![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
১. ভূমিকা
সাধারণ তৌহিদী জনগণের হৃদয়ে উসমানীয় খিলাফত এক স্বর্ণালী স্বপ্নের নাম। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম প্রান্তে এই সাম্রাজ্যকে ইসলামী ঐক্য, ন্যায়বিচার ও খোদাভীতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সাধারণ মুসলমানদের কল্পনায় উসমানীয় সুলতানেরা ছিলেন ধর্মপ্রাণ, ন্যায়পরায়ণ ও আল্লাহর পথের যোদ্ধা। কিন্তু ইতিহাসের নিরপেক্ষ দলিল-দস্তাবেজ ও সত্যনিষ্ঠ গবেষণা এক ভিন্ন চিত্র তুলে ধরে।
প্রকৃত ইতিহাসে উসমানীয় খিলাফত ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, যারা ইসলামের পবিত্র নাম ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ হাসিল করেছে। তৌহিদী জনতার প্রত্যাশা আর বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। আল্লাহর দ্বীনের নামে যে সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল, সেখানে প্রকৃতপক্ষে ছিল ক্ষমতালিপ্সা, নৈতিক অধঃপতন ও মানবিক মূল্যবোধের চরম লঙ্ঘন। এই প্রবন্ধে আমরা ইসলামিক সূত্র ও ঐতিহাসিক প্রমাণের ভিত্তিতে উসমানীয় খিলাফতের সত্যিকারের চেহারা উন্মোচন করার চেষ্টা করব।
২. ইসলামী বৈধতার প্রশ্ন: কুরাইশ বংশের শর্ত
উসমানীয় খিলাফতের বৈধতা নিয়ে প্রথম যে প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী খলিফার যোগ্যতার বিষয়টি। ইসলামিক স্কলার ইবন তায়মিয়াহসহ অনেক বিখ্যাত আলেম স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, খলিফা হওয়ার জন্য কুরাইশ বংশভুক্ত হওয়া আবশ্যক। এই মতবাদ সহীহ হাদীস এবং আল-কুরআনের ব্যাখ্যা থেকে প্রতিষ্ঠিত।¹'²⁰ অথচ উসমানীয় সম্রাটেরা ছিলেন তুর্কী বংশোদ্ভূত, কুরাইশ বংশের সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এই কারণে তাদের খিলাফতের ইসলামী বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ থেকে যায়।
৩. ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব: কনস্টান্টিনোপল পতন ও ইউরোপীয় প্রতিক্রিয়া
১৪৫৩ সালে অটোমানদের কনস্টান্টিনোপল দখল ইতিহাসের একটি যুগান্তকারী ঘটনা।³'⁴ এই ঘটনার ফলে বিপুল সংখ্যক বাইজ্যান্টাইন খ্রিষ্টান পণ্ডিত, সাহিত্যিক, শিল্পী এবং বুদ্ধিজীবী পশ্চিম ইউরোপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।² এই অভিবাসন ইউরোপে রেনেসাঁ আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। আরও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, কনস্টান্টিনোপল পতনের প্রভাবে ইউরোপীয়রা ইসলাম-বিরোধী মনোভাব নিয়ে সংগঠিত হয়ে ওঠে। এর প্রত্যক্ষ ফলাফল হিসেবে ১৪৯২ সালে তারা স্পেনের গ্রানাডা দখল করে এবং সেখানকার মুসলিম শাসনের অবসান ঘটিয়ে নির্মম অত্যাচার চালায়।³'⁵
৪. সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণ: ইসলামের অপব্যবহার
উসমানীয় সাম্রাজ্যের একটি উল্লেখযোগ্য সমালোচনা হলো তারা ইসলাম ধর্মকে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।⁶'⁷'⁸ ধর্মের নামে তারা বহু অঞ্চল দখল, হত্যা, লুণ্ঠন এবং দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। এই ধরনের কার্যকলাপ ইসলামের মূল শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। ধর্মকে রাজনৈতিক ও সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার এই প্রবণতা তাদের আধ্যাত্মিক বৈধতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
৫. নৈতিক অধঃপতন: হারেম ব্যবস্থা ও যৌন অনাচার
উসমানীয় সুলতানদের ব্যক্তিগত জীবনযাত্রা ইসলামী নৈতিকতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। তাদের হারেমে শত শত নারী থাকত, যাদের মধ্যে অনেকে ছিলেন দাসী বা উপপত্নী।⁹'¹⁰ একাধিক সুলতানের ৫০ থেকে ১৬০ জনের বেশি উপপত্নী ছিল। যদিও বিয়ের রীতি বিদ্যমান থাকলেও, রাজপরিবারে আনুষ্ঠানিক বিয়ের তুলনায় উপপত্নীর সংখ্যা ও প্রথা ছিল ব্যাপক। এই ধরনের জীবনযাত্রা ইসলামের পবিত্রতা ও সংযমের শিক্ষার বিপরীত।
৬. ক্ষমতার নিষ্ঠুরতা: রাজপরিবারে হত্যা ও ষড়যন্ত্র
উসমানীয় রাজপরিবারে ক্ষমতা দখলের জন্য ভ্রাতৃহত্যা একটি প্রথাগত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল।¹¹'¹² ভাই-ভাইকে হত্যা, পিতা-সন্তানকে হত্যা, বা ষড়যন্ত্রমূলক খুন ছিল স্বাভাবিক ঘটনা। এই নিষ্ঠুর প্রথাকে 'ফ্র্যাট্রিসাইড' (Fratricide) নামে আনুষ্ঠানিকভাবে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল। কোনো কোনো সুলতান একসাথে ১০-২০ জন ভাইকে নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। এই ধরনের বর্বরতা ইসলামের করুণা ও ভ্রাতৃত্বের শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।
