নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভাষিক উপনিবেশবাদ ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ: একটি বিস্তৃত আলোচনা

০৩ রা আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৫:১৭


১. ভাষিক উপনিবেশের ঐতিহাসিক পটভূমি
ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরও যে নব্য-সাম্রাজ্যবাদের রূপ আমরা দেখতে পাই, তার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো ভাষিক আধিপত্য। ঈঙ্গমার্কিন ভাষিক উপনিবেশ ও ফরাসি ভাষিক ও স্পেনীয় উপনিবেশসমূহকে যথাক্রমে এ্যাংলোফোন, ফ্রাংকোফোন ও স্পেনিয়ার্ড ভাষা-সাংস্কৃতিক বলয় নামে অভিহিত করা হয়। এই ভাষিক বলয়গুলো কেবলমাত্র ভাষার ব্যবহারিক দিকই নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক ও চিন্তাগত কাঠামো তৈরি করে যা প্রাক্তন উপনিবেশগুলোর মানসিক স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করে।

২. ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের আধুনিক রূপ
ঈঙ্গমার্কিন, ফরাসি ও স্পেনীয় ভাষিক উপনিবেশসমূহে ক্রমবর্ধমান হারে বেড়ে চলেছে এই ভাষাগুলোতে উচ্চশিক্ষা প্রাপ্ত ভাষিক সাম্রাজ্যবাদের প্রতিভূ শক্তি, যারা চেহারা দেশীয়দের মতো কিন্তু চিন্তাচেতনায় ভাষিক সাম্রাজ্যবাদীদের মতো। এই শ্রেণীটি তৈরি হয় মূলত উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে, যেখানে পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, পশ্চিমা গবেষণা পদ্ধতি এবং পশ্চিমা মূল্যবোধকে শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
এই শিক্ষিত শ্রেণী দেশীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে পশ্চাৎপদ ও অনুন্নত মনে করে। তাদের কাছে স্থানীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান, দর্শন ও চিন্তাধারা গৌণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তারা নিজেদের দেশের মানুষকে অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে করে এবং পশ্চিমা সভ্যতার আলোকে তাদের 'সভ্য' করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নেয়।

৩। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্থানীয় প্রতিনিধি
তারা সাম্রাজ্যবাদের অনুগত হিসেবে ভাষিক সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজে ব্যপৃত থাকে। এই কাজটি তারা করে বিভিন্ন উপায়ে:
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে: তারা বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও শ্রমশক্তিকে বিদেশী পুঁজির কাছে সস্তায় বিক্রি করে দেয়। স্থানীয় শিল্প ও ব্যবসার পরিবর্তে বিদেশী পণ্য ও সেবার প্রসার ঘটায়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে: তারা এমন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করে যা সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর স্বার্থে কাজ করে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার চেয়ে বিদেশী শক্তির মতামত ও নির্দেশনাকে বেশি গুরুত্ব দেয়।
সামরিক ক্ষেত্রে: তারা দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বিদেশী সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল করে তোলে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর নিরাপত্তা স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।

৪. অভিজাত শ্রেণীর স্বর্গরাজ্য
তাদের মধ্যে অভিজাত শ্রেণীগণ সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহের নিজেদের আবাসিক ও ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজেরা স্বর্গ রাজ্যে বসবাস করার মতো গর্ব করে। এই অভিজাত শ্রেণী দেশের মধ্যেই একটি বিদেশী ছিটমহল তৈরি করে, যেখানে:
• পশ্চিমা স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত বাড়িঘর
• বিদেশী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শাখা
• পশ্চিমা জীবনযাত্রার অনুকরণ
• দেশীয় খাদ্য, পোশাক ও সংস্কৃতির পরিবর্তে বিদেশী রীতিনীতির প্রাধান্য
• স্থানীয় ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি, ফরাসি বা স্পেনীয় ভাষার ব্যবহার
এই অভিজাত শ্রেণী মনে করে যে তারা একটি উন্নত সভ্যতার প্রতিনিধি এবং সাধারণ জনগণ থেকে তারা উচ্চতর মানের মানুষ।

