নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রঘুদার প্রথম কেস......(প্রথম পর্ব)

১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:২৬

১.
রঘুনাথ। নামটা শুনে ভড়কে যাওয়াটা স্বাভাবিক। ভাবছেন, রঘু ডাকাতের কথা বলছি। কিন্তু না, আমি রঘু ডাকাতের কথা বলছি না। আমি যার কথা বলছি সে হচ্ছে রঘুনাথ দাস। পেশায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর।
আমি হলাম অনিমেষ দাস। সিলেটের মুরারি চাঁদ(এম.সি.)কলেজে ইন্টারমিডিয়েট সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। রঘুদার সাথে আমার পরিচয় অনেক আগে থেকেই। আমার আর ওঁর বাড়ি একই গ্রামে। এস.এস.সি. পাস করার পর আমি এম.সি. কলেজে চান্স পেয়ে যাই, আর ঠিক সেই সময়টায় রঘুদা গোয়েন্দাগিরি শুরু করে। রঘুদার নিজের প্রসারের জন্য আর আমার ভালভাবে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে একটা ভাল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স প্রাপ্তির জন্য সিলেটে পাড়ি জমানোটা ছিল জরুরি। তাই পরিকল্পনা মত আমরা সিলেটে এসে একটি ছোটখাটো রুম ভাড়া করলাম। রুমটাতে কোনো রকমে দুটি বিছানা আর দুটি করে চেয়ার-টেবিল পাতা যায়। রান্নাবান্নার জন্য স্থানীয় এক মহিলাকে রাখা হল। মহিলার নামটা আজও জানি না। তবে বেশ কয়েকজনকে “বি®ঞুর মা” বলে ডাকতে শুনেছি। আমি ওসব নিয়ে বেশি মাথা ঘামাই না। উনাকে বি®ঞুর মা বলেই সম্বোধন করি। রঘুদাও তাই ।
আমাদের সিলেটে আসার প্রায় দেড় বছর হতে চলল। এর মধ্যে রঘুদা পাঁচটি মামলা পেয়েছে।আর সব কটাতেই সফল।তবে মক্কেলগুলো তেমন অবস্থাস¤পন্ন ছিল না। তাই তেমন মাল-পানি মিলে নি। এতে অবশ্য রঘুদার কোনো দুঃখ নেই । রঘুদা বলে, যেকোনো লাইনে নতুন অবস্থায় টাকাকড়ি কম মিলে। তবে ধৈর্য্য ধরতে হবে। স্ট্রাগল করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ ওঁ আমাকে মিঠুন চক্রবর্তীর কথা বলে। বলিউড টালিউড সবখানে সমান জনপ্রিয়তা এই তারকার। রঘুদা কিন্তু মিঠুন চক্রবর্তীর অনেক বড় একজন ফ্যান।

দিনটি ছিল শুক্রবার। সকালবেলা। আমার কলেজ বন্ধ। বি®ঞুর মা আজ একটু দেরিতে আসলেন। অন্যান্য দিন সকালের রান্নাটা নয়টার ভিতর শেষ হয়ে যেত। কিন্তু আজ প্রায় দশটার সময় তার আগমন ঘটল। রঘুদা কারণটা জিজ্ঞেস করাতে তিনি যেটা বললেন, সেটা রঘুদা প্রত্যাশা করুক আর নাই করুক আমি কিন্তু করি নি।
বি®ঞুর মা বললেন, “আর বলো না বাপু। যতসব উদ্ভট কান্ডকারখানা। ঐ রায় পাড়ার মুদি দোকানটায় গতকাল রাত নাকি চুরি হয়। দোকান থেকে প্রায় দুল টাকা উধাও। আজ সকালে সব জানাজানি হলে দোকানের সামনে বড়-সড় ভিড় জমে যায়। ভিড় জমেছে দেখে কৌতুহল নিয়ে আমি ঐ দিকে গেলাম। গিয়ে দেখি এই কান্ড।
“আমি থাকতে থাকতেই পুলিশ আসল। কতণ দেবুবাবুর সাথে কি সব কথাবার্তা বলল। তারপর”
রঘুদা বি®ঞুর মাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এই দেবুবাবুটা কে?”
