নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাজনের গল্প ..........

১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৭

সন্ধ্যাবেলা।
প্রবল ঠান্ডায় গায়ের মধ্যে শুধু একখানা চাদর জড়িয়ে বসে আছে পায়েল। আজ ঠান্ডার মাত্রাটা আসলেই বেশি। মনে হচ্ছে বডির জয়েন্টগুলো পর্যন্ত জমে গেছে। এর মধ্যে মাথাটাও ধরেছে। দুপুর থেকেই একটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে মাথার মধ্যে। তিন তিন কাপ রং চা শেষ করেছে অলরেডি। তারপরেও কমছে না। পায়েলের স্বামী হাসান সচরাচর সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে না। কোনো কোনো রাত বাড়ির বাইরেই কাটিয়ে দেয়। ছন্নছাড়া হয়ে থাকাটা যেন নেশা হয়ে গেছে হাসানের। সংসারের ব্যাপারে কেমন যেনো উদাসীন উদাসীন ভাব।
শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে পায়েলের। মনে হচ্ছে পাশের দোকান থেকে কোনো ওষুধ নিয়ে আসলে কাজে দিতে পারে। কিন্তু বিছানা থেকে উঠার একটুও শক্তি পাচ্ছে না সে। খানিকটা বিরক্তি নিয়ে চাদরের মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে আছে সেজন্য।
আচমকা পাশের ঘরে টিভির ঘরে টিভির শব্দে চমকিত হয় পায়েল। টিভিতে বিবিসির সংবাদ শুনতে পাচ্ছে সে। নিশ্চয়ই হাসান এসেছে। ওসব নিউজ হাসান ছাড়া এ তল্লাটে আর কারো মাথায় ঢুকে না। যত সব উদ্ভট উদ্ভট নিউজ! অথচ কী তন্ময় হয়ে হাসান এসব শুনে।
হাসানের সাথে কি এখন কোনো কথা বলবে পায়েল? কতক্ষণ ধরে বসে আছে কে জানে। এক কাপ চা দেয়া যায় কি? প্লাস্টিকের বৈয়ামটার মধ্যে ড্রাই কেকও কিছু ছিলো। কথাটা ভেবেই অন্যদিকে চিন্তাটাকে মুচড়ে দিলো পায়েল। না, হাসানের জন্য অন্তত আজকের দিনটাতে সে নিজেকে কোনো কষ্ট দিতে চায় না।
জীবনের প্রতি হাসান পুরোপুরিই কেয়ারলেস। পুরো ছাত্র জীবনটা সে পলিটিক্স করে পার করেছে। তার বন্ধুরা অনেকে বড়ো বড়ো অফিসে চাকরি করছে, অনেকে স্কলারশিপ নিয়ে চলে গেছে বিভিন্ন দেশে। শুধু মাত্র হাসান অকাল কুষ্মান্ডের মতো পড়ে আছে। একটা হাই স্কুলে টিচার হিসেবে আছে সে। মাস শেষে অল্প যে টাকাটা পায় তাতে অনেক টেনেটুনে চলতে হয়। তবে এসব নিয়ে হাসানের কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তার ভাষ্য মতে সে বেশ আছে, সুখে আছে।
দেশে কোনো আন্দোলন শুরু হলেই পায়েলের বুকটা ধরু ধুরু শব্দে বেজে ওঠে। এই বুঝি হাসান আবার মিছিল মিটিং এ জড়িয়ে পড়লো। ধানমন্ডির ঐ সবুজ রঙের দু’তলা বাসায় থাকার দিনগুলোর কথা ভাবলে আজো শিউড়ে ওঠে পায়েল। পুলিশ টেনে হিঁচকে নিয়ে যাচ্ছিলো হাসানকে! তারপর টানা তিন মাসের কারা জীবন। সেই ভয়ংকর দিনগুলোর কথা ভাবলে আজো পায়েলের শরীরের প্রতিটি রোম খাড়া হয়ে যায়।
হাসানকে বিশ্বাস করেছিলো পায়েল। অসম্ভব রকম বিশ্বাস। এই বিশ্বাসই মাঝে মাঝে এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরে অগ্নি পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় পায়েলকে।
