নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুবাদ গল্প : কেরানির মহাপ্রয়াণ

১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ১০:৩৮

আচমকা সারামুখ কেঁপে উঠলো শেরভাখভের। গল্প, উপন্যাসে ‘আচমকা’ শব্দটির সাথে পাঠকেরা বেশ পরিচিত। গল্পের মোড় ঘোরাতে কিংবা পাঠককে পুলকিত করতে লেখকের এমন শব্দপ্রয়োগ কার্যকর বটে। লেখকেরা যথার্থই বলেন, জীবনে আচমকা মানেই ঘটন-অঘটনে পরিপূর্ণ।

ইভান দিমিত্রিচ শেরভাখভ তার পুরো নাম। সরকারি কেরানি। কোনো এক বিকালের শৈশবাবসান তাকে যাত্রা দেখার টান ধরিয়ে ছিলো। মুনোমুগ্ধকর সন্ধ্যা। এমন একটি সন্ধ্যার জন্যই কবি-সাহিত্যিকরা অপেক্ষায় থাকে যুগ যুগ। স্টেডিয়ামের খোলা আকাশে যাত্রার মঞ্চ। তারকাহীন নীল আঁধারে ইয়া বড় চাঁদটাও মঞ্চের শোভা বাড়িয়েছে দ্বিগুণ। চারিদিকে উজ্জ্বল চন্দ্রবলয়। দ্বিতীয় সাড়িতে বসে যাত্রা দেখছিলো শেরভাখভ। প্রথম সাড়িতে বসেছে সরকারি উচ্চপদস্থ লোকেরা। সে তো নিতান্তই কেরানি। দ্বিতীয় বা আরো পরের সাড়িতে এদের অবস্থান।

আচমকা মুখ কেঁপে ওঠার সাথে চোখটাও বুজে ফেলল শেরভাখভ। নিঃশাস থমকে গেল। অপেরা গ্লাস চোখের সামনে থেকে সরিয়ে খানিকটা অধবদন হতে না হতেই হ্যাঁচ্চোঁ দিয়ে উঠলো। বেসামাল হাঁচিটাকে আর ধরে রাখতে পারলো না। যেখানে সেখানে হাঁচি দেয়াটা অপরাধ নয়। সবাই হাঁচি দেয়, প্রাইভি কাউন্সিলারের লোকেরা দেয়, পুলিশ কর্মকর্তারা দেয়, চোর বেচারাও বেসময়ে বেসামাল হাঁচির জন্য জেলহাজত খাটে; বাধে পুলিশের সাথে অহি-নকুলী দ্বন্দ্ব। কমবেশি সব লোকেই না বলে কয়ে আসা এ হাঁচিটার কাছে পরাস্ত। শেরভাখভও এর ব্যতিক্রম নয়।

বুকপকেট থেকে রুমাল বের করে সারামুখ মুছে ফেললো সে। নিতান্ত ভদ্রতাসূলভ একবার এদিকসেদিক তাকিয়েও নিলো; এমন অযাচিত কাজে কারোর বিরক্তি ঘটেছে কিনা দেখে নিলো। দেখলো, সামনের সাড়িতে বসে থাকা প্রবীণ ভদ্রলোক তার গ্লাভস দিয়ে সন্তর্পণে নিজের টেকোমাথা আর ঘাড় সাফ করছেন। সেই সাথে বিড় বিড় করছেন নিজে নিজে। তেলেমাথায় শরোদিন্দু রচিত হচ্ছিলো তার চকমকি টেকোতে। অবিরল রঙের ধারায় মোলায়েম টেকোমাথার প্রতিফলিত আলো ছিটকে পড়ছিলো শেরভাখভের মুখে। এরই মধ্যে তিনি আবার মাথায় হাত বুলিয়ে সুযোগে পেছনের বাবরি চুল সামনে টেনে নিলেন।

ভদ্রলোককে চিনতে কষ্ট হলো না শেরভাখভের। ব্রিজালহভ তার নাম। যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের একজন সিভিল জেনারেল তিনি। শেরভাখভের ভ্রম হলো। ‘ভদ্রলোকের গায়ে থুতু ছিটালাম! যদিও তিনি আমার মন্ত্রণালয়ের হেড নন, তবুও এমনটি করা মোটেই ভদ্র্রোচিত হয় নি। তার কাছে আমার ক্ষমা চেয়ে নেয়া উচিত।’ ভাবলো সে।

একবার কেশে নিলো শেরভাখভ। কী যেন ভাবলো। আবারো কাশিচ্ছলে গলাটা পরিস্কার করে নিলো। তারপর পুরো শরীরখানা ঝুকিয়ে দিলো সামনে। জেনারেলের কানে ফিশফিশিয়ে বললো, ‘সরি স্যার, আমার অনিচ্ছায়...’

