নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক আধিপত্য বনাম গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি: সংগীতচর্চার বিষয়টির রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন

২৯ শে আগস্ট, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৭



বাংলাদেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে সংগীতচর্চাকে ঘিরে একটি সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি ও আধিপত্যমূলক বোধ তৈরি হয়েছে, যার মূল শিকড় আধুনিক রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম ও শহুরে অভিজাত শ্রেণির সাংস্কৃতিক কল্পনায় নিহিত। টেলিভিশন, রেডিও ও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যেসব সংগীতকে “জাতীয় সংস্কৃতি” বা “বাংলার ঐতিহ্য” হিসেবে তুলে ধরা হয়, তা মূলত একটি নিয়ন্ত্রিত, আনুষ্ঠানিক, এবং উচ্চবর্গপ্রসূত সাংস্কৃতিক চেতনার প্রতিফলন। এই প্রবণতা গণমানুষের সংগীতচর্চাকে অবদমিত করে রেখেছে এবং সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের একটি ঘনিষ্ঠ রূপে পরিণত হয়েছে।

ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক কল্পনা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান
ফ্যাসিবাদী সাংস্কৃতিক কল্পনা এখানে বোঝায় সেই প্রবণতাকে, যা একটি নির্দিষ্ট রুচি ও আঙ্গিককে সর্বজনীন ও বৈধ সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে, অন্যদিকে প্রান্তিক, লোকজ বা পরম্পরাগত সংগীতরূপগুলিকে ‘অপর’ হিসেবে চিহ্নিত করে। এই চর্চা মূলত উপনিবেশ-উত্তর কালের “নেশন বিল্ডিং” এর অংশ হিসেবে আধুনিক রাষ্ট্র ও তার মিডিয়াগুলোর মাধ্যমে জারি হয়, যার ফলে সংস্কৃতি হয়ে পড়ে কর্তৃত্ববাদী এবং শ্রেণিগতভাবে একমুখী। এই সংস্কৃতি জীবি শ্রেণি মনে করে যে, “মঞ্চভিত্তিক, আনুষ্ঠানিক, রেওয়াজকৃত” সংগীতই একমাত্র পরিচ্ছন্ন ও মর্যাদাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক রূপ।

গণমানুষের সংগীত: জীবনের সংগীত, প্রতিরোধের ভাষা
আসলে, যে সংগীত বাঙালির সংস্কৃতি হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত, তা হলো সেই সংগীত যা সমাজের গভীর স্তর থেকে উদ্ভূত, যা বাঙালির জীবনাচারে, ধর্মীয় চর্চায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে, কিংবা রাজনৈতিক প্রতিরোধে নিজেকে প্রকাশ করে। যেমন:
বিয়ের গীত, গায়ে হলুদের গান, লাঠিখেলা বা নৌকাবাইচের সংগীত—যেগুলো নির্দিষ্ট সামাজিক আচারের অঙ্গ।
ধর্মীয় সংগীত—যেমন ইসলামী জিকির, বৈষ্ণব পদের গান, কিংবা সুফি সাধনার সংগীত।
রাজনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংগীত—যেমন ভাষা আন্দোলনের গান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংগীত, শ্রমজীবী মানুষের প্রতিবাদী গান।
এসব সংগীত শুধুমাত্র এক সাংস্কৃতিক রীতি নয়, বরং সমাজের শ্রেণি-সংঘাত, জাতিসত্তার সংজ্ঞা, এবং প্রতিরোধের অভিব্যক্তি হিসেবে কাজ করে। এগুলো সাংস্কৃতিকভাবে গণমুখী, বহুধা-ধর্মবিশ্বাসী এবং বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করে।
আসলে যে সংগীত আমাদের সংস্কৃতি, সগুলো হলো আমাদের জীবনযাপনে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যে সংগীত সমাজ থেকে নিংড়ে গড়ে উঠে সেগুলো হলো আমাদের সংস্কৃতি, যেমন- বিয়ের অনুষ্ঠান, গায়ে হলুদ, বিভিন্ন ক্রীড়া (লাঠি খেলা, নৌকা বাইচ), ধর্মীয় জিকির, আধ্যাত্মিক সাধনা, রাজনৈতিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, দেশরক্ষা আন্দোলন অথবা কোনও কাহিনীর প্রচারপ্রচারণার সাথে সম্পৃক্ত সংগীত।
 
কল্পিত সংস্কৃতি বনাম সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র
বর্তমান সময়ের ‘সংস্কৃতি’ নামধারী প্রচারচর্চা আসলে একটি কল্পিত ও বিচ্ছিন্ন সংস্কৃতি, যা কিছুসংখ্যক মিডিয়াকেন্দ্রিক সংগঠক, কর্তাব্যক্তি ও সংস্কৃতি জীবির ধারণায় গড়ে উঠেছে। এটি গণমানুষের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে অস্বীকার করে এবং চূড়ান্তভাবে ভাষা ও সংস্কৃতির ভাঙন তৈরি করে। এই ধরনের আধিপত্যবাদী সংস্কৃতিকে চ্যালেঞ্জ না করলে, জাতীয় সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় তার অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়বে।

সাংস্কৃতিক মুক্তি ও গণআন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা
এ অবস্থার অবসান ঘটিয়ে জনগণের প্রাণ থেকে উদ্ভূত সংগীত ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক গণতন্ত্র কায়েম করা অত্যাবশ্যক। এর জন্য প্রয়োজন একটি ব্যাপক সাংস্কৃতিক আন্দোলনের, যার মূল লক্ষ্য হবে:
প্রান্তিক সংগীত ও শিল্পকে স্বীকৃতি ও প্রচার দেওয়া,
জাতিসত্তার সংগীতচর্চার ঐতিহাসিকতা পুনরুদ্ধার,
মিডিয়াভিত্তিক একক সংস্কৃতি-চর্চাকে প্রতিরোধ করা,
এবং সংস্কৃতিকে শ্রেণি, ধর্ম ও জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।

উপসংহার:
বাংলাদেশের সংস্কৃতি কোনো কল্পিত ও মিডিয়াকেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন নয়। এটি বহুত্ববাদী, গ্রামীণ ও নাগরিক, ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ, বুদ্ধিবৃত্তিক ও শ্রমজীবী—সমস্ত রূপের সমন্বয়ে গঠিত। সংস্কৃতিকে যদি জীবনের সঙ্গে যুক্ত না করা যায়, তবে তা সাংস্কৃতিক ফ্যাসিবাদের হাতেই বন্দী হয়ে থাকবে। তাই প্রয়োজন সাংস্কৃতিক পুনরুদ্ধার ও গণসংস্কৃতি পুনর্নির্মাণের সংগ্রাম।
 

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.