“এই দেবুবাবুই হচ্ছেন দোকানের মালিক। পুরো নাম দেবাংশু রায়। তবে দোকানের দেখাশুনা, টাকা-পয়সা সামলানো এখন তাঁর দুই ছেলেই করে। দেবুবাবুর অনেক বয়স হয়েছে, তাই ওসবের ধার ঘেঁষেন না।”
“বুঝেছি, পরের ঘটনাটা বলুন।” রঘুদা বলল।
বি®ঞুর মা আবার শুর” করলেন, “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম, পুলিশ পরবর্তীতে দোকানের ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু ম্যানেজার বার বার টাকা চুরির বিষয়টা অস্বীকার করছে।”
“ম্যানেজার কেন? আপনি না বললেন দুই ছেলেই ব্যবসাপাতি দেখাশুনা করে।” রঘুদার প্রশ্ন।
“আরে সে তো নামমাত্র। দুই ছেলেই আরামপ্রিয় স্বভাবের। দোকানে কারো মন টিকে না। তাই দেবুবাবুর অনুমতি নিয়েই তারা ঐ ম্যানেজারকে রাখে। দোকানে যা বিক্রি হয় রাত্রে সে সবকিছুর হিসাব দেবুবাবুর বাড়িতে দিয়ে আসে। তবে ছেলে দুটি দোকানে একেবারে আসে না, এটা কিন্তু ঠিক নয়। প্রতিদিনই তারা ঘন্টা তিনেক দোকানের দেখাশুনা করে যায়। ভাগ্যিস দোকানে ভাল ব্যবসা হয়।নইলে এই পরিবার অনেক আগেই পথে বসত।” বি®ঞুর মা থামলেন।
রঘুদা প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, ম্যানেজারের পরিচয়টা বলতে পারবেন?”
“সে পারব না বাপু। তবে সিলেটের স্থানীয় নয়। তার জন্য দোকানের দুতলায় একটা রুমে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়েছে। এজন্য অবশ্য তার মাইনে থেকে কিছু টাকা কাটাও হত।” এই বলে বি®ঞুর মা রান্না করার জন্য চলে গেলেন। হঠাৎ আবার ফিরেও এলেন।
“একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কাল কিন্তু ঐ দোকানের পাশে আগুনও ধরেছিল। সাবধানে থেকো বাপু। ঘরবাড়ি ছেড়ে এসেছ, এখন যদি একটা অঘটন ঘটাও তাহলে এখানে খোঁজ নিতে কেউ আসবে না।এটা শহর বুঝলে, গ্রাম নয়।” বি®ঞুর মা উপদেশমূলক কথাগুলো দিয়ে আবার চলে গেলেন।
রঘুদা আমার দিকে তাকাল, “কিছু বুঝলি?
- “কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
রঘুদা বলল, “আরে গাধা, ঐ দোকানটার কথা বলছিলাম, যেখানে চুরি হয়েছে, আগুন ধরেছে।”
- এখানে আবার বুঝার কি হল? পুলিশ তো সমাধান করেই দিল।”
- “আমার মনে হয় একবার সেখান থেকে ঘুরে আসি। বি®ঞুর মার কথা শুনে মনে হল ঘটনাটা অন্য দিকে মোড় নিতে পারে।”
- “তাহলে যাবে রায় পাড়ায়?”
