নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাংবাদিক, গবেষক, লেখক, গ্রন্থকার, ফোটোগ্রাফার, কবি, আবৃত্তিকার, যুক্তিবাদী মানবতাবাদী আন্দোলনকর্মী
বাংলা শব্দে বিপ্লব হোক:
শমীন্দ্রঘোষ
"যেই ভাষে প্রভু করিছে সৃজন।
সেই ভাষ তাহার অমূল্য সেই ধন।"
পঙক্তি দুটো ঊনবিংশ শতকেরও নয়। ষোলো শতকের কবি সৈয়দ সুলতানের। বঙ্গভাষাপ্রীতির এমন বহু উদাহরণ রয়েছে মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যে।
"কি কহিব কুমারীর রূপের প্রসঙ্গ
অঙ্গের লীলায় যেন বান্ধিছে অনঙ্গ।
কাঞ্চনকমল মুখ পূর্ণশশী নিন্দে
অপমানে জলেতে প্রবেশে অরবিন্দে।
চঞ্চল যুগল আঁখি নীলোত্পল গঞ্জে
মৃগাঞ্জন শরে মৃগ পলায় নিকুঞ্জে।" ---- দৌলত কাজী। সতেরো শতকের আরাকান তথা চাটিগাঁ-রোসাঙ্গা রাজার সভাকবি। লক্ষ্যনীয় শব্দ, ভাব, বুদ্ধিদীপ্ত মিল, শৈলী, ধ্যানধারণা। এখানে ধর্ম ছাপ ফেলেনি। বাংলার স্বকীয়তাই প্রধান। পানি বা আব্বু আম্মু মার্কা শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। এমন দেড়শতাধিক কবির কাব্য-পদ্য বাংলাভাষা প্রীতির নিদর্শণ। সঙ্গে শব্দে ভাষায় সাম্প্রদায়িকতা, আরবি-ফার্সির অন্ধ অনুকরণ, ধর্মভিত্তিক চর্চার অনুপস্থিতি দৃষ্টান্তস্বরূপ। এতদ্বারা এটাও বোঝা যায় যে, ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ছিল এবং বাংলাভাষাকে বৈদেশিক দূষণমুক্ত করার প্রয়াস ছিল ষোলো শতকেও। কিন্তু বর্তমানে বিবর্তনের* নামে চলছে আগ্রাসন। এই আগ্রাসনের শুরুও পুরোনো বলে অনুমান করা যায়। বৈদিক আক্রান্ত হওয়ার পরে। গুপ্তরাজার যুগে শশাঙ্কের সময়ে। এরপরে ইসলামে আক্রান্ত হওয়ার সময়ে। মোঘল আমলেও ব্যাপক আগ্রাসন চলেছে উর্দু দ্বারা। তাঁবুর ভাষা সৈনিকরা ব্যবহার করতো। এরাই সাম্রাজ্য দখলকারী। ফল, উর্দুর প্রতি নতজানু হয় একবাংলা,যারা ইসলাম মানেই উর্দু ভাবত। বর্তমানেও এই ধারাটা আছে।
.
তাই, ভাবতে অবাক লাগে এই বাঙালি নাকি ভাষা আন্দোলন করেছিল; মাতৃভাষা রক্ষায় প্রাণ দিয়েছিল! এখন এই ভাষাকে যদি ধর্ম, সম্প্রদায় এবং বৈদেশিক অনুকরণ বর্জন করা হয়, আপত্তি কেন? দীর্ঘকাল ধরে বাংলাভাষার বিবর্তনে* আজকের রূপ। এমন নয় যে, আজকেরটাও অনড় থাকবে। এখনই কিছু শব্দের অর্থ বদলাচ্ছে; "ব্যপক", "ভয়ংকর" ইত্যাদি শব্দের অর্থ বদল হচ্ছে, নতুন ব্যাঞ্জনা যুক্ত হচ্ছে, বুঝছেন কি বিরোধীগণ? এই বদলটাই ভাষাকে সমকালীন রাখে, জীবন্ত রাখে।
বাংলাভাষা স্বকীয়, স্বতন্ত্র; অনুকরণ প্রায় ছিলই না; অন্তত ১০০/১৫০ বছর আগে পর্যন্ত। তাই, আর্মাডা হয় হার্মাদ, মজ্হ হয় মজা। হুজুকেই অনুকৃতি হয়েছে। কিছুটা সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় হুজুকে হয়ে, কিছুটা তালেগোলে।
.
