নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

মুমিন-জিন্দিকের দ্বৈত চরিত্র সম্পন্ন নেতাকর্মীদের ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব

১১ ই আগস্ট, ২০২৫ দুপুর ১:২২


১. ভূমিকা
মানুষ এক বিচিত্র প্রাণী। এই প্রাণী বিভিন্ন প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হয়ে পরিচালিত হয়। এই প্রবৃত্তিগুলোর কারণেই সমাজ এবং সমাজের সংস্কৃতি নির্মিত হয়। মানুষের সত্তায় নিহিত এই প্রবৃত্তিগুলো শাশ্বত ও অসীম। মানুষের বিশ্বাস হলো রূপান্তরশীল, যা জন্মপ্রাপ্ত দেশ ও সমাজে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় লাভ করে থাকে। বিশ্বাসগুলো হলো মানুষের জাগতিক ও পারলৌকিক বিশ্বাস। বিশ্বাসগুলো দর্শনও বটে। মানুষের বিশ্বাস নির্মাণে ধর্মের ভূমিকা ব্যাপক। সামাজিকীকরণের প্রক্রিয়ায় এই বিশ্বাসের রূপান্তর ঘটে। মানুষের সত্তায় নিহিত প্রবৃত্তিগুলো এই ধর্মীয় বা অধর্মীয় বা বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের পটভূমিতে নির্মিত বিশ্বাস দ্বারা তাড়িত হয়ে পরিচালিত হয়। এই বিশ্বাস দ্বারা মানুষের রাজনৈতিক আচরণ দিগনির্দেশিত হয়। তার মধ্যে ধর্মবিশ্বাসও এক প্রকার বিশ্বাস, যার দ্বারা মানুষের রাজনৈতিক চিন্তা ও কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ইসলাম ধর্ম দ্বারা নির্মিত বিশ্বাস দ্বারা দিগনির্দেশিত ব্যক্তি বা দলেরও রাজনৈতিক চেতনা ও কর্মকাণ্ড দিগনির্দেশিত হয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে নিহিত প্রবৃত্তি দ্বারা তাড়িত হওয়ার কারণে যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা ও কর্মকাণ্ড প্রতিভাত হয়, তাও সেই ইসলামী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে যুগপৎভাবে বা মিশ্রিতভাবে সমাজে দৃশ্যমান হয়। প্রবৃত্তিভিত্তিক রাজনৈতিক গতিশীলতার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, লোভ থেকে অর্থনৈতিক শোষণ ও দুর্নীতি, ভয়ংকার থেকে জাতীয়তাবাদ ও একনায়কত্ব, মাৎসর্য্য থেকে শেণীসংগ্রাম ও গোত্রীয়দ্বন্দ্ব, ক্রোধ থেকে যুদ্ধ ও সহিংস আক্রমণ, কাম থেকে যৌন রাজনীতি ও নারীর শরীরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা, এবং মোহ থেকে আদর্শান্ধতা ও চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ প্রকাশ পায়। সে জন্য রাজনৈতিক মানুষ বা দলে বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডে নড়বড়ে অবস্থা দৃশ্যমান হয়। এই বিশ্বাসের নড়বড়ে অবস্থার কারণে একজন মানুষ বা একটি রাজনৈতিক গ্রুপ মুমিন বা মুনাফিক হতে পারে। এই বিশ্বাস ও প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে একটি বিশেষ ধরনের দ্বৈত চরিত্রের জন্ম হয়, যা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভয়ানক মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব ফেলে। এই দ্বৈত চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ ঘটে বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার মাধ্যমে: গুণ্ডামি/মানসিক পর্যায়ে ভিন্নমতকে 'বিদ্আতি', কাফিরবাদী বা ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা; প্রকাশ্য/যৌথিক পর্যায়ে গালিগালাজ, অপমান, হুমকি ও প্রতারণামূলক বক্তৃতা; প্রকাশ্য/শারীরিক পর্যায়ে মারধর, ভাঙচুর, ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানিক সম্পদের ক্ষতিসাধন; এবং সংগঠিত/রাজনৈতিক পর্যায়ে রাজনৈতিক সহিংসতা, ভিন্নমত দমন ও আদর্শিক বিরোধিতা।

২. মানুষের প্রবৃত্তি ও তার প্রকৃতি
২.১. প্রবৃত্তির সংজ্ঞা ও প্রকৃতি
মানুষের প্রবৃত্তি (Human Instincts/Nafs) হল সেই সহজাত শক্তি যা তার চিন্তা, আবেগ ও কর্মকে প্রেরণা যোগায়। এটি মানব সত্তার গভীরে প্রোথিত জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক চালিকাশক্তি। ইসলামী দর্শন, মনোবিজ্ঞান ও দার্শনিক ঐতিহ্যে এর বিস্তৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
২.২. দ্বৈত সত্তার সংঘাত
প্রবৃত্তি তিনটি স্তরে বিভক্ত: জৈবিক প্রবৃত্তি (নফসে আম্মারা): কুরআনে বর্ণিত "নফসে আম্মারা" (يُؤْمَرُ بِالسُّؤْ) - যা মন্দের প্রতি প্ররোচিত করে (সূরা ইউসুফ ১২:৫৩)। এর অন্তর্গত: ক্ষুধা, যৌনাকাঙ্ক্ষা, আত্মরক্ষার তাড়না, আধিপত্যবোধ। নৈতিক সত্তা (নফসে লাওয়ামা): "অনুতাপকারী আত্মা" (সূরা আল-কিয়ামাহ ৭৫:২) – যা পাপে অনুতপ্ত হয় ও ন্যায়ের সন্ধান করে। পরিশুদ্ধ সত্তা (নফসে মুতমাইন্নাহ): "শান্ত আত্মা" (সূরা আল-ফজর ৮৯:২৭) – যা আল্লাহর সাথে সম্প্রীতি স্থাপন করে।
২.৩. প্রধান প্রবৃত্তিসমূহ ও তাদের প্রভাব
মানুষের মধ্যে বিদ্যমান প্রধান প্রবৃত্তিগুলো এবং তাদের রাজনৈতিক প্রভাব নিম্নরূপ: কাম (শাহওয়া) যা ফ্রয়েডীয় লিবিডোর সমতুল্য এবং ইতিবাচকভাবে প্রেম ও সৃজনশীলতায় রূপান্তরিত হতে পারে; ক্রোধ (গাদাব) যা এডলারীয় অ্যাগ্রেশনের সমতুল্য এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার শক্তিতে পরিণত হতে পারে; লোভ (হির্স) যা আধুনিক মনোবিজ্ঞানের গ্রিডের সমতুল্য এবং উদারতা ও সম্পদ বণ্টনে রূপান্তরিত হতে পারে; অহংকার (কিব্র) যা নার্সিসিজমের সমতুল্য এবং আত্মমর্যাদাবোধে পরিণত হতে পারে; এবং মাৎসর্য্য (হাসদ) যা সামাজিক মনোবিজ্ঞানের এনভির সমতুল্য এবং প্রতিযোগিতামূলক প্রেরণায় রূপান্তরিত হতে পারে।
২.৪. প্রবৃত্তির সামাজিক অভিব্যক্তি
প্রবৃত্তির ইতিবাচক দিকসমূহ: কাম থেকে পরিবার গঠন, লোভ থেকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, ক্রোধ থেকে সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। নেতিবাচক দিকসমূহ: মাৎসর্য্য থেকে সমাজে বিভেদ, অহংকার থেকে শ্রেণীসংঘাত, লোভ থেকে অর্থনৈতিক বৈষম্য।
