নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা : সমস্যা কোথায়?....

২৯ শে জুলাই, ২০১৫ বিকাল ৪:০৫

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রথম প্রথম আমরা সবাইই একটা বড়সড় হোঁচট খাই। এতদিন পড়াশুনা করলাম নিজের মাতৃভাষায় আর এখন পড়তে হচ্ছে একেবারে ভিন্ন একটি ভাষায- ইংরেজিতে। অনেকে বছর ছ মাসের মাথায় এই সমস্যাটা মোটামুটি কাটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। অনেকে আবার একদমই পারেন না। ছটফট ছটফট করে এক পর্যায়ে ডিগ্রিটাই পেয়ে যান অনায়াসে। তারপর এঁটোকাঁটার মতো ছন্নছাড়া হয়ে এদিক সেদিক হারিয়ে যায়। ইদানিং আমরা প্রশ্ন করতেও ভুলে গেছি। আমাদের বার বার ল্যাং মেরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আর আমরাও কেমন যেন মিইয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে আমাদের কম বেশি সকলের মনেই এই প্রশ্নটা জাগে। বাংলা থাকতে আবার ইংরেজি কেন? ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ দীর্ঘ বারোটি বছর এই ভাষার সাথে মাখামাখি করে আমরা বেড়ে উঠেছি। সে ভাষাটিকে কেন আমাদের ছাড়তে হবে? আমাদের প্রশ্নটা কেবল মনের ভেতরেই আকষ্মিক জেগে আকষ্মিক হারিয়ে যায়। যদিও প্রশ্নটা ফালতু কিছু নয়, বাস্তবিক।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার হর্তাকর্তাদের মতে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে। বর্তমান যুগ বিশ্বায়নের যুগ। এই বিশ্বায়নের সিনায় ভালোবাসার পরশ বুলাচ্ছে ইংরেজি ভাষা। তাই ইংরেজি ভাষা জানতে হবে। নইলে জাতি হিসেবে আমরা নির্বাণ লাভ করতে পারব না্। শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ করে উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি ভাষার গুরুত্ব প্রসঙ্গে তারা সব সময় এই ধরনের কিছু যুক্তি তর্ক করে থাকেন।
কিন্তু একটা বিষয়কে এস্টাবলিশ করতে গিয়ে যে আরো অনেক বিষয়কে অগ্নিগর্ভ হাঁ মুখের দিকে ফেলে দিচ্ছি সে বিষয়টা কি আমরা বুঝি না? নাকি বুঝার মতো মগজ নাই?
প্রথমত, আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে ছেলেমেয়েগুলো পড়তে আসে তাদের ইকোনমিক স্ট্যাটাস হিসেব করলে আমরা দেখব, যাদের আমরা এলিট সোসাইটি হিসেবে চিনি তাদের পরিবারের সন্তানেরা এখানে একেবারেই নগণ্য। এখানে ঐ হাকালুকি হাওরের পাশে ছোট্ট একটা ঘুপচি ঘরের মধ্যে বাস করা একটা ছেলে থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পদচারণাটাই মুখ্য। এই ছেলেমেয়েগুলো নামমাত্র ইংরেজির সাথে সম্পর্ক রাখে। তাও রীতিমতো বাধ্য হয়ে। কিন্তু এদের পড়াশুনার একমাত্র মাধ্যম বাংলা। এই মাধ্যমেই এরা একের পর এক ক্লাস পাশ করে উচ্চশিক্ষার দিকে ধাবিত হয়। এদের মাতৃভাষা বাংলা, হাসি-ঠাট্টা, রাগ-দুঃখ-ক্ষোভ, অনুধাবন সবকিছুর ভাষাই বাংলা।
দ্বিতীয়ত, ইংরেজি যেহেতু বিশ্বায়নের সিনায় ভালোবাসার পরশ বুলাচ্ছে তাই ইংরেজিকেও খুব একটা এভয়েড করা যায় না। তার উপর আবার দু’শ বছরের দাসত্বের রক্ত এখনো গঙ্গার স্রোতের মতো শরীরে বইছে। তাই প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে অন্যান্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি রাখা হয়েছে। ঠিক রাখাও নয়, এক প্রকার চাপিয়ে দেয়া যাকে বলে। এর আউটপুটটাও অত্যন্ত স্পষ্ট। ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরেও স্পিকিং তো দূরের কথা, মৌলিক বিষয়গুলো কয়জনে শিখে বা শিখতে পেরেছে? কিন্তু তারা তো অবলীলায় পরীক্ষায় ভালো করছে। রেজাল্টের পরপর তো আনন্দের বন্যা বয়ে যায় সারা দেশে।
বিশ্ববিদ্যালয় বলতে আমরা বুঝি জ্ঞান লাভের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীট। এখানে জ্ঞানের চর্চা হবে, নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হবে। এটাই হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কনসেপ্ট। এই জ্ঞান চর্চা এবং সৃষ্টির মধ্যে ভাষাকে কি আমরা একটা কনস্টেন্ট ভ্যালুর মতো নির্দিষ্ট রাখব? নির্দিষ্ট একটা ভাষায় জ্ঞানের চর্চা করতেই হবে, নইলে জাতি বিকশিত হবে না। নাকি যে ভাষাটা জ্ঞানের চর্চার অনুকূল, যে ভাষাটা একজন শিক্ষার্থী হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে পারবে সেটা?