দু’দিন আগে শহরের কোথায় নাকি একটা শিশুকে খুন করা হয়। খুন করে শিশুটির উপর অত্যাচারের ভিডিও ফুটেজ ছেড়ে দেয়া হয় ফেইসবুকে। এতে তোলপার শুরু হয়ে যায় পুরো দেশ জুড়ে। প্রতিটি স্তরের মানুষ স্লোগানে স্লোগানে মিছিল করে এর প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। হাসানও হারিয়ে যায় আন্দোলনের স্রোতে। খাওয়া দাওয়ার কোনো টাইম টেবিল নেই। কখন ঘর থেকে বের হয় কখন আসে সেটা ধরাও কঠিন হয়ে পড়ে।
কিছুক্ষণ টিভি দেখে পায়েলের খোঁজ করে আসলো হাসান। পায়েলকে এরকম গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতে দেখে হাসান একটু অন্যরকম হয়ে যায়। সে পায়েলের কাছে বসে তার মাথায় হাত রাখলো।
পায়েলের মুখের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো হাসান, “মাথাটা একটু গরম লাগছে যে-”
পায়েলের গলার স্বর এমনিতেই বসে গিয়েছিলো। কোনো মতে বললো, “খুব মাথা ব্যাথা করছে।”
“ওষুধ খেয়েছো।”
এবারে মুখ দিয়ে না বলে না সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে পায়েল।
“ঠিক আছে আমি নিয়ে আসছি।”
হাসান আবার বাইরে বেরিয়ে পড়ে। ব্যস্ততার জীবনকে খুব উপভোগ করে হাসান। তার মনে পড়ে যায় বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সেই ব্যস্ততম দিনগুলোর কথা। এক নেশায় রাজনীতি করতো হাসান। কদাচিৎ বিপদে পড়লো ক্লাসে যেতো শুধু। প্রতিটি সেমিস্টারে বিশেষ বিবেচনায় পরীক্ষা দিয়েছে। ভুলেও কোনো প্রাকটিক্যাল খাতা লিখে নি। প্রাকটিক্যাল খাতা ছাড়াই কোনো মতে পাশ করতো শুধু।
দমকা বাতাস আসছে দক্ষিণ দিক থেকে। গাছের পাতাগুলো নড়ছে, না দৌঁড়াচ্ছে সেটা বুঝা মুশকিল। আকাশে ওড়াওড়ি করছে কালো মেঘ। যেকোনো মুহূর্তে পুরো পৃথিবী গোসল করিয়ে দিবে মনে হচ্ছে। বাতাসের বেগ ক্রমাগত বাড়ছেই। মনে হচ্ছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার এটম বোমার মতো কোনো কিছু ধেয়ে আসছে। বাতাসের বেগ বাড়ার সাথে সাথে রাস্তার ধুলোবালিও লাফিয়ে উঠছে। বাতাসের সাথে এবার উড়তে লাগলো রাস্তার প্রতিটি ধূলিকণা। এর মাঝে বিষণ্ন মনে একটা গাছের নিচে বসে আছে ১৩-১৪ বছরের একটা শিশু। পরনে কেবলই একটা অপরিষ্কার প্যান্ট, পুরো গা খালি।
খুব অবাক হলো হাসান। এরকম পরিবেশে এত নিশ্চিন্তে একটা শিশু এখানে বসে আছে এটা তার দু’চোখ একদম বিশ্বাস করতে পারছিলো না। একটু এগিয়েই চমকে যায় হাসান। একেবারে হাজার ভোল্টেজের শক খাওয়ার মতো অবস্থা তার। এতো রাজন- সামিউল আলম রাজন। যাকে পুরো দেশ আজ চিনে। যাকে নিয়ে পুরো দেশ আন্দোলন করছে। যাকে কেন্দ্র করে ঘটে গেছে কোটি কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্য। প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের পকেট বেলুনের মতো ফুলে উঠেছে ঘুষের টাকায়।
হাসান রাজনকে দেখে চমকে উঠলেও রাজন পুরোপুরিই স্বাভাবিক। মুখ দিয়ে বুদ্ধিসুলভ একটা হাসি ছেড়ে বললো, “কী হাসান ভাই, এরকম ঝড় তুফানের রাতে কোথায় যাচ্ছে?”