- “একবার গিয়েই দেখি না।যেতে তো আর মানা নেই।”
বি®ঞুর মার রান্না শেষ হতে হতে বেলা প্রায় এগারোটার মত হয়ে গেল। আমি আর রঘুদা তাড়াতাড়ি খেয়ে নিলাম। এমনিতেই সকাল থেকে ক্ষিদের জ্বালায় পেটটা কচকচ করছিল। রঘুদারও মনে হয় একই দশা ছিল। কারণ খাওয়ার সময় দেখলাম বেশ হাত চালিয়ে খা”েছ। সাধারণত এরকম হয় না। খাওয়া শেষে রঘুদা রায় পাড়া যাবার রাস্তাটা বি®ঞুর মার কাছ থেকে জেনে নিল।আমাদের এখান থেকে বেশি দূরে নয়। হাঁটলে বড় জোর দশ মিনিট।এর থেকে বেশি লাগার কথা নয়। আর দেবাংশুবাবু এই রায় পাড়ারই বাসিন্দা। তাই রঘুদা প্রথমে দেবাংশবাবুর বাসায় যাবে বলেই ঠিক করল।

তখন বিকেল ৪টা। আমি আর রঘুদা রায় পাড়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছি। সাধারণত কলেজ ছাড়া বাইরে কোথাও যাবার সুযোগ পাই না। আজ রঘুদার সাথে এই দশ মিনিটের রাস্তা হাঁটার মধ্যেও কেন জানি অ্যাডভেনচারের গন্ধ পাচ্ছি।
আমরা অবশ্য দশ মিনিটের আগেই রায় পাড়ায় পৌঁছে গেছি। রাস্তায় একটা লোককে রঘুদা দেবাংশবাবুর কথা বলতেই সে বাসার রাস্তাটা বাতলে দিল। রায় পাড়ার মেইন রাস্তা থেকে সোজা গিয়ে বাম দিকে যে রাস্তাটা গেছে সেখানেই। তবে লোকটা বাসার নাম্বার বলতে পারে নি। শুধু বলল, টিনে ছাওয়া বড় একটা বাসা। আমাদের অবশ্য বাসাটা বের করতে তেমন কষ্ট হয় নি। লোকটার কথামতই বাসাটা পেয়ে গেলাম।
বাসার বাইরে বেশ পুরনো ধাচের একটা গেইট। গেইটের পাশে কলিং বেল। রঘুদা বেল চাপতেই ভিতর থেকে একজন ভদ্রলোক আসলেন। দেখে মনে হল দেবাংশবাবুর ছেলেই হবেন। বয়স অন্তত পঁচিশ। রঘুদা জিজ্ঞেস করল, “এটা কি দেবুবাবু আই মীন দেবাংশ রায়ের বাসা?”
ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, আমি উনার বড় ছেলে।”
-“আপনার নামটা?”
-“বিপ্লব রায়। কেন বলুন তো?”
রঘুদা বিপ্লববাবুকে তাঁর কার্ডটা দেখাল। আর সাথে সাথেই বিপ্লববাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, “দেখুন মশাই, আমাদের ঝামেলা মিটে গেছে। দোষী পুলিশের জিম্মায়। এর মধ্যে আপনি আরেকটা ঝামেলা পাকাতে চান এটা আমি চাই না।”
রঘুদা সবকিছু হজম করে বলতে শুরু করল, “দেখুন, আমি কোনো ঝামেলা পাকাতে আসি নি। আমি শুনেছি যে, আপনাদের দোকানে চুরি হয়েছে, পুলিশ দোকানের ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে গেছে। কিন্তু এতে কি আপনাদের টাকাটা মিলল? আপনি যদি চান আমি সে ব্যাপারে তদন্ত চালাতে পারি। আর হ্যাঁ, যদি আমি আপনার টাকাটা ফেরত দিতে না পারি তাহলে আমার ভিজিটও দিতে হবে না। এবার আপনিই চিন্তা করুন।”
