নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দর্শনের আশায় পথ চলি...

রিদওয়ান হাসান

শুধু একদিন ভালোবাসা, মৃত্যু যে তারপর... যদি তা-ও পাই, আমি তা-ই চাই, চাই না বাঁচতে আমি প্রেমহীন হাজার বছর।

রিদওয়ান হাসান › বিস্তারিত পোস্টঃ

মন্দের দৃশ্যায়ন, হিন্দি চ্যানেল ও তার অনুচরদের নেতিবাচক আগ্রাসন

২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:১০


০১.
জমকালো এক লাইভ অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে হাজারো দর্শকের হাততালি ভেদ করে ছুটে আসলো কয়েকটি কথা। কথাটা শোনামাত্রই দর্শকদের মাঝে আনন্দের ঢেউ খেলে গেল। কিছু কিছু অভিনেত্রী ও মহিলা দর্শকের চুম্বুকাংশগুলোও টিভিস্ক্রীনে ধরা পড়ল সহজেই। অনেকটা সাড়ম্বরভাবেই বরণ করে নিল মঞ্চপরিচালক সেই কথাগুলো। প্রথমে সামান্য ইতস্ততবোধ করেছিল হয়ত। যার কারণে ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমসহ ঈশান কোণ থেকে শুরু করে মোটে তিন-চারবার ক্যামেরা ধীরগতিতে সে দৃশ্যটি ধারণ করেছিল। কিন্তু পরক্ষণেই সহজ হয়ে মঞ্চপরিচালক মুখে মুক্তার দানা ছড়াল। পরিস্থিতি হালকা করার জন্য সে কথাটি পরিচালক নিজেও একবার জাবর কাটল অন্যান্য ‘নান্দনিক’ শব্দের ইন্দ্রজালে।
ব্যাপারটা আরেকটু খুল্লমখোলা করা দরকার। অনুষ্ঠানটি সে বছর পরিচালনা করেছিল নামকরা এক অভিনেতা। ভারতীয় অভিনেতা। পরিতাপের বিষয় ছিল সে বছর নামী-বেনামী, নবীন-প্রবীণদের প্রায় প্রত্যেকেই অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। শুধু ভাগ্যের চাকা ঘুড়েনি মঞ্চপরিচালক সেই অভিনেতার। নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর অ্যাওয়ার্ড দিতে মনোনয়নপত্র পাঠের জন্য ডাকা হল আরেক সুদর্শনা অভিনেত্রীকে। সঙ্গতকারণে এখানে তার রূপের বর্ণনা নিস্প্রয়োজন। বলাবাহুল্য যে, সেই অভিনেত্রীও একটু আগে একটি অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। খুবসম্ভবত এবারেই তার প্রথম অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্তি। তাই মঞ্চপরিচালক মুখে কৌতুকের হাসি ছড়িয়ে বলল, কি ব্যাপার! অ্যাওয়ার্ড জিতে বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে, তাহলে আমার সাথে অভিনয় করে কবে আমাকে অ্যাওয়ার্ডের মুখ দেখাবে?
অভিনেত্রী উত্তরে যেটা বলল তার জন্য হয়ত পরিচালক প্রস্তুত ছিল না। আর একথাটিই এ প্রবন্ধের বিশেষ উপাত্ত। সেই অভিনেত্রী অত্যন্ত সহজভাবে বলেছিল, তুমি নিজেই তো একটা অ্যাওয়ার্ড। শুনে মুহূর্তেই কেঁপে উঠল দর্শকের ঠোঁট। ছন্দ তুলল হাতের তালু। মঞ্চপরিচালক সেই অভিনেতা এবার মুখ বেজার করে বলে, হুম! এমনি অ্যাওয়ার্ড আমি, যে কেউ আমাকে ঘরে তুলতে চায় না। এখানেই ফেলে চলে যায়। নিমিষেই হতভম্ব দর্শকের টিমটিমে প্রদীপের মুখখানা মেঘগলানো চাঁদের মতো ফুটি ফুটি করে উঠল।
