![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
১. ভূমিকা
"Reconciliation & Truth Commission" কেবলমাত্র একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি নয়, বরং এটি একটি নৈতিক ও ন্যায়ভিত্তিক সামাজিক যন্ত্র যা ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের সমাজকে শুদ্ধ পথে পরিচালিত করে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অ্যাপারথেইড পরবর্তী সময়ে ট্রুথ কমিশনের সফলতা এই ধারণাকে আরও জোরালো করেছে। অথচ বাংলাদেশে তেমন একটি কাঠামো কখনো গড়ে ওঠেনি। বরং এখানে অপরাধীদের 'পলিটিক্যাল স্যানিটাইজেশন' ও 'রিলিজিয়াস স্যাক্রালাইজেশন' একটি গভীর সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে ঘটেছে।
২. রাষ্ট্রযন্ত্রের অনুপস্থিতিতে বিকল্প ট্রুথ কমিশন
বাংলাদেশের সামাজিক পরিসরে যেসব প্রতিষ্ঠান ব্যাপক জনসংযোগ ও বিশ্বাসের ওপর টিকে আছে, তার মধ্যে মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের নেটওয়ার্ক অন্যতম। পাশাপাশি ওলামা-মাশায়েখদের নিয়ন্ত্রিত ইসলামিক চিন্তাবিদ্যালয়সমূহও একটি বড় নৈতিক ও আদর্শিক প্রভাব সৃষ্টি করে থাকে। রাষ্ট্র যখন ট্রুথ কমিশনের মতো কোনো কাঠামো তৈরি করতে ব্যর্থ হয়, তখন এই ধর্মীয় নেতৃবৃন্দই হয়ে উঠতে পারতেন সমাজশুদ্ধির প্রাকৃতিক বিকল্প।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই নেটওয়ার্কই ক্রমশ এক প্রতিসামাজিক ও আপসকামী কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে।
৩. হাদিয়া, দান ও ধর্মীয় মাহফিল: ঈমানি প্রলেপের কৌশল
যেসব বিত্তবান ব্যক্তি বা শ্রেণি অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত, তারা অর্থের জোরে নিজেদের বৈধ ও ‘পবিত্র’ প্রমাণ করতে চায়। এ কাজে তারা মসজিদে দান করে, মিলাদ-মাহফিল আয়োজন করে, হজের খরচ বহন করে বা ওয়াজ মাহফিলের বড় পৃষ্ঠপোষক হয়। ধর্মীয় নেতৃবৃন্দও অর্থনৈতিক সুবিধার জন্য এ প্রক্রিয়াকে প্রশ্ন না করে বরং উৎসাহিত করে থাকেন।
এভাবে ধর্মীয় অনুশাসন ও নৈতিকতার সাইনবোর্ড ব্যবহার করে এক শ্রেণির বিত্তবান সমাজে "ঈমানদার ব্যক্তি" হিসেবে স্থান করে নেয়, যদিও তাদের প্রকৃত অর্থনৈতিক কর্মকলাপ শোষণ ও দুর্নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
৪. নৈতিকতা ও ধর্মের পতন: একটি নিগূঢ় সামাজিক বন্দোবস্ত
এই পরস্পর-নির্ভরতা একটি সামাজিক চুক্তি (tacit social contract) তৈরি করেছে, যার মূল ভিত্তি হলো:
• অপরাধ করো, কিন্তু তাওবা ও দান করে সমাজে পুনর্বাসিত হয়ে যাও
• ঈমানি ছবি আঁকো, কিন্তু ভিতরে নৈতিক শূন্যতা লুকিয়ে রাখো
• মুনাফেকি করো, কিন্তু ওয়াজে ‘খোদাভীতি’র কথা বলো
এই চুক্তিতে রয়েছে দুই পক্ষ:
১. অবৈধ উপার্জনে লিপ্ত ধনী শ্রেণি
২. ধর্মীয় সম্মান ও জ্ঞানের বাহক হওয়া সত্ত্বেও নৈতিক আপোষে লিপ্ত ওলামা-মাশায়েখ গোষ্ঠী
এটি একটি অদৃশ্য কিন্তু সুসংগঠিত 'বন্দোবস্ত', যা সমাজে এক ধরণের 'ধর্মীয় চিহ্নিত বৈধতা' প্রদান করে।
৫. এর সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল
এই ধরনের ধর্ম-অর্থ-ক্ষমতার আপোষমূলক সম্পর্কই তৈরি করেছে লুটেরা রাজনীতির ভিত।
• দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদরা ধর্মীয় নেতাদের দিয়ে ফতোয়া বা দোয়া গ্রহণ করে বৈধতা লাভ করে।
• ধর্মীয় জমায়েতে রাজনীতিবিদরা উপস্থিত থেকে নিজেদের ‘বিশ্বাসী’ প্রমাণ করে।
• অন্যদিকে, ধর্মীয় নেতারাও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নীত হন উচ্চতর ধর্মীয় পদে।
ফলাফলস্বরূপ সমাজের নৈতিক স্তম্ভগুলো ভেঙে পড়ে এবং 'সত্য' ও 'ন্যায়' হয়ে যায় আপেক্ষিক ও বিক্রয়যোগ্য পণ্য।
৬. বিকল্প পথ ও সম্ভাব্য সমাধান
যদি সত্যিকার অর্থে রাষ্ট্র ট্রুথ কমিশন চালু করতো—
• ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর আর্থিক উৎস যাচাই হতো
• ধর্মীয় নেতাদের আয় ও ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষণ হতো
• সমাজে ধর্মীয় অনুশাসনকে ক্ষমতার হাতিয়ার না বানিয়ে নৈতিক জবাবদিহিতার হাতিয়ার বানানো যেত
ধর্মের আসল কাজ যেমন আত্মশুদ্ধি, ত্যাগ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা—তা তখন আবার সমাজে কার্যকর হতো।
৭. উপসংহার
বাংলাদেশের সমাজ আজ যে সংকটে পতিত, তার অন্যতম কারণ হলো ধর্মীয় ও বিত্তশালী শ্রেণির মধ্যে গঠিত এক মৌন চুক্তি, যা নৈতিকতা ও বিশ্বাসের নামে দুর্নীতিকে বৈধতা দেয়। রাষ্ট্র যখন সত্য অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়, তখন সমাজের ভেতরে থাকা বিকল্প কাঠামো—যেমন ধর্মীয় নেতৃত্ব—তার আসল দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়ে যায়। এই দ্বৈত ব্যর্থতা আমাদের সমাজকে এক গভীর নৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছে।
এই পরিস্থিতির উত্তরণে প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি স্বচ্ছ ও সাহসী ট্রুথ কমিশন, পাশাপাশি প্রয়োজন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের আত্মসমালোচনা ও দায়বদ্ধতা। সমাজের প্রতিটি স্তরে সত্য ও ন্যায়ের দাবিকে পুনরুজ্জীবিত না করলে ‘ঈমানি প্রলেপে ঢাকা’ অপবিত্র বাস্তবতা আমাদের জাতিকে ক্রমাগত দুর্নীতির গভীরে ঠেলে দেবে।
©somewhere in net ltd.