: ‘ইটস ওকে। নো প্রবলেম। আমি বুঝতে পেরেছি।’
: ‘প্লিজ, আমি বুঝতে পারি নি স্যার। আমায় ক্ষমা করবেন।’
: ‘আহা। হয়েছে। এখন বসো। যাত্রা দেখতে দাও।’

লজ্জা পেলো শেরভাখভ। অনুতপ্ত সে। নিজের অজান্তেই বোকার মতো একবার হাসলো। তারপর মঞ্চের দিকে ফ্যা ফ্যা করে চেয়ে থাকলো। শুধু চেয়েই থাকলো; দেখছিলো না কিছুই। মন থেকে যাত্রার বিনোদন উধাও গিয়েছিলো। মাথায় কেবল তার শরীরে থুতু দেয়ার ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। একটা অস্বস্তিবোধ হতে লাগলো মনে। বিরতির ফাঁকে ব্রিজালহভের কাছে গেলো। দাঁড়ালো ঠিক তার পাশে। লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেললো আবার, ‘স্যার, কাজটা আচমকা হয়ে গেছে। একেবারে বেসামাল হয়ে পড়েছিলাম। দেখেন স্যার, আমি আসলেই...’

: ‘ওহ! যথেষ্ট হয়েছে। আমি ওসব ভুলে গেছি। এবার ওগুলো ছাড়ো তো!’। অধৈর্য্য ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন জেনারেল।
: ‘তিনি বললেন সব ভুলে গেছেন তাহলে তার চোখে যে রাগ দেখলাম, সেটা কিসের?’ আড়চোখে জেনারেলের দিকে চেয়ে কথাগুলো মিনমিনিয়ে বললো শেরভাখভ।
: ‘বুঝেছি। তিনি এখন আমার সাথে কথাও বলতে চাইছেন না। প্রচণ্ড রেগে আছে বোধহয়। ব্যাপারটা খুল্লমখোলা বলে দেয়া দরকার যে, আমি ওটা ইচ্ছে করে করি নি। তা নাহলে আমাকে তিনি ভুল বুঝতে পারেন। যদিও এখন মুখে বলছেন না; কিন্তু পরে ঠিকই বাজে ভাববেন আমাকে।’ বাড়িতে ফিরতে ফিরতে কথাগুলো ভাবছিলো শেরভাখভ।

বাড়িতে গিয়ে বউকে ঘটনার আদ্যোপান্ত জানালো সে। শুনে ঘটনা উড়িয়ে দিলো বউ। এতে খানিকটা ক্ষুণ্ন শেরভাখভ। ইতিমধ্যে বউ জানতে পেরেছে, ভদ্রলোকটি অন্য মন্ত্রণালয়ের। তাই সে একটু নিশ্চিত। অন্তত চাকুরি যাওয়া নিয়ে কোনো ভয় নেই। আবার একেবারে ভয়শূন্যও নয়। কারণ ভদ্রলোকটিকে সে চেনে।

: ‘তারচে’ বরং তুমি আরেকবার ওনার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ো। না হলে তোমাকে অভদ্র ভাবতে পারেন।’ বলল বউ।
: ‘হ্যাঁ। সেটাই ঢের ভালো। আমি কিন্তু একবার ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনি ব্যাপারটাকে ভালোভাবে নেন নি; আমাকে বেয়াদব ভেবেছেন মনে হলো। রাগে তেমন কিছু বলেনও নি। অবশ্য বলার মতো সময়ও ছিলো না তখন।’

পরদিন সকালে শেরভাখভ দাড়িমোঁচ কামালো; কুঁকড়ে থাকা চুলগুলো সামান্য কেটে সোজা করলো মেশিনে। বউ নতুন ইউনিফর্ম এনে পরিয়ে দিলো। বেশ পরিপাটি বলা চলে। ক্ষমা চাওয়ার তাগিদে আজ অফিসে গেলো ব্রিজালভের। সোজা গিয়ে উঠল জেনারেলের রিসেপশন রুমে। রুমে কয়েকজন লোক তন্মধ্যে জেনারেল নিজেও আছেন। ছোটখাটো ধরনের একটা মিটিং হচ্ছিলো বললে অত্যুক্তি হবে না। জেনারেল পিটিশনারের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত। বেশ কিছুক্ষণ পর জেনারেলের মনে হলো কেউ শিয়রে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে দেখতে পেলেন শেরভাখভকে।

: ‘গতকাল আর্কাদিয়ায়। ওই যে যাত্রানুষ্ঠানে...’ এ পর্যন্ত বলতেই জেনারেল একবার ভ্রু কুঞ্চিত করলেন। ‘আপনি যদি কিছু মনে না করেন স্যার, আমি কিন্তু হাঁচি দিয়েছিলাম অনিচ্ছায়...।’ কথা শেষ হতে না হতে অঁ-অ্যাঁ শুরু করে দিলো শেরভাখভ।
: ‘আজিব লোক তো! এসবের মানে কি?’ বললেন জেনারেল। তারপর অন্য পিটিশনারের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলুন আপনার জন্য আমি কী করতে পারি?’
: ‘তিনি হয়তো তার সাথে আর কথাই বলবেন না।’ ভাবলো শেরভাখভ। মুখখানা পাংশুটে হয়ে গেলো।
: ‘তার মানে তিনি এখনো চটে আছেন! নাহ! এভাবে হবে না। ঘটনাটা ব্যাখ্যা করে বলতেই হবে।’ আবারো ভাবলো শেরভাখভ।

