নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণে মানুষের জৈবিক সত্তা ও মানবিক প্রবৃত্তির ভূমিকা

১০ ই আগস্ট, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৫৪





১. ভূমিকা:
মানুষ একইসঙ্গে জৈবিক প্রাণী ও সাংস্কৃতিক সত্তা। তার ভেতর নিহিত মৌলিক প্রবৃত্তি বা 'রিপু' (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, অহংকার, মাৎসর্য্য) শুধু ব্যক্তিগত আচরণই নয়, সামষ্টিক রাজনৈতিক ব্যবস্থারও নির্মাতা। এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্লেষণ করব কীভাবে মানুষের এই অন্তর্নিহিত শক্তিসমূহ সমাজের গতিশীলতা সৃষ্টি করে, রাজনৈতিক কাঠামো রূপ দেয়, এবং কীভাবে তা সমাজে প্রতিভাত নানা প্রপঞ্চের নির্ণায়ক হয়ে ওঠে।

২. তাত্ত্বিক কাঠামো: রিপু, সমাজ ও রাজনীতি
২.১ জৈবিক সত্তা বনাম নৈতিক সত্তার দ্বন্দ্ব:
টমাস হবসের মতে, 'প্রকৃতির অবস্থায়' মানুষের জীবন ছিল "নিঃসঙ্গ, দরিদ্র, পাশবিক ও ক্ষণস্থায়ী"—যেখানে রিপুসমূহের অবাধ বিচরণ ছিল।
ইসলামী দর্শনে 'নফস' (নিম্নমনা সত্তা) এই রিপুগুলোর আধার, যা নিয়ন্ত্রণ করতে 'জিহাদুল আকরাম' (আত্মার বিরুদ্ধে জিহাদ) আবশ্যক।
ফ্রয়েডীয় মনোবিশ্লেষণেও 'ইড' (অবচেতন কামনা)-এর শক্তি সামাজিক নিয়ম ('সুপারইগো';) দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।
২.২ রাজনৈতিক বন্দোবস্ত: রিপুর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ:
ম্যাকিয়াভেলীয় দৃষ্টিভঙ্গি: ক্ষমতার লালসা (লোভ ও অহংকার) রাজনীতির চালিকাশক্তি।
ইবনে খালদুনের 'আসাবিয়্যাহ': গোত্রীয় সংহতি বা জাতীয়তাবাদ অহংকার ও মাৎসর্য্যেরই প্রাতিষ্ঠানিক প্রকাশ।
আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্ব: ম্যাক্স ওয়েবারের 'ক্ষমতার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ' লোভ ও মোহেরই রাষ্ট্রীয় রূপ।

৩. রিপুভিত্তিক রাজনৈতিক গতিশীলতার বিশ্লেষণ
সারণী দ্রষ্টব্য

৪. রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণে গতিশীলতা
৪.১ সমাজচুক্তি থেকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ:
রুশোর মতে, মানুষ রিপুর হাত থেকে রক্ষা পেতে 'সামাজিক চুক্তি' করে রাষ্ট্র গঠন করে।
ইসলামী রাষ্ট্রদর্শনে 'হিসবা' (নৈতিক পুলিশিং) ও 'হুদুদ' আইন রিপু দমনের প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতি।
৪.২ ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও রিপু নিয়ন্ত্রণ:
মন্টেস্কুর 'ক্ষমতা বিভাজন' তত্ত্ব রিপুর রাজনৈতিক অপব্যবহার রোধের কৌশল।
ইসলামে 'শুরা' (পরামর্শভিত্তিক শাসন) ও 'আমর বিল মারুফ' (ন্যায়ের আদেশ) অহংকার ও লোভের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা।
৪.৩ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও লোভের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ:
মার্ক্সের মতে, পুঁজিবাদ লোভকে 'মুনাফার আদর্শে' পরিণত করে।
ইসলামী অর্থনীতিতে 'জাকাত', 'রিবা নিষিদ্ধকরণ' ও 'মিরাস' আইনের মাধ্যমে সম্পদ বণ্টনে লোভের লাগাম টেনে ধরা হয়।

৫. রিপু থেকে মুক্তির পথ: আধ্যাত্মিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান
৫.১ ব্যক্তিগত স্তরে: আত্মশুদ্ধি (তাজকিয়ায়ে নফস)
ইসলামে মুমিনের লক্ষ্য হলো 'নফসে মুতমাইন্না' (শান্ত আত্মা) অর্জন—যেখানে রিপু রূপান্তরিত হয় সৃজনশীল শক্তিতে।
গান্ধীর 'আত্মসংযম' ও বুদ্ধের 'মধ্যবর্তী পথ' একই দর্শনের প্রতিধ্বনি।
৫.২ প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে: ভারসাম্যমূলক ব্যবস্থা
জবাবদিহিতা: স্বাধীন বিচারব্যবস্থা, সক্রিয় নাগরিক সমাজ ও মিডিয়া দ্বারা অহংকার ও লোভ নিয়ন্ত্রণ।
সহিষ্ণুতা শিক্ষা: ক্রোধ ও মাৎসর্য্য কাটাতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার একীকরণ।
ন্যায়ভিত্তিক বণ্টন: সম্পদ বণ্টনে ন্যায় (আদল) প্রতিষ্ঠা করে লোভের রাজনীতির মূলে আঘাত।
আধ্যাত্মিক নেতৃত্ব: ওলি-আউলিয়াদের আদর্শ রাজনৈতিক নেতাদের জন্য মডেল—যেখানে ক্ষমতা নয়, সেবাই মুখ্য।

৬. উপসংহার:
রাজনীতি কখনো 'রিপুমুক্ত' নয়—এটি মানুষের জৈবিক সত্তারই প্রাতিষ্ঠানিক অভিব্যক্তি। তবে এই রিপুসমূহ ধ্বংসেরও রূপক হতে পারে, আবার সভ্যতার চালিকাশক্তিও। চাবিকাঠি হলো ভারসাম্য:
ব্যক্তি-স্তরে আত্মশুদ্ধি (তাসাওফ/ধ্যান) দ্বারা রিপুর শৃঙ্খলায়ন,
রাষ্ট্র-স্তরে জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ।
যে সমাজ এই দ্বিমাত্রিক কৌশল গ্রহণ করে—সেখানে রিপু 'অপরাধ' নয়, বরং 'শক্তির উৎস' হয়ে ওঠে। ভারতীয় সংবিধানের 'ধর্মনিরপেক্ষতা', 'সমাজতন্ত্র' ও 'নৈতিকতা'—এই ত্রয়ী আদর্শই এর বাস্তব রূপ; যেখানে মানুষের অন্ধকার প্রবৃত্তিকে আলোর পথে ফেরানোর প্রাতিষ্ঠানিক ও আধ্যাত্মিক প্রয়াস একসঙ্গে সন্নিবিষ্ট।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.