নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, গ্রন্থকার, ফোটোগ্রাফার, কবি, আবৃত্তিকার, যুক্তিবাদী মানবতাবাদী আন্দোলনকর্মী
বাংলাভাষা আক্রান্ত
সংক্ষিপ্ত
শমীন্দ্রঘোষ
বাংলাভাষা সংস্কৃতজাত নয়। অস্ট্রিক এবং প্রাকৃত, মাগধি, মাগধি-প্রাকৃতভাষা ভিত্তি রচনা করেছে বাংলার। এরপর দ্রাবিড়, হিট্টি, পালা, কাঠি, পালি ভাষাগুলো বাংলাভাষা নির্মাণ করেছে। এর সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানা নেই; তবে আনুমানিক কাল বোঝা যায়; সেটা খ্রিস্টপূর্ব অব্দগুলোতে।
এরপরে সংস্কৃত, পর্তুগীজ, হিন্দি, তুর্কী, পার্সি, আরবি, ফরাসী, ডাচ, ইংরাজি, গুজরাটি, মৈথিলী, পাঞ্জাবী ভাষার শব্দ সম্বৃদ্ধ করেছে বাংলা ভাষাকে।
.
বাংলাভাষায় প্রায় ১,১৫,০০০ (মতান্তরে ১,২৫,০০০) শব্দের মধ্যে ২৫% শব্দও সংস্কৃতের দান নয়। সংস্কৃত ভাষা বাংলাভাষার বিকৃতিও ঘটিয়েছে, বহু শব্দ চুরি করেছে, বহু শব্দ লুপ্ত করেছে। আদপে বৈদিকদের দ্বারা বাংলা দখল হওয়ার সময়ে বৈদিকরা একাজ করেছিল। ১) নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে নিজেদের ছাঁচে গড়েছিল। এতে তাদের যাতে সুবিধা হয়, হয়েছিলও; ২) শব্দগুলোকে নিজেদের মতো করে বুঝে নিতে। এটা সকলেরই হয়; যেমন, #পটেটো বললে আমরা বুঝব না; কিন্তু জিনিসটা দেখলেই বলব, 'ও এটা তো #আলু'। যেমন, #বাতাতা থেকে #পটেটো। এভাবেই বৈদিকরা বহু শত শব্দ ধাতুরূপে শব্দরূপে ইত্যাদি বৈয়াকরণিক পদ্ধতিতে বুঝে নিতে শব্দের বিন্যাস করেছে এবং পুরাতন বুলি বাতিল করে নিজেদের ছকে নতুন বুলির প্রবর্তন করেছে। শেষে প্রচার করেছে, বাংলা সংস্কৃতজাত। এসবের বহু উদাহরণ ছড়িয়ে আছে বাংলাভাষাতেই। দুধ যেহেতু বাঙালিরা খেতো, তাই এটা চিহ্নিত করার শব্দ সংস্কৃতজাত হতেই পারে না।
সংস্কৃতভাষাটাই আর্যভাষা সংস্কারকৃত রূপ; তাই #সংস্কৃত। ঋগ্বেদের ভাষাটা আর্যভাষার সংস্কার করা। এরপরে আবারও সংস্কার করা হয়; যা পৌরাণিক সংস্কৃত। বেদ উপনিষদ পুরাণের ভাষা সংস্কৃত হলেও তা পৃথক পৃথক।
এই সংস্কৃতিভাষাকেও বাংলায় নতুন রীতিতে গড়লো বাঙালিরা। নাম হলো #গৌড়িয়_রীতি। এই রীতিও বিখ্যাত, মর্যাদার এবং গ্রহণযোগ্য ছিল বৈদিক উত্তরাধিকারীদের নিকটে। এই রীতির শেষ বিখ্যাত বাঙালি কবি #জয়দেব। অর্থাত্ বাঙালি এখানেও স্বকীয়তা স্বাতন্ত্র্যের সাক্ষর রেখেছে। এটাই বাঙালির সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য।
.