পিটিশনারের সাথে মিটিং শেষ করে জেনারেল ভেতরে যেতে উদ্যত হলেন। শেরভাখভ লম্বা পা ছুটে তার দিকে গেলো।
: ‘স্যার, আপনি বারবার বিরক্ত হচ্ছেন। তবে আমি নিতান্তই দুঃখিত যে, ওটা আমি ইচ্ছে করে করি নি। মাইরি স্যার! বিশ্বাস করুন।’ প্রচণ্ড বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠলো জেনারেলের মুখে। দীঘল মুখখানা কুঁচকে আস্ত একটা নিতম্বরূপ নিলো। রাগে, ক্ষোভে এবার হাত নাড়লেন তিনি।
: ‘কেন তামাশা করছেন বলুন তো? দুনিয়ার এত মানুষ থাকতে আমাকেই কেন নায়ক বানাতে ইচ্ছে করলো আপনার?’ শেরভাখভের মুখের ওপর দরজাটা ধপাশ করে লাগিয়ে দিতে দিতে বললেন জেনারেল।
: ‘তামাশা? তামাশা কখন করলাম? তিনি একজন জেনারেল। তিনি কোথায় আর আমি কোথায়? উফ! একটুও বুঝলো না আমাকে!’ মনে মনে কথাগুলো আউড়াতে থাকলো শেরভাখত।
: ‘যাকগে, এরকমই যখন করলেন তাহলে ক্ষমা চেয়ে আর কাম নেই; বরং কালকে একটা চিঠিই লিখে দিবো। আমার যাওয়াটা আর উচিত হবে না। তাছাড়া আমি নিজেও তো আর যাবো না।’ খানিকটা অপমানে এসবই ভাবছিলো শেরভাখত।

চিঠি লিখতে বসেছে সে। কিন্তু লিখলো ছাই। শুধুই ভাবলো। ভাবনার অতল গহ্বরে গিয়ে এক চুমুক অবগাহন করে এলো শুধু। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলো, কাল নিজেই সরাসরি গিয়ে বলবে সব।

: ‘স্যার, গত দুই দিন আপনাকে খুব বিরক্ত করছি। বলল শেরভাখভ। কৌতুহল আর সীমাহীন বিরক্তভরা দৃষ্টিতে জেনারেল শুধু তাকিয়ে দেখছিলেন তাকে।
: ‘আপনি বললেন আমি নাকি তামাশা করছি! ব্যাপারটা মোটেই এমন নয় স্যার। আপনার ওপর হাঁচি দেয়ার কারণে আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত... কিন্তু তামাশা? সেটা আমি ভাবতেও পারি না। একদিন আপনি সুপারিশ দিয়েছিলেন বলে আজ আমি সরকারি কেরানি। সেই আপনার সাথে কোন সাহসে তামাশা করতে পারি? ভুলেও তামাশা করে স্বার্থপর হতে চাই না। তামাশা করা তো ভালো কাজ নয় স্যার...।’ কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে ফেললো শেরভাখভ।
: ‘দূর হও।’ জেনারেলের চিৎকারে গাছের মগডালে থাকা দুটি পাখি উড়ে গেলো।
: ‘কী?’ সীমাহীন ভয়ার্ত আর আতঙ্কগ্রস্থের মতো জিজ্ঞেস করলো শেরভাখভ।
: ‘দূর হও।’ আবারো চেঁচিয়ে উঠলেন জেনারেল।

এবার কোনো পাখি উড়লো না। পেটের মধ্যে কিসে যেন একটা মোচড় দিয়ে উঠলো শেরভাখভের। শুনশান নগরী মনে হচ্ছিলো একটা। নিরব, নিস্তব্ধ। অখণ্ড নিরবতার মাঝে আর কিছুই বোধগম্য হচ্ছিলো না তার। ধীরে ধীরে দরজা ঠেলে রাস্তায় নেমে আসলো। যন্ত্রের মতো হেঁটে চললো রাস্তা। অনেক কষ্টের পথ মাড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছলো। ইউনিফর্ম না খুলেই শুয়ে পড়লো সোফায়। তখন সব কিছু নিস্প্রভ হয়ে পড়লো; বর্ণহীন হয়ে ওঠলো... মারা গেলো শেরভাখভ।


------------------------------------------------
মূল গল্প : the death of a government clerk
মূল লেখক : আন্তন শেখভ। খ্যাতনামা রুশ সাহিত্যিক।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই এপ্রিল, ২০১৫ দুপুর ১:৫৩

বিএম বরকতউল্লাহ বলেছেন: অসাধারণ গল্প ও এর অনুবাদ। ধন্যবাদ নিন।

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৫ সকাল ৭:১৩

রিদওয়ান হাসান বলেছেন: আপনিও ধন্যবাদ নিন। ভালো থাকুন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.