২.৫. প্রবৃত্তিভিত্তিক রাজনৈতিক গতিশীলতার বিস্তারিত বিশ্লেষণ
প্রবৃত্তিগুলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়: লোভের রাজনৈতিক প্রকাশ: অর্থনৈতিক শোষণ, দুর্নীতি, সম্পদ কুক্ষিগতকরণ; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ও কর্পোরেট লবিইজম; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে কালানিয়ান শোষণ ও ট্যাক্স হ্যাভেন। ভয়ংকারের রাজনৈতিক প্রকাশ: জাতীয়তাবাদ, ফ্যাসিবাদ, একনায়কত্ব; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে ধ্বংসাত্মক শাসন ও সামরিক শাসন; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে হিটলারের নাৎসিবাদ ও উপনিবেশিকতা। মাৎসর্য্যের রাজনৈতিক প্রকাশ: শেণীসংগ্রাম, গোত্রীয়দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক খুনখারাবি; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে বিপ্লব, গৃহযুদ্ধ, বিভাজনমূলক রাজনীতি; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে ফরাসি বিপ্লব ও রুয়ান্ডা গণহত্যা। ক্রোধের রাজনৈতিক প্রকাশ: যুদ্ধ, সহিংস আক্রমণ, জাতিগত দাঙ্গা; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে সেনাতন্ত্র, পুলিশি রাষ্ট্র, জাতীয় নিরাপত্তা আইন; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে সিরীয় গৃহযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা। কামের রাজনৈতিক প্রকাশ: যৌন রাজনীতি, নারীর শরীরকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করা; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নৈতিক পুলিশিং; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে #MeToo আন্দোলনের প্রতিবাদ। মোহের রাজনৈতিক প্রকাশ: আদর্শান্ধতা, চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ; প্রত্যাশিত ব্যবহার হিসেবে একদলীয় শাসন ও সম্প্রদায়বাদ; বাস্তব উদাহরণ হিসেবে উগ্র কোরিয়ান জুচে আদর্শ।


৩. বিশ্বাস ও ঈমানের শ্রেণিবিভাগ
৩.১. বিশ্বাসের রূপান্তরশীলতা
মানুষের বিশ্বাস জন্মপ্রাপ্ত দেশ ও সমাজে সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়। এই বিশ্বাসগুলো জাগতিক ও পারলৌকিক উভয় ক্ষেত্রেই মানুষের চিন্তাধারা নির্মাণ করে। ধর্মের ভূমিকা এক্ষেত্রে ব্যাপক। মানুষের সত্তায় নিহিত প্রবৃত্তিগুলো এই ধর্মীয় বা অধর্মীয় বা বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসের পটভূমিতে পরিচালিত হয়।
৩.২. ঈমানের দৃঢ়তা ও সম্পূর্ণতার ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
মুমিন (مؤمن): যিনি অন্তরে ও মুখে ঈমান স্বীকার করেন এবং কর্মে তা বাস্তবায়ন করেন। আল-কুরআনের বর্ণনা: "যাদের অন্তরে ও মুখে ঈমান এক, এবং তারা সৎকর্মে ব্যস্ত" (সূরা আল-হুজুরাত ৪৯:১৫)। মুসলিম (مسلم): যিনি মুখে কালেমা পাঠ করে ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং ইসলামের মূল বিধানগুলো মানেন, কিন্তু ঈমানের দৃঢ়তা মুমিনের পর্যায়ে নয়। সব মুমিন মুসলিম, কিন্তু সব মুসলিম মুমিন নন।