রঘুদার কথায় যে বেশ কাজ হয়েছে সেটা বিপ্লববাবুর মুখ দেখেই বোঝা গেল। তিনি রাগের মাত্রা জিরো ডিগ্রিতে নামিয়ে মাথায় চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আসুন ভিতরে।” এবারে ভদ্রলোকের কথায় একটু কোমলতার আভাসও ফুটে উঠল। আমরা ভিতরে গেলাম। বাসাটা বেশ বড়। তবে চারিপাশে যে হারে বড় বড় দালানকোঠা গড়ে উঠছে তার মাঝে কিন্তু এই বাসাটা চোখে পড়ার মত নয়। বেশ পুরাতন। তবে বাসার ভিতরে কিন্তু আধুনিকতার ছোঁয়া রয়েছে। বিপ্লববাবু আমাদের ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে দেবাংশবাবুকে ডাকতে গেলেন। আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতেও হয় নি। মিনিট দুয়েক পরেই দেবাংশবাবু হাজির হলেন। তাঁকে দেখেই আমি আর রঘুদা সোফা থেকে দাঁড়িয়ে নমস্কার দিলাম।
- “নমস্কার, নমস্কার, আরে বসুন না।” বলে দেবাংশবাবুও একটা সোফায় বসে পড়লেন।
“আপনিই কি গোয়েন্দা?” রঘুদার দিকে চেয়ে দেবাংশবাবু প্রশ্ন করলেন।
বুঝলাম, বিপ্লববাবু আমাদের স¤পর্কে দেবাংশবাবুকে বলেছেন। রঘুদা জবাব দিল, “হ্যাঁ, আমিই-। আমার নাম রঘুনাথ দাস। আর এই হচ্ছে আমার ছোট ভাই অনিমেষ দাস।”
রঘুদা নিজের ছোট ভাই বলেই আমার পরিচয় দেয়। ভালোই লাগে। তাই আমিও কোনো আপত্তি করি না।
-“বেশ, বেশ।” দেবাংশবাবু বললেন।
তারপর একটু থেমে আবার শুরু করলেন, “আসলে গতকালের ঘটনায় মনটা পুরো খারাপ হয়ে গেছে। জীবনে এই প্রথম এত টাকার লসে পড়লাম। দোকানটা যখন শুরু করি তখন আমি পুরোপুরি ইয়াং। অনেক অভাব অনটনের মধ্যেও আমি দোকানটাকে ধরে রেখেছি। বিনিময়ে পেয়েছি এই বাসা। বুক ফুলিয়ে বলতে পারছি আমার নিজের বাসা। আজ এই দোকানে চুরি হল। খবরটা শুনে বড় একটা আঘাত পেলাম। জীবনে খুব কমই এরকম আঘাত পেয়েছি।” দেবাংশবাবু থামলেন।
- “আচ্ছা, গতকালের ঘটনাটা যদি একটু পরিস্কার করে বলেন তাহলে খুব ভাল হয়।” – রঘুদা বলল।
রঘুদার কথা শেষ হতেই বিপ্লববাবু একপ্লেট বিস্কুট নিয়ে হাজির। তবে এবার বিপ্লববাবুর সাথে আরেকজনকে দেখলাম। দেখে মনে হল বিপ্লববাবুর থেকে বছর দুয়েকের ছোট। বিপ্লববাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন যে ইনি তার ছোট ভাই। নাম প্রিয়জিৎ রায়। প্রিয়জিৎবাবুর সাথে পরিচিত হবার পর প্রিয়জিৎবাবু ও বিপ্লববাবুর সামনেই দেবাংশবাবু শুরু করলেন, `আমার ছেলে দুটি হচ্ছে নির্ষ্কমার ঢেঁকি। কাজের বেলায় গায়ে ফুঁ দিয়ে চলে। বিয়ে হলে কি হবে জানি না। তবে এখন তো আমার রক্ত চোষে খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। একটা দোকান পর্যন্ত দেখে রাখতে পারে না। কোত্থেকে একটা লোককে এনে দোকানে বসিয়ে দিল। অবশ্য এখানে আমারও দোষ ছিল। লোকটাকে রাখতে দেওয়াই ছিল অনেক বড় ভুল। যাক গে সেসব কথা। কালকের ঘটনায় আসছি।
