নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অন্ধচোখে তাকাই, চোখাচোখি হয়.... দেখা হয়না কখনো, কোনদিন......

স্বপ্ন সতীর্থ

কাউকে না কাউকে হেরে যেতে হয়, নয়তো বিজয়ী বলে কিছু থাকত না......

স্বপ্ন সতীর্থ › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক যুবতী ঝর্ণার মুখোমুখি

২২ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১১:০৭




পা কাঁপছে আমার। প্রচণ্ড রকম পিচ্চিল একটা পাথর ধরে ঝুলে আছি বলা চলে৷ নিচে ভেলাখুম নামে ছোট কিন্তু স্রোতস্বিনী এক ঝরণা। আমি সামনের জনকে ডাক দিলাম। উনি শুনলেন না৷ ছবি তুলছেন ভদ্রলোক। এমন জায়গায় আসলে সবারই কিছু না কিছু স্মৃতি জমা রাখতে মন চাইবে। আবার ডাকলাম। এবার শুনলেন৷ আমার অবস্থাটা টের পেলেন মুহূর্তেই। হাতে থাকা বাঁশের লাঠিটা বাড়িয়ে ধরলেন। ওটা ধরে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলাম।

এখনো বুক ধড়ফড় করছে। বসে পড়লাম পাথরের উপর। জায়গাটা একদম সরু। কোনরকমে একজন দাঁড়ানো যায়। চারপাশটা জুড়ে কেবল পাথর। সব পিচ্ছিল হয়ে আছে। এরমধ্যে বৃষ্টি হচ্ছে গতরাত থেকে। ভেলাখুম পাড় হচ্ছিলাম নাইক্ষ্যংমুখ ঝরনা দেখতে যাবো বলে।

ওপাশ থেকে গান গাইতে গাইতে কারা যেন ফিরছে নাইক্ষ্যংমুখ ঝরনা দেখে৷ চিনতে পারলাম। দেবতা পাহাড়ে ওঠার সময়ে এদের সাথে দেখা হয়েছিলো। আলাপও হয়েছিলো দুই এক টুকরো। কুয়েটে পড়ে ওরা। আমি যে জায়গাটায় ঝুলে ছিলাম সেখানে আসতেই আরেকজন ঝপ করে নিচে পড়লো। একদম ঝরণার পানিতে। একটু এদিক সেদিক হলে ঘাড় আস্ত থাকতো না।
ছেলেটা প্রাণপনে সাঁতার কাটছে। ভেলাখুমে আসতে হয় ভেলা দিয়ে। স্রোতের বিপরীতে ভেলা নোঙর করার জন্য ঝরণার কাছেই পাথরের খাঁজে বিশেষভাবে একধরণের দড়ি বেঁধে রাখা হয়েছে। আমার পায়ের কাছে একটা দড়ি। ছুঁড়ে দিলাম ওর দিকে। হাত বাড়িয়ে ধরলো। যাক রক্ষা৷

আবারও বৃষ্টি নেমেছে। মাথার কয়েক হাত উপরেই মেঘ। বৃষ্টি না থাকলে এদের ভেসে বেড়ানো দেখতে বেশ লাগে। এখানকার বৃষ্টিতে বাজ পড়ার কোন শব্দই পেলাম না গত দুইদিনে।

ভেলাখুম থেকে ফেরার অপেক্ষা করছি। জায়গাটা ভাল লাগছে না। মাঝেমাঝে ভয়ংকর সুন্দরে আমার বিরক্তি ধরে যায়।
চারপাশে উঁচু পাথুরে পাহাড়। ঘন সবুজ অরণ্য। পাখি আর ঝরণার শব্দ ছাড়া কিছু নেই। এমনটা একটা পরিবেশ হন্যে হয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। তবুও কেন যেন এই জায়গাটা বিরক্তিকর ঠেকছে। খানিকক্ষণ বাদেই টের পেলাম কারণটা। দেড়টার মতন বাজে এখনো আসল গন্তব্য আমিয়াখুম যাওয়া হলো না। ওটার রুদ্র সুন্দর রূপ দেখার জন্য আঁকুপাঁকু করছে মন।

এই ট্যুরে আমার হঠাৎ করেই আসা। চারদিনের সফর। ট্যুরমেট কাউকেই চিনিনা। আসার দিন সন্ধ্যা বেলাও আমি নিশ্চিত ছিলাম না আসবো কীনা। অনেক ঝক্কিঝামেলা শেষ করে ফকিরাপুল বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছাতে দশটা বেজে গিয়েছিলো।

