নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

আমেরিকার ভূকৌশল, বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তারের কৌশল এবং ভারত–আমেরিকা–বাংলাদেশ ত্রিভুজ সম্পর্ক

০৬ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৮:১৭


ভূমিকা
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ এক জটিল জটিলতার ঘূর্ণিপাকে আটকে গেছে। একদিকে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব বিস্তারের কৌশল, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক উপস্থিতির চেষ্টা—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও অভ্যন্তরীণ নীতি এক ধরনের প্রক্সি রাজনীতির অঙ্গনে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই প্রভাবের দ্বন্দ্ব নতুন মাত্রা পেয়েছে, যখন দেশের কিছু সামরিক কর্মকর্তা ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার দেশীয় সহযোগীরা আওয়ামীলীগের ভারতমুখী নীতির তীব্র সমালোচনা করলেও যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে নীরব থেকেছে। প্রশ্ন হলো, আওয়ামীলীগের ভারতঘেঁষা নীতির প্রতিশোধ নিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে দেশ তুলে দেওয়া কি কোনো জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করে?
এই প্রবন্ধে আমরা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আমেরিকার প্রভাব বিস্তারের কৌশল, ভারত–আমেরিকা–বাংলাদেশ ত্রিভুজ সম্পর্ক, এবং সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতার প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণ করব।
________________________________________
আমেরিকার ভূকৌশল: সুই হয়ে প্রবেশ, কুড়াল হয়ে প্রস্থান
"আমেরিকা যদি একবার সুই হয়ে ঢোকে, তাহলে কুড়াল হয়ে বের হয়"—এই রূপকটি আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলকে সঠিকভাবে প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি সাধারণত তিন ধাপে বিস্তৃত হয়:
1. সহযোগিতার হাত বাড়ানো:
যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ও উন্নয়নের এজেন্ডা নিয়ে কূটনৈতিকভাবে প্রবেশ করে। বেসরকারি সংস্থা (NGO), মানবাধিকার সংগঠন এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে জনমত গঠন করে।
2. অর্থনৈতিক ও সামরিক নির্ভরতা সৃষ্টি:
USAID, IMF ও World Bank-এর মতো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীতে সামরিক মহড়া, নিরাপত্তা সহযোগিতা এবং প্রতিরক্ষা চুক্তির মাধ্যমে প্রতিরক্ষা খাতে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।
3. রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিষ্ঠা:
একবার প্রভাব বিস্তার হলে যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি করে এবং এমন নেতৃত্বে সমর্থন দেয় যারা তাদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে অনুকূল। লাতিন আমেরিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত এর অসংখ্য উদাহরণ আছে—চিলি (১৯৭৩), ইরাক (২০০৩), আফগানিস্তান (২০০১) ইত্যাদি।
বাংলাদেশেও একই রূপকৌশল লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ২০১৩ সালের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে মানবাধিকার ইস্যু, নির্বাচন তদারকি এবং সামরিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ক্রমবর্ধমানভাবে সক্রিয় হয়েছে।
________________________________________
ভারত–আমেরিকা–বাংলাদেশ ত্রিভুজ সম্পর্ক
বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান এই ত্রিভুজ সম্পর্ককে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।
1. ভারতের অবস্থান:
o ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তার সীমান্ত নিরাপত্তা, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সংযোগ, এবং জলসম্পদ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে দেখে।
o আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় থাকায় ভারত তার জন্য সুবিধাজনক কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে।
2. আমেরিকার অবস্থান:
o যুক্তরাষ্ট্র ভারতের সাথে কোয়াড (QUAD) জোটে যুক্ত হয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাব ঠেকাতে কাজ করছে। বাংলাদেশকে তারা ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে দেখতে চায়।
o যুক্তরাষ্ট্র চায়, বাংলাদেশে একটি গণতান্ত্রিক মুখোশধারী, কিন্তু আমেরিকামুখী সরকার গড়ে উঠুক, যাতে তাদের সামরিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুণ্ণ থাকে।
3. বাংলাদেশের অবস্থান:
o বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ভারতের ওপর অতিনির্ভরতার কারণে জনমনে ক্ষোভ তৈরি করেছে।
o এই ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কিছু গোষ্ঠী "আমেরিকাপন্থী বিকল্প" হিসেবে জনমত গঠনের চেষ্টা করছে।
o কিন্তু বাস্তবে এই বিকল্পও আরেকটি পরাশক্তির প্রভাব বিস্তারের দরজা খুলে দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিকে দুর্বল করে।
________________________________________
সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা: লুকানো সমীকরণ
বক্তব্যে উল্লেখিত "সামরিক কর্মকর্তা ও বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার দেশীয় চর" প্রসঙ্গটি বাংলাদেশের নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের দিকে ইঙ্গিত করে।
• সামরিক সহযোগিতা:
যুক্তরাষ্ট্রের IMET (International Military Education and Training) প্রোগ্রামের মাধ্যমে বহু বাংলাদেশি সেনা কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত চিন্তাধারার প্রভাব বিস্তার সহজ হয়।
• গোয়েন্দা সংযোগ:
যুক্তরাষ্ট্রের CIA এবং ভারতের RAW—দুই সংস্থাই বাংলাদেশে সক্রিয়।
কিছু ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে উভয়েই নিজেদের স্বার্থে সুবিধা নেয়।
• নির্বাচনী হস্তক্ষেপ:
নির্বাচনের সময় যুক্তরাষ্ট্র ভিসা নীতি, মানবাধিকার প্রতিবেদন ইত্যাদি কূটনৈতিক হাতিয়ার ব্যবহার করে সরকারকে চাপের মুখে ফেলে।
এই প্রেক্ষাপটে সামরিক বাহিনীর কিছু অংশ যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ছত্রছায়ায় নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার চেষ্টা করছে।
________________________________________
ডাল ম্যায় কুচ কালা হ্যায়: নীরবতার ব্যাখ্যা
বক্তব্যে ব্যবহৃত উর্দু প্রবাদ "ডাল ম্যায় কুচ কালা হ্যায়" বোঝায়—বিষয়টির অন্তরে কোনো গোপন চুক্তি বা অস্বচ্ছ স্বার্থ জড়িত।
• যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে সরব না হওয়ার মানে হলো, সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থের যোগসূত্র রয়েছে।
• তাদের সমালোচনার মূল লক্ষ্য আসলে ভারতের প্রভাব হ্রাস, কিন্তু আমেরিকান প্রভাব নিয়ে তারা নীরব, কারণ সেই প্রভাব তাদের রাজনৈতিক ও সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার সাথে সাযুজ্যপূর্ণ।
________________________________________
উপসংহার
বাংলাদেশ আজ এক জটিল ভূরাজনৈতিক খেলায় জড়িয়ে গেছে। আওয়ামীলীগের ভারতমুখী নীতি সমালোচনার দাবি রাখে, কিন্তু প্রতিশোধের নামে যুক্তরাষ্ট্রের মতো আরেক সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দেওয়া জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী।
যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি বহুমুখী—প্রথমে সুই হয়ে ঢোকে (সহযোগিতা, মানবাধিকার, উন্নয়নের নামে), পরে কুড়াল হয়ে বের হয় (অর্থনৈতিক, সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে)।
তাই বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকদের উচিত:
• ভারত–আমেরিকা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে কৌশলগতভাবে ব্যবহার করা, কিন্তু কোনো পক্ষের অধীনস্ত হওয়া নয়।
• স্বাধীন ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করা।
• সামরিক ও গোয়েন্দা খাতে বিদেশি প্রভাব হ্রাস করে নিজস্ব সক্ষমতা বৃদ্ধি করা।
অন্যথায় প্রতিশোধের আবেগে নেওয়া সিদ্ধান্ত একদিন জাতীয় সার্বভৌমত্বকে অন্য এক প্রভাববলয়ে বন্দী করে ফেলতে পারে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.