রাজনের মুখে এরকম হাসি দেখে হাসান ভয় পেয়ে যায়। তার উপর এরকম বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন। গলার স্বর পুরোপুরি শুকিয়ে যায় হাসানের। হাসান আমতা আমতা করে বললো, “এ-এই এ-একটা ওষুধ কিনতে যাচ্ছি।”
রাজন জিজ্ঞেস করে, “আপনি অসুস্থ নাকি?”
হাসান উত্তর দেয়, “না না, আমার ওয়াইফ।”
“আপনি এতো ভয় পাচ্ছেন কেনো হাসান ভাই? আমাকে ভয় পাবার দরকার নেই। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলুন। আমি আপনার কিছু করবো না এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন। আচ্ছা কী হয়েছে জানি ভাবীর?”
রাজনের এরকম আশ্বাসে হাসান একটু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। বললো, “মাথাটা একটু গরম দেখেছিলাম, বলছিলো মাথা ব্যাথা করছে।”
“ওষুধ কিনেছেন?”
“না, এই তো কিনতে যাচ্ছি।”
“আমাকে মিনিট পাঁচেক সময় দিতে পারবেন? একটু কথা বলতাম।”
হাসানের মন থেকে ভয়টা এখনো যায়নি। তার উপর রাজন আরো সময় চাইছে। হাসান যদি না বলে, আর রাজন যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দেয়। তাহলে তো আরো বিপদ। হাসান জবাব দিলো, “হ্যাঁ, কোনো সমস্যা নেই।”
রাজন তার পাশের দুর্বাঘাসে আচ্ছাদিত জায়গাটি দেখিয়ে বললো, “এখানে বসতে কোনো সমস্যা আছে হাসান ভাই?”
হাসানের ওসব ছুঁতমার্গ একদম নেই। সে কিছু না বলে সোজাসুজি বসে পড়লো।
রাজন বললো, “আমাকে দেখে খুব অবাক হচ্ছেন, তাই না হাসান ভাই?”
হাসান বললো, “না হওয়ার কোনো কারণও তো দেখছি না। সবাই জানে তুমি আর বেঁচে নেই। তার মধ্যে এরকম জায়গায় তোমাকে দেখলে যে কোনো রক্ত মাংসের মানুষ ভিড়মি খাবে এ আর অস্বাভাবিক কী?”
“কিছুই অস্বাভাবিক নয় হাসান ভাই। অপমৃত্যুর আত্মাগুলো পৃথিবী জুড়েই ঘুরঘুর করতে থাকে। ঈশ্বর এদের গ্রহণ করতে চান না, যতক্ষণ না এরা এই অপমৃত্যুর প্রতিশোধ নিবে।”
“তাই নাকি?” ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করে হাসান।
রাজন মাথা নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ।”
“তো কবে মারছো ওদের।”
“সেটা নিয়ে আপনার মাথা ঘামানো লাগবে না হাসান ভাই। সে কাজ আমি যেকোনো মুহূর্তেই করতে পারবো। এখন বলুন আপনাদের আন্দোলনের কী অবস্থা?”
