নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

ডক্টর এ.বি.এম. রেজাউল করিম ফকির, অধ্যাপক, জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতি বিভাগ আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় e-mail: [email protected]

রেজাউল করিম ফকির

অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়

রেজাউল করিম ফকির › বিস্তারিত পোস্টঃ

ওয়াজ-মাহফিলের বক্তব্য, শ্রোতার মানসিকতা ও “মানবিক মুসলমান” গঠনের রূপরেখা

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১:১৪


১) ভূমিকা
অনেক ওয়াজিন/ওলামা-মাশায়েখ ইসলামের দোহাই দিয়ে ওয়াজ-মাহফিল আয়োজন করেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যের সবটাই সমানভাবে ধর্মশিক্ষাভিত্তিক নয়—অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত প্রচার, তথ্য-বিকৃতি, রাজনৈতিক উসকানি বা উগ্রপন্থার সুর মিশে যায়। এতে সাধারণ মুসলমানের মনে এক ধরনের মিশ্র মানসিকতা গড়ে ওঠে—কখনো ধার্মিকতার ইতিবাচক দিক, আবার কখনো ধর্মের নামে উগ্রতা বা বিভ্রান্তি।


২) ওয়াজের বিষয়বস্তুর শ্রেণিবিভাগ (৭ ধরণ)
একজন ওয়াজিনের বক্তব্য মোটামুটি সাত ভাগে পড়তে দেখা যায়—
1. ইসলাম-ধর্ম সম্পর্কিত জ্ঞানভিত্তিক বক্তব্য: আকিদা, আখলাক, ফিকহ, সীরাহ ইত্যাদির আলোচনাভিত্তিক নির্মোহ উপস্থাপনা।
2. ঈমান–আমল ও ইহকাল–পরকালের হিসাব: আল্লাহভীতি, ন্যায়-অন্যায়ের জবাবদিহি, তওবার গুরুত্ব ইত্যাদি। (সমস্যা হয় যখন “গুনাহ করে গেলেও শুধু তওবা করলেই হবে”—এই সরলীকরণ দিয়ে নৈতিক দায় ও সংশোধনের শর্তকে আড়াল করা হয়।)
3. ব্যক্তিকেন্দ্রিক আত্মপ্রচার: বক্তার জনপ্রিয়তা, মর্যাদা বা “কারামত”কে বড় করে দেখানো।
4. তথ্য বিকৃতি/ভ্রান্ত উদ্ধৃতি: দুর্বল বা মনগড়া বয়ান, ইতিহাস-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা, প্রোপাগান্ডা।
5. প্রতিপক্ষের প্রতি বিষোদগার: আদর্শিক ভিন্নমত, ব্যক্তি বা দলের বিরুদ্ধে গালিগালাজ/হুমকি-ধমকি।
6. রাজনৈতিক বক্তৃতা: দলীয় প্রচারণা, ক্ষমতাকেন্দ্রিক বার্তা, নির্বাচনী ইশারা-ইঙ্গিত।
7. উগ্র ‘জিহাদি জোশ’ উসকে দেওয়া: সহিংসতার রোমান্টিকীকরণ, বাস্তব আইন-নৈতিকতা অগ্রাহ্য করে আবেগাত্মক প্ররোচনা।

৩) “মিশ্র চিন্তাধারা” মডেল: ধার্মিক বনাম উগ্রধর্মীয় ঝোঁক
• যাদের চিন্তা-আচরণে ১ নম্বর (জ্ঞানভিত্তিক, নৈতিক উন্নয়নমুখী) ধারার আধিক্য, তাঁরা সাধারণত ধর্মমনস্ক ও সংযত আচরণে অভ্যস্ত।
• আর ২–৭ নম্বর ধারা বেশি প্রাধান্য পেলে, বিশেষত ৪–৭ নম্বরের উপাদান ঘন হলে, ব্যক্তি উগ্রধর্মীয়/চরমপন্থী প্রবণতার দিকে ঝুঁকতে পারেন—যা সমাজে বিভাজন, বিদ্বেষ ও সহিংসতার ঝুঁকি বাড়ায়।

৪) “তওবা করলে মাফ”—ধারণার মনস্তত্ত্ব
কিছু ওয়াজে এমন বার্তা ভেসে আসে যে, “গুনাহ চলুক, শেষে তওবা করলেই ক্ষমা”—এমন অতিসরলীকরণ নৈতিক শৃঙ্খলা ভেঙে দেয়। এর ফলে—
• মোরাল লাইসেন্সিং: “যেমন খুশি করব, শেষে তওবা”—এই মানসিক ছাড়পত্র।
• চক্রাকারে গুনাহ–তওবা: সংশোধনের বদলে পুনরাবৃত্তি।
• গ্রুপ-থিঙ্ক ও উত্তেজনা: আবেগে ভেসে সহিংসতা বা উগ্র দলীয়তাকে “ধর্মীয় কর্তব্য” মনে করা।
বাস্তবে, ঐতিহ্যগত আলোচনায় তওবার সাথে থাকে অনুতাপ, গুনাহ ত্যাগ, ক্ষতিপূরণ/সংশোধন, পুনরাবৃত্তি না করার অঙ্গীকার—এগুলো আড়াল হলেই বিপদ তৈরি হয়।


৫) সমাধানের দিকনির্দেশ: ডেটাবেজ-ভিত্তিক তথ্যপ্রচার কাঠামো
উগ্রতা কমিয়ে “মানবিক মুসলমান” গড়ে তুলতে একটি উন্মুক্ত, নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার ও সম্প্রচারব্যবস্থা গড়ে তোলা যেতে পারে—
(ক) কন্টেন্ট ট্যাক্সোনমি ও যাচাই
• ট্যাক্সোনমি: উপরের ৭ শ্রেণিতে ওয়াজ-উদ্ধৃতি/ক্লিপ ট্যাগিং।
• রেটিং মানদণ্ড: জ্ঞানভিত্তিক/উপকারী, বিভ্রান্তিকর, ঘৃণাত্মক, রাজনৈতিক, উসকানিমূলক—এমন সূচক।
• স্কলার প্যানেল: আলেম–গবেষকদের পিয়ার-রিভিউ; দুর্বল/ভুল বয়ান চিহ্নিতকরণ; “সংশোধিত নোট” প্রকাশ।
(খ) ইতিবাচক বিকল্প-বার্তা (Counter-Narrative)
• খুতবা/বক্তৃতা টেমপ্লেট: করুণা, ন্যায়, amanah, প্রতিবেশী-অধিকার, দুর্নীতি-বিরোধ, নাগরিক দায়িত্ব ইত্যাদি কেন্দ্র করে।
• মিথ-ভাঙা কার্ড: ঘনঘন ভ্রান্ত ধারণার সংক্ষিপ্ত খণ্ডনপত্র (১–২ মিনিট ভিডিও/ইনফোগ্রাফিক)।
• Ask-a-Scholar: সাধারণ মানুষের প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত, উদ্ধৃতিসহ জবাব-ডেটাবেজ।
(গ) সম্প্রচার ও প্রাপ্তি
• কমিউনিটি রেডিও/মসজিদ মিডিয়া কিট: যাচাইকৃত সাপ্তাহিক কনটেন্ট-প্যাক।
• যুব প্ল্যাটফর্ম: শর্ট ভিডিও, কুইজ, চ্যালেঞ্জ—নৈতিকতা ও সহনশীলতার গল্পভিত্তিক কনটেন্ট।
• ওপেন API: মসজিদ/মাদ্রাসা/এনজিও তাদের অ্যাপে কনটেন্ট টেনে নিতে পারবে।
(ঘ) শাসন ও নীতিগত রক্ষাকবচ
• স্বচ্ছতা: কাদের দ্বারা যাচাই হয়—তা প্রকাশ।
• স্বাধীন মতের প্রতি সম্মান: “সেন্সরশিপ” নয়, উত্তম বিকল্প দেওয়া—এই দর্শন।
• অভিযোগ–আপিল চ্যানেল: ভুল ট্যাগিং/রেটিং সংশোধনের দ্রুত ব্যবস্থা।


৬) সহায়ক সামাজিক–নৈতিক উদ্যোগ
• বক্তা প্রশিক্ষণ: তথ্য-যাচাই, উদ্ধৃতি-শুদ্ধতা, ঘৃণামুক্ত ভাষা, নাগরিক নৈতিকতা।
• নৈতিক চার্টার: আয়োজক–বক্তা–স্বেচ্ছাসেবীদের জন্য আচরণবিধি।
• মিডিয়া সাক্ষরতা: ভুয়া উদ্ধৃতি/ক্লিপ চিনে নেওয়ার কৌশল শেখানো।
• মনোসামাজিক সহায়তা: রাগ-হতাশা–আবেগ নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি কাউন্সেলিং।
• যুব সম্পৃক্ততা: সামাজিক সেবা, আন্তঃধর্ম সংলাপ, ক্রীড়া–সংস্কৃতি—উগ্রতা থেকে গঠনমূলক অংশগ্রহণে টান।


৭) “মানবিক মুসলমান”—লক্ষ্যমাত্রার প্রোফাইল
• জ্ঞানভিত্তিক ধর্মচর্চা, ন্যায়–করুণা–সহনশীলতা, ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা, আইনমান্যতা, গুজববিরোধী অবস্থান, সামাজিক দায়িত্ববোধ।


৮) উপসংহার
ওয়াজ-মাহফিল সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে—যদি তা জ্ঞান, নৈতিকতা ও সামাজিক সেতুবন্ধনের দিকে নিবদ্ধ থাকে। কিন্তু ব্যক্তিপূজা, তথ্য-বিকৃতি, বিদ্বেষ ও সহিংসতার প্ররোচনা ঢুকে পড়লে তা সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। তাই ডেটাবেজ-ভিত্তিক যাচাই ও কনটেন্ট-ইকোসিস্টেম, ইতিবাচক বিকল্প-বার্তা, এবং নৈতিক–সামাজিক উদ্যোগ—এই তিন স্তম্ভে সমন্বিত প্রয়াসই উগ্রতা কমিয়ে মানবিক মুসলমান গঠনের টেকসই পথ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.