৭. ধর্মীয় দ্বিচারিতা ও জাতিগত নিপীড়ন
উসমানীয়দের বাহ্যিক ইসলামী ঐতিহ্য এবং ইবাদত-বন্দেগী থাকলেও, তাদের প্রকৃত ইমান, সদাচরণ ও মানবিক আচরণে ব্যর্থতা স্পষ্ট ছিল।¹³'¹⁴'¹⁵ তারা দেবশিরমে নামক একটি অমানবিক প্রথা চালু করেছিল, যেখানে পূর্ব ইউরোপের খ্রিষ্টান শিশুদের জোরপূর্বক ধরে এনে সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করা হতো। এছাড়া আর্মেনীয় ও আসিরীয় জাতির ওপর তারা শতাব্দীকাল ধরে নিপীড়ন চালিয়েছে। এর মধ্যে ছিল বড় ধরনের গণহত্যা, নারী-শিশু নিধন এবং জোরপূর্বক ধর্মান্তরণ।
৮. আধুনিক যুগে ধারাবাহিকতা: কুর্দিদের ওপর অত্যাচার
উসমানীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় আধুনিক তুর্কি প্রশাসনও কুর্দ সম্প্রদায়ের ওপর হত্যা ও নিপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।¹² তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করার নামে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এই নীতি উসমানীয় আমলের জাতিগত নিপীড়নের একটি আধুনিক রূপ।
৯. বিতর্কিত পররাষ্ট্রনীতি: ইসরাইল-আমেরিকার সাথে সম্পর্ক
সমসাময়িক তুরস্ক, যা উসমানীয় খিলাফতের উত্তরাধিকার রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত, ইসরাইল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গভীর সামরিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনে আবদ্ধ।¹² বিভিন্ন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনায় তারা এই দেশগুলোকে সহায়তা প্রদান করে থাকে। ফিলিস্তিনি সমস্যা এবং মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য সংকটের প্রেক্ষাপটে এই নীতি তাদের মুস্লিম পরিচয়ের সাথে সাংঘর্ষিক বলে অনেকে মনে করেন।
১০. উপসংহার: স্বপ্ন থেকে জাগরণের ডাক
তৌহিদী জনতার হৃদয়ে লালিত উসমানীয় খিলাফতের স্বর্ণময় স্বপ্ন এবং ইতিহাসের রূঢ় বাস্তবতার মধ্যে রয়েছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। যে সাম্রাজ্যকে আমরা ইসলামী আদর্শের প্রতীক মনে করি, প্রকৃতপক্ষে সেটি ছিল একটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যারা আল্লাহর দ্বীনের পবিত্র নাম ব্যবহার করে নিজেদের লোভ-লালসা চরিতার্থ করেছে।
ইসলামের প্রকৃত মূল্যবোধ—তাকওয়া, ইহসান, আদল, রহমত এবং মানবিক মর্যাদা—উসমানীয় শাসনে প্রায়শই অনুপস্থিত ছিল। বরং ক্ষমতার মোহ, কামনা-বাসনার দাসত্ব, রক্তাক্ত ষড়যন্ত্র এবং নিরপরাধ জাতিগোষ্ঠীর ওপর জুলুম-নির্যাতন—এইসব কালিমাই ছিল তাদের প্রকৃত পরিচয়। ইসলামী খিলাফতের নামে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা লালন করা হয়, তার সাথে উসমানীয় বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
আজকের যুগে এসে আমাদের উচিত ইতিহাসের এই তিক্ত সত্যগুলো মেনে নেওয়া। অন্ধ মোহাচ্ছন্নতা ত্যাগ করে প্রকৃত ইসলামী আদর্শের সন্ধান করা। উসমানীয় খিলাফতের কল্পিত মহিমা প্রচারের পরিবর্তে আল্লাহর সত্যিকারের হুকুম ও রাসূলের (সা.) প্রকৃত সুন্নাহ অনুসরণে মনোযোগী হওয়া।
মুসলিম উম্মাহর জাগরণ ও কল্যাণ নিহিত রয়েছে সত্যের স্বীকৃতিতে, মিথ্যা গৌরবগাঁথায় নয়। কেবল তখনই আমরা প্রকৃত তৌহিদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে পারব যখন ইতিহাসের কালিমা থেকে শিক্ষা নিয়ে আল্লাহর পথে সত্যিকারের পদক্ষেপ নেব।
________________________________________
তথ্যসূত্র
1. Prerequisites of a Rightly-Guided Khalifa - Al Islam
2. How Did the Fall of Constantinople Change the Renaissance in Italy? - Saint Sophia DC
3. Granada War - Wikipedia
4. Fall of Constantinople - Wikipedia
5. Reconquista - Wikipedia
6. The Ottoman Empire and Islam - YouTube
7. Ottoman Empire - Wikipedia
8. Islam in the Ottoman Empire - Wikipedia
9. Weddings a Lavish Affairs Under the Ottomans - Hürriyet Daily News
10. Cage Life and Child Marriage: 10 Crazy Ottoman Laws - Kipchaks
11. Ottoman Dynasty - Wikipedia
12. The Decline of the Ottoman Empire (1566-1807) - Britannica
13. How Religion Influenced Law in the Ottoman Empire - The Collector
14. Hamidian Massacres - Wikipedia
15. The Ottoman Christian Genocide - World Without Genocide
16. The Obligation of Establishing a Caliphate - Al Hakam
17. Who is the Caliph and How is He Chosen? - Al Islam
18. Hadith Collection - IIUM
19. Narration of Umar about Choice of Khalifa - SeekersGuidance
20. Caliphate - Wikipedia
©somewhere in net ltd.