নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

উত্তর-ঔপনিবেশিক আয়নায়: আওয়ামী লীগ বিরোধিতার একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

০৭ ই আগস্ট, ২০২৫ সকাল ৮:৪৬

১. ভূমিকা
বাংলার মাটি ও মানুষের ইতিহাসে ঔপনিবেশিক শোষণ ও পরাধীনতার যন্ত্রণা গভীর ক্ষত রেখে গেছে। ব্রিটিশ শাসনের সেই স্মৃতি আজও জাতীয় স্মৃতিতে জ্বলজ্বলে, যেখানে শোষণ, অত্যাচার, এবং জাতির আত্মিক-অর্থনৈতিক ধ্বংসের চিত্র অঙ্কিত। একই সাথে, বর্তমান সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও সহিংসতার ডাক ("যেখানে পাচ্ছেন সেখানেই মারছেন") এবং সেইসাথে ব্রিটিশ উত্তরাধিকার ও সংস্কৃতির প্রতি এক ধরনের গ্রহণযোগ্যতা বা এমনকি শ্রদ্ধার দ্বৈততা বিদ্যমান, যা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের দাবি রাখে। উত্তর-ঔপনিবেশিক তত্ত্বের নিরিখে এই জটিল পরিস্থিতি পরীক্ষা করাই এই রচনার উদ্দেশ্য, যার কেন্দ্রে থাকবে সহিংসতা পরিহারের জরুরি আহ্বান।

২. উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ: ক্ষমতার চক্র ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ
উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাবিদগণ (ফ্রানৎজ ফ্যানন, এডওয়ার্ড সাঈদ, হোমি কে. ভাবা, গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক প্রমুখ) বারংবার দেখিয়েছেন যে ঔপনিবেশিকতা কেবল ভৌতিক দখলদারিত্বই নয়, এটি একটি জ্ঞানকাণ্ড (Discourse), ক্ষমতার কাঠামো, এবং মানসিকতার ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ঔপনিবেশিক শক্তি চলে গেলেও এই কাঠামো ও মানসিকতা প্রায়শই টিকে থাকে বা রূপান্তরিত হয়।
• "অভ্যন্তরীণ উপনিবেশবাদ" (Internal Colonialism) ও ক্ষমতার পুনরুৎপাদন: আপনার পর্যবেক্ষণে একটি মৌলিক সত্য ধরা পড়ে: ক্ষমতায় যারা আসেন, তারা কখনো কখনো তাদের পূর্বসূরি ঔপনিবেশিক শাসকদেরই ক্ষমতার কৌশল (দমন, শোষণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা, ভিন্নমত দমন) পুনরুৎপাদন করেন। ফ্যানন সতর্ক করেছিলেন যে মুক্তিযুদ্ধের পরেও নতুন অভিজাত শ্রেণি প্রায়শই ঔপনিবেশিক শাসকদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে, স্থানীয় জনগণকে "অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ"-এর অধিবাসী হিসেবে শাসন করতে পারে। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আপনার উত্থাপিত অভিযোগগুলি (অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ) যদি সত্য হয়, তাহলে তা এই ক্ষমতার দুষ্টচক্রেরই উদাহরণ – যেখানে স্বাধীনতার নামে আসলে ক্ষমতার কাঠামো ও দমনপীড়নের পদ্ধতিগুলোই টিকে থাকে বা পুনঃস্থাপিত হয়, শুধু শাসকের পরিচয় বদলায়।
• সাংস্কৃতিক হেজিমনি ও মানসিক দাসত্ব: ব্রিটিশ সংস্কৃতি, ভাষা (ইংরেজি), এবং জীবনযাপনের প্রতি অনুরাগ বা "গর্ববোধ" (যেমনটি আপনি উল্লেখ করেছেন) সাংস্কৃতিক হেজিমনির (এ্যন্তোনিও গ্রাম্শী) একটি জটিল দিক। ঔপনিবেশিক শাসন জ্ঞান, সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের এমন একটি ব্যবস্থা চাপিয়ে দেয়/গড়ে তোলে, যাতে উপনিবেশিতরা নিজেদের সংস্কৃতিকে হীন ও ঔপনিবেশিক সংস্কৃতিকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। এই মানসিক দাসত্ব (ফ্যানন) দীর্ঘস্থায়ী হয়। ইংরেজদের প্রতি এই "সম্মান" বা অনুকরণ (ভাবশিষ্য, তল্পিবাহক) এবং একই সাথে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক শক্তির প্রতি চরম সহিংসতার ডাক, এই সাংস্কৃতিক দ্বিচারিতা বা বিভাজিত মনস্তত্ত্বকেই (Split Psyche) নির্দেশ করে, যা উত্তর-ঔপনিবেশিক সমাজের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। ভাবার ধারণা "মিমিক্রি" (Mimicry) এখানে প্রাসঙ্গিক – ঔপনিবেশিক প্রভুর অনুকরণ, কিন্তু কখনো সম্পূর্ণ সমান হওয়া নয়।

