নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ইউনুসের কর্মকাণ্ডে কীসের প্রতিচ্ছবি? ত্রাণকর্তার না-কি কুটিলতার?

২০ শে জুলাই, ২০২৫ রাত ৮:৩৬



১. প্রারম্ভিকা
ড. মুহম্মদ ইউনুসের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের প্রতীক হিসেবে উচ্চারিত হয়—বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ (মাইক্রোক্রেডিট) প্রবর্তক হিসেবে। বিশ্বজুড়ে তাকে গরিবের বন্ধু, নারীর ক্ষমতায়নের দিশারি, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু দেশীয় রাজনীতি ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় তাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে জটিল বিতর্ক—যেখানে একদিকে তিনি “ত্রাণকর্তা” ও “মহামানব”, অন্যদিকে এক শ্রেণির বিশ্লেষক তাকে “বিদেশি লবিস্ট” ও “কৌশলী ব্যবসায়ী” আখ্যা দিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান, ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও পশ্চিমা কূটনীতি—সব মিলিয়ে ইউনুসের ভাবমূর্তি আজ আর কেবল অর্থনীতির সীমায় আবদ্ধ নেই; বরং এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, রাজনৈতিক ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এক অনিবার্য বিতর্কের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।

২. “মহানুভব ত্রাণকর্তা” হিসেবে আবির্ভাব
ড. ইউনুসের সমর্থকরা যুক্তি দেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, প্রশাসনিক অনিয়ম এবং ভারতের সীমান্ত-জল সমস্যা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি আগ্রাসী মনোভাব—এই প্রেক্ষাপটে পশ্চিমা বিশ্ব এমন একজন ‘উদার, মানবিক ও নোবেল ইমেজধারী’ নেতৃত্ব খুঁজছে, যিনি বাংলাদেশকে ভারতের একচেটিয়া প্রভাব থেকে কিছুটা মুক্ত করতে পারেন।
এই ন্যারেটিভে ড. ইউনুসের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা একটি ‘সফট পাওয়ার’ টুল হিসেবে বিবেচিত।
তিনি যেন এক ‘মানবিক প্রতীক’ হয়ে দেশের সার্বভৌম স্বার্থ রক্ষা করবেন, আবার বিদেশি লগ্নি ও উন্নয়ন সহযোগিতার সেতুবন্ধও হবেন—এটি অনেকের দৃষ্টিতে কেবল আদর্শের রোমান্টিক ছবি, বাস্তব রাজনীতিতে যার মূল উদ্দেশ্য ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের জটিলতা সমাধান নয়, বরং পশ্চিমা প্রভাব টিকিয়ে রাখা।

৩. ভারতীয় আগ্রাসন ও পশ্চিমা গেমপ্ল্যান
অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জলসম্পদ, সীমান্ত, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা নীতিকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে আসছে। তিস্তা চুক্তি, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড, চোরাচালান, ট্রানজিট সুবিধা—সবই এর অংশ।
এমন প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে ভারতের ‘একতরফা বলয়’ থেকে বের করে আনতে চাইছে।
তাদের দৃষ্টিতে ইউনুস এক “ট্রাস্টেবল ফেস”—বিশ্বমঞ্চে প্রমাণিত, নোবেলধারী, পশ্চিমা মিডিয়ায় গ্রহণযোগ্য, আবার দেশীয় মূলধারার রাজনীতির বাইরে থাকা এক বিকল্প চরিত্র।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে—এটি কি সত্যিই বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করবে, নাকি নতুন ধরণের নব্য-উপনিবেশিক শৃঙ্খল তৈরি করবে?