“রাত্রে আমি শুতে গেছি। তখন প্রায় বারোটা বাজে। হঠাৎ প্রিয়জিৎ আমার ঘরে এসে বলে, দোকানের পাশে আগুন ধরেছে। তাকে নাকি ম্যানেজার ফোন করে জানিয়েছে। বিপ্লব তখন ঘুমে ছিল। প্রিয়জিৎ তাকে ডেকে তুললে সেও আমাদের সাথে গেল।”
“আমাদের এখান থেকে মিনিট পাঁচেকের রাস্তা। গিয়ে দেখি আশেপাশের লোকদের প্রচেষ্টায় আগুন নেভার পথে রয়েছে। আর আমাদের দোকানেও আগুন লাগে নি। খুব স্বস্তি পেলাম। কিন্তু বাজটা পড়ল তখনই যখন ম্যানেজার বলল দুলক্ষ টাকা চুরি হয়েছে। কেন জানি না সব রাগ গিয়ে পড়ল ঐ ম্যানেজারের উপর। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রাখি।”
“আস্তে আস্তে সকাল হল। দোকানেই আমরা সবাই নির্ঘুম রাত কাটালাম। এতক্ষণে খবরটা পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। তাই দোকানের বাইরে বড়-সড় একটা ভিড় জমে গেছে। হঠাৎ পুলিশ আসল। আমি তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিলাম। তারা বিপ্লব, প্রিয়জিৎ, ম্যানেজারকে নানান বিষয়ে জিজ্ঞেস করল। তারপর দোকানের দুএকটা জিনিস নাড়াচাড়া করে আমায় বলল যে, তাদের ধারণা ম্যানেজারই টাকাটা চুরি করেছে। তাই তারা ম্যানেজারকে ধরে নিয়ে যায়। আমিও আপত্তি করতে পারি নি। কিন্তু ম্যানেজার বারবার বলছিল সে টাকাটা চুরি করে নি। তার কথা সত্যি কি না জানি না। তবে রঘুবাবু, আপনি যদি টাকাটা ফেরত দিতে পারেন, আমি আপনাকে যথেষ্ট পারিশ্রমিক দেব।”
“ পারিশ্রমিকের হিসাব পরে হবে। তার আগে ম্যানেজারের পরিচয়টা যদি একটু বলতেন।” রঘুদা বলল।
দেবাংশবাবু বললেন, “ম্যানেজারের নাম রাজকুমার সাহা। বাড়ি নেত্রকোণায়। তবে সিলেটেই সবকিছু। প্রায় কুঁড়ি বছর ধরে সিলেটে আছে। আজ ও দোকান, কাল ও দোকান এভাবেই কাজ করছে। তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নেত্রকোণায়ই থাকে। তাছাড়া প্রতি মাসে বেতন নিয়ে দিন পাঁচেকের ছুটিতে সে নেত্রকোণায় যেত।”
দেবাংশবাবুর সাথে কেসটা নিয়ে এটুকুই কথা হল। তারপর যতক্ষণ ছিলাম ততক্ষণ বিপ্লববাবু ও প্রিয়জিৎবাবুর সাথেই কথা হয়েছে। তাদের সাথে কথাবার্তা বলে কেসে সহায়তা করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া গেল না। তবে এটা জানতে পেরেছি যে, দোকানের টাকা পয়সা রাখার দায়িত্ব বিপ্লবাবুই পালন করেন (যদিও বি®ঞুর মা বলেছিল কাজটা দুইভাই-ই করেন। হয়তো একথা লোকমুখে প্রচারিত। আর তা থেকেই বি®ঞুর মা বলেছিলেন)। তবে প্রিয়জিৎবাবুকে সপ্তাহে সপ্তাহে হাত খরচের টাকাটা পেতে কোনো অসুবিধা হয় না। বিপ্লববাবুকে বললেই তিনি ছোট ভাইকে টাকাটা দিয়ে দেন। আরেকটা কথা। দেবাংশবাবুর স্ত্রী বছর ছয়েক আগে মারা যান।
