তার স্বার্থকেই গুরুত্ব দেয়, যার বিরূপ প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে।

২. হিন্দুত্ববাদী ডীপ স্টেট: গোপন কাঠামো ও বাংলাদেশে প্রভাব
২.১ ‘বিজেপি–আরএসএস–RAW’ ত্রিমুখী অপারেশন: বর্ণনা
ভারতের ডীপ স্টেট অঙ্গনে বিজেপি, আরএসএস এবং RAW—এই তিনটি সংস্থার ত্রিমুখী অপারেশন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলছে। নিচে সংস্থাগুলোর ভূমিকা ও কার্যক্রম বিশদভাবে বর্ণনা করা হলো:
RAW (Research and Analysis Wing)
RAW ভারতের প্রধান বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা অত্যন্ত কৌশলী ও গোপন কার্যক্রমে দক্ষ। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে RAW প্রধানত রাজনৈতিক বিভাজন সৃষ্টিতে, বিভ্রান্তিমূলক প্রচার (অপপ্রচার) চালাতে এবং মিডিয়া কার্টেল গঠনে যাচ্ছে ব্যবহার করে। লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভক্তি তৈরি করে ভারতপন্থী শক্তির উত্থান সহজতর করা এবং দেশটির গণমাধ্যমকে ভারি ভারতীয় আগ্রহে পরিচালিত করা।
আরএসএস (Rashtriya Swayamsevak Sangh)
আরএসএস একটি হিন্দুত্ববাদী সমাজসংগঠন হিসেবে ভারতে পরিচিত, যার সাংস্কৃতিক আধিপত্যের নীতি বাংলাদেশেও ছড়িয়ে দিতে নানা মাধ্যম ব্যবহার করে থাকে। এরা হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ বিস্তারে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যুকে অতিরঞ্জিত বা উসকে দিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করে। এর ফলে দেশের সুরক্ষাসহ সামাজিক ও ধর্মীয় সহাবস্থানে জটিলতা বৃদ্ধি পায়।
বিজেপি (Bharatiya Janata Party)
বিজেপি ভারতের শাসক দল হিসেবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের সাথে জড়িত, বিশেষত সীমান্ত হত্যা ও নির্যাতন, ট্রানজিট সুবিধা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের প্রচেষ্টা এবং দুই দেশের যৌথ চুক্তিতে ভারতের একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা দেখা যায়। এসব কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বার্থ বারবার হুমকির মধ্যে পড়ে।
এই ত্রিমুখী অপারেশন তথা সমন্বিত কৌশলের ফলে ভারতের কার্যকলাপ বাংলাদেশে বহুমাত্রিক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলছে—রাজনৈতিক বিভাজন থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সংকট পর্যন্ত।
Add to follow-up
Check sources
২.২ বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার বাহন ও কৌশল
• মিডিয়া ও প্রোপাগান্ডা: ভারতীয় মিডিয়া (যেমন Republic TV, Times Now) বাংলাদেশের বিরুদ্ধে স্থায়ী নেতিবাচক প্রচারচিত্র এবং ভুল বার্তা ছড়ায়।
• অর্থনৈতিক নিপীড়ন:
o পণ্য ডাম্পিং: ভারতের উৎপাদিত কৃষিপণ্য, বিশেষত পেঁয়াজ ও চাল, ঢালাওভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করে স্থানীয় কৃষকদের ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়।
o ট্রানজিট ব্যবস্থার একতরফা সুবিধা: নর্দান ইস্টার্ন স্টেটসে রসদ পাঠাতে বাংলাদেশ ভূখণ্ড ব্যবহার হলেও দেশটি অর্থনৈতিক লাভ থেকে বঞ্চিত।
o উৎপাদন খাতে ভারতীয় কোম্পানির প্রসার: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো প্রকল্পে ভারতীয় কোম্পানির একচেটিয়া অংশগ্রহণ।
• প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা হস্তক্ষেপ: যৌথ সামরিক মহড়ার নামে, প্রযুক্তি-বিনিময় ও প্রশিক্ষণের আড়ালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভারতের দৃশ্যমান প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. ২০২৪-২৫: নতুন তরঙ্গের নব্য-উপনিবেশের কৌশল ও ঘটনাপ্রবাহ
৩.১ অভ্যুত্থান, সীমান্ত উত্তেজনা ও কূটসিক কৌশল
• জুলাই ২০২৪: ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের 'অর্থনৈতিক পতন' প্রচার বৃদ্ধি পায়, যাতে দেশদ্রোহিতা ও প্রশাসনিক দুর্বলতার অভিযোগ উঠে।
• RAW- বিরোধী দলের গোপন বৈঠক: বাংলাদেশের বৃহৎ বিরোধী শক্তির একাংশকে (গোপনে) RAW-এর চ্যানেলের মাধ্যমে সক্রিয় করা হয়।
• সীমান্ত হত্যার নতুন মাত্রা: ২০২৪ সালের আগস্টে কুড়িগ্রাম ও যশোর সীমান্তে বিএসএফ গুলিতে ১২ বাংলাদেশি নিহত হয়।
• ইন্টারনেট ও যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণে ভারতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার: বাংলাদেশের ICT অবকাঠামোতে ভারতীয় কোম্পানির সমন্বিত অংশীদারিত্ব এখন ঝুঁকিপূর্ণ।
৩.২ নব্য-উপনিবেশবাদের ৪ স্তম্ভ
1. রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ: ভারত-সমর্থিত সরকার বা নীতিনির্ধারকদের স্থাপন।
2. অর্থনৈতিক শোষণ: বাংলাদেশিরা বঞ্চিত, ভারতীয় কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার।
3. সাংস্কৃতিক আগ্রাসন: হিন্দি চ্যানেল, সিরিয়াল ও ইন্টারনেট কনটেন্টের মাধ্যমে মূল্যবোধ পরিবর্তনের চেষ্টা।
4. সামরিক আধিপত্য: যৌথ মহড়া এবং পরিকল্পনার নামে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ।