আমরা হয়তো নিজ ক্ষমতা বলে অনেক বিষয় জোর করে চাপিয়ে দিতে পারি। কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবটাও তো আমাদের জানা দরকার। একজন শিক্ষার্থী যতই মেধাবী হোক না কেন নতুন একটা ভাষার কাছে সে সবসময়ই অসহায়। জ্ঞান চর্চার প্রসঙ্গ আসলে জ্ঞান শব্দটাকে ছেঁটে দিয়ে ভাষা নিয়েই তাকে বসে থাকতে হয়। ভিন্ন একটি ভাষা আত্তস্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত হতে হয়। যদিও গৃহে থেকে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না।
তাহলে ফলাফলটা কি দাঁড়াচ্ছে? বিশ্বায়নের দোহাই দিয়ে আমরা কিছু মেধাবী ছেলেমেয়েকে হারাচ্ছি। যে তার মেধা থাকা সত্ত্বেও ভাষার মারপ্যাঁচের কারণে সেটাকে প্রয়োগের পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না। আর যে ছেলেগুলো অতটা পন্ডিত হয়ে আসেনি, যাদের দায়িত্ব নিয়ে আমাদের উচিত ছিল তাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা। কিন্তু আমরা দেখি এরা ভাষার জালে অতি সহজেই আটকে নিজেদের বিসর্জন দিয়ে দেয়। হাতের চেটোতে পয়েন্ট লিখে পরীক্ষায় পাশ করে করে এক পর্যায়ে ডিগ্রিটাও অর্জন করে নেয়। অথচ চরিত্রগত ও জানার দিক দিয়ে তাদের পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হল।
সমাধানের কথা বললেই আমরা বিশ্বায়নের লেজ টেনে কথা বলি। তবে সমাধানের প্রসঙ্গ না তুলে আমরা যদি একটি বার জাপানের দিকে তাকাই, জার্মানি, ফ্রান্স কিংবা রাশিয়ার দিকে তাকাই তাহলে আশা করি কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমরা ওদের থেকে খুব একটা ভদ্র হয়ে যাইনি যাতে ওদেরকে স্রেফ উদাহরণ হিসেবেই দেখব। সামান্য হলেও শেখার আছে। আমরা কি এটা বুঝতে পারছি না, এভাবে চলতে গিয়ে আমরা এগিয়ে যাওয়ার বদলে নানা ভাবে পিছিয়ে পড়ছি।
ভাষা হিসেবে বাংলার একটা উজ্জল ইতিহাস আছে। যেটা আর কারো নাই। আমরা যদি ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটের একেবারে গোড়ায় গিয়ে কথা বলি তাহলে দেখব, মূলত তিনটি সংগঠন একেবারে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই মাতৃভাষা বাংলার ভাষার দাবিতে সোচ্চার ছিল। গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমুদ্দিন মজলিস। এদের মধ্যে প্রথম দুটি রাজনৈতিক ও তৃতীয়টি সাংস্কৃতিক। আমরা যদি এদের এজেন্ডাগুলো দেখি তাহলে দেখব, গণআজাদী লীগ তার ম্যানিফেস্টোতে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে উল্লেখ করে- “মাতৃভাষার সাহায্যে শিক্ষাদান করতে হবে।” গণতান্ত্রিক যুবলীগ তাদের ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবে উল্লেখ করে- “বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন আদালতের ভাষা করা হউক।” তমুদ্দিন মজলিসও তাদের একটি পুস্তিকায় উল্লেখ করে- “ বাংলা ভাষাই হবে : (ক) পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন। (খ) পূর্ব পাকিস্তানের আদালতের ভাষা। (গ) পূর্ব পাকিস্তানের অফিসাদির ভাষা।
তাহলে কি করছি আমরা? কার সাথে প্রতারণা করছি?
যে ভাষাকে নিয়ে আমাদের এত গৌরব সেই ভাষাকে আমরা কখনো জেনে, কখনো না জেনে টেনে হিঁচড়ে নিচে নামাচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আস্তে আস্তে আমরা বাংলাকে ঝেটিয়ে বিদায় করার সাথে সাথে শত শত ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল কলেজ গড়ে তুলছি। সেগুলো নামও কুড়োচ্ছে বেশ। মাতৃভাষাকে এরূপ ঝেটিয়ে বিদায় করার প্রবণতা কি শুধুই একটা সমস্যা নাকি পদক্ষেপ নেওয়ারও প্রয়োজন আছে? পদক্ষেপ গ্রহীতারাই এটা বোধ হয় ভালো বুঝবেন।




মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.