ভাষা মূলত গড়ে ওঠে কাজের ভিত্তিতে, ব্যবহার্য বস্তুর, আচরণ অভিব্যক্তি ইত্যাদির ভিত্তিতে। এখন যেমন, কম্পিউটার, মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি শব্দ ঢুকেছে; কিন্তু তা আভিধানিক হয়নি। তবু, আমরা বলছি, বুঝছিও। এগুলো হয় একদিন সরাসরি অভিধানে ঢুকবে, নচেত্ পারিভাষিক ভাবে ঢুকবে। বাংলায় বহু শব্দ পর্তুগীজ জাত; কিন্তু তা স্বকীয়তার, হুবহু নয়। যেমন, আলকাতরা, আতা, আলু, আনারস, ইস্ত্রি, মিস্ত্রি, বয়াম ইত্যাদি। অতীতে বহু শব্দ ঢুকেছে; তবে তা বাংলার স্বকীয় রীতিতে উচ্চারিত হয়েছে। কব্জি, কবজা, মগজ, হাওয়ালা, মজুমদার, আর্মাডা থেকে হার্মাদ ইত্যাদি। #মগজকে যে প্রাচীন বাংলায় কী বলা হতো, জানি না। এভাবেই কাজের সঙ্গে যুক্ত না থেকে ও উচ্চারণ বিপর্যয়ে মগজ থেকে লুপ্ত হয়েছে প্রাচীন বাংলার শব্দাবলী।
যে-ভাষা কর্মের সঙ্গে যুক্ত নয়, জড়িয়ে থাকে না, নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর সঙ্গে যুক্ত থাকে না এবং সহজে উচ্চারিত হয় না ও বোঝাতে বুঝতে সময় লাগে, সেই ভাষা লুপ্ত হয়। ভাষা শুধু শব্দে নয় বাক্যগঠনে, ব্যাকরণে, উচ্চারণে স্বকীয়তাতে থাকে। সংস্কৃত এসবে দিগভ্রষ্ট, স্বৈরাচারী, অনমনীয়; এজন্যই সেটি মৃত ভাষা। বাংলাভাষা যতদিন কর্মের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তা বজায় রেখে সহজে উচ্চারিত হবে, ততদিন তা জীবিত প্রাণবন্ত থাকবে।
.
অধুনা বাংলাভাষার ব্যাকরণ আক্রান্ত হয়েছে হিন্দির দৌলতে। বাংলায় পদ, কর্ম ও বস্তুর পুংলিঙ্গ-স্ত্রীলিঙ্গ হয় না। হিন্দির সবেতেই এমন লিঙ্গ আছে--- "গাড়ি ছুটেগি," ছুটেগা নয়। ফলে, পুরপিতা, পুরমাতা, #মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী, #মাননীয়া #প্রধানা শিক্ষিকা, প্রধানা, শিক্ষিকা, ইত্যাদি হিন্দি আক্রান্ত অবাঙালি শব্দ ব্যবহৃত হচ্ছে বাংলায়। এরপর হয়ত নারী মন্ত্রীকে #মন্ত্রীণী বলা হবে! সবেতেই পুংলিঙ্গ, স্ত্রীলিঙ্গের এই বিভেদ করতে #নারীস্বাধীনতারও তকমা দেওয়া হচ্ছে। নারী পুরুষ সমান সমান বলতে এমন উদ্ভট কাজ করা হচ্ছে। অতীতে #সমিতি শব্দটা সমাজে নারীর অংশগ্রহণকে বোঝাত। এটা প্রাচীনবঙ্গের তথা #পূর্বদেশের রীতি। অর্থাত্ পুং-স্ত্রী ভেদে শব্দ ছিল স্বতন্ত্র; "ঈ"কার, "আ"কার যুক্ত নয়। সবই পুরুষশব্দ নয়। সেসবের অর্থমূলক ব্যবহার এখন লুপ্ত বৈদিকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে। এটাও ঠিক যে একসময়ে সমাজে নারীর অংশগ্রহণ কম ছিল। কর্মে শব্দ সৃষ্টিও হয়েছে। পরে নারী আসাতে সেসবের স্ত্রীলিঙ্গ খোঁজা হয়েছে বহাল শব্দটিকে পুরুষ ছাপ দিয়ে; যেমন, শিক্ষক থেকে শিক্ষিকা। অথচ, এটা কর্মমূলক পদ, এতে এমন লিঙ্গ হয় না। এসবই বাংলাভাষাকে কলুষিত করে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বাঙালির অবনতির সাক্ষ্য: "মাতৃভাষায় কথা বলিতে শিক্ষিত বাঙ্গালী পারে না। সে যে শিক্ষিত, তাহা ইংরাজী শব্দ মিশান বাঙ্গালা বলিয়া প্রমাণ করে। ইংরাজী শিক্ষিত এমন বাঙ্গালী অতি অল্পই দেখিয়াছি, যাঁহারা পরস্পরের সহিত বিশুদ্ধ বাঙ্গালায় কথা বলেন।" --- দেশ_পত্রিকা, ৩০ ডিসেম্বর, ১৯৩৩।
