![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের ধর্মশিক্ষা সংস্কার: দেশজ দর্শনভিত্তিক মানবিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা
১. বর্তমান ধর্মশিক্ষার সমস্যা
বাংলাদেশের স্কুল পর্যায়ের ধর্মশিক্ষা পাঠ্যক্রম মূলত সরলীকৃত এবং আনুগত্যমূলক দিকেই বেশি মনোযোগ দেয়। "ইবাদত-আমল করলে মানুষ নৈতিক হবে এবং বেহেশত লাভ করবে" ধরণের শিক্ষা প্রদান করা হয়। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, এই পদ্ধতি দেশের মানুষকে সম্পূর্ণ নৈতিক বা মানবিকভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে।
সরল ধর্মশিক্ষার সীমাবদ্ধতা
প্রচলিত ধর্মশিক্ষা প্রায়শই কেবল আনুষ্ঠানিক ইবাদত, ব্যক্তিগত পুরস্কার (বেহেশত) ও শাস্তির (জাহান্নাম) ভয় দেখানো পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। এই পদ্ধতির মূল সমস্যাগুলো:
• আনুগত্যমূলক শিক্ষার একমুখীতা: শুধু আনুগত্যমূলক ধর্মচর্চা একজনকে যুক্তিসম্মত চিন্তা, সহমর্মিতা, সামাজিক দায়িত্ববোধ বা মানবিক মূল্যবোধ শেখায় না
• ব্যক্তিগত মুক্তির সীমাবদ্ধতা: শিক্ষার্থীরা ধর্মকে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মুক্তির একটি মাধ্যম হিসেবে দেখে
• সামাজিক দায়বদ্ধতার অভাব: সমাজ ও মানবতার সেবা, ন্যায়বিচার, সহনশীলতা এবং বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধার মতো গুণাবলী বিকশিত হয় না
• নৈতিকতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা ও সার্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের অনুপস্থিতি
২. প্রস্তাবিত সমাধান: বহুমুখী দর্শনভিত্তিক শিক্ষা
বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও নৈতিকতার গবেষকরা জানিয়েছেন যে, শিক্ষার মাধ্যমে মানুষের চরিত্র ও নৈতিকতা গড়ে তুলতে হলে শুধু ধর্মীয় বিধান নয়, বরং দেশজ আত্মদর্শন, দেশদর্শন এবং সাংখ্য দর্শনের মতো বৌদ্ধিক ও দর্শনমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
তিনটি মূল স্তম্ভ
২.১. বাঙ্গালাবর্ত ও শিকড়ের দেশজ আত্মদর্শন
দেশজ আত্মদর্শন শেখায় একজন ব্যক্তি তার নিজের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের প্রতি সচেতন হবে এবং জাতিগত ও সাংস্কৃতিক মান বুঝবে।
বাংলাদেশ একটি সুপ্রাচীন সাংস্কৃতিক ও দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারক। এই অঞ্চলের বৌদ্ধিক ইতিহাসের অংশ:
• বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, বেদান্ত দর্শন
• বাউল ও সুফি ঐতিহ্য
• নবজাগরণের দর্শন
• মানবতাবাদী দর্শন
এই দর্শনগুলো মানবতা, সহাবস্থান, আত্মানুসন্ধান এবং প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্যের উপর জোর দেয়।
২.২. দেশ দর্শন
দেশ দর্শন শিক্ষায় দেশ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পায়।
বাংলাদেশের জাতীয় দর্শনের মূল উপাদান:
• মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আত্মত্যাগের আদর্শ
• ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধ
• গণতান্ত্রিক চেতনা ও ভাষা আন্দোলনের আদর্শ
• জাতীয়তাবাদী মূল্যবোধ
এটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে দেশপ্রেম, নাগরিক দায়িত্ববোধ এবং বহুত্ববাদের প্রতি শ্রদ্ধা গড়ে তুলবে।
২.৩. সাংখ্য দর্শন
সাংখ্য দর্শন যুক্তি, বিশ্লেষণ ও মূলনীতিজ্ঞান ভিত্তিক চিন্তা এবং তথ্য যাচাই করার ক্ষমতা বিকাশ করে।
সাংখ্য হলো ভারতীয় দর্শনের একটি অন্যতম শাখা যা:
• যুক্তি ও বুদ্ধিবাদ শেখায়
• জড় ও চেতনার সম্পর্কের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বুঝতে সাহায্য করে
• বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিবাদিতা গড়ে তোলে
• বিশ্লেষণী ক্ষমতা বিকাশ করে
৩. প্রত্যাশিত ফলাফল
এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের কেবল আনুগত্যী নয়, নৈতিক ও মানবিক চেতনার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে উন্নয়ন