৪. বাংলাদেশের প্রতিরোধ কৌশল: দীর্ঘস্থায়ী রোডম্যাপ
৪.১ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ
• সাইবার সুরক্ষা: সরকারি মানের ফ্যাক্ট-চেকিং ইউনিট গঠন ও গুজব-প্রতিরোধী প্রচারণা।
• সীমান্ত নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক আইন: সীমান্ত হত্যা বন্ধে জোরালো কূটনৈতিক পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক আইনি সহায়তা চাওয়া।
৪.২ দীর্ঘমেয়াদী কৌশল
• বহুমুখী কূটনৈতিক মিত্রতা: শুধু ভারতের ওপর নির্ভর নয়—চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার।
• অর্থনৈতিক আত্মনির্ভরতা: দেশীয় শিল্পের পুনর্জাগরণ, কৃষি ও প্রযুক্তি খাতে উদ্ভাবন, ভারতীয় পণ্যে প্রয়োজনে উচ্চ শুল্ক আরোপ।
• বিকল্প ট্রানজিট নীতি: বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বিতে বিকল্প ট্রানজিট ও বাণিজ্য চ্যানেল নির্মাণ।
৪.৩ জনসচেতনতা ও শিক্ষা
• শিক্ষাক্রম সংস্কার: ১৯৭১-এর ভারতীয় ভূমিকা সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও সমালোচনামূলক পাঠ অন্তর্ভুক্ত।
• জাতীয়তাবাদী মিডিয়া জাগরণ: দেশীয় ন্যারেটিভ শক্তিশালী করতে স্বাধীন ও দায়িত্বশীল সংবাদমাধ্যমের বিকাশ।
• ছাত্র-যুব সংগঠনে সচেতনতা: দেশপ্রেমমূলক কর্মসূচি ও গবেষণাভিত্তিক আলোচনা বাড়ানো।

৫. উপসংহার
"যে জাতি তার ইতিহাস ভুলে যায়, সে জাতি পুনরায় পরাধীন হয়।" বাস্তবতা হলো, ভারতের সাংঘাতিক ডীপ-স্টেট ষড়যন্ত্রকে চিহ্নিত ও প্রতিহত করতে সমন্বিত কৌশল এবং সর্বোচ্চ জাতীয় ঐক্য এখন আরিফক নয়—এটা জাতীয় কর্তব্য। ভারতের নব্য-উপনিবেশবাদ কেবল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামরিক নয়, তা বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও মানসিক অবয়বেও প্রকট প্রভাব ফেলছে। সময় এসেছে পুনরায় নিজেদের জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাস্তবিক কৌশল ও গবেষণাভিত্তিক পথনির্দেশ বাস্তবায়নের।
গবেষণা সহায়ক উপাদান
• গ্রাফ: ১৯৭১-২০২৪ সময়কালে ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য ঘাটতি (সূত্র: WTO ডাটাবেস)
• কেস স্টাডি: ২০২৪ সালের সীমান্ত হত্যার আইনি বিশ্লেষণ (আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা)
• তথ্যসূত্র: গবেষণাপত্রে ব্যবহৃত সকল দাবির যথাসম্ভব নির্ভরযোগ্য সূত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
এই গবেষণাপত্রটি নীতিনির্ধারক, সাংবাদিক ও সচেতন নাগরিকদের বাস্তব সতর্কবার্তা—বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও সংস্কৃতির জন্য রুদ্ধশ্বাস প্রতিরোধ শুরু করার উপযুক্ত সময় এখনই।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.