৩. "মারমুখীদের" প্রতি আহ্বান: সহিংসতার বিপদ ও বিকল্প পথের সন্ধান
মারমুখিদের বর্তমান আচরণ বুঝতে হলে উত্তর-ঔপনিবেশিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই সহিংসতার ডাকের প্রতি আমাদের প্রতিক্রিয়া কঠোরভাবে বিশ্লেষণাত্মক ও সতর্কতামূলক হতে হবে:
1. ফ্যাননের সতর্কবাণী ও বাস্তবতা: ফ্রানৎজ ফ্যানন ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যাকে তিনি শোধনাত্মক সহিংসতা বলে দেখতেন। তবে, তিনি স্পষ্ট করেছিলেন যে এই সহিংসতা নির্দিষ্ট, ঔপনিবেশিক প্রভুর বিরুদ্ধে এবং মুক্তির লক্ষ্যে পরিচালিত হতে হবে। স্বাধীন দেশে, একটি রাজনৈতিক দল বা সরকারের বিরুদ্ধে (তা সে যতই দমনমূলক হোক না কেন) "যেখানে পাচ্ছেন সেখানেই মারার" ডাক দেওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন ও বিপজ্জনক প্রপঞ্চ। এটি:
o গৃহযুদ্ধ ও বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়।
o নিরপরাধ নাগরিকদের জীবন বিপন্ন করে।
o বিচারবহির্ভূত হত্যা, প্রতিশোধস্পৃহা ও অরাজকতার জন্ম দেয় – যা ঔপনিবেশিক দমনপীড়নের চেয়েও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
o ক্ষমতার সেই দুষ্টচক্রকেই শক্তিশালী করে যার বিরুদ্ধে এটি দাঁড়াতে চায়। সহিংসতা নতুন করে সহিংসতা জন্ম দেয়।
2. স্পিভাকের "নিম্নবর্গ" (Subaltern) ও কণ্ঠস্বর হরণ: সহিংস সংঘাতের প্রধান শিকার হন সাধারণ মানুষ, যাদের কণ্ঠস্বর ইতোমধ্যেই প্রান্তিক (স্পিভাকের "ক্যান দ্য সাবঅল্টার্ন স্পিক?")। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এই চক্রে তাদের এজেন্সি আরও লোপ পায়, তাদেরকে পরিণত করা হয় কেবলমাত্র সংখ্যায় বা বলির পাঁঠায়।
3. বিকল্প পথ: গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ ও সমালোচনার সংস্কৃতি: উত্তর-ঔপনিবেশিক আকাঙ্ক্ষা ছিল মুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের। স্বাধীন দেশে দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার সহিংসতা নয়, বরং অবিচল গণতান্ত্রিক প্রতিরোধ:
o সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন: শান্তিপূর্ণ সমাবেশ, মিছিল, ধর্মঘট।
o আইনি লড়াই: আদালতের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার কমিশনের সুযোগ নেওয়া।
o সিভিল সোসাইটির শক্তিশালীকরণ: স্বতন্ত্র মিডিয়া, মানবাধিকার সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনের ভূমিকা।
o জ্ঞান নির্মাণ ও সমালোচনা: লেখনী, শিল্প, সাহিত্য, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনার মাধ্যমে সরকারের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা ও বিকল্প ভাবনা উপস্থাপন।
o নির্বাচন: সর্বোপরি, জনগণের রায়ের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তনের পথ খোলা রাখা।