সহযাত্রীদের সাথে টুকটাক আলাপ জমায়ে চেষ্টা করলাম। তেমন একটা সুবিধা হলো না। সবাই নিজের সার্কেলের মধ্যেই আলাপে মগ্ন। অবশ্য এমনটাই হবার কথা। বাস আসতে বেশ খানিকক্ষণ দেরি। আকাশে তাকালাম। মস্ত একটা চাঁদ ফিক করে হেসে উঠলো। বেশ ফুরফুরে একটা অনুভব নাড়িয়ে গেলো ভেতরটা। আমরা যেতে যেতে এই চাঁদ পূর্ণ যুবতী হয়ে উঠবে৷

বাস ছাড়লো। আমার পাশের সিট ফাঁকা। কেউ নেই। উকুলেলেটাতে হেলান দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। লাভ হচ্ছে না। পুরো বাসই এই দলের দখলে। গান শুরু হলো। দারুণ আনন্দ করছে সবাই। আমার কেমন একটা খারাপ লাগা শুরু হলো। এই প্রথম একা অপরিচিত কোন টিমের সাথে যাওয়া। এর আগে গেলেও কমকরে দুই তিনজন থাকতো পরিচিত।

আমি তো হুট করে মিশতে পারিনা কারো সাথে। লোক গানের আসর জমেছে। হাসন, লালন, শাহ করিম চলছে। হঠাৎ কেউ একজিন আর্টসেলের গান শুরু করলো। তাল কেটে গেছে আড্ডার। সবাই চুপ করে আছে। সে একাই ধৈর্য নিয়ে গাইছে।

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম।আকাশে বিশাল রূপালী চাঁদ। আমাকে দেখে আবারো ফিক করে হেসে উঠলো।
সকালে বান্দরবান পৌঁছেই থানচির পথে যাত্রা। এবার যাব চান্দের গাড়িতে। চান্দের গাড়ি আমার বিশেষ পছন্দ। নামটার জন্যতো বটেই। গাড়ি ছাড়লো। আমিও গলা ছাড়লাম। চলে আমার চান্দের গাড়ি.... যাইবো সোনা বন্ধুর বাড়ি....

ঘন্টা চারেক পর থানচি পৌঁছালাম। পথে একবার বমিও করলাম। পথে হলের সাবেক কয়েকজন সিনিয়রের দেখা পেয়েছিলাম। তাদের পাল্লায় পড়ে লেবুর শরবত খেয়েছিলাম খালি পেটে। চান্দের গাড়ির ঝাঁকুনিতে ফল পেলাম হাতেনাতে।

থানচি থেকে বের হতে বেশ সময় লেগে গেল। নানান কাগজপত্র সই করো। পুলিশের সামনে লাইন ধরে ছবি তুলো। কত কী।
দুইটার একটু আগে নৌকায় উঠলাম। খরস্রোতা সাঙ্গু নদী ধরে যাবে দেশীয় প্রযুক্তিতে বানানো স্পিডবোট। আমাদের আপাতত লক্ষ্য বড়পাথর। জায়গাটা নাকি বেশ চমৎকার। ওখানে রাতে ক্যাম্পিং করবো আমরা। স্রোতের বিপরীতে চলছে নৌকা। একেক নৌকায় ৫ জন করে।

যতই যাচ্ছি ততই পাহাড় তার রূপ মেলে সামনে দাঁড়াচ্ছে। একইরকম দেখতে পাহাড়ের কত বৈচিত্র্য। নদীর মাঝে প্রচণ্ড স্রোত। বড় পাথর এলাকাটায় নদীর বুক জুড়ে অনেক বড় বড় কিছু পাথর দাঁড়িয়ে আছে। সেসব পাথরের মাঝদিয়ে পথ বের করে নৌকা চালানোটা বেশ কষ্টসাধ্য কাজই মনে হলো।

ক্যাম্পিং এর জায়গায় পৌঁছে আমাদের হতাশ হতে হলো। জায়গাটা খালি নেই। বাঁশ কেটে কেটে নতুন দোকানপাট করছে স্থানীয়রা। ক্যাম্প করা যাবেনা। একে তো কোলাহল তার উপর জায়গাও কম৷ সিদ্ধান্ত হলো রাতে রেমাক্রি থাকবো। আরও আধ ঘন্টা বাদে রেমাক্রির দেখা পেলাম। পথে রেমাক্রি ফলস দেখে তো চোখ ছানাবড়া। দারুণ একটা জায়গা।