৫. মানবিক চেতনার অনুপস্থিতি
তারা তাদের প্রভূরূপ ভাষিক সাম্রাজ্যবাদীদের কর্তৃক দেশকে দূরনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক শাসন ও শোষণের বিষয়টিতে বিব্রতবোধ বা মানবাতাবোধ পোষণ করে না। এই অবস্থার কারণ হলো:
৫.১ চেতনাগত দাসত্ব: তারা মানসিকভাবে এতটাই পরাধীন যে নিজেদের দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের মূল্য বুঝতে পারে না।
৫.২ ব্যক্তিগত স্বার্থ: তাদের ব্যক্তিগত সুবিধা ও লাভের সাথে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির স্বার্থ জড়িত থাকায় তারা জাতীয় স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
৫.৩ সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা: তারা নিজেদের দেশের মানুষ ও সংস্কৃতি থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে দেশের কষ্ট ও যন্ত্রণা তাদের স্পর্শ করে না।

৬. ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিচয় সংকট
তাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সাম্রাজ্যবাদী দেশের আলোবাতাসে মানুষ হয়ে সেখানের সংস্কৃতির সাথে মিশে গিয়ে ভিনজাতির সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব বীলিন করে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায়:
৬.১ সাংস্কৃতিক আত্মীকরণ: ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সম্পূর্ণভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আত্মীকৃত হয়ে যায় এবং নিজেদের মূল পরিচয় ভুলে যায়।
৬.২ জাতিগত মিশ্রণ: আন্তর্জাতিক বিবাহের মাধ্যমে তারা ধীরে ধীরে নিজেদের জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় হারিয়ে ফেলে।
৬.৩ ভাষাগত বিলুপ্তি: মাতৃভাষার পরিবর্তে বিদেশী ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে কয়েক প্রজন্মের মধ্যেই তারা নিজেদের ভাষা ভুলে যায়।
৬.৪ মূল্যবোধের পরিবর্তন: পূর্বপুরুষের মূল্যবোধ, নৈতিকতা ও জীবনদর্শনের পরিবর্তে বিদেশী মূল্যবোধ গ্রহণ করে।

৭. জাতীয় ক্ষতির ব্যাপকতা
কিন্তু এ বিষয়ে তাদের মধ্যে কোনও বিব্রতবোধ নেই। অথচ তারা দেশের সর্বনাশ করে যাচ্ছে। এই সর্বনাশের রূপ বহুমাত্রিক:
৭.১ অর্থনৈতিক সর্বনাশ: দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার, স্থানীয় শিল্পের ধ্বংস, বেকারত্ব বৃদ্ধি এবং আর্থিক নির্ভরশীলতা।
৭.২ সাংস্কৃতিক সর্বনাশ: ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিলুপ্তি, ভাষার অবক্ষয়, শিল্পকলার হ্রাস এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ক্ষয়।
৭.৩ রাজনৈতিক সর্বনাশ: জাতীয় সার্বভৌমত্বের হানি, পররাষ্ট্রনীতিতে স্বাধীনতার অভাব এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা।
৭.৪ সামাজিক সর্বনাশ: শ্রেণী বৈষম্য বৃদ্ধি, সামাজিক সংহতির অভাব এবং জাতীয় ঐক্যের ক্ষয়।

৮. উত্তরণের পথ
এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন:
৮.১ শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার: দেশীয় ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
৮.২ সাংস্কৃতিক জাগরণ: ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন এবং নতুন প্রজন্মের মধ্যে সাংস্কৃতিক চেতনা সৃষ্টি।
৮.৩ অর্থনৈতিক স্বাধীনতা: স্থানীয় শিল্প ও উৎপাদনের বিকাশ এবং বিদেশী নির্ভরতা কমানো।
৮.৪ রাজনৈতিক সচেতনতা: জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
৮.৫ গণমাধ্যমের ভূমিকা: দেশীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে জাতীয় চেতনা ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ প্রচার।

৯. উপসংহার
ভাষিক উপনিবেশবাদ আধুনিক যুগের এক সূক্ষ্ম কিন্তু ভয়ানক অস্ত্র। এটি প্রত্যক্ষ সামরিক দখলদারিত্বের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর কারণ এটি মানুষের মন ও চেতনাকে গোলাম বানিয়ে ফেলে। একটি জাতির প্রকৃত স্বাধীনতা তখনই অর্জিত হয় যখন তার মানুষ মানসিকভাবে স্বাধীন হয়, নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতিতে গর্ববোধ করে এবং জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। অন্যথায় রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেবল একটি মিথ্যা নাম মাত্র।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.