হাসান বললো, “ভালো। সাধারণ জনগণের এরকম ব্যাপক আকারে অংশগ্রহণ বিগত কয়েক বছরেও হয়নি।”
“গতকালের বিক্ষোভ সমাবেশে আপনার বক্তব্যটা কিন্তু দারুণ হয়েছে। একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছেন।”
একটু হতাশার ভঙ্গিতে বললো হাসান, “বক্তব্য দিয়ে আর কী হবে রাজন, খোদ প্রশাসনই এখন টাল্টিবাল্টি শুরু করে দিয়েছে। পুলিশ টাকা খেয়েছে, মন্ত্রী এমপিরা টাকা খেয়েছে, সবাই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।”
পাঁচ মিনিট নয়, রাজনের সাথে গল্প করতে করতে অবলীলায় আধা ঘন্টা কেটে গেলো। হাসান বুঝতেই পারেনি। তবে এতক্ষণ রাজনের সাথে কথা বলে হাসান জানতে পেরেছে অনেক কিছু। রাজন এতক্ষণ ধরে তার মনের সব লুকানো কথাগুলো হাসানকে বলেছে।
রাজন দেখছে, সবকিছু দেখছে। তার মুখটা একটু শুকনো লাগলেও ভালোবাসার এক নিখুঁত ছায়া এখনো সেখানে স্পষ্ট ধরা পড়ে। রাজন তার বুকের মধ্যে অনুভব করছে এক অদ্ভুত রকমের নির্জনতা। তার চেহারার মধ্যে কোনো রাগ নেই, বিদ্বেষ নেই, ঘৃণা নেই। কেবল তার কপালের মধ্যে একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। যে প্রশ্নের কোনো উত্তর রাজন পাচ্ছে না।
রাজনকে যখন ওরা নির্যাতন করা শুরু করেছিলো রাজন মোটেও অবাক হয় নি। এরকম নির্যাতন সহ্য করেই রাজন বড় হয়েছে। কারণের চেয়ে অকারণে মারের পরিমাণটাই বেশি ছিলো। দোকানে একটু আধটু ভুল করলেই দোকানদার কষিয়ে তার তলপেটে লাথি বসিয়ে দেয়, পাশের দোকানের আবুল চাচা তার সাথে একটু ফাইজলামি করতে করতেই তার গালে কষিয়ে দুইটা চড় মারেন, তাদের পাশের দালান বাড়িরর আনিস সাহেবের গাড়ির গ্লাসে একটু হাত লেগেছিলো বলে তার সর্ব শরীরে স্টীলের স্কেল দিয়ে পুরো পাঁচ মিনিট মেরেছিলেন।
কিন্তু সেদিন ওরা এতো হিংস্র হয়ে উঠলো কেনো? প্রশ্নটা এখনো রাজনের মাথায় চক্কর দেয়। রাজন এখনো বুঝতে পারেনি সেই কারণ। উত্তরের খোঁজে রাজন আজ ছুটছে এ জায়গা থেকে ও জায়গা, এ জেলা থেকে আরেক জেলা, পুরো বাংলাদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে রাজনের নির্লিপ্ত আত্মা। সে তার প্রশ্নের উত্তর খোঁজে।
যে জায়গায় ওরা রাজনকে হত্যা করেছিলো তার পাশেই রয়েছে একটা নামকরা মস্ত বড় বিশ্ববিদ্যালয়। রাজন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের গেস্ট রুমে উঁকি দিলো। উঁকি দিয়ে যা দেখলো তাতে এক ভয়ংকর শূণ্যতার মধ্যে ভাসতে লাগলো তার নির্লিপ্ত আত্মা।
তখন ছিলো রাত্রিবেলা। গেস্টরুমে সবাইকে ডাকা হয়েছে। সবাই বেশ অনুগতের মতো মুহূর্তের মধ্যেই এসে দাঁড়িয়ে গেলো। সোফার মধ্যে বসা তাদের হলের শ্রদ্ধেয় বড় ভাই। সবাই এসে গেলে কালো মতন একটা বড় ভাই, দেখলে মনে হয় সবে মাত্র গাঞ্জা খাওয়া পরবর্তী ঘুম সেরে এসেছে, সে বলা শুরু করলো, “এই আজ প্রভোস্টকে ফোন দিয়েছে কে?”