৪. দরিদ্রের নামে কর্পোরেটাইজড উন্নয়ন মডেল
ড. ইউনুসের সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে ধরা হয় ক্ষুদ্রঋণ মডেল। গ্রামের দরিদ্র নারী, ভূমিহীন পরিবারকে ‘ঋণযোগ্য’ করে তোলার এই ধারণা প্রথমে বিপ্লবী মনে হলেও, এর নানামুখী নেতিবাচক দিকও আজ স্পষ্ট:
• অতিরিক্ত সুদের বোঝা: অনেক গ্রাহক অভিযোগ করেছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প উচ্চ সুদের কারণে তাদের দরিদ্রতা দূর না হয়ে বরং ঋণচক্রে ফেলেছে।
• রাষ্ট্রীয় সহায়তা ও বিদেশি অনুদানের অপব্যবহার: সরকারি প্রণোদনা ও বৈদেশিক অনুদান ব্যবহার করে গ্রামীণ ব্যাংক লাভজনক বাণিজ্যিক মডেলে রূপ নেয়, অথচ ‘দরিদ্রের মঙ্গল’ শ্লোগানেই অর্থ সংগ্রহ করা হয়।
• আন্তর্জাতিক লবিস্ট ও পুরস্কার প্রাপ্তি: বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে যে, গ্রামীণ ব্যাংক ও ইউনুসের সাফল্য আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও পুরস্কার কমিটিগুলোতে লবিং কোম্পানি নিয়োগ করে জোরদার করা হয়েছিল। এর খরচ এসেছে আংশিকভাবে গ্রামীণ ব্যাংক বা সংশ্লিষ্ট সামাজিক ব্যবসার লাভ থেকে।
• গ্রামীণ ফোন ও কর্পোরেট স্বার্থ: ইউনুসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ফোন দেশের বৃহত্তম টেলিকম প্রতিষ্ঠান, যা নরওয়ের টেলিনর-এর সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালিত। এটি মূলত মাইক্রোক্রেডিট বা সামাজিক ব্যবসার আওতার বাইরে গিয়ে কর্পোরেট শেয়ারভিত্তিক লাভ তৈরি করেছে, যা দরিদ্র শেয়ারহোল্ডারদের হাতে যায়নি।

৫. বিতর্কিত রাজনৈতিক অভিসন্ধি
অভিযোগ রয়েছে, ইউনুস দরিদ্রদের নামে প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে সরকার থেকে ছাড়পত্র, অনুদান ও বিশেষ সুবিধা আদায় করে সেই অর্থনৈতিক পুঁজি রাজনৈতিক লবিং ও ক্ষমতার বলয়ে রূপান্তরিত করেছেন।
কিছু রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা বা ‘তৃতীয় শক্তি’ গঠনের নেপথ্যে তার আন্তর্জাতিক যোগাযোগ, নেটওয়ার্ক ও বৈদেশিক তহবিল সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।
এই প্রক্রিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার সাথে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ, তা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে।

৬. সার্বিক মূল্যায়ন
ড. মুহম্মদ ইউনুসের জীবন ও কাজ একটি দ্বৈত বাস্তবতার প্রতীক:
• একদিকে তিনি গরিব নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে আত্মবিশ্বাস, ঋণপথে ক্ষুদ্র ব্যবসার স্বপ্ন দেখানোর পথিকৃৎ।
• অন্যদিকে তার কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক ফান্ডিং, কর্পোরেট মুনাফা ও পশ্চিমা রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারযোগ্য একটি ব্র্যান্ড—যা জাতীয় সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করার অপবাদ বয়ে এনেছে।

৭. উপসংহার
বাংলাদেশের উন্নয়ন, গণতন্ত্র ও স্বার্থরক্ষা—এই ত্রিমাত্রিক সমীকরণে ড. মুহম্মদ ইউনুস এক অনিবার্য চরিত্র।
তিনি কি সত্যিই “ত্রাণকর্তা ও মহানুভব মহামানব”, নাকি **“গরীবের নামে ধনীর বাজার” তৈরি করা এক বিতর্কিত কারিগর”—এ প্রশ্নের জবাব ইতিহাসই দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা ও ভারতের আধিপত্য মোকাবিলা করার জন্য দেশীয় রাজনৈতিক ঐক্য ও স্বচ্ছ নেতৃত্বই দীর্ঘমেয়াদি সমাধান, কোন আন্তর্জাতিক ‘মহামানব’ নয়।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.