এটি একটি দৃশ্য, ফিল্মিভাষায় শট। অনিচ্ছাসত্ত্বেও অপ্রাসঙ্গিকভাবে এ কল্পকাহিনীর দৃশ্যায়ন আমাকে করতে হল। এ বিষয়টি বোঝানোর জন্য যে, এ দৃশ্যে না আছে কারোর বাস্তব রূপরেখা, না বিশেষ কোনো ভূমিকা। তবুও এটি জনমনে প্রভাব ফেলতে সক্ষম। অনেকেই হয়ত এতক্ষণে নিজেদের মধ্যে দৃশ্যটির বাস্তবতা কল্পনা করে ফেলেছেন। হয়ত কারোর চোখে কল্পিত এ দৃশ্যটি ভেসে বেরাচ্ছে অথবা অদেখা অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং হাজারো দর্শকম-লীর ছবি নিজেদের মধ্যে কু-ুলী পাকাচ্ছে। নিজ নিজ পছন্দমাফিক লোকদের কখনো নায়কের ভূমিকায় বা কখনো দর্শকের কিংবা খোদ নিজেই নায়িকা হতে অপরাধ কিসে? এখানে আছে অফুরন্ত সময়। নেই ধরাবাধা কোনো নিয়ম। কল্পনার রাজ্যে কারোর অধিকার চলে না। যেমন আমি নিজেই দৃশ্যটি ধারণ করে লেখার মধ্যে জীবন্ত রূপ দিয়েছি। কতটুকু এটির বাস্তবতার তা জানি না। ঠিক তেমনি সকলের মধ্যে এ দৃশ্যটির বিভিন্ন রঙ-রূপ-রেখা পরিস্ফুটিত। কারোর সঙ্গে কারো মিল নেই বা হতেই পারে কাকতালীয় কোনো মিল।
মনোবিজ্ঞানের এই সূত্র আমি শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের ওপর প্রয়োগ করে থাকি। কোনো বিষয়ের সবক দিতে গিয়ে আমি বরাবরই দৃশ্যায়নের দ্বারস্থ হই। কারণ মনোবিজ্ঞানের সূত্রানুসারে যে বিষয় সম্পর্কে মানুষ নিজের চিন্তা-শক্তি ও মেধা ব্যবহার করে, তা মানসপটে এমনভাবে গেঁথে যায় যে, ভোলা কঠিন। সে নিমিত্তে কোনো কিছুর দৃশ্যায়ন মন্দ হলে এমনিতেই মানুষের মস্তিস্কে চাপ তৈরি করে। নেতিবাচক ভাবনার জালে জড়িয়ে যায় তার চিন্তন প্রক্রিয়া। ফলে আক্রান্ত হয় আবেগ। আর আবেগের ঘুর্ণি থেকে ফুঁসে ওঠে অপরাধপ্রবণতা। আর এ প্রবণতার কারণে আচরণে যেমন পড়ে নেগেটিভ ছাপ, দেহেও জাগাতে পারে নানা উপসর্গ। তখন নেতিবাচক গোলকধাঁধায় আটকে যায় মানুষের মননশীলতা।
বর্তমান চ্যানেলগুলোর সাথে মনোবিজ্ঞানের দৃশ্যায়ননীতির ঠিক কোথায় মিল, এবার সে কথায় আসা যাক। হিন্দি চ্যানেল বা অন্যসব গোত্রীয় চ্যানেলগুলো দৈনন্দিন আমাদের চোখের ক্ষুধা নিবারণ করে। এর সাথে মনের কী সম্পর্ক, তা একটা ঘটনা দিয়ে বলার প্রয়াস পাব। ঘটনাটি সংক্ষেপে এমন: এক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন দেশবরেণ্য ব্যক্তিবর্গ। অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা দেয়া হবে দেশের অগ্রগণ্য তিন মনোচিকিৎসককে। যাদের মধ্যে একজনের স্বামী ছিলেন সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক। স্ক্রেচ হাতে তুলে দেয়ার প্রাক্কালে স্বামীসহ উপস্থিত হয়েছেন আনোয়ারা সৈয়দ হক। একপর্যায়ে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেয়ার জন্য ডাক পড়ল সৈয়দ হকের। কবি মঞ্চে উঠে বিনয়ের সাথে বললেন, ‘এ সমাবেশে আমি বেমানান...। আমি লেখক মানুষ, কাব্য-সাহিত্যচর্চা আমার ধ্যান-জ্ঞান ইত্যাদি।’
সৈয়দ হকের কথাটি মানতে পারল না অনুষ্ঠানে উপস্থিত এক মনোচিকিৎসক। তার খুবই বলতে ইচ্ছে করছিল, স্যার আপনি যে শব্দের পর শব্দ গেঁথে চাষ করে চলেছেন কাব্যমালা। মস্তিস্কের গোপন চালে আপনার যে শব্দের স্ফূরণ, রোমাঞ্চকর ক্ষুরধার চিন্তন, সিদ্ধান্ত নেয়া কিংবা সমস্যার জট তৈরি ও তা থেকে বেরিয়ে আসার সুকৌশলী ক্ষমতা, অর্থপূর্ণ উপলব্ধি এবং চরিত্র সৃষ্টির নিপুণতা- এসব কোত্থেকে পেয়েছেন? এগুলো কি শুধুই হাতের ঘুর্ণন, কলমের চালনা বা কী-বোর্ডে আঙ্গুলের চাপ? না। মোটেই না। কারণ মেধা-প্রতিভা মূলত মনেরই একটি বিশেষায়িত অঙ্গ বা উপাদান। আর এ মেধা-প্রতিভা বা মনের গোপন চালেই হয়ে ওঠে একেকটি কবিতা ও তার দৃশ্যায়ন। এ কারণে মানুষ দৃশ্যায়নের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে। খুব সহজে মনের মেমোরিতে সযতেœ রেখে দেয় অটুট ও অম্লান স্মৃতি।