৪. বরাবর আহ্বান:
বর্তমানে চলমান ক্ষোভ, বেদনা ও প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা বোধগম্য। ইতিহাসের বোঝা এবং বর্তমানের সম্ভাব্য নিপীড়নের গ্লানি যে কত ভারী, তা অনুধাবন করি। কিন্তু, "যেখানে পাচ্ছেন সেখানেই মারার" সেই ভয়াবহ আহ্বান আমাদেরকে ঔপনিবেশিকতার সেই নৃশংস চক্রেই ফেরত নিয়ে যায়, যা গ্রহণযোগ্য নয়। এটি সেই পথ যেখানে শাসক বদলায়, কিন্তু শোষণের কাঠামো, দমনের পদ্ধতি, এবং সহিংসতার সংস্কৃতি আরও গভীরে প্রোথিত হয়।
• সহিংসতা কখনোই স্থায়ী সমাধান আনে না; এটি কেবল নতুন ক্ষত, নতুন শত্রুতা, নতুন করে রক্তপাতের বীজ বপন করে। এটি আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে অরাজকতার গহ্বরে নিক্ষেপ করবে, যার মূল্য দেবে নিরীহ জনতা।
• ব্রিটিশ শাসকদের প্রতি মনোভাবের দ্বৈততা নিয়ে জটিল প্রশ্ন রয়েছে, কিন্তু তার সমাধান বর্তমানের সহিংসতা নয়। বরং, ঔপনিবেশিক মানসিকতার জাঁতাকল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়ার চেষ্টাই কাম্য, যা কঠোর আত্মসমালোচনা, নিজ সংস্কৃতির গভীর মূল্যায়ন এবং বিশ্বজনীন জ্ঞানের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে সম্ভব।
• আওয়ামী লীগের শাসন পদ্ধতির তীব্র সমালোচনা, জবাবদিহি দাবি এবং গণতান্ত্রিক পন্থায় তাদের পরিবর্তনের চেষ্টা – এ সবই বৈধ এবং প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার হাতিয়ার হতে হবে যুক্তি, সংগঠন, আইন, শান্তিপূর্ণ সংহতি এবং জনমত।

৫. উপসংহার:
উত্তর-ঔপনিবেশিক যাত্রা কেবল বিদেশি শাসকের বিতাড়নেই শেষ হয় না; এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া ক্ষমতার সকল রূপের (অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত) থেকে মুক্তি, সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার, এবং সত্যিকার গণতান্ত্রিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ নির্মাণের। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে সহিংসতার ডাক এই মুক্তির যাত্রাকে ধ্বংস করে, ঔপনিবেশিকতার সবচেয়ে নৃশংস দিক – অর্থাৎ জীবনহানিকর সহিংসতা ও অরাজকতা – কে পুনরুজ্জীবিত করে। আসুন, আমরা ইতিহাসের গভীর শিক্ষা গ্রহণ করি। আসুন, ঔপনিবেশিক শৃঙ্খল ভাঙার সংগ্রামের নামে স্বাধীন দেশে নতুন করে সহিংসতার শৃঙ্খল তৈরি না করি। আসুন, ক্ষোভকে শাণিত করি যুক্তির অস্ত্রে, সংগঠিত করি শান্তিপূর্ণ প্রতিরোধে, এবং গড়ে তুলি একটি বাংলাদেশ, যেখানে সমালোচনা হয় মঞ্চে ও মিছিলে, রাস্তায় রক্তপাতে নয়; যেখানে জবাবদিহি নিশ্চিত হয় আদালত ও নির্বাচনে, গুলি ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে নয়।
গণতন্ত্র, সংলাপ এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথেই নিহিত আছে সত্যিকারের পরিবর্তন ও ন্যায়ের আশা। সহিংসতার পথ পরিহার করে সেই কষ্টিপথেই চলুন।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.