এই সমন্বিত পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীদেরকে শুধুমাত্র ধর্মানুগতিক নয়, বরং একজন মানবিক, যুক্তিবাদী, এবং দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে:
• সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার ক্ষমতা
• নৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা
• বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা
• আত্মসচেতনতা ও দায়িত্ববোধ
• অন্যের প্রতি সহানুভূতি ও করুণার বিকাশ
সামাজিক প্রভাব
দেশজ দর্শন ও ইতিহাসের সাথে সংযোগ স্থাপন করলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি স্থিতিশীল আত্মপরিচয় গড়ে উঠবে এবং তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবে।
সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে:
• দুর্নীতি ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ
• সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধি
• গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রসার
• পরিবেশ ও প্রকৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা
৪. বাস্তবায়ন কৌশল ও সময়সীমা
প্রয়োজনীয় উপাদান
প্রস্তাবনাটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন:
• সরকারি সদিচ্ছা
• শিক্ষাবিদদের মধ্যে পরামর্শ
• একটি সুপরিকল্পিত রোডম্যাপ
• শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ
• উপযুক্ত শিক্ষা উপকরণ প্রস্তুতি
• ধীরে ধীরে পাঠ্যক্রমে সংযোজন
পাঠ্যক্রমের নতুন কাঠামো
• ধর্মীয় শিক্ষার সাথে দর্শনের সমন্বয়
• গল্প ও উপাখ্যানের মাধ্যমে নৈতিক শিক্ষা
• ব্যবহারিক জীবনে নৈতিকতার প্রয়োগ
• সমাজসেবা ও মানবকল্যাণের প্রকল্প
শিক্ষাদান পদ্ধতির পরিবর্তন
• প্রশ্ন-উত্তর ও আলোচনার মাধ্যমে শিক্ষা
• গোঁড়ামির পরিবর্তে উদার চিন্তার প্রসার
• বিভিন্ন মতাদর্শের প্রতি সহনশীলতা
• সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তির বিকাশ
সময়সীমা ও লক্ষ্য
দেশজ এবং দর্শনভিত্তিক পাঠ্যক্রম শিক্ষার্থীর চিন্তা-চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে, যার মাধ্যমে পাঁচ বছরের মধ্যে সমাজে নৈতিক ও মানবিক মানুষ তৈরির লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
৫ বছরের সময়সীমাটি একটি চ্যালেঞ্জিং কিন্তু অনুপ্রেরণামূলক লক্ষ্য। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার গুণগত মানে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনা সম্ভব, যদিও একটি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তনে আরও সময় লাগতে পারে।
৫. সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
৫.১ বাধাসমূহ
• রক্ষণশীল শিক্ষাবিদদের প্রতিরোধ
• ধর্মীয় গোষ্ঠীর আপত্তি
• শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাব
৫.২ সমাধানের উপায়
• ক্রমান্বয়ে পরিবর্তন আনা
• শিক্ষক ও অভিভাবকদের সচেতনতা বৃদ্ধি
• সফল উদাহরণের মাধ্যমে প্রমাণ করা
• সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে জনমত গঠন
৬. উপসংহার
সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, বর্তমান সরল ধর্মশিক্ষা পাঠ্যক্রম মানুষের নৈতিক ও মানবিক গঠন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই দেশজ বৌদ্ধিক ও দর্শনমূলক দিক সংযুক্ত পাঠ্যক্রম প্রবর্তন নৈতিক ও মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় একটি গুণগত পরিবর্তনের জন্য ধর্মশিক্ষার সংস্কার অত্যন্ত জরুরি। একটি সমন্বিত ও দেশজ দার্শনিক ভিত্তি সম্পন্ন পাঠ্যক্রমই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে নৈতিক, মানবিক ও যুক্তিবাদী নাগরিক গড়ে তুলতে সক্ষম হবে, যারা দেশ ও বিশ্ব উভয়ের সমৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুধু ধর্মশিক্ষার পরিবর্তন নয়, বরং একটি সামগ্রিক মানসিক পরিবর্তনের কর্মসূচি। বাঙালির হাজার বছরের দর্শন ও ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক বিজ্ঞান ও যুক্তির সমন্বয়ে এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব যারা প্রকৃত অর্থেই নৈতিক, মানবিক ও দেশপ্রেমিক হবে।
©somewhere in net ltd.