০২.
মনোবিজ্ঞানের দৃশ্যায়ননীতির এ বিশদ আলোচনার প্রধানতম কারণ হলো, ভালো ও মন্দের মধ্য থেকে একটি ভালো আরেকটি মন্দ নির্ণয় করা যেতে পারে। কিন্তু দুটি ভালোর মাঝে একটি ভালো এবং দুটি মন্দের মাঝে একটি মন্দ নির্ণয় করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি অভিনেত্রীর সেই পিণ্ডি চটকানো কথাটি স্মরণ করাবো। যে বলেছিল ‘তুমি নিজেই তো একটা অ্যাওয়ার্ড’।
এখন কেউ যদি বলে, এসব অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান শুধু সময় ক্ষেপন মাত্র। তখন আমিও অভিনেত্রীর মতো করে বলব, যেসবের কারণে অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয় সেসবই তো সময় ক্ষেপন আর অযথা অর্থ ব্যয় ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই যেখানে চ্যানেলগুলোই সাক্ষাৎ মন্দ, সেখানে শুধু হিন্দি চ্যানেলের মন্দ বলে অন্য চ্যানেলকে কিভাবে ভালো বলব? কারণ অনেকগুলো মন্দের মধ্য থেকে একটি মন্দকে নির্ণয় করা তো সহজ নয়। সেমতে শুধু হিন্দি চ্যানেলই যে সমাজের জন্য ক্ষতিকর ও চেতনা-বিধ্বংসী তা নয়। বরং এ জাতীয় মন্দ দৃশ্যায়নের যত গোত্রীয় চ্যানেল রয়েছে- সবই মন্দ। হোক তা বলিউড, টলিউড বা হলিউড কিংবা ঢালিউড। তবুও তুলনামূলক মন্দের মন্দ এবং ভালোর ভালো নির্ণয় করা যেতে পারে। আর এ কারণেই আমি এ প্রবন্ধে অনুচরদের কাহিনী জুড়ে দিয়েছি। যেহেতু হিন্দি চ্যানেল সম্পর্কে আমার খুব বেশি ধারণা নেই। এ বিষয়ে লিখতে হলে আমাকে হিন্দি চ্যানেল দেখতে হবে, জানতে হবে- এটাও সম্ভব নয়। তাই মনোবিজ্ঞানের সূত্র ধরে মন্দ দৃশ্যায়নের খারাবি বর্ণনা করেছি। যাতে শুধু হিন্দি চ্যানেলকে খারাপ বলে ‘প্রসেস অব এলিমিনেশন’ (বস্তুর মন্দ দিক অতিক্রম করে ভালো দিকে পৌঁছানো)-এর ভিত্তিতে অন্য গোত্রীয় চ্যানেলকে ‘পবিত্র’ ভাবার ভুলটা কেউ না করে।
মন্দ দৃশ্যায়ন মানুষের মধ্যে মন্দ প্রভাব বিস্তার করে- একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও এর প্রতি মানুষের আকর্ষণ স্বভাবগত। কারণ নিষিদ্ধ বস্তুর প্রতি মানুষের মন একটু বেশিই প্রলুব্ধ হয়ে থাকে। তবে এই অযাচিত আকর্ষণ যে একপর্যায়ে মনের রোগ ও বদ অভ্যাসে রূপান্তর হয় সে ভয়াবহ পরিণতির কথা কেউ ভাবে না। ইসলামি শরিয়াহমতে এসব মন্দ দৃশ্যায়ন চাই প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষ- এগুলো মানুষের স্বভাব, মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারায় বহুবিধ নেতিবাচক প্রভাব পড়ার কারণে তা স্বমূলে হারাম করে দেয়া হয়েছে।
প্রত্যক্ষ মন্দ দৃশ্যায়নের চেয়ে মারাত্মক ক্ষতিকর হলো পরোক্ষ মন্দ দৃশ্যায়ন। যা চোখে দেখা যায় না কিন্তু মেধার অপচয় করে অনুভব করে নিতে হয়। যেমন, বই-পুস্তকে রচিত মন্দ চরিত্রায়ন বা দৃশ্যায়ন। এ সমাজে ইসলামিক জীবন গঠনমূলক উপন্যাস যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে উঠল তখন তথাকথিত ইসলামি ঔপন্যাসিকদের মন্দ চরিত্রায়ন ও দৃশ্যায়নসম্বলিত উপন্যাস ও গল্প সংকলনগুলো রাতারাতি তাদের পকেট আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ করতে লাগল। আর এ মোহে নিমজ্জিত হয়ে ইন্টারনেটের মাগনাদুনিয়া ও দৈনিক পত্রিকার হট কেক ঘটনাগুলো কপি-পেস্ট করে বিকৃত চরিত্রায়ন করে পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে লাগল কতিপয় তরুণ লেখকরা।
