নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
রাস্তায় এখনো দিনের মতোই জট লেগে আছে। অজগর সাপের মতো গাড়ির লম্বা লম্বা লাইন। গাড়ি বলতে কেবল প্রাইভেট কারই বলা চলে। ফাঁকে ফাঁকে দু একটা দ্বিতল বাস ছাড়া আর তেমন কিছু চোখে পড়ছে না। মফস্বল এলাকা হলে এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে যেত চারদিক। স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকা শত শত গাড়িগুলোর হেডলাইটসহ রাস্তার দুপাশের লাইটগুলোর কারণে সেটা আপাতত আর হচ্ছে না। দুপদাপ পায়ের শব্দে ছুটছে মানুষ। তারপরেও পরিবেশটা কেমন যেন একঘেয়ে বিচ্ছিরি। একপ্রকার নীরস জিরজির ভাব।
রাস্তার পাশে একটা ল্যা¤পপোস্টের নিচে বসে আছে তিনটে ছোকরা। টিকলু, মন্টু আর কয়েছ। দেয়ালে দিয়ে গ্যাঁট হয়ে বসে ডান্ডি খাচ্ছে। ওদের খাওয়ার মধ্যেও একটা আর্ট আছে। যেন কোনো বনেদি ঘরের সন্তান ওরা। খাচ্ছে পুরোপুরি সাহেবি কায়দায। ওদের জীবনের সকল আনন্দ যেন এই একটি জায়গায়, এই অমৃত সুধার মধ্যেই।
রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে কত্ত মানুষ। বেশির ভাগই এদের দেখছে। কেউ কৌতুহল ভরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আড়ষ্ট চোখে ওদের দিকে তাকাচ্ছেন, কেউ আবার দেখেও না দেখার ভান করে চলে যান, খুব কমই ধমক দেওয়ার চেষ্টা করেন। এ যেন শহরের এক ওপেন সিক্রেট বিষয়। ডান্ডি খাচ্ছে এ আর এমন কী! মাঝে মাঝে শহরের পুলিশগুলোও এভাবে এড়িয়ে যায় টিকলুদের। এরকম ছেলেমেয়ের সংখ্যা এ শহরে কম করে হলেও আড়াই লক্ষ হবে। কজনকে ধরবে তারা? যদি ওরা তিনজন একা খেত তাহলে হয়তো একটা কথা ছিল। কিন্তু খায় তো টিকলুদের মতো সবাই।
এই শহরে টিকলুরা বেশ স্বাধীন। যখন ইচ্ছে যেখানে ইচ্ছে হুড়মুড় করে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাদের বিরক্ত করে না। বরঞ্চ টাকার জ্বালায় তারাই মানুষগুলোকে করে তুলে দারুণ অস্থির। আটার মতো লেগে থাকে মানুষের পিছু পিছু। বেলেল্লাপনার চূড়ান্ত পর্যায় যাকে বলে। হঠাৎ হঠাৎ দু একটা পুলিশ অবশ্য লাটি নিয়ে তাদের তাড়া করে। কিন্তু টিকলুরাও কম যায় না। ইট, কাঠ যা পায় তাই ছুড়ে মারে ঐ খচ্চর পুলিশগুলোর মাথায়। তারপর দু চোখ বন্ধ করে একেবারে বাঁদর দৌড়- দেখি শালা কোন বান্দির পুত আমাদের ধরে!
সেদিন এরকমই ধাওয়া খেতে খেতে টিকলুরা থামল একটা প্রাইমারী স্কুলের সামান্য আগে। ঘামের ছুটে টিকলু, মন্টু, কয়েস তিনজনেই ভিজে একেবারে জুবজুবে হয়ে গেছে। একটা রেন্ট্রি গাছের ছায়ায় বসে উদভ্রান্তের মতো তাকাচ্ছে এদিক সেদিক। হঠাৎ দেখল দশ-বারোটার মতো ছেলে একই ধরনের পোশাক পরে কোথায় যেন যাচ্ছে। সবার পিঠে কী সুন্দরে সুন্দর ব্যাগ ঝুলানো। সবাই মশগুল হয়ে আছে বিভিন্ন আলাপে। টিকলুদের মন উচাটন হয়। এই চিড়বিড়ে গরম উপেক্ষা করে তারা ওই ছেলেগুলোর পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। মিনিটখানেক পর ছেলেগুলো একটা বিশাল বড় বড় গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে। টিকলুরা যেই ঢুকবে গেটের দাঁড়োয়ান তার হাত দুটো দিয়ে গেটটা আলগে রেখে জিজ্ঞেস করল, “কী চাই?”
চোখেমুখে কেমন যেন কটমট কটমট ভাব।
টিকলুরা কোনো উত্তর না দিয়ে নির্নিমেষে তাকিয়ে দেখল ভেতরটা। কত্ত ছেলেমেয়ে ঐ এক রঙের পোশাক পরে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ওপাশ থেকে মাইকে আওয়াজ করে কী যেন বলছে আর ওরা একসাথে একবার পা উঠাচ্ছে, একবার নামাচ্ছে। একবার বসছে, একবার উঠছে। গেটের দাড়োয়ান এবারে বিরক্ত হয়ে টিকলুদের ধাক্কা মারতে থাকে- এই যা যা।
এসব যেন টিকলুরা শুনছেই না। রূপকথার রাজ্যে প্রবেশের পর মানুষের মুখখানা প্রথম যেমন রক্তশূন্য হয়ে যায়, চোখদুটি থাকে অপার বিস্মযে মোহময় অনেকটা সেরকম অবস্থা টিকলুদের। রূপকথার পরীকে দেখার মতো তাকিয়ে রইল ঐ রহস্যময় ছেলেমেয়েগুলোর দিকে।
টিকলু দাড়োয়ানকে জিজ্ঞেস করল, “ ওখানে কী হয়?”