তাই, স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে, বাঙালির সম্পর্কের শব্দগুলো কেন অবিকৃত আরবি ফার্সি তথা উর্দু হিন্দির থাকবে? পর্যবেক্ষণে বোধগম্য হচ্ছে যে, উর্দু মানেই ইসলামীর ভাষা নয়। মুসলিমশব্দ বলে কিছু নেই; পুরোটাই গুজব। হিন্দি বা সংস্কৃত মানেই হিন্দুত্ব নয়। হিন্দুশব্দ মানেও গুজব। শব্দের কোনো ধর্ম নেই। আরবি বললে কি বেশি মুসলমানত্ব বোঝায়? যদি তা বোঝায় তাহলে একশোটা প্রশ্ন ধেয়ে আসবে আপনাদের প্রতি; যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে পারবেন তো? যতদূর অনুমান,পারবেন না। কারণ, সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য যাবে কোথায়! তবু, ভাষাতে কেন এত গোঁড়ামি? এটা অনেকটা 'বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়' হয়ে গেলো না কি? তাহলে আর মাতৃভাষা আন্দোলন এবং শহিদদিবস পালন করা কেন?
.
বাংলাভাষায় অজস্র শব্দ আরবি, ফার্সি, তুর্কী উদ্ভূত; কিন্তু অনুকৃত নয়। তুর্কী ও আরবি মিশ্রিত শব্দ বাবা নয়; হাজং ভাষায় বাবা শব্দটি পাওয়া যাচ্ছে। চুরিরসং শব্দ মা; ফার্সিজাত শব্দ কাকা; বঙ্গীয় মাসি, পিসি, বোন, ভাই, ঝি, ভাইঝি, বোনঝি, ভাইপো, বোনপো, পিসে, মেসো, কাকীমা, জেঠিমা, জেঠা; চুরিরসং শব্দ দাদা, দিদি, দিদিমা, দাদু, ঠাকুরদা, ঠাকুমা, মামা--- এগুলোই চলুক। ইস্কুলে এগুলোই পড়ানো হোক। চুরিরসং মানে সংস্কৃত বৈয়াকরণিকগণ বঙ্গীয় আদি শব্দগুলো চুরি করে সেগুলোকে নিজেদের ছকে সাজিয়ে নিজেদের উত্পন্ন বলে চালিয়েছিলেন। এই সত্যটা জানানো দরকার এইভাবেই। প্রাগ্বৈদিক যুগে বঙ্গের মানুষ কি আকার ইঙ্গিতে ভাব আদানপ্রদান করতো? নাকি "ব্যাঁ ব্যাঁ" বলে বাবাকে ডাকতো? প্রাগৈস্লামিক বঙ্গে মা-কে কি "ম্যাঁ ম্যাঁ" বা "হাম্বা" বলে ডাকা হতো? তা তো নয়। অথচ, ৯৯% মুসলিমই ধর্মান্তরিত, ৯৯% হিন্দুও ধর্মান্তরিত এবং ৯৯% বৌদ্ধ, খ্রিস্টানও ধর্মান্তরিত। তাই সমস্যাটা হলো গোয়ার্তুমি, হুজুক। আত্মপরিচয়ের অভাবে ভিন্ন খুঁটিতে নাড়াবাঁধার হুজুক। এটা থামানো আবশ্যক। তাইতে সাম্প্রদায়িকতা মুছে যাবে ধীরে ধীরে। ধর্মান্ধতাও কমবে। এই পৃথক অস্তিত্ব ভাবনাটাই বাঙালির একতার মূল বিরোধী। এটাকেই ক্ষমতার তাস করেছিল বিদেশীরা; ব্রিটিশরা। এখন করছে দেশীয় রাজনীতিকরা। ফলে, দীর্ণ জীর্ণ শীর্ণ হয়ে বঙ্গসমাজ গুঁড়ো গুঁড়ো। অধিক পণ্ডিতমন্যতাও ক্ষতি করছে। বরং সহজ সরল ভাবলে ও কাজ করলে মঙ্গল।
.
তাই ঝেঁটিয়ে বিদায় করুন, আব্বা, আম্মু, চাচা, চাচি, দাদা, দাদী, নানী, নানা, ফুফা, খালা, আপা, বুবু সহ জ্বী, পানি, ফর্জ, খানা, জায়েজ, নায়েয, আযান, নমায, গোসল, রোযা ইত্যাদি যাবতীয় অবিকৃত বিদেশী উত্পাতী শব্দ; যার সিংহভাগই গত এক-দেড়শো বছরে বঙ্গীয় বুলিতে ঢুকেছে। কিছু ঢুকেছিল মোঘল আমলে। অধিকাংশই ব্যবহৃত হতো নগরাঞ্চলে। এরমধ্যেও বেশিরভাগ গত প্রায় আশি বছরের পাকিস্তানি সময়ে ঢুকেছে। এগুলো যুক্ত করতে যাঁরা মনপ্রাণ সঁপেছিলেন তাঁরা হলেন, মোল্লা-মৌলভী-কাজী-পীর-ফকির-মুফতি-হাফিজ প্রভৃতি ইসলামী ধর্মবেত্তাগণ। গ্রামবাংলায় এদের চাষ থাকলেও, আমবাঙালি প্রাথমিকভাবে এসব শব্দ ব্যবহার করতো না। এখনও বহু মুসলিম পরিবারে এসব শব্দের চল নেই। এমনকি মধ্যযুগের মুসলিমধর্মীয় কবি/লেখকদের রচনায় এসব শব্দ নেই বললেই চলে; এখন অবধি যতটুকু ঘেঁটে পাওয়া গেছে, তার ভিত্তিতে বলা গেলো।
.