কথাটা ঘন্টা ধ্বনির মতো করে বাজলো শুভ্র নামক একটা ছেলের কানে।
“এই তাড়াতাড়ি বলে ফেল, নইলে কিন্তু সবকটার বাপের নাম ভুলিয়ে দিবো?”
গেস্ট রুমে দাঁড়ানো প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট ভয়ে কাঁতরাচ্ছে। সবার হাত-পা-পুরো শরীরে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিনবিনে ঘাম। সবার মুখ চুপসে একেবারে আমসির মতো হয়ে গেছে। শুভ্র নামক ছেলেটার পুরো দেহ যেনো একেবারে চেতনাহীন অবস্থায় লেপ্টে রয়েছে দেয়ালের সাথে। নড়ার বিন্দুমাত্র শক্তি সে পাচ্ছে না। তার মাথাটা ঘুরছে। পুরো দেহ অবশ হয়ে আসছে। কারণ শুভ্রই আজ প্রভোস্টের কাছে গিয়েছিলো। সে জানতো না হলের এসব বিদঘুটে নিয়ম কানুন।
শুভ্র অনেক কষ্টে হাত তুললো। তার দিকে তার প্রতিটি বন্ধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
সোফা থেকে বড় ভাইদের আরেক জন এসে শুভ্রর চুলের মুটি ধরে ইচ্ছেমতো কয়েকটা থাপ্পর দিলো দু’গালে। তারপর বললো, “এই শালা, সাহস তো কম করিসনি। সিটের জন্য প্রভোস্টকে ফোন দিস? গেটে আমাদের নাম আর মোবাইল নাম্বারের লিস্ট দেখতে পাস নি?”
শুভ্র কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “ভাইয়া দেখেছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি।”
বড় ভাইটি এবার আরো রেগে গেলো, “বুঝতে পারিসনি মানে? গেটম্যান তোকে কিছু বলেনি?”
শুভ্র এবার চুপ মেরে যায়। কারণ গেটম্যান তাকে বারণ করেছিলো সে শুনেনি। শুভ্রর এখন আর কিছু বলার নেই।
“এই সবাই শোন, শুধু এই হল না, এই ক্যাম্পাসের প্রতিটি হলের সিট আমরা দিই। তোরা প্রভোস্টকে ফোন দিতে পারিস। কিন্তু ওই প্রভোস্টই কিন্তু আমাদের পরে ফোন দেয় সিটের জন্য। সুতরাং বেশি লাফালাফি করিস না। আর কাউকে যদি এরকম দেখি প্রভোস্টের কাছে গেছে তো মেরে একেকটার পিঠের চামড়া তুলে ফেলবো।”
এ কোন আজব জায়গায় আসলো শুভ্র? এটা কি আদৌ কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, নাকি কিছু বর্বর মন মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের আবাসস্থল। শুভ্র এটার জন্য বিন্দুমাত্র প্রস্তুত ছিলো না। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের হল লাইফকে কল্পনা করেছিলো একেবারে অন্যরকম করে। সে ভেবেছিলো হলের সবাই তাকে বরণ করে নিবে আপন জনের মতো। নিজ পরিবারের লোকজনের মতোই সবাই তার দুঃখ কষ্ট বুঝবে। আর এটা আশা করাও দোষের কিছু ছিলো না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা পুরো জাতির কাছে একটা উদাহরণ। তাদের কাছে একটু স্নেহ-মমতা পাওয়ার আবদার শুভ্র রাখতেই পারে। কিন্তু স্নেহ মমতা পাওয়ার বদলে শুভ্র যেটা পেলো সেটা তাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে পুরোপুরি। শুভ্রর মাথাটা ঝিনঝিন করছিলো। নিজেকে মনে হচ্ছিলো পুরোপুরি মেরুদন্ডহীন একটা ছেলে। যার মধ্যে নূন্যতম প্রতিবাদ নেই, যাকে ইচ্ছে মতো পিঠানো যায়, দৌঁড়ানো যায়।
