![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী অবস্থান রাজনৈতিক তত্ত্বের তিনটি মূল ধারণার মাধ্যমে বোঝা যায়: ক্ষমতা সংরক্ষণ (Power Preservation), অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতি (Existential Politics), এবং ইতিহাসের নিরাপত্তাকরণ (Securitization of History)। এই তিনটি তত্ত্ব একসাথে মিলে একটি জটিল কিন্তু সুসংগত রাজনৈতিক যুক্তি তৈরি করে।
________________________________________
১. Power Preservation: ক্ষমতা সংরক্ষণের রাজনীতি
তাত্ত্বিক কাঠামো
ক্ষমতা সংরক্ষণ তত্ত্ব অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা হারানোর পরিণতি এড়াতে এমন কৌশল গ্রহণ করে যা প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো পরিবর্তন করে ফেলে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে ক্ষমতা শুধু শাসনের যন্ত্র নয়, বরং রাজনৈতিক বেঁচে থাকার একমাত্র নিশ্চয়তা।
ঐতিহাসিক প্রমাণ
২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা
• তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে পরাজয়ের পর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর ব্যাপক নির্যাতন
• দলের স্থানীয় নেতৃত্বের প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্নকরণ চেষ্টা
• এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা: ক্ষমতা হারানো = প্রতিপক্ষের অনিয়ন্ত্রিত প্রতিশোধের শিকার হওয়া
২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত সরকার
• তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অকার্যকরতা প্রমাণ
• শেখ হাসিনাসহ উভয় দলের নেত্রীকে গ্রেফতার
• প্রমাণিত হয় যে সামরিক প্রভাব থাকলে নির্বাচন কখনোই নিরপেক্ষ হয় না
কৌশলগত প্রতিক্রিয়া
আওয়ামী লীগ pre-emptive strategy হিসেবে সিদ্ধান্ত নেয়:
• সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল (২০১১)
• দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পক্ষে যুক্তি তৈরি
• রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা
________________________________________
২. Existential Politics: অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতি
তাত্ত্বিক ভিত্তি
অস্তিত্ব রক্ষার রাজনীতিতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা life-or-death struggle এ রূপান্তরিত হয়। এখানে পরাজয়ের অর্থ শুধু ক্ষমতা হারানো নয়, বরং রাজনৈতিক ও শারীরিক অস্তিত্বের সংকট।
অস্তিত্বগত হুমকির উদাহরণ
২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা
• শেখ হাসিনাকে হত্যার সুস্পষ্ট চেষ্টা
• ২৪ জন নিহত, শত শত আহত
• বার্তা স্পষ্ট: প্রতিপক্ষ শুধু রাজনৈতিক পরাজয় নয়, শারীরিক নিশ্চিহ্নকরণ চায়
বিডিআর বিদ্রোহ (২০০৯)
• আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ষে সামরিক ষড়যন্ত্রের অভিযোগ
• সেনাবাহিনীর সাথে সম্পর্কের অবনতি
• রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারানোর ঝুঁকি
২০১৩ সালের শাপলা চত্বর ঘটনা
• হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে সরকারের কঠোর অবস্থান
• ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদী শক্তির উত্থানের আশঙ্কা
• আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয়ের প্রতি চ্যালেঞ্জ
রাজনৈতিক যুক্তি
এই অভিজ্ঞতাগুলো থেকে আওয়ামী লীগের মূল সিদ্ধান্ত:
• বিএনপি-জামায়াত জোট = অস্তিত্বের সরাসরি হুমকি
• যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির আশঙ্কা
• ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান ও ধর্মনিরপেক্ষতার অবসান
ফলাফল: আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হারানো মানেই দল ও নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার ঝুঁকিতে ঠেলে দেওয়া।
________________________________________
৩. Securitization of History: ইতিহাসের নিরাপত্তাকরণ
তাত্ত্বিক পরিচয়
Securitization তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো বিষয়কে "নিরাপত্তা-প্রশ্ন" হিসেবে উপস্থাপন করা হলে তা জরুরি অবস্থার ন্যায্যতা প্রদান করে এবং ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা গ্রহণের অধিকার দেয়।