এ ব্যাপারে এক লেখকের সাথে আমার কথা হয়েছিল। বাজারে তার কয়েকটি বইয়ের ‘সিরিজ’ রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা থেকে পাওয়া প্রেম, ধর্ষণ, চুরিসহ নানা অপকর্মের বিস্তারিত বিবরণ। সেগুলোকে তিনি খুব সুন্দর করে মনোজ্ঞ ভাষায় দৃশ্যায়ন করেছেন। এসব দ্বারা পাঠকের মনে কী প্রভাব পড়তে পারে, এ নিয়ে তার চিন্তা নেই। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, তার এক বইয়ের একটি ঘটনা হুবহু আরেকজনের করা বাংলা অনুবাদ। সরাসরি তা নিজের নামে চালিয়ে দিয়েছে। তার সাথে আলোচনাকালে তিনি আমাকে বলেছিল, ‘মানুষের মনের কুচিন্তা বা মন্দ বাসনা যতক্ষণ না সে বাস্তবায়ন করে, ততক্ষণ তার আমলনামায় তা লেখা হয় না...।’
বাহ! সার্থসিদ্ধির জন্য ইসলামের কি ‘চমৎকার’ ব্যবহার! তার কথা শুনে বিস্ময়ে সেদিন আমার চোখ কপালে উঠেছিল। পরে আমি তাকে শুধু এতটুকুই বলেছিলাম, ‘মনের ভালো চিন্তা বা বাসনা যদি কেউ পূরণ না-ও করে, তবুও চেষ্টার ফলে সেটা তার পূণ্যের খাতায় লিপিবদ্ধ হয়ে থাকে। এখন আপনি মন্দ দৃশ্যায়নের পরিবর্তে যদি ভালো দৃশ্যায়ন করতেন, এর ফলে তার অন্তকরণে কুচিন্তার বদলে ভালো চিন্তা আসত। তখন এর সওয়াব তার আমলনামার পাশাপাশি আপনার আমলেও সদকায়ে জারিয়া হিসেবে আসতে থাকত।’ সত্যি বলতে কি, এসব লেখকদের বই পড়লে জনৈক কবির বাণী আমাকে প্রবলভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়―ভালো লেখা বা মন্দ লেখা দুটোই মানুষকে শেখায়। আর মন্দ লেখা মানুষকে বেশি শেখায় যে, এর জন্মদাতা কতইনা নিকৃষ্টতর লেখক।
যাই হোক, এসব মন্দ চরিত্রায়ন বা দৃশ্যায়নসম্বলিত উপন্যাসও হিন্দি চ্যানেল এবং চরিত্রবিধ্বংসীদের অনুচর। এসব পরোক্ষ দৃশ্যায়ন বর্তমান তরুণ সমাজের মেধাকে একেবারে ভোঁতা করে রেখেছে। ফলে মানসিক বিকারগ্রস্ত এবং দৈহিক নানা উপসর্গ আজ জোকের মতোই জেঁকে বসেছে। সাম্প্রতিক এদেশের প্রচলিত এফ.এমগুলোতেও এসব পরোক্ষ দৃশ্যায়নের প্রভাব পড়েছে। সেখানে অনেকে তার জীবনের কাহিনী, ভালোবাসা, হতাশা ও নানা অপরাধের কথা অকপটে স্বীকার করে যায়। এতেও রয়েছে মন্দ চরিত্রায়ন। তবুও সেই চরিত্রের নায়ক বা নায়িকাকে আইনের আওতায় আনা হয় না। ভাবখানা এমন যে, মুখে হাজার অপরাধের কথা স্বীকার করে নিলেই বেকসুর খালাস! কিছুদিন আগে কথিত এক আলেমকে দিয়ে অভিনয় করিয়েছিল তাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রে। বোঝার হয়ত বাকি নেই কেন আলেমকে দিয়ে মন্দের দৃশ্যায়ন করা? কারণ তারা ইসলামের সুমহান আদর্শ নিচু করতে পারলেই বাঁচে। এজন্যই সিনেমা, কল্পকাহিনী, বই-পুস্তক বা এফ.এমগুলোতে টেরোরিস্ট বলতেই চিত্রায়ন করা হয় শুধু দাঁড়ি-টুপিওয়ালা লোকদের। তারপরও কুলাঙ্গার থাকতে পারে হিসেবে মেনে নিলাম সেই কথিত আলেম অপরাধ করেছে। তাহলে একটার পর একটা অপরাধ করে যাওয়া সত্ত্বেও কেন তাকে শাস্তির বেগ পোহাতে হয়নি? অথচ এফ.এম-এ যখন সে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিচ্ছিল তখন প্রশাসনের টনক কেন নড়েনি? বুঝতে দেরি হওয়ার কথা নয়, আসলে এগুলোর বাস্তবতা সিনেমার মতোই। সিনেমাতে কতশত খুন-খারাবি আর অনৈতিক কাজে মেতে ওঠে অভিনেতারা। গল্পের তাগিদে অভিনেত্রীও অনেক সময় মরিয়া হয়ে ওঠে। খলনায়কের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে এগুলোর কোনো বিচার হয় কি?