৩.৩. ঈমানের দুর্বলতা বা ভণ্ডামির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
মুনাফিক (منافق): বাইরে ইসলামি পরিচয় দেখালেও অন্তরে ঈমান নেই। কুরআন: "যখন তারা মুসলমানদের সঙ্গে মেলে, বলে 'আমরা ঈমান এনেছি'; আর যখন নিজেদের শয়তানদের সঙ্গে একা হয়, বলে 'আমরা তোমাদের সঙ্গে আছি'।" (সূরা আল-বাকারা ২:১৪)। ফাসিক (فاسق): ঈমান আছে, কিন্তু প্রকাশ্যে ও নিয়মিত বড় পাপ করে, আল্লাহর বিধান অমান্য করে। যেমন - মদ্যপান, সুদখোরি, অন্যায় হত্যা।
৩.৪. ইসলাম থেকে বিচ্যুতির ভিত্তিতে শ্রেণিবিভাগ
কাফির (كافر): যিনি স্পষ্টভাবে ইসলাম অস্বীকার করেন বা ইসলাম গ্রহণের পর তা ত্যাগ করেন (মুরতাদ)। মুশরিক (مشرك): যিনি আল্লাহর সাথে শরিক স্থাপন করেন। মুরতাদ (مرتد): ইসলাম গ্রহণের পর প্রকাশ্যে তা ত্যাগ করা।

৪. প্রবৃত্তি তাড়িত অপরাধ ও তার শ্রেণিবিভাগ
৪.১. অপরাধের প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগ
প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষ বিভিন্ন সময় নানান অপরাধে লিপ্ত হয়। ফৌজদারি অপরাধ: গুরুতর অপরাধ হিসেবে হত্যা, ধর্ষণ, সন্ত্রাসবাদ, রাষ্ট্রদ্রোহ; সাধারণ অপরাধ হিসেবে চুরি, প্রতারণা, মারধর, নকল নথি তৈরি। দেওয়ানি অপরাধ: চুক্তিভঙ্গ, মানহানি, সম্পত্তি বিরোধ, দেনাদারীর মামলা।
৪.২. সহিংসতার ধরন ও কুরআনের আদেশের সাথে দ্বৈততা
এই কথিত আদর্শের বাস্তবায়নের নামে এবং বাস্তবতার অহিংকরণের ফলে, এই চিন্তাবিদ দলগুলো ও তাদের অনুসারীরা একটি বিশৃঙ্খল দমনমূলক সমস্যা তৈরি করে, যার মধ্যে বিভিন্ন স্তরের সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা প্রকাশ পায়। গুণ্ডামি/মানসিক স্তর: নরম ধরনের সহিংসতা যেখানে ভিন্নমতকে 'বিদ্আতি', কাফিরবাদী বা ইসলামবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, ভিন্নমতের প্রতি গভীর অহং ও ভিন্নমতকে মানসিকভাবে চূর্ণ করার চেষ্টা করা হয়; এটি কুরআনের হিকমতের আহ্বান, সংশোধন অনুসরণ (সূরা যুমার ৩৯:১৮) ও অন্যের ধারণা থেকে বিরত থাকার নির্দেশনার (সূরা আনআম ০:৬৮) সাথে সাংঘর্ষিক। প্রকাশ্য/যৌথিক স্তর: মধ্যম ধরনের সহিংসতা যেখানে গালিগালাজ, অপমান, হুমকি, ফতোয়া প্রদান, ভিন্নমতের বিরুদ্ধে সামাজিক বক্তৃতা ও সামাজিক বিচ্ছেদকরণ ঘটে; এটি কুরআনের উত্তম কথার নির্দেশ (সূরা বনি ইসরাইল ১৭:৫৩), নম্রতার শিক্ষা (সূরা আলে ইমরান ৩:১৫৯) ও গালিগালাজ নিষেধের (সূরা হুজুরাত ৪৯:১১) সাথে বিরোধী। প্রকাশ্য/শারীরিক স্তর: কঠোর ধরনের সহিংসতা যেখানে মারধর, ভাঙচুর, ব্যক্তিগত ও প্রতিষ্ঠানিক সম্পদের ক্ষতিসাধন ও ভিন্নমতাবলম্বীকে শারীরিক আক্রমণ করা হয়; এটি কুরআনের আহিংসা ও শান্তির আদেশ (সূরা বাকারা ২:২০৮), অন্যায়ভাবে প্রাণ নিষেধন (সূরা আনআম ৬:১৫১) ও সীমালঙ্ঘন নিষেধের (সূরা বাকারা ২:১৯০) বিরোধী। সংগঠিত/রাজনৈতিক স্তর: কঠোরতম রাষ্ট্রীয় ধরনের সহিংসতা যেখানে রাজনৈতিক সহিংসতা, ভিন্নমত দমন, আদর্শিক বিরোধীদের প্রভূত্ব হরণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং সহিংসতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল ঘটে; এটি কুরআনের সতর্কতার সাথে বিতর্কের নির্দেশনা (সূরা আনকাবুত ২৯:৪৬), ন্যায়বিচার (আদল) প্রতিষ্ঠার আদেশ (সূরা নিসা ৪:১৩৫) ও ধর্মে জোরজবরদস্তি নিষেধের (সূরা বাকারা ২:২৫৬) সাথে সাংঘর্ষিক।
৪.৩. উদ্দেশ্য ও প্রভাব অনুযায়ী অপরাধের শ্রেণিবিভাগ
ব্যক্তি-বিরোধী অপরাধ: শারীরিক ক্ষতি হিসেবে হত্যা, গুরুতর আঘাত, গার্হস্থ্য সহিংসতা; মানসিক ক্ষতি হিসেবে হুমকি, অপমান, মানহানি। সম্পত্তি-বিরোধী অপরাধ: চুরি, ডাকাতি, দখল, জাল নথি, অগ্নিসংযোগ। রাষ্ট্র-বিরোধী অপরাধ: রাষ্ট্রদ্রোহ, গুপ্তচরবৃত্তি, কর ফাঁকি, দুর্নীতি। সমাজবিরোধী অপরাধ: সন্ত্রাসবাদ, মাদক পাচার, মানবপাচার।

৫. তওবার বিকৃত ব্যাখ্যা ও তার পরিণতি
৫.১. অপরাধবোধ ও নৈতিক পীড়ন
প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে অন্যায় বা অপরাধ করার পর মানুষের মধ্যে অপরাধবোধ ও পাপবোধ জন্মায়। এই নৈতিক পীড়ন থেকে মুক্তির জন্য মানুষ তওবা করে থাকে।
৫.২. ইবনে তাইমিয়্যার তওবা সম্পর্কিত ফতোয়া
ওয়াহাবীবাদে তওবার গুরুত্ব অত্যাধিক। ইসলাম ধর্মের এককালীন মুজতাহিদ ইবনে তাইমিয়্যা তওবার বিষয়টিকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, তওবার মূল ধারণা বিকৃত হয়ে গেছে। তাঁর মতে: "গুনাহ সংঘটিত হওয়ার পর বান্দা তওবা করলে, সেটা অসম্পূর্ণ হলেও তার গুনাহ মোচন করে দেয়। তওবা আসলে বিষের প্রতিষেধকের মতো; বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেলেও বিষের প্রভাবকে রোধ করে দিতে পারে। তওবা হলো খাবার-পানীয় গ্রহণ করার মতো; যা ক্ষুধার্তের একমাত্র সমাধান। তওবাকে হালাল উপভোগ্য বস্তুর সঙ্গে তুলনা করা যায়, যা মনকে হারাম বস্তুর চাহিদা থেকে বিরত রাখে।" তিনি আরও বলেন: "অন্তরের প্রশস্ততার বৃদ্ধি হচ্ছে না, ঈমানের মিষ্টতা অনুভূত হচ্ছে না, হিদায়াতের নূর বাড়ছে না, যে ব্যক্তি নিজের মাঝে এগুলো দেখতে পায় সে যেন তওবা-ইস্তিগফার বাড়িয়ে দেয়।"
৫.৩. তওবার বিকৃত ব্যবহার
ইসলাম ধর্মকে অপব্যাখ্যা দিয়ে যারা মুসলমান ও জিন্দিকের দ্বৈত চরিত্র ধারণ করে বা যাদের ইসলামী বিশ্বাস নড়বড়ে ও প্রবৃত্তি তাড়িত আচরণে অভ্যস্ত, তারা এই ফতোয়াকে ইসলামী মহাষৌধ হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। তারা এক দিকে নানান পাপকাজ, অনিয়ম ও অপরাধে লিপ্ত থাকে, অন্যদিকে ইবাদত ও আমল করে থাকে।

৬. ইসলামী রাজনৈতিক দলে দ্বৈত চরিত্রের প্রকাশ
৬.১. মুমিন-জিন্দিকের দ্বৈত সত্তা