রেমাক্রি বাজারে থাকার ঘর নেওয়া হলো ওখানে তল্পি তল্পা রেখে কয়েকজন চলে এলাম রেমাক্রি ফলসে গোসল করতে। সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে ততক্ষণে। কী ঠাণ্ডা এখানকার পানি৷ আমি সারা শরীর ভাসিয়ে দিলাম পানিতে। উপরে চাঁদ উঠছে। কী সুন্দর! কী সুন্দর! চোখ বন্ধ করে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। নিজেকে কেমন পবিত্র লাগছে। আরামে চোখ বুঁজে আসছে এমনিতেই। ঘন্টাখানিক পর ফিরলাম।

রাতে গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো আমার। আরও কয়েকজনের এসেছিলো পরে জেনেছিলাম। ওষুধপত্র খেয়ে একটা ঘুম দিলাম। ভোরে উঠে দেখি গা ঝরঝরে। জ্বর হাওয়া। এবার আসল যাত্রা শুরু। হাঁটতে হবে৷

পাহাড়ি পাথুরে পিচ্ছিল পথ পেরিয়ে ঘণ্টা তিনেক বাদে পৌঁছালাম নাফাখুম ঝরণায়। এত কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এত মানুষ আসবে বিশ্বাসই হচ্ছে না৷ পুরো বাজারের মতো ভিড়। মনটাই খারাপ হয়ে গেল।

নাফাখুমে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার যাত্রা শুরু থুইসা পাড়ার দিকে। রেমাক্রি নদীটা বেশ কয়েকবার এপার ওপার করে, পিচ্ছিল পাথুরে পথ শেষ করে যখন থুইসা পাড়া পৌঁছি ততক্ষণে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে গেছে৷ সারাদিনের হেঁটে আসা ক্লান্তিতে ঘুম জড়িয়ে এলো।
রাতে খাওয়ার পর এবার জুম ঘরে বসে গানের পালা। সুনসান পাহাড়ের বুকে গলা খুলে গাইছি আমি। মাথার উপর মেঘ মেদুর আকাশ। ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে লজ্জাবতী চাঁদ। মাথার মধ্যে খেলা করছে সকাল হলেই পৌঁছে যাব আমিয়াখুম রাত গভীর হয়ে এলে গানের আড্ডা ভাঙে। মনের মধ্যে তবুও গান রয়ে যায়।

ভেলা চলে এসেছে৷ দেবতা পাহাড়ের নিচে পৌঁছালাম আবার। এখান থেকে অল্প দূরেই স্বপ্নের গন্তব্য আমিয়াখুম। এই দেবতা পাহাড় বেয়ে নামতে বেশ কষ্টই হয়েছে বলা যায়। খাড়া পাহাড় বেয়ে নামা প্রথম অভিজ্ঞতা ছিল অনেকের কাছেই।

আমিয়াখুম। অবশেষে পৌঁছাতে পারলাম। ভয়ংকর সুন্দর এক ঝরণা৷ আমার চোখ সরে না। কোন কোলাহল নেই৷ কোন গাড়ির হর্ন নেই, মোবাইল নেই। হারিয়ে যাবার জন্য এক আদর্শ জায়গা। আমিয়াখুম ঝরণার পাশেই রাতে তাবু করার ব্যবস্থা হলো। সেই রাত। ভয়ংকর সুন্দর রাত। ঝলমলে এক চাঁদ ঝুলে আছে পাহাড়ের মাথায়। মায়া মায়া আলো ছড়িয়ে হাসছে। তবে সে হাসি বেশিক্ষণ থাকেনি। ঘূর্ণিঝড় 'বুলবুল' এসেছিল সেই রাতেই। কী ভয়ংকর সেই রাত।

এই এক রাতের গল্প বলতেও আমার কয়েকরাত লেগে যাবে। হয়তো অন্যকোন সময় সে গল্পও বলা হবে।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +২/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ৩:৪৭

রাজীব নুর বলেছেন: এত কম ছবি দিলেন!!
আরও কিছু বেশি ছবি দিতেন।

২| ২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ বিকাল ৪:১৮

অপু তানভীর বলেছেন: বান্দরবানের অন্য দিক গুলোতে গেলেই এই নাফাকুম রেমাক্রিতে এখনও যাওয়া হয় নি । যাবো সামনে একদিন । ভ্রমন ব্লগে বর্ণনার চেয়ে যত বেশি ছবি যুক্ত হয় তত ভাল লাগে । আরও কয়েকটি ছবি যুক্ত করলে ভাল হত !

২৩ শে নভেম্বর, ২০২০ রাত ১০:০২

স্বপ্ন সতীর্থ বলেছেন: লেখার মাঝে মাঝে ছবি দিতে চেয়েছিলাম। পারি না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.