০৩.
এবার আসা যাক মূল গল্পে। নির্ণয় করা যাক তুলনামূলক মন্দের মন্দ এবং ভালোর ভালো। এদেশের জন্য হিন্দি চ্যানেলকে বলা যেতে পারে সব নষ্টের মূল। কারণ ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো যে আমাদের অনেক ক্ষতি করছে- এ ব্যাপারে কারোর দ্বিমত নেই। এসব হিন্দি চ্যানেলের অবাধ প্রচারণা আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক অঙ্গনকে প্রভূত আঘাত হানছে। বাংলা চ্যানেল বা অন্যসব গোত্রীয় চ্যানেল যে আমাদের ক্ষতি করছে না, তা নয়। হোক বাংলা, ইংলিশ বা হিন্দি- যেখানেই মন্দের দৃশ্যায়ন ও তার চর্চা হবে তা আমাদের বর্জন করাই শ্রেয়। এর কারণ উপরে ইতিবৃত্ত হয়েছে।
একটি জাতিকে ধ্বংস করতে হলে প্রথমে সে জাতির চেতনা ও স্বকীয়তাকে ধ্বংস করতে হয়। এ কারণে পাকিস্তানি আমলে পাক-সরকার প্রথমে আঘাত হেনেছিল বাংলা ভাষার ওপর। সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর পাকিস্তান বিভাজন হওয়ার আগপর্যন্ত তারা সে অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকেনি। কাজী নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, রবী ঠাকুর ও তাদের ভাষার ওপর লিখিত বই, গান সবকিছুর ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। আর এদেশের দেশপ্রেমিক মানুষ পাকিস্তানি কুটিল শাসকশ্রেণির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নিজস্ব চেতনা অব্যাহত রেখে তাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে চেতনা বিশ্বায়নের নামে বিদেশীদের আগ্রাসনের শিকার।
বর্তমানে হিন্দি ভাষায় ডাবিংকৃত যেসব কার্টুন কোমলমতি বাচ্চাদের মেধা বিকৃত করছে, তা অব্যাহত থাকলে এদেশের বাচ্চারা এক সময় বাংলা ভাষাই ভুলে যেতে বসবে, হিন্দিই হবে তাদের মূল ভাষা। যদিও এক্ষেত্রে আমি একটু মুক্তচিন্তা করি। কোনো ভাষার শেখার বিপক্ষে আমি না। আর একথা আমি মনে-প্রাণে মানি, যে ব্যক্তি যত বেশি ভাষা জানবে তার মেধা তত বেশি ক্রিয়াশীল থাকবে। তবে বিপত্তিটা হলো, এসব ভাষা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে তা যেখানে সেখানে উদগীরণ করা। শুধু বাচ্চারা কেন, মা-মেয়ে ও গৃহবধূরা যে হারে হিন্দি চ্যানেল ও সিরিয়ালের ভক্ত, তা বলা মুশকিল। নিত্যদিনের কর্মের ফিরিস্তিতে হিন্দি চ্যানেল দেখার সময় তাদের থাকবেই। না দেখা নিয়ে আত্মহুতি দিতেও তাদের গায়ে বাধে না। ভাবখানা এমন যে, খোকা ঘুমাল, পাড়া জুড়াল, হিন্দি চ্যানেল এলো ঘরে।
