![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বৈষম্যের ভেতরে সাম্য, অসুন্দরের ভেতরে সৌন্দর্য খুঁজে ফিরি।
সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণের মত লোকালয়ে ‘গণচিন্তক’ও একটা বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি। সামাজিক অসংগতিকে মুক্তমনে বিশ্লেষণ করে তাঁদের যেখানে অপরাধী বা সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানকে চ্যলেঞ্জ করার কথা, সেখানে তাঁরা উদাসীন। অথচ এদের বগলে বেঙ্গল ব্রাদার্সের ছাতা বা বাটা জুতার বদলে ঝুলছে নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ। সেই সনদে না মানাচ্ছে সামাজিক বর্ষা, না বুদ্ধিবৃত্তিক কাদা। তাই বলে কি এত লোকের ভীড়ে ‘মানুষ’ একেবারেই নেই? প্রতিষ্ঠানগুলো ‘গণচিন্তক’ তৈরিতে এমন চরম ব্যর্থ হচ্ছে কেন?
ভারতের ঐতিহাসিক রমিলা থাপার ১৫ই অক্টোবর ২০১৫, এনডিটিভির এক ইন্টারভিউতে শুরু করেছেন এভাবে: ‘ব্যাপারটা আসলে যতটুকু, তার সাথে যোগ হয়েছে কথা বলার জায়গার অভাব’। কিন্তু ঘামাচির মতো এতগুলো পত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিও চ্যানেল গজিয়ে ওঠার পরেও জায়গার অভাব বলা হচ্ছে কেন! সেখানে লিখছে বা বলছে কারা? কে তাঁদের ডাকছে? কেন বা কোন উদ্দেশ্যে ডাকছেন? ডাকলেও কোন অসংগতিকে চ্যালেঞ্জ করা ‘উচিত বা উচিত না’ সেই প্রশ্নকেও চ্যালেঞ্জ করা দরকার, কিন্তু হচ্ছে না কেন?
যারা ডাকছেন বা যারা লিখছেন বা বলছেন সবাই কি এক হালি সোয়াসের ইলিশ, রাস্তায় আরও দুটো সালাম বা দুটো টেন্ডারের জন্য করছেন? দায়বদ্ধতা, বা চেতনাকে দিয়ে বসুন্ধরা টিস্যু বা রুমালের কাজটা করে নিয়ে আবার পকেটে ঢুকিয়ে রাখছেন? আপনি যদি সুশীল হয়ে থাকেন তাহলে উত্তর হবে ‘না’। কিন্তু যদি ‘গণচিন্তক’ হয়ে থাকেন তাহলে উত্তর হবে ‘হ্যাঁ’। কারন এটাই বাস্তব। আপনাদের কথা-কর্ম সামাজিক অসংগতিগুলোর উপর কোন ভালো প্রভাব ফেলছে না।
তাই বলে কী ‘সুশীলেরা’ গণচিন্তক নয়? না, অন্তত বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটাই তাদের সাম্প্রতিক রূপ। তারা ‘গণচিন্তক’ হলে ‘গণমানুষের থেকে নিজেদের আলাদা করতে চাইত না। গণচিন্তক হলে মহালয়ায় অমাবশ্যার রাতে পাড়ায় দূর্গার গলাটা কেটে যে ছেলেটা ছোয়াব কামিয়েছে তাঁকে আপনি জীবন বাজি রেখে খুঁজতে বের হতেন। পাশাপাশি দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করতে পিছপা হতেন না। টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদকের সাথে পরবর্তী ‘টক শো’র দিন ঠিক করার জন্য মোবাইলে তাঁর নাম্বার খুঁজতেন না। আওয়ামিলীগের ক্ষমতায় যাওয়া আসার সাথে আপনার মুক্তিযুদ্ধের চেতনাদণ্ড ওঠানামা করত না। এইতো কদিন পরে বিজয় দিবস, তার পরেই ভাষা দিবস, তার পর স্বাধীনতা দিবস, আপনাদের ভরা মৌসুম। বিয়ে বা পুজোর সময় ঠাকুরদের এবং রোজা বা শীতের সময় হযরতে মাওলানাদের যেমন মৌসুম আসে আপনাদেরও তেমনি মৌসুম আসছে।
এইসব সুশীলেরা ব্যর্থ কেন? এরা কেন গণচিন্তক হয়ে উঠতে পারছে না? কেন মানুষ এদেরকে ভীনগ্রহের প্রাণী মনে করে? কারণ: যেখানে তাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা সেখানে তারা চুপ। যেখানে একটা পাশবিক, জঘন্য আচরণকে যেভাবে আক্রমন করে গণমানুষের বিবেকে আগুন ধরিয়ে দেয়া উচিত সেখানে ইনিয়ে বিনিয়ে, গলার টাই চুলের সিঁথি ঠিক রেখে প্যান প্যান করে যাচ্ছেন। তাতে কিছুই বদলাচ্ছে না। বরং সুড়সুড়ি লাগছে, সন্ত্রাসীর মাথায় আইডিয়া জাগছে। মুর্তি ভাঙছে, ধর্ষণ করছে, ঘুষ খাচ্ছে, খুন করছে। এমন কোন অপরাধ আছে যা অতীতের থেকে কমেছে? কথা বলে যদি কাজ না হয়, তাহলে বলার-ই বা দরকার কী?
