![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
অধ্যাপক, কোবে গাকুইন বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে তৌহিদী জনতার প্যানেল থেকে সহসভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও সহকারী সাধারণ সম্পাদক পদে যারা জয়লাভ করেছেন, তারা সকলেই মাদ্রাসা শিক্ষার পটভূমি থেকে এসেছেন। এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তবে তাদের এই সাফল্যকে কেবল ব্যক্তিগত অর্জন হিসেবে দেখলে চলবে না। বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেরও জন্ম দেয়—যেহেতু তারা মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার ভেতর থেকে উঠে এসেছেন, তাই আলিয়া মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামী শিক্ষা, ধর্মীয় অনুশাসন এবং সামগ্রিক শিক্ষার যে দুরবস্থা ও সংকট বিরাজ করছে, তা জাতির সামনে প্রকাশ করার এখনই উপযুক্ত সময়।
মাদ্রাসাগুলোতে ইসলামের নামে যা শেখানো হয়, তা অনেক ক্ষেত্রেই কোরআন-সুন্নাহর বিশুদ্ধ জ্ঞানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। একটি সীমিত পরিসরে আবদ্ধ থেকে, সেকালের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে রচিত কিছু বইয়ের মাধ্যমে ধর্ম শেখানো হয়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তাফসির, ফিকহ ও হাদিস অধ্যয়নের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। আধুনিক বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যে সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি (critical thinking skills) এবং প্রাসঙ্গিক ধর্মীয় জ্ঞানের প্রয়োজন, তারা তা থেকে বঞ্চিত হয়। পরিণতিতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি সংকীর্ণ হয়ে পড়ে এবং তারা সহজেই কূপমণ্ডূকতার শিকার হয়।
ধর্মীয় অনুশাসন শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও গুরুতর অবহেলা ও বিকৃতি দেখা যায়। অনেক মাদ্রাসায় ধর্মের নামে এমন কিছু প্রথা চালু আছে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। যেমন—অন্ধভাবে কোনো একটি মাজহাব বা ব্যক্তিকে অনুসরণ করা, যা তাকলীদের নামে প্রচলিত হলেও, অনেক ক্ষেত্রে তা কোরআন-হাদিসের সরাসরি বিধানকে উপেক্ষা করার সামিল। এছাড়া, নারীর শিক্ষা, অন্যান্য ধর্মের প্রতি সম্মান এবং আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের সঙ্গে ধর্মের সমন্বয়—এসব বিষয় হয় উপেক্ষা করা হয়, নয়তো অত্যন্ত কঠোর ও সেকেলে মানসিকতায় পড়ানো হয়।
শিক্ষার সামগ্রিক মানের দিক থেকেও মাদ্রাসাগুলো পিছিয়ে আছে। দাখিল ও আলিম পর্যায়ে বিজ্ঞান, গণিত, ইংরেজি, বাংলা এবং সমাজবিজ্ঞান শিক্ষা অত্যন্ত অপ্রতুল ও নিম্নমানের। পাঠ্যক্রম বর্তমান সময়ের চাহিদা অনুযায়ী হালনাগাদ করা হয়নি। এর ফলে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা আধুনিক বিশ্বের পূর্ণাঙ্গ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজার ও উচ্চশিক্ষার সুযোগেও তারা পিছিয়ে পড়ে। এই শিক্ষাগত পশ্চাৎপদতা তাদের সামগ্রিক উন্নয়নের বড় বাধা।
এখন, ডাকসুর মতো একটি মর্যাদাপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে যারা মাদ্রাসা-শিক্ষিত প্রতিনিধি হিসেবে এসেছেন, তাদের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হলো এই সমস্যাগুলো জাতির সামনে তুলে ধরা। তারা নিজেরাই এই ব্যবস্থার ফল, তাই এর দুর্বলতাগুলো তারা প্রত্যক্ষভাবে জানেন। যদি তারা নীরব থাকে, তবে এটি শুধু ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়, বরং সেই লক্ষ লক্ষ মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে, যারা উন্নত ও আধুনিক শিক্ষার অধিকারী হওয়ার যোগ্য।
তাদের দাবি করা উচিত:
মাদ্রাসার পাঠ্যক্রমের সামগ্রিক সংস্কার, যাতে কোরআন-হাদিসের বিশুদ্ধ শিক্ষা, আধুনিক বিজ্ঞান, মানবিকবিদ্যা ও ভাষার একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমন্বয় ঘটে।
মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও যোগ্যতার উন্নয়ন, যাতে তারা শিক্ষার্থীদের হালনাগাদ ও ভারসাম্যপূর্ণ জ্ঞান দিতে পারেন।
অন্ধ অনুসরণের সংস্কৃতি পরিত্যাগ করে সমালোচনামূলক চিন্তা ও গবেষণার সংস্কৃতি চালু করা।
মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
যদি তারা তাদের অবস্থান ও প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এসব সংস্কারের পক্ষে প্রচারণা চালান, তবে তারাই প্রকৃত অর্থে দেশ ও ধর্মের সেবা করবেন। অন্যথায়, তাদের এই সাফল্য কেবল ব্যবস্থার আরেকটি সুবিধাভোগী শ্রেণি তৈরি করবে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন বয়ে আনবে না। জাতি এখন তাদের দিকে তাকিয়ে আছে—তারা কি পরিবর্তনের অগ্রদূত হবেন, নাকি আবারও একদল নীরব দর্শকে পরিণত হবেন?
©somewhere in net ltd.