সাধারণত মা-মেয়ে ও গৃহবধূরা হিন্দি সিরিয়াল দেখে পোষাকের কারণে। সারাক্ষণ সেজে থাকা, হিংসা, বিদ্বেষ, কূটনামী, পারিবারিক অশান্তি, বৌ-শাশুড়ির ক্যাচাল, ননদ-ভাবীর ঝগড়া, জায়ে-জায়ে চোখ রাঙানি, বড়লোকি মনোভাব, পরকীয়া আর অযথা সময় ক্ষেপন ও ত্যানাপ্যাঁচানি ছাড়া কিছুই নেই এসব সিরিয়ালগুলোতে। আর যেভাবে তারা ডলভি সাউন্ড দিয়ে স্লো মোশন বা চুইংগামের মতো টেনে বড় করে, আর পর্বের সমাপ্তি ঘটানো হয় এমন জায়গায়- যেন পরের পর্বটা আপনার না দেখলেই নয়। দুঃখের বিষয়, এসব হিন্দি সিরিয়ালের অনুকরণ করে বাজারে কেনার ধুম পড়ছে হিন্দি অভিনেত্রীদের নামের পোষাকগুলো। হতাশ লাগে যখন শুনি, সম্ভাবনাময় তরুণ প্রজন্ম এসব পোশাকের জন্য বায়না ধরছে। এমনকি কিনে না দিলে নিজের মূল্যবান জীবনটুকুও দিতে দ্বিধাবোধ করছে না। প্রতিনিয়ই তারা তাদের আচার-আচরণ, চলনে-বলন এবং পোশাক-পরিচ্ছদে হিন্দি রীতির প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। আর একাজটি তারা করছে অত্যন্ত উৎসাহে এবং এর পরিণতি সম্পর্কে সম্যক কোনো ধারণা ছাড়াই। কারণ হিন্দি চ্যানেলের অনুকরণ ও অনুসরণ আমাদের প্রজন্মের কাছে আধুনিকতার সমার্থক হয়ে পড়েছে। এমনকি প্রাত্যহিক জীবনের কথাবার্তায় বাংলা শব্দের সঙ্গে হিন্দি শব্দের মিশেল তথাকথিত স্টাইলে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া সাম্প্রতিক পরকীয়া ও ডিভোর্সের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে সামাজিক বিশ্লেষকরা হিন্দি সিরিয়ালের দিকেই ইঙ্গিত করছে। ‘ঐশী’ নাম্নী এক মেয়ের কথা আমরা কমবেশি সকলেই শুনেছি। যে হিন্দি সিরিয়ালের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নিজের বাবা-মাকে খুন করার মতো জঘন্য কাজটি করেছিল। সেদিন তো এক মেয়ে প্রেমিককে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়ার টানে বলেই বসল, ...আমি আয়েশা থেকে ‘ঐশী’ হতে চাই!
মূলকথা হলো, যারা মন্দ দৃশ্যায়ন, চিত্র বা চরিত্রায়নের চ্যানেলগুলো দেখছি তারা অজান্তেই নিজেদের চেতনা ও স্বকীয়তা হারাতে বসেছি। কারণ একটা জিনিস যখন চোখের সামনে কিংবা মেধার পরিধিতে ক্রমাগত ভাসতে থাকে মনের অজান্তেই মানুষ সেটা গ্রহণ করে বসে। ‘ভালো-মন্দ সব নিজের কাছে’ বলে যারা সেøাগান দেয় তারা কি আসলেই নিজে ভালো থাকতে পারে? মন্দের প্রভাবে তাদের আচরণে কি বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসে না? আপনি যেমনই হোন, খারাপ লোকের সাথে চলতে থাকলে আপনি নিজেই কখন খারাপটাকে ভালো ভেবে বসবেন, সেটা বলা মুশকিল। কারণ অনুকরণপ্রিয়তা আমাদের একটি অতি সাধারণ বৈশিষ্ট্য। তাই মন্দের অনুকরণ ও অনুসরণ আমাদের মোটেই উচিত নয়। এর থেকে বিরত থাকা সুস্থ বিবেকের পরিচায়ক।