দেবাংশবাবুর বাসা থেকে যখন বেরুই তখন সোয়া পাঁচটা বাজে। আমরা ঘটনাস্থল দেখতে রওয়ানা দিলাম। দেবাংশবাবু বললেন পাঁচ মিনিটের রাস্তা। তাই রঘুদা এই সিদ্ধান্ত নিল। দেবাংশবাবু অবশ্য তাঁর ছোট ছেলে প্রিয়জিৎ রায়কে আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দিয়েছেন।
আমি, রঘুদা আর প্রিয়জিৎবাবু হেঁটেই ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হলাম।

রাস্তায় রঘুদা একটা অদ্ভুত কান্ড করে বসল। অবশ্য সেটা সবার কাছে অদ্ভুত মনে নাও হতে পারে। তবে রঘুদা আমায় বেশ কয়েকবার এরকম কাজ করতে বারণ করেছে। রঘুদা বলে, এতে নাকি ছোটলোকের মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু আজ রঘুদা নিজে এটা করল কেন? আমি এর উত্তর খুঁজে পেলাম না। ঘটনাটা বলছি। দেবাংশবাবুর দোকানের দিকে যাচ্ছি, এমন সময় রঘুদা হঠাৎ প্রিয়জিৎবাবুকে বলে উঠল, ‘আপনার মোবাইলে ব্যালেন্স আছে?’
-‘হ্যাঁ।’
-‘আসলে আমার মোবাইলটা বাসায় রেখে এসেছি। যদি আপনার মোবাইলটা একটু দেন, মানে একজনের সাথে কথা বলার ছিল আর কি।’
একেবারে টাটকা মিথ্যা কথা। কারণ বাসা থেকে বেরুবার সময় আমি নিজের চোখে দেখেছি, রঘুদা তাঁর পকেটে মোবাইলটা নিয়ে নিয়েছে। আর মোবাইলে ব্যালেন্সও আছে। কারণ আমার মোবাইলে ব্যালেন্স না থাকার কারণে গতকাল আমি আমার দুই বন্ধুকে রঘুদার মোবাইল থেকে ফোন করেছিলাম। তখন প্রায় ৫০ টাকার মত তাঁর ব্যালেন্সে ছিল। যাই হোক। প্রিয়জিৎবাবু মোবাইলটা দিয়ে দিলেন। রঘুদা মোবাইলে কিছুক্ষণ টিপাটিপি করে ‘হ্যাঁলো, হ্যাঁলো’ বলে প্রিয়জিৎবাবুকে মোবাইলটা দিয়ে বলল, ‘বন্ধ মনে হয়। বাসায় গিয়েই করব। চলুন।’
যখন দোকানে পৌঁছলাম, তখন আনুমানিক পাঁচটা বাইশ কি তেইশ হবে। প্রথমে দোকানের কিছু বর্ণনা দিচ্ছি। আমরা গিয়ে দোকানটা বন্ধ পেলাম। হয়তো চুরির ঘটনার রেশ কাটলে আগামি দু’এক দিনের মধ্যেই বিপ্লববাবু ও প্রিয়জিৎবাবু আবার চালু করবেন। তবে দোকানটা কিন্তু চোখে পড়ার মত। আর দোতলা মুদি দোকান আমি নিজেও কম দেখেছি। তাছাড়া আশেপাশেও কোনো দোতলা দোকান নেই। তাই দেবাংশবাবুর দোকানটাকে একটু অন্যরকম লাগাটাই স্বাভাবিক। দোকানের পিছনে বেশ কিছু জায়গা খালি। প্রিয়জিৎবাবুকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, জায়গাটা তাদের নয়। আমরা দোকানে ঢুকে প্রথমেই দেখলাম, কোনো একটা কিছুর আঘাতে ক্যাশের তালাটা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। রঘুদা ভাঙ্গা তালাটা নিয়ে ভালভাবে কিছু একটা পর্যবেক্ষণ করল। তারপর