![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
________________________________________
১. বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ: ঐতিহাসিক ভিত্তি
সমগ্র বাঙ্গালাবর্ত জুড়ে বিস্তৃত বাঙ্গালা ভাষাভাষীদের সাধারণভাবে একটি সমসত্ত্ব জাতি হিসেবে ধরা হয়—যদিও কারও কারও কাছে এই ধারণা প্রশ্নসাপেক্ষ, কারণ এখানে কিছু যৌগিক জাতিসত্তাগত বৈশিষ্ট্য এখনও রয়ে গেছে। খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকে আর্য জনগোষ্ঠীর আগমন এবং দ্বাদশ শতক থেকে মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপনিবেশ স্থাপনের ধারায় এই অঞ্চলে ধারাবাহিকভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। স্থানীয় নিষাদ জনগোষ্ঠী—এবং কিছু সংখ্যক কিরাত ও দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী—ক্রমে বৌদ্ধায়ন, পৌরাণিকায়ন ও ইসলামায়ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রায় দেড় হাজার বছরে ধীরে ধীরে আত্তীকৃত হয়।
একক বাঙ্গালা ভাষাভাষী জনসমষ্টিতে সম্পূর্ণভাবে মিলিত হওয়ার প্রাক্কালে এই জনগোষ্ঠীগুলি ভাষা, ধর্ম, বংশগতি ও সংস্কৃতি—এই যৌথ জাতিসত্ত্বার অধিকারী হয়ে ওঠে। এর ফলে গঠিত হয় বাঙ্গালী জাতি। এই জাতিসত্ত্বার বাহক হিসেবে বাঙ্গালী পরিচয় জন্ম নেয়, যার মধ্যে নিহিত থাকে এক প্রচ্ছন্ন জাতীয় চেতনা—এটিই বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। দীর্ঘ সময় ধরে এই জাতীয়তাবাদ একটি সর্বজনীন রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে কাজ করেছে, যা ভাষাগত ঐক্য, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও যৌথ ইতিহাসকে একসূত্রে বেঁধেছে।
________________________________________
২. মতাদর্শগত প্রক্রিয়া হিসেবে হ্রাসবাদ
তত্ত্বগত হ্রাসবাদ হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যেখানে একটি অধিক সাধারণ তত্ত্ব একটি অপেক্ষাকৃত বিশেষ তত্ত্বকে শোষণ করে নেয়, যদি পরেরটির সমস্ত ব্যাখ্যাগত ক্ষমতা আগেরটির মধ্যে নিহিত থাকে। বিজ্ঞানে যেমন নিউটনের গতি-তত্ত্ব কেপলারের গ্রহগত আইন ও গ্যালিলিওর গতির তত্ত্বকে শোষণ করেছে—কারণ নিউটনের তত্ত্ব এগুলির সব ব্যাখ্যা দেয়, তার চেয়েও বেশি। রাজনীতিতেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, যখন একটি বৃহত্তর মতাদর্শ একটি সংকীর্ণ মতাদর্শকে শোষণ করে নেয়, ফলে পরেরটি অপ্রাসঙ্গিক বা লুপ্ত হয়ে যায়।
হ্রাসবাদ মূলত তিনভাবে কাজ করে—
1. অনুবাদ (Translation) – সংকীর্ণ মতাদর্শকে বৃহত্তর মতাদর্শের ভাষায় রূপান্তর করা।
2. উপপাদন (Derivation) – একে বৃহত্তর তত্ত্বের একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হিসেবে উপস্থাপন করা।
3. ব্যাখ্যা (Explanation) – সংকীর্ণ মতাদর্শের উৎস ও কার্যকারিতা সম্পূর্ণভাবে বৃহত্তর তত্ত্বের যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা।
এই প্রক্রিয়া সফল হলে সংকীর্ণ মতাদর্শটি নিজের স্বাতন্ত্র্য হারায়, রাজনৈতিকভাবে জনসমর্থন হারায় এবং তার ঐতিহাসিক ভূমিকা গৌণ হয়ে পড়ে।
________________________________________
৩. ইসলামপন্থীদের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে অপ্রাসঙ্গিককরণে হ্রাসবাদী প্রয়াস
বাংলাদেশে কিছু ইসলামপন্থী আন্দোলন—বিশেষ করে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ—জাতীয়তাবাদকে বৈধ রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে মানতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের মতে, জাতীয়তাবাদ একটি কুফরি মতাদর্শ, কারণ এটি মানুষ-নির্ধারিত ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক সীমারেখার উপর ভিত্তি করে, যা আল-কোরআনে ঘোষিত উম্মাহ–এর ঐক্যের বিপরীত। তারা যুক্তি দেয় যে, কোরআনের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ইসলামই হলো সর্বজনীন রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা শাসনব্যবস্থা, আইন ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
এই মতাদর্শিক কাঠামোর মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে একটি পরিকল্পিত হ্রাসবাদের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্রায়িত ও লুপ্ত করার চেষ্টা করা হয়—