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৭

মোস্তফা সোহেল বলেছেন: খুব ভাল লিখেছেন। কিছু কিছু জায়গায় শব্দ ছুটে গেছে মনে হয় টাইপিংয়ে সমস্যা ।ভাল থাকবেন

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩০

রিদওয়ান হাসান বলেছেন: ঠিক কোন জায়গায় বুঝতে পারছি না। বললে শুধরে দিতাম।

আপনিও ভালো থাকুন।

২| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:১০

জ্বি হুজুর বলেছেন: অস্কার অনুকরণ করতে গিয়ে কি ছ্যাড়া ব্যারা অবস্থা.. পানমসলা এ্যাওয়ার্ড X(( বদনা এ্যাওয়ার্ড X#
আরো কত কি
একাডেমী এ্যাওয়ার্ড এর নাম মুখে নেয়ার যোগ্যতাও নেই বলে এত চুল ছিড়াছিড়ি ।
ওদের জাস্ট ঘৃণাই প্রাপ্য X#

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩০

রিদওয়ান হাসান বলেছেন: হা হা হা। ঠিক বলেছেন।

৩| ২৩ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৪:৩০

শাহাদাত হোসেন বলেছেন: অসাধারণ একটি লেখা ।

২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ রাত ১২:৩১

রিদওয়ান হাসান বলেছেন: ধন্যবাদ আপনাকে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.