গণমানুষের সাথে না মিশে, তাঁদের কথা যে প্লাটফর্মেই বলেন না কেন, মানুষ তা শুনবে না। এটাই মানুষের চরিত্র, বড্ড বেয়াড়া। কিন্তু গণ মানুষের ভেতরে থেকে, চর্চা করে, গণমানুষের কথা গণমানুষের মত করে বললে মানুষ সেটা না শুনে পারে না। আর সরকারের ভয়? কাল পুলিশে তুলে নিয়ে দুটো মামালা ঝুলিয়ে দেবে? যদি সেটার ভয় পান তবে আপনি ‘সুশীল’, যদি তোয়াক্কা না করে সত্যি কথাটা অকাট্য যুক্তি দিয়ে বলেন, সরকার ক’জনকে তুলে নিয়ে যাবে? গা বাঁচিয়ে, জান বাঁচিয়ে, মান বাঁচিয়ে যতটুকু বলা যায়, বাড়িতে বৌ ছেলেপুলে আছে এসব অজুহাত গনচিন্তকদের চিন্তার বিষয় হতে পারে না! কারণ তারা গণমানুষে বিশ্বাসী, রাষ্ট্রকাঠামোর উপর আস্থাশীল এবং সরকারকে ভয় করে না।
বর্তামানে লাগামহীন আমাদের প্রায়মারি স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, লাগামহীন আমাদের সরকারী প্রশাসন যন্ত্র। তা সে যে লেভেলেরই হোক, পাড়ার চৌকিদার থেকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস অবধি। আর বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো স্রেফ দোকান, তাদের টিকে থাকতে গেলে ধামা ধরতে হয়। ওদের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকুক তা দাবি করা, ৮০% ব্যাবসায়ী দিয়ে সুষ্ঠুভাবে সংসদ চালানোর দাবির মতো। কিন্তু তাই বলে কী গণমানুষের জীবন থেমে থাকে? থাকে না। চলে, কিন্তু সেই চলা দুর্বিসহ, অপমানকর। এর জন্য একজন টেম্পুচালক দায়ী না হতে পারে; কিন্তু একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, একজন এম পি, দারোগা, সচিব অবশ্যই দায়ী। কারণ তাঁদের এই অবস্থানের পেছনে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ বেশি এবং এই শর্তেই যে তাঁরা ‘সামাজিক দায়বদ্ধ মানুষ’ হয়ে উঠবে। কিন্তু হায়!