রাজন দেখে, তার মতো করেই তাগড়া তাগড়া জোয়ান ছেলেগুলোকে কখনো ন্যাংটো করা হচ্ছে, কখনো পিঠানো হচ্ছে, কখনো মুখের মধ্যে বল পূর্বক গাঞ্জা ঠেলে দেয়া হচ্ছে। দৃশ্যটি দেখেই তার পুরো শরীর রি রি করে উঠলো। এ কী দেখছে সে! এটা তো বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে পড়াশুনা করে দেশের সবচেয়ে মেধাবি ছাত্রছাত্রীরা। এরা রাজনের মতো দোকানে খেটে খাওয়া কোনো শিশু নয়, এরা রাজনের মতো অশিক্ষিত মূর্খ নয়। সর্বোচ্চ শিক্ষিতদের পীঠস্থানে এরা এসেছে। অথচ কি বিচ্ছিরি নির্যাতন এখানে। রাজন এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যায়, কোথাও এর ভিন্নতা দেখতে পায় না। হ্যাঁ, ভিন্নতা একটু আধটু আছে বটে। কোথাও লাটির বদলে ঝাঁটা দিয়ে পেটানো হচ্ছে, কোথাও পুরো ন্যাংটো না করে আন্ডারওয়্যার পর্যন্ত পড়ার অনুমতি আছে, কোথাও গাঞ্জার বদলে নিজের পেশাব চাটতে বলা হচ্ছে।
রাজন বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে ঘুরতে লাগলো হোটেলে হোটেলে, রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে, রেলস্টশনে, পথে ঘাটে সব জায়গায়। রাজনদের ভিড়ে জায়গাগুলো গমগম করছে। রাজন তার প্রচুর ভবিষ্যত সহযাত্রী পেয়ে গেছে ইতোমধ্যে।
হাসান উঠে পড়বে এমন সময় রাজন তার শেষ কথাটি বললো, “হাসান ভাই, আন্দোলনের মাধ্যমে ওদের মৃত্যু হলে আমার আত্মাটা মনে হয় স্বর্গে যাবে। আপনার উপর আমার পুরো পরকাল নির্ভর করছে হাসান ভাই।”
হুট করে বাতাসে মিলিয়ে গেলো রাজন।

বাসায় এসে হাসান বেশ চিন্তিত হয়ে যায়। পায়েলের হাতে ওষুধ গুলো তুলে দিয়ে টিভি ছাড়লো। রাজন হত্যার নিউজগুলো কেমন যেনো চাপা পড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। তাহলে কী সত্যি সত্যিই খুনিদের জয় হয়ে যাচ্ছে! না না, এ হতে পারে না। হাসান তাড়াতাড়ি শার্ট প্যান্ট পড়লো। ফোন দিলো সাদি ভাইকে- “সাদি ভাই, সবাইকে ডাক দেন। ইমিডিয়েটলি। একটা জরুরি মিটিং করতে হবে। আমি চলে আসছি। জাস্ট ফাইভ মিনিট।”
পাশের রুম থেকে সবই শুনতে পাচ্ছে পায়েল। না, পিয়াল আর কিচ্ছু বলবে না। হাসান যা ইচ্ছে তাই করুক।
পিয়ালই মনে হয় এই পৃথিবীতে একমাত্র স্ত্রী যে তার স্বামীর উপর বিন্দুমাত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেনি।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১২ ই আগস্ট, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৭

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সাগর রুনি আজ ইতিহাসের বিষয় হয়ে গেছে!! রাজনও হয়তো সে পথেই!

দু:খজনক!

হাসানেরা কষ্ট পায়.. মিছিল করে, গল্প লেখে......

দুষ্টচক্র তাদের কাজ চালীয়ে যায়...এক অন্তবিহীন লুপ!!!

২| ১৩ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১:৫৮

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: তবে হাসানদের এই আন্দোলনই আমাদের একমাত্র ভরসা। হাসানরাই আমাদের নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখায়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.