________________________________________
৩.১ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে ধর্মীয় সার্বজনীনতায় অনুবাদ
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের ওপর জোরকে “ইসলামি” পরিভাষায় রূপান্তর করা হয়—যেন এটি কেবল বৈশ্বিক মুসলিম পরিচয়ের একটি আঞ্চলিক রূপ। বাঙ্গালী জাতির অনন্য ঐতিহাসিক গঠনপ্রক্রিয়া (আর্য, নিষাদ, কিরাত, দ্রাবিড়ের সমন্বয়) ইসলামের দক্ষিণ এশিয়ায় বিস্তারের বৃহত্তর ইতিহাসের তুলনায় তুচ্ছ বিষয় হিসেবে উপস্থাপিত হয়।
________________________________________
৩.২ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে উম্মাহ–এর একটি উপসেট হিসেবে উপপাদন
জাতীয় পরিচয়কে আরও “আসল” ইসলামি পরিচয়ের অধীনস্ত হিসেবে দেখানো হয়। বাঙ্গালী মুসলমানদের বোঝানো হয় যে তাদের প্রধান আনুগত্য বাঙ্গালী জাতির প্রতি নয়, বরং উম্মাহ–এর প্রতি; ফলে জাতীয়তাবাদকে একটি সীমিত ও পার্থিব গঠন হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়, যা একটি বৈশ্বিক ঈমানি সম্প্রদায়ের তুলনায় গৌণ।
________________________________________
৩.৩ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে শরিয়া-ভিত্তিক শাসনের মাধ্যমে ব্যাখ্যা
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ঐতিহাসিকভাবে যে সামাজিক সংহতি প্রদান করেছে, ইসলামপন্থীরা তা শরিয়ার যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করে—ঐক্য ও ন্যায়বিচার অর্জিত হবে ইসলামি আইন দ্বারা, জাতীয়তাবাদের ভাষাগত–ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তি দিয়ে নয়। এই প্রেক্ষাপটে জাতীয়তাবাদ অপ্রয়োজনীয়, কারণ ইসলাম ইতোমধ্যেই শাসন, পরিচয় ও নৈতিকতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল নীতি ধারণ করে।
________________________________________
৪. ইসলামপন্থীদের হ্রাসবাদী প্রয়াসে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের পরিণতি
এই প্রক্রিয়ার ফলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যে ভাবে লুপ্ত প্রায় হচ্ছে—
• স্বাতন্ত্র্য – এটি আর স্বাধীন রাজনৈতিক চালিকাশক্তি হিসেবে দেখা হয় না, বরং একটি বৃহত্তর ধর্মীয় মিশনের সাংস্কৃতিক রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়।
• জনসমর্থন আহরণের ক্ষমতা – জনগণের আনুগত্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক আন্দোলনের দিকে সরে যায়, ফলে জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়।
• ঐতিহাসিক কেন্দ্রীয়তা – ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সমন্বয়ের দীর্ঘ প্রক্রিয়াকে ইসলামি ইতিহাসের গৌণ অংশ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
এভাবে জাতীয়তাবাদকে সর্বোচ্চ সহনীয় সাংস্কৃতিক পরিচয় বা সর্বনিম্নে এক বিপজ্জনক ধর্মনিরপেক্ষ বিচ্যুতি হিসেবে চিত্রিত করা হয়। সময়ের সাথে সাথে বৃহত্তর ইসলামি রাজনৈতিক কাঠামো জাতীয়তাবাদের কার্যকারিতা—ঐক্য, বৈধতা, জনমোতাবেক আহরণ—শোষণ করে নেয় এবং তার ধর্মনিরপেক্ষ ও ভৌগোলিক ভিত্তিকে অবমূল্যায়ন করে।
________________________________________
৫. উপসংহার
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ভাষাগত–সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক একীকরণের ফল হিসেবে গড়ে উঠেছে এবং একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ হিসেবে বাঙ্গালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। কিন্তু ইসলামপন্থী আন্দোলনসমূহ জাতীয়তাবাদকে কুফরি আখ্যা দিয়ে একে একটি হ্রাসবাদের প্রক্রিয়ায় সঁপে দিয়েছে, যেখানে এই ধর্মনিরপেক্ষ–ভাষাভিত্তিক মতাদর্শকে শোষণ, পুনঃব্যাখ্যা ও একটি সর্বজনীন ধর্মীয়–রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনস্ত করে ফেলা হয়। অনুবাদ–এর মাধ্যমে একে ইসলামি পরিভাষায় রূপান্তর, উপপাদন–এর মাধ্যমে একে উম্মাহ–এর উপসেট হিসেবে উপস্থাপন এবং ব্যাখ্যা–এর মাধ্যমে শরিয়া-ভিত্তিক যুক্তিতে তার ভূমিকা নির্ধারণ—এই তিন ধাপের মাধ্যমে ইসলামপন্থীরা কার্যত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে রাজনৈতিকভাবে লুপ্ত করে তুলেছে, যা এখন কেবল একটি ক্ষুদ্রায়িত সাংস্কৃতিক অনুভূতি হিসেবে টিকে আছে, কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে নয়।
©somewhere in net ltd.