এখানে এমন একটা গণচিন্তক গোষ্ঠী গড়ে তুলবার কথা প্রস্তাব করা যেতে পারে, যারা ক্ষমতা বা অর্থের জন্য কথা বলবে না, লিখবে না। রাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবে তাঁদের স্বাধীনতা দিয়ে আসছে। যদিও সরকার কখনও সরাসরি প্রসঙ্গটি নিয়ে সামনে আসবে না। কারণ, উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক দেশের সরকার গনমানুষের উপর পুরো আস্থাশীল হতে পারে না। গণচিন্তকদের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতরে থেকেই এই চ্যালেঞ্জটি নিতে হবে। প্রয়োজন এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই মারাত্মক।
এক্ষেত্রে রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং সমাজের সর্বস্তরের প্রতিষ্ঠানকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কাজটি একটুও কঠিন এবং অবাস্তব নয়। সমাজে এই বার্তাটি সবাই একযোগে পৌঁছে দিতে হবে যে: একই পাড়ায় পাশাপাশি ভিন্ন বিশ্বাস, ভিন্ন পোশাক এবং ভিন্ন চিন্তার মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারে। একজন ঈমাম ‘জুম্মার খুতবায়’ মুর্তি ভাঙার প্রতিবাদ করতে পারে। ইসলামের গ্রহনযোগ্য সূত্র দিয়ে, মসজিদ থেকেই কাজটি শুরু হতে পারে। পাশাপাশি একজন পুলিশ যদি তন্ন তন্ন করে মুর্তি ভাঙার সন্ত্রাসীকে খুঁজে বের করে, কোর্ট যদি তার দৃষ্টান্তমুলক সাজা নিশ্চিত করে, এমপি তার এলাকায় সব প্রতিষ্ঠানকে একত্রিত করে একটা দিকনির্দেশনা দাঁড় করায় তাহলে এরকম জঘন্য কাজের পুনঃবৃত্তি ঘটতে পারে না। তার উপর একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে তার বিশ্বাসের ভাইরাসকে মেরে ফেলে সেখানে মানবতার বীজ পুতে দেয়, ঘরে ফেরার পর বাবা মা সেখানে জলসেচ দেয়, ঐ ছোট্ট সন্তানটি বড় হলে শারিরীক ও মানুষিকভাবে শক্তিশালী হবে কিন্তু কখনই হিংস্র হবে না। আরেকজনের স্বর্গে কোপ দিয়ে নিজেরটা নিশ্চত করার কথা ভাবতেও পারবে না। তখন নাস্তিক, ঈমাম ও ঠাকুর একপাড়ায় নিশ্চিন্তে ঘুমতে পারবে। এটাই প্রয়োজন।
একজন কী পোষাক পরবে, কী খাবার খাবে, কোথায় যাবে তাতে অন্য কেউ নাক গলাতে পারে না। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রত্যেক মানুষের। এগুলো নিয়ে কোন গোষ্ঠী যখন নাক গলাতে আসে, প্রথমেই তাদের কে থমকে দেওয়ার দায়িত্ব সরকারের, মানুষের প্রতিনিধি হয়ে প্রতিবাদ করবে গণচিন্তকেরা। অথচ আজকের সুশীলেরা দেখছে রাষ্ট্রের চোখ দিয়ে নয়, সরকারের চোখ দিয়ে। তারা কথা বলছে রাষ্ট্রের মুখ দিয়ে নয়, সরকারের মুখ দিয়ে। তাই তারা মানুষ বলে নিজেদের দাবি করলেও, মানুষ তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
বাংলায় যৌক্তিক চিন্তার ইতিহাস আজ সবাই ভুলতে বসেছে। আমাদের এই সভ্যতায় যৌক্তিক চিন্তার ইতিহাস চার্বাক আমলের, বৌদ্ধ আমলের, লালনেরা চর্চা করে এসেছে। তাঁদের নিদর্শন স্বরূপ এই অঞ্চলের প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। সম্প্রতিক ৫০০ বছরে ভিন্ন ভিন্ন রূপে হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বিষ যৌক্তিক চিন্তাকে হত্যা করেছে। ইংরেজ আমলে এই বিদ্বেষকে কাজে লাগিয়ে ইংরেজরা লুটেছে, পাকিস্তানিরা লুটেছে, পঁচাত্তরের পরেও লুট থেমে থাকেনি। এখন ভিন্নতার সৌন্দর্যকে এমন অবাস্তব এক ধারণায় রূপ নিয়েছে যে, বাংলাদেশের মানুষ আর যৌক্তিক চিন্তা এবং গণচিন্তক ধারণাটি গ্রহন করতে প্রস্তুত নয়। কিন্তু একে চ্যালেঞ্জ করে পুনরুদ্ধারের কাজটা করতে এগিয়ে আসা উচিত সবার। সর্বপ্রথম শুরু করতে হবে টিএসসি, ইবলিশ চত্ত্বর, জারুল তলার মতো পঁয়ত্রিশটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন থেকে।
রব্বানী
ক্রয়ডন, ১৭ই অক্টোবর ২০১৫
©somewhere in net ltd.