ইতিহাসকে নিরাপত্তা-প্রশ্নে রূপান্তর
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস = জাতীয় নিরাপত্তা
আওয়ামী লীগের যুক্তি:
• মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কেবল অতীতের ঘটনা নয়, বরং জাতির পরিচয় ও রাষ্ট্রের বৈধতার ভিত্তি
• প্রতিপক্ষ ক্ষমতায় এলে এই ইতিহাস মুছে দেওয়া হবে
• স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির পুনর্বাসন ঘটবে
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার = নিরাপত্তা ইস্যু
• যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু ন্যায়বিচার নয়, বরং রাষ্ট্রের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন
• এই বিচার বন্ধ হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারিয়ে যাবে
• জাতির মূল পরিচয় সংকটে পড়বে
কৌশলগত ব্যবহার
ইতিহাসের নিরাপত্তাকরণের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ:
• নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র অভিভাবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে
• বিরোধীদেরকে স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করে
• যে কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ইতিহাস মুছে দেওয়ার ষড়যন্ত্র হিসেবে উপস্থাপন করে
________________________________________
৪. সমন্বিত তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
তিনটি তত্ত্বের আন্তর্সংযোগ
Power Preservation ──┐
├──► রাজনৈতিক আচরণ
Existential Politics ──┤
│
Securitization ──────┘
of History
যুক্তির শৃঙ্খল
1. ক্ষমতা ছাড়া অস্তিত্ব নেই (Power Preservation)
2. ক্ষমতা হারানো মানেই ধ্বংস (Existential Politics)
3. ইতিহাস রক্ষা মানেই ক্ষমতায় থাকা (Securitization of History)
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত
এই তিনটি তত্ত্ব মিলে আওয়ামী লীগের কাছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার = ট্রিপল থ্রেট:
• ক্ষমতা হারানোর ষড়যন্ত্র
• অস্তিত্বের ঝুঁকি
• ইতিহাস মুছে দেওয়ার হুমকি
ফলাফল: আর কখনোই এমন কাঠামোর অধীনে নির্বাচনে না যাওয়া যেখানে পরাজয়ের সম্ভাবনা রয়েছে।
________________________________________
৫. তাত্ত্বিক মূল্যায়ন
শক্তিশালী দিক
• যুক্তিসংগত ভয়: ২০০১ ও ২০০৪ সালের অভিজ্ঞতা প্রকৃতই ভীতিকর
• রাজনৈতিক বাস্তবতা: বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রতিশোধের সংস্কৃতি বিদ্যমান
• ইতিহাসিক চেতনা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ
দুর্বল দিক
• গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অবমূল্যায়ন: তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা সংস্কার সম্ভব ছিল
• Self-fulfilling prophecy: ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকার চেষ্টা আরও বেশি বিরোধিতা সৃষ্টি করে
• বৈধতার সংকট: নিয়মিত বিতর্কিত নির্বাচন গণতান্ত্রিক বৈধতা হ্রাস করে
পরিণতি (২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান)
তিনটি তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক কৌশল শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়:
• ক্ষমতা সংরক্ষণ → গণঅভ্যুত্থানে পতন
• অস্তিত্ব রক্ষা → দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া
• ইতিহাস নিরাপত্তা → ৩২ নম্বর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া
________________________________________
উপসংহার
আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারবিরোধী অবস্থান রাজনৈতিক তত্ত্বের দৃষ্টিতে একটি rational but ultimately self-defeating strategy। ক্ষমতা সংরক্ষণ, অস্তিত্ব রক্ষা ও ইতিহাসের নিরাপত্তাকরণের যুক্তি স্বল্পমেয়াদে শক্তিশালী হলেও দীর্ঘমেয়াদে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষয় ও সামাজিক অস্থিতিশীলতার কারণ হয়েছে।
মূল শিক্ষা: রাজনৈতিক বেঁচে থাকার জন্য গৃহীত কৌশল যদি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষুণ্ন করে, তাহলে তা শেষ পর্যন্ত সেই শক্তিকেই ধ্বংস করে যার রক্ষার জন্য এই কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল।
©somewhere in net ltd.