এই ধরনের দ্বৈত মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা ইসলামী রাজনৈতিক দলে অনেক বেশি। যারা একই ইসলামী রাজনৈতিক দলে থেকে ইসলাম ধর্মীয় রাজনৈতিক আদর্শ মহিমান্বিত করার প্রয়াসী হয়, তেমনিভাবে তারা আল-কুরআন ও হাদীসে নিষেধাজ্ঞা আছে বা হারাম হিসেবে বলা হয়েছে এমন সমস্ত কর্মকাণ্ড করে থাকে।
৬.২. হিংসাত্মক রাজনৈতিক আচরণ
এই ধরনের দ্বৈত চরিত্রের অধিকারীরা বিভিন্ন হিংসাত্মক ও অনৈতিক রাজনৈতিক আচরণে লিপ্ত হয়, যা ইসলামের মূল শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক।
৬.৩. ইসলামী নিষেধাজ্ঞা বনাম বাস্তব আচরণ
স্পষ্ট যে, ইসলামের নামে যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়, তার অনেকটাই ইসলাম ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে নিষিদ্ধ।

৭. ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ
৭.১. প্রবৃত্তি ও রাজনীতির মিশ্রণ
প্রবৃত্তি তাড়িত মানুষের মধ্যে যারা নানান অন্যায়, অনিয়ম, পাপ ও অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত থাকে, তা স্বাভাবিক। ইসলাম ধর্মীয় রাজনৈতিক দলভুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও এই প্রবণতা স্বাভাবিকভাবেই রয়েছে।
৭.২. তওবার ভুল ব্যাখ্যার পরিণতি
কিন্তু ঈমান, ইবাদত ও আমলসর্বস্ব ইসলাম ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের মধ্যে যারা মনে করে যে তওবার মাধ্যমে পাপ বা অপরাধ সম্পূর্ণভাবে খণ্ডন হয়, তারা ইসলামী রাজনৈতিক দলের কর্মী-নেতা হিসেবে অত্যন্ত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে।
৭.৩. রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিফলন
এই মানসিকতার প্রতিফলন বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিলক্ষিত হয়। এরা একদিকে ধর্মীয় আবেগকে কাজে লাগিয়ে জনগণের সমর্থন আদায় করে, অন্যদিকে ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বার্থে অনৈতিক কার্যকলাপে লিপ্ত হয়।

৮. উপসংহার
মুমিন-জিন্দিকের দ্বৈত চরিত্র সম্পন্ন নেতাকর্মীদের এই ভয়ঙ্কর রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব আমাদের সমাজের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তওবার ভুল ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। প্রকৃত ইসলামী আদর্শ ও রাজনৈতিক বাস্তবতার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য প্রয়োজন গভীর আত্মদর্শন এবং নৈতিক পুনর্জাগরণ। এই দ্বৈত চরিত্রের মূল কারণ হলো প্রবৃত্তি ও বিশ্বাসের মধ্যে সঠিক ভারসাম্য না থাকা। যতদিন না এই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন এই ধরনের বিপজ্জনক রাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব আমাদের সমাজে বিদ্যমান থাকবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.