নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

শয়তানের অস্তিত্ব বনাম তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়সমূহের রাজনৈতিক দর্শন: একটি বৈপরীত্য

১২ ই আগস্ট, ২০২৫ সকাল ১০:৪২

ভূমিকা
ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তায় শয়তানের (ইবলিস) ভূমিকা একটি গভীর কিন্তু প্রায়শই উপেক্ষিত বিষয়। কুরআন ও হাদিসে শয়তানের অস্তিত্ব, তার প্ররোচনা (ওয়াসওয়াসা) এবং মানুষের মন-রাজনীতি-সমাজে তার প্রভাব স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী গোষ্ঠীগুলো—চাই তারা ওলামা-মাশায়েখ হোন বা তৌহিদী জনতার নেতা—প্রায়ই "ক্ষমতার লড়াইয়ে শয়তানের কার্যকারিতা"কে অস্বীকার করে একটি আদর্শবাদী কিন্তু অবাস্তব রাষ্ট্রদর্শন নির্মাণ করেন। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব, কীভাবে শয়তানের প্রভাবকে উপেক্ষা করায় ইসলামী রাজনীতির চিন্তায় একটি মৌলিক বৈপরীত্য তৈরি হয়, এবং এর সমাধান কী হতে পারে।
১. শয়তানের অস্তিত্ব: কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক উপেক্ষা
(ক) শয়তানের প্ররোচনা: একটি স্বীকৃত সত্য
কুরআন ও হাদিসে শয়তানকে মানুষের প্রকাশ্য শত্রু (আদুওয়ুম মুবীন) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে (সূরা ইয়াসিন, ৩৬:৬০)। তার কাজ হলো:
ওয়াসওয়াসা দেওয়া (সূরা নাস, ১১৪:৪-৬)।
মানুষকে বিভ্রান্ত করে ক্ষমতা, লোভ ও অহংকারে লিপ্ত করা (সূরা সাদ, ৩৮:৮২-৮৩)।
সৎ কাজে বাধা দেওয়া (সূরা বাকারা, ২:১৬৮)।
(খ) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শয়তানের উপস্থিতি
ইসলামী রাজনীতিতে শয়তানের প্রভাব দুইভাবে কাজ করে:
ব্যক্তিগত স্তরে: নেতা-কর্মীদের অহংকার, ক্ষমতার লোভ ও স্বার্থপরতা তৈরি করা।
সামষ্টিক স্তরে: সমগ্র তৌহিদী জনতাকে বিভ্রান্তিকর আদর্শে আটকে রাখা (যেমন: "আমাদের নেতৃত্ব শয়তানের প্রভাবমুক্ত")।
সমস্যা: ইসলামী রাজনীতিবিদরা শয়তানের অস্তিত্ব তো মানেন, কিন্তু রাজনৈতিক দর্শন নির্মাণের সময় এই শক্তিকে গণনায় নেন না। ফলে তাদের রাষ্ট্রচিন্তা হয়ে ওঠে ফানুস সর্বস্ব—সুন্দর কিন্তু বাস্তবতাবর্জিত।

২. তৌহিদী চিন্তাবিদ্যালয়ের রাজনৈতিক দর্শনে বৈপরীত্য
(ক) আদর্শবাদ বনাম বাস্তবতা
তৌহিদী চিন্তাবিদেরা প্রায়ই এই ভুল করেন:
তারা মনে করেন, ইসলামী নেতৃত্ব শয়তানের প্রভাব থেকে মুক্ত।
তারা ক্ষমতার রাজনীতিকে পবিত্র হিসেবে দেখেন, অথচ কুরআনে বলা হয়েছে:
"নিশ্চয় ক্ষমতা (সুলতান) আল্লাহর ছায়া; যারা তা পায়, তাদের পরীক্ষা করা হয়।" (হাদিস, মিশকাত)
ফলাফল:
তারা এমন রাষ্ট্রকাঠামো প্রস্তাব করেন যেখানে নেতাদের নৈতিক পতনের সম্ভাবনা শূন্য ধরে নেওয়া হয়।
কিন্তু ইতিহাস বলে, ইসলামী শাসকদের মধ্যেও স্বৈরাচার, দুর্নীতি ও অহংকার এসেছে (যেমন: উমাইয়া-আব্বাসীয় যুগের সংঘাত)।
(খ) শয়তান-মুক্ত নেতৃত্বের মিথ
তৌহিদী চিন্তাবিদেরা ভুলে যান:
শয়তানের প্ররোচনা সবাইকে স্পর্শ করে—চাই তারা আলেম হোন বা রাজনীতিবিদ।
ক্ষমতা পেলে মানুষের মনোবৃত্তি বদলে যায় (Power Corrupts)।
নবী সুলাইমান (আ.)-এর দোয়া:
"হে আমার রব! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমাকে এমন রাজ্য দান করুন যা অন্য কারও জন্য উপযুক্ত নয়। নিশ্চয় আপনি মহাদাতা।" (সূরা সাদ, ৩৮:৩৫) → এখানে ক্ষমতার ফিতনা থেকে বাঁচার প্রার্থনা রয়েছে।
প্রশ্ন: যদি নবীরাও ক্ষমতার ফিতনাকে ভয় পেতেন, তাহলে আজকের নেতারা কীভাবে নিজেদের শয়তানের প্রভাবমুক্ত দাবি করেন?

৩. সমাধান: শয়তানের কার্যকারিতা স্বীকার করে রাষ্ট্রদর্শন নির্মাণ
(ক) বাস্তববাদী ইসলামী রাজনীতি কী হওয়া উচিত?
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ:
খিলাফত বা ইসলামী রাষ্ট্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি ব্যবস্থা রাখা (যেমন: ওমর (রা.)-এর হিসাব নিকাশ)।
নেতৃত্বকে অস্থায়ী ও নিয়ন্ত্রিত করা (যেমন: শুরা পদ্ধতি)।
নেতৃত্বের মানবিক দুর্বলতা স্বীকার:
এই স্বীকারোক্তি যে, ইসলামী নেতারাও ভুল করতে পারেন (যেমন: খুলাফায়ে রাশিদুনের সময় সংঘাত)।
শয়তানের প্রভাব মোকাবেলার কৌশল:
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে আত্মসমালোচনা ও মুহাসাবা (আত্মপরীক্ষা) চর্চা।
রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে অহংকার ও লোভের বিরুদ্ধে সতর্কতা (যেমন: উমর (রা.)-এর বলতেন, "আমার জামায় যদি একটুও বাড়তি কাপড় দেখ, তা কেটে ফেলো")।
(খ) একটি উদাহরণ: ইরান ও সৌদি আরব
ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর আয়াতুল্লাহ খোমেনী বলেছিলেন, "ক্ষমতা ২০ বছর পরেও পবিত্র থাকবে না।"
সৌদি আরবের রাজতন্ত্র শুরুর দিকে ওয়াহাবি আদর্শে চললেও আজ তা অর্থ-ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। → উভয় ক্ষেত্রেই শয়তানের প্রভাব উপেক্ষা করা হয়নি, কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ না থাকায় সমস্যা তৈরি হয়েছে।

৪. উপসংহার: শয়তান-সচেতন রাজনৈতিক দর্শনের প্রয়োজন
ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তা তখনই বাস্তবসম্মত হবে, যখন তা:
শয়তানের প্ররোচনাকে একটি সক্রিয় শক্তি হিসেবে বিবেচনা করবে।
নেতৃত্বের দুর্বলতাকে স্বীকার করে জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি করবে।
ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যমে স্বৈরাচার রোধ করবে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.