মধ্যযুগের ১২২জন পদাবলী রচয়িতা কবি ধর্মে মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাঁরাও এমন শব্দ ব্যবহার করেননি। ভিন্ন ধারার দেড়শতাধিক কবিও এমন শব্দ ব্যবহার করেননি, যেগুলোকে তথাকথিত মুসলমানশব্দ বলা হয়। ষোলো শতক ও পরবর্তীকালের বিখ্যাত কবিদের মধ্যে দৌলত উজির, আলাওল, সৈয়দ সুলতান, দৌলত কাজী ছাড়াও শেখ কবীর, শাহ বারিদ, দোনা গাজী, চাঁদ গাজী প্রমুখ বহু আছেন। ঊনবিংশ শতকে ও বিংশ শতকের প্রথমদিকে ফয়জুন্নেসা, তাহেরুন্নেসা, মীর মশারফ হোসেন, কায়কবাদ, মোজাম্মেল হক, আজিজন্নেছা, করিমুন্নেসা, রোকেয়া, ফজিলতুন্নেসা, রাজিয়া খাতুন তাঁরা এমন বাংলায় লিখেছেন, যা পড়লে আপনারা চমকে যাবেন। ভাষায় পাকা বাংলা। সেই সাগর থেকে প্রাপ্ত এক চিমটে পড়ে দেখুন।
"বিরহী জনের প্রতি শশী দয়াহীন।
এই পাপে প্রতিমাসে এক পক্ষ ক্ষীণ।।
বিরহী জনের তনু দগধে কারণ।
প্রতিমাসে একবার বন্ধুর মরণ।" --- দৌলত উজির, ষোলো শতক।
এনারা কেউই খালা ফুফা নানী নানা আপা গোসল জ্বী জায়েজ ব্যবহার করেননি। আলাওল রচনা করেছিলেন #পদ্মাবতী_কাব্য। তিনি আরাকানের বৌদ্ধ রাজার সভাকবি ছিলেন। কাব্যে খলনায়ক মুসলমান রাজা, নায়ক-নায়িকা হিন্দু, ভাষা সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা, লিপি আরবি। মন্ত্রীর নাম মাগন ঠাকুর, ধর্মে মুসলমান।
কবি সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের একচিমটে:
"ভুরুর ভঙ্গিমা হেরি ভুজঙ্গ সকল।
ভাবিয়া চিন্তিয়া মনে গেল রসাতল।।
কাননে কুরঙ্গ জলে সফরী লুকিত।
খঞ্জন-গঞ্জন নেত্র অঞ্জন রঞ্জিত।।"
অর্থ : (পদ্মাবতীর) ভ্রুভঙ্গি দেখে মৌমাছির দল গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। কাজলরাঙা সেই চোখ খঞ্জন পাখির চোখকেও হার মানায় যা দেখে হরিণেরা বনে আর পুঁটিমাছগুলো জলে লুকিয়ে গেল।
পদ্মাবতী কাব্যের একটি অন্তরা :
"প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস
ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ
যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অঙ্কুর
মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর।।"
ভাষা অরন্তস্থ না করলে এভাবে লেখা যায় না।
এতদ্বারা কিছু বুঝেছেন, আরব্যপন্থি মুসলিমগণ, সাম্প্রদায়িক সুবিধাবাদীগণ এবং তথাকথিত বঙ্গীয় আন্দোলনকারী, ভাষাবিদগণ সহ "লিঙ্গুইস্টিক ইকুয়ালিটি"গণ? না জেনে বকবক করা থামালে আপনাদের দেখতে ভালো লাগবে; হট্টোগোলটা বন্ধ হলে সৃজনে মনোনিবেশ করা যাবে। দেখুন, এভাবে মুসলিম ও অমুসলিমের চূড়ান্ত সংশ্লেষ হয়েছিল বঙ্গে। এটাও বঙ্গীয় স্বকীয়তায়। তাই, বাবা-মা-মাসি-ঠাকুরদা ইত্যাদি বঙ্গীয় শব্দ বলুন। বর্তমানের আম্মু-ফুফা-খালা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা বাদ দিন। এগুলো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শব্দ, স্বকীয়তা বর্জিত; যা বাংলা ভাষার এবং বাঙালির একতাকে, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য স্বকীয়তার ক্ষতি করছে। এগুলো আত্মবিশ্বাসহীন, মেরুদণ্ডহীন, পরপদলেহী হয়ে ভিক্ষার শিক্ষা দিচ্ছে। অতএব, উত্পাত বাদ দিন। পড়ুন, আহমেদ শরীফের মধ্যযুগের কাব্য সংগ্রহ। তারপরেই ভুলে যান তথাকথিত ইসলামী বুলি। সর্বোতভাবে বাঙালি জাতির মঙ্গল হোক।
শমীন্দ্রঘোষ
১৭/০১/১৭
©somewhere in net ltd.