নি®প্রাণ গলা।
দাড়োয়ানের মেজাজ আরো রুক্ষ হয়ে যায়। খেঁকিয়ে বলল, “ওখানে তোর বাপের শ্রাদ্ধ হচ্ছে নটির পুত, এবার যা, নইলে পেদিয়ে বিদায় করব।”
মন্টু আর কয়েস হাঁটতে থাকে অন্যদিকে। কিন্তু টিকলুর মন থেকে ঘোর যেন কাটছেই না। তৃষিতের মতো তাকিয়ে রইল স্কুলটার দিকে। বুকের ভেতর এক অহিংস্র অতৃপ্তি ছটফট ছটফট করছে তার। হঠাৎ মন্টু ডাকল, “এই চল।”
টিকলু এবার সম্বিৎ ফিরে পেল। বলল, “হ্যাঁ চল।”
আজ আর টিকলুর ডান্ডি খেতে ইচ্ছে করছে না। ডান্ডিখেলে তার মন আনচান করে উঠে খিলখিল অট্টহাসির মতো। তার মনের ভেতর বেজে উঠে সকল নিস্তব্ধতা, অন্ধকারের মাঝে আলোর মিছিল। আজ ডান্ডি ছাড়াই টিকলুর মনটা আনচান করে উঠল। টিকলুর চোখে পর্দার মতো লেগে রয়েছে ঐ দৃশ্যটি- একদল ছেলেমেয়ে একবার পা উঠাচ্ছে, একবার নামাচ্ছে। একবার বসছে, একবার উঠছে। এটা ছাড়া যেন আর কিছুই দেখতে পারছে না এই মুহূর্তে।
পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ উঠছে আকাশে। টিকলু সেদিকে সুবিমল প্রফুল্লতায় তাকিয়ে আছে। শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। অন্ধকারের মাঝে অনুভূত হচ্ছে হু হু আবহাওয়া। চারপাশের সবকিছুই জীবন্ত। কিন্তু এর মধ্যেও নির্জীব, পরমগম্ভীরভাব।
পরদিন টিকলু একাই সেই জায়গায় গেল। এ যেন ডান্ডির থেকেও বড় নেশায় পেয়েছে তাকে। কিছুক্ষণ মাতালের মতো এদিক ওদিক তাকাল। তারপর দাড়োয়ানকে ফাঁকি দিয়ে ফুড়–ৎ করে ঢুকে পড়ল ভেতরে। আজও ছেলেমেয়েগুলো গতকালের মতো লাইনে দাঁড়িয়ে আছে। টিকলু মুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখছে এসব। তার ভেতর আনন্দের কল্লোল ধ্বনি ছলছল করছে। তার সমস্ত দেহ ক¤পমান।
হঠাৎ সুবিকট চেহারার একটা লোক আসল টিকলুর দিকে। টাই-কোট পরা, মুখখানা দেখতে কাঁসার থালার মতো, পরিপাটি চুল, বেশ সুশৃঙ্খল পোশাক-পরিচ্ছদ।
“এই, এই দিকে আয়।” টিকলুকে লক্ষ্য করে হাঁক দিল লোকটি।
টিকলু গেল। তার চোখদুটি মারবেলের মতো গোল গোল দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে লোকটার দিকে।
লোকটার কাছে যেতেই টিকলুর চুলের মুঠি ধরে দু’গাল ভরিয়ে ধুমধাম কয়েকটা থাপ্পর মারল। ভাগ্যিস টিকলুর গায়ের রং ম্যাটমেটে কালো, নইলে এতক্ষণে পাকা টমেটোর মতো হয়ে যেত তার গাল দুটি।
টিকলু নিমিষেই নি®প্রভ হয়ে গেল। তার প্রসন্ন বদন অন্ধকার প্লাবনে ভেসে যায়। ভীত সন্ত্রস্ত মুখে একটা অব্যক্ত আর্তস্বর করতে গিয়েও থেমে যায়।
টিকলু এবার হাঁটতে লাগল গেটের দিকে। সব ছেলেমেয়েরা তার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তাচ্ছিল্যভাবে। টিকলু আর মাথা তোলার সাহস করল না বিন্দুমাত্র। সে জানে মাথা তুললে এক বীভৎস দৃশ্য ফুটে উঠবে তার চোখের সামনে। সেটা টিকলু সহ্য করতে পারবে না।
দাড়োয়ানটা তার পিছু পিছু বলছে, “এই বেশ হযেছে, আর শালা এদিকে পা মাড়ানোর সাহস পাবে না। ”
টিকলু এবারও নিরুত্তর, নিরুত্তাপ। না, আর এদিকে আসা যাবে না। এই জায়গাটাকে টিকলুর কাছে কালিমালিপ্ত দূষিত মনে হচ্ছে।
২| ২৬ শে জুলাই, ২০১৫ রাত ৮:৫৪
সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: হুম।। টিকলুরা আজও রুপকথার মতই দেখে স্কুল গুলোকে।
©somewhere in net ltd.
১| ২৬ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৫:০৭
বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: রুপকথার মতোই....