"আমাদের দেশে প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে, অর্থনৈতিক অবস্থা অনুসারে, যেরূপ রীতি আদব-কায়দা হওয়া স্বাভাবিক, তাহা ক্রমে ক্রমে গঠিত হইতেছিল। এখন আমরা সেগুলি ছাড়িতেছি, সেগুলির সহিত পরিচয়ের অভাব হেতু এবং ইউরোপীয় রীতি-নীতির সহিত পরিচয় ও তাহার অনুচিকীর্ষা হেতু।" --- আমাদের_সামাজিক_প্রগতি, ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়।
উক্ত দুটি পর্যবেক্ষণ-মূলক সিদ্ধান্ত আজ এই একবিংশ শতাব্দিতেও প্রাসঙ্গিক। এর মূল কারণ, বাঙালির জাতিসত্ত্বাগত আত্মপরিচয়ের অভাব, আত্মবিস্মৃতি, আত্মমর্যাদা বোধহীনতা, আত্মঘাতী স্বভাব। ফলশ্রুতি দিশাহীনতা এবং পরপদলেহন, অনুকরণ ও উশৃঙ্খলতা। ফল, অবনতি। এখন তলানিতে।
আমাদের এটা মনেরাখা দরকার যে, ভাষার শব্দে আক্রমণ করে যেমন ভাষার স্বকীয়তা স্বাতন্ত্র্য ভাঙা যায়; তেমনি ব্যাকরণে আক্রমণ করেও ভাঙা যায়। প্রায় দুই-আড়াই হাজার বছর আগে বৈদিকরা এই ভাবেই বাংলার স্বকীয়তা ধ্বংস করেছে। এখন হিন্দিয়ানীরা করছে। ইংরাজি শব্দ বহু ঢুকেছে নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর সঙ্গে, আচরণের ভাব ব্যক্ততে, উচ্চশিক্ষায় ও বহু কর্মে। অর্থাত্ বাংলাভাষা বহুদিক থেকে আক্রান্ত। অনতিবিলম্বে পরিভাষা শব্দ চালু করা দরকার। বৈজ্ঞানিক বস্তু, নিত্যব্যবহার্য বস্তু আবিষ্কার বাঙালির দ্বারা হওয়া দরকার এবং তার শব্দ বঙ্গীয় হওয়া দরকার। কিডনি-কে #বৃক্ক বলতে, হার্ট-কে #হৃদপিণ্ড বলতে অসুবিধা কী? এভাবেই বাংলাভাষার হৃদপিণ্ডের পুনর্নিমাণ চালু হোক।
.
ইউনেস্কো স্বীকৃত পৃথিবীর #মধুরতম ভাষা বাংলা; গর্বের।
.
আধুনিক বাংলা লিখিতভাষা রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট। কথ্যের রূপও বিবর্তিত হয়েছে। তবু, সুরে বেশকিছুটা প্রাচীনত্ব আছে।
গত প্রায় ৩০বছর ধরে ইংরাজি ও হিন্দির আগ্রাসনে নতুন একটি কথ্যভাষা গঠিত হয়েছে বাংলায়; নাম দিয়েছি ইংলাবান্দি ভাষা।
.
তেমন দরকার পড়লে আবার ইতিহাস লেখা হবে, "বা.ভা.উ.ক্র" ইংরাজি নাম "ওডিবিএল"।
বাংলা লিপি সিন্ধুলিপি থেকে বিবর্তিত।
ওড়িয়াভাষা ও অসমীয়াভাষা বাংলার অপভ্রংশরূপী, সহোদর। মুণ্ডা, সাঁওতালি, কুর্মী অর্থাত্ উপজাতিদের ভাষাও অস্ট্রিকজাত বাংলার সহোদর।
#শমীন্দ্রঘোষ
০১/১২/১৬
২| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:০৩
আনু মোল্লাহ বলেছেন: আলোচনা ভাল লাগল। আপনার আশংকা আমার কাছেও সত্য মনে হয়।
৩| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৫:২৯
ঢাকাবাসী বলেছেন: উঁচুমানের গবেষনামূলক লেখা, আপনি কে জানা নেই তবে এধরণের লেখার জন্য ধন্যবাদ পেতে পারেন।
©somewhere in net ltd.
১| ১৬ ই জানুয়ারি, ২০১৭ বিকাল ৪:১৫
একজন সত্যিকার হিমু বলেছেন: অতি চমত্কার তথ্যবহুল লেখা ।মুগ্ধ হলাম পড়ে ।