![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
ভূমিকা
জুলাই ২০২৪ সালের ছাত্র অভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া এই গণঅভ্যুত্থান শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ পনের বছরের আওয়ামী লীগ শাসনের অবসান ঘটায়। জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা সৃষ্টি হয় যে এই অভ্যুত্থান একটি নতুন রাজনৈতিক যুগের সূচনা করবে, যেখানে থাকবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষণের গভীরে গেলে প্রশ্ন ওঠে - এই অভ্যুত্থান কি সত্যিই একটি নতুন রাজনৈতিক বিন্যাসের জন্ম দিতে পারবে, নাকি শুধুমাত্র একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
১. রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাজনৈতিক বিন্যাসের মধ্যে পার্থক্য
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ও রাজনৈতিক বিন্যাসের মধ্যে রয়েছে মৌলিক পার্থক্য। রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হলো ক্ষমতাবান গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক চুক্তি বা বোঝাপড়া, যা নির্ধারণ করে কে ক্ষমতায় থাকবে, কীভাবে সম্পদ বণ্টিত হবে এবং কারা অন্তর্ভুক্ত বা বর্জিত হবে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিন্যাস হলো এই বন্দোবস্তের প্রাতিষ্ঠানিক রূপায়ণ - সংবিধান, আইন, নীতিমালা এবং সরকারি কাঠামো।
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বেশ কয়েকবার রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পরিবর্তন দেখেছে:
• ১৯৭২-৭৫: ক্যারিশম্যাটিক-পপুলিস্ট বন্দোবস্ত
• ১৯৭৫-৯০: সামরিক-কর্তৃত্ববাদী বন্দোবস্ত
• ১৯৯১-২০০৬: প্রতিযোগিতামূলক ক্লায়েন্টেলিস্ট বন্দোবস্ত
• ২০০৮-২০২ৄ: প্রভাবশালী দলীয় বন্দোবস্ত
কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রেই মূল রাজনৈতিক বিন্যাসের নিয়ামকগুলো অপরিবর্তিত থেকে গেছে।
২. রাজনৈতিক বিন্যাসের অপরিবর্তনীয় নিয়ামকসমূহ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিন্যাসকে আকার দেওয়া ছয়টি মূল নিয়ামক রয়েছে, যেগুলো ১৯৭৫ সালের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে কার্যকর রয়েছে:
২.১ হত্যাকাণ্ড, অভ্যুত্থান ও সামরিক হস্তক্ষেপ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতাকে একটি বৈধ উপায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এরপর থেকে প্রতিটি রাজনৈতিক পরিবর্তনে সহিংসতার ছাপ রয়েছে। জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানও এই ধারাবাহিকতারই অংশ।
২.২ সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকা
১৯৭৫ সালের পর থেকে সামরিক বাহিনী বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থান করছে। গণতান্ত্রিক যুগেও এটি 'কিংমেকার' হিসেবে কাজ করে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও সামরিক বাহিনীর সমর্থন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।
২.৩ আদর্শিক সংস্কার
ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ থেকে ধর্মভিত্তিক বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদে রূপান্তর। এই দ্বন্দ্ব এখনও সমাধান হয়নি এবং রাজনৈতিক মেরুকরণের মূল উৎস।
২.৪ বংশীয় রাজনীতি ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন
দুই পরিবারের মধ্যে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন। এই কাঠামো পরিবর্তনের কোনো স্পষ্ট ইঙ্গিত নেই।
২.৫ গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ
অস্তিত্বগত, শূন্য-সমষ্টি প্রতিযোগিতার প্রকৃতি। রাজনীতি এখনও 'আমরা বনাম ওরা' ধারণার উপর ভিত্তি করে।
২.৬ অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও ক্লায়েন্টেলিজম
রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে আনুগত্য কেনা এবং ক্ষমতা বজায় রাখা।
৩. নতুন বন্দোবস্তের সীমাবদ্ধতা
জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রতিনিধিত্ব করে। এই বন্দোবস্তে রয়েছে:
• সিভিল সোসাইটির নেতৃত্ব
• ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিত্ব
• সামরিক বাহিনীর নিরব সমর্থন
• ব্যবসায়ী শ্রেণীর সাবধানী অবস্থান
কিন্তু এই নতুন বন্দোবস্ত রাজনৈতিক বিন্যাসের মূল নিয়ামকগুলো পরিবর্তন করতে পারছে না:
৩.১ সামরিক বাহিনীর ভূমিকা অপরিবর্তিত
অন্তর্বর্তী সরকার সামরিক বাহিনীর সমর্থনের উপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভূমিকাকে আরও শক্তিশালী করেছে।
৩.২ ক্লায়েন্টেলিজমের ধারাবাহিকতা
নতুন সরকারও রাষ্ট্রীয় পদে নিজেদের সমর্থকদের নিয়োগ দিচ্ছে। আমলাতন্ত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হচ্ছে, যা ক্লায়েন্টেলিজমেরই নতুন রূপ।
৩.৩ আদর্শিক বিভাজনের গভীরতা
ধর্মনিরপেক্ষতা বনাম ইসলামি মূল্যবোধের দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয়েছে। এই বিভাজন সমাজে গভীর ফাটল সৃষ্টি করছে।
৩.৪ প্রতিশোধের রাজনীতি
পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিশোধমূলক কার্যক্রম চালানো হচ্ছে, যা রাজনৈতিক মেরুকরণকে আরও গভীর করছে।
৪. চক্রাকার প্রকৃতির পুনরাবৃত্তি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস দেখায় যে প্রতিটি নতুন বন্দোবস্ত একই চক্রাকার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে:
৪.১ প্রাথমিক উৎসাহ ও আশাবাদ
নতুন বন্দোবস্তের শুরুতে জনগণের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ ও প্রত্যাশা থাকে। বর্তমানেও একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
৪.২ ধীরে ধীরে হতাশা
যখন মূল কাঠামোগত সমস্যাগুলো অপরিবর্তিত থাকে, তখন জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে।
৪.৩ নতুন সংকট ও পতন
অবশেষে নতুন বন্দোবস্তও তার অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে ভেঙে পড়ে এবং আরেকটি সহিংস পরিবর্তনের পথ তৈরি হয়।
৫. জনগণের প্রত্যাশা বনাম বাস্তবতা
জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থানের পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল:
• গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের পুনরুজ্জীবন
• দুর্নীতি নির্মূল
• বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা
• মুক্ত গণমাধ্যম
• অর্থনৈতিক সুশাসন
কিন্তু বাস্তবতা হলো:
• সামরিক বাহিনীর প্রভাব বৃদ্ধি
• নতুন রূপে ক্লায়েন্টেলিজম
• আদর্শিক মেরুকরণের তীব্রতা
• প্রতিশোধের রাজনীতি
• অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা
৬. পথ-নির্ভরতার ফাঁদ
বাংলাদেশ 'পথ-নির্ভরতার' (Path Dependency) একটি ক্লাসিক উদাহরণ। ১৯৭৫ সালের সংকটকালীন ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ দেশকে একটি নির্দিষ্ট গতিপথে আবদ্ধ করেছে। এই গতিপথ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন:
৬.১ প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার
শুধু ব্যক্তি পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন গভীর প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার।
৬.২ সামরিক বাহিনীর রাজনীতিকরণ বন্ধ
সামরিক বাহিনীকে পেশাদার প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা।
৬.৩ আদর্শিক সমঝোতা
ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের মধ্যে একটি সমঝোতা।
৬.৪ বিকেন্দ্রীকরণ
ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানীয় সরকারের শক্তিশালীকরণ।
৬.৫ নিয়মতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা
ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার পরিবর্তে নীতি ও কর্মসূচিভিত্তিক রাজনীতি।
৭. উপসংহার: নিরাশাবাদী কিন্তু বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি
জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থান নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এটি দেশের তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক চেতনা ও সাংগঠনিক ক্ষমতার প্রমাণ। কিন্তু ইতিহাসের শিক্ষা ও রাজনৈতিক বিন্যাসের নিয়ামকগুলোর ধারাবাহিকতা বিবেচনা করলে বলতে হয় যে, এই অভ্যুত্থান থেকে জনগণের প্রত্যাশিত মৌলিক পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা সীমিত।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত হয়তো সাময়িক কিছু উন্নতি আনতে পারে, কিন্তু যতক্ষণ না রাজনৈতিক বিন্যাসের মূল নিয়ামকগুলো পরিবর্তিত হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কাঠামোগত পরিবর্তন আশা করা অবাস্তব। ফলে জনগণের প্রত্যাশা ও বাস্তবতার মধ্যে যে ব্যবধান, তা সময়ের সাথে হতাশায় রূপ নেবে এবং পরবর্তী রাজনৈতিক অস্থিরতার বীজ বপন করবে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী, ধৈর্যশীল এবং ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার - যা কোনো একক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের পক্ষে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐকমত্য, ধারাবাহিক প্রচেষ্টা এবং সর্বোপরি রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি। যতদিন এই পূর্বশর্তগুলো পূরণ না হচ্ছে, ততদিন বাংলাদেশ একই চক্রাকার প্রক্রিয়ার মধ্যে আবদ্ধ থাকবে এবং জনগণের প্রত্যাশা বার বার ভেঙে চুরমার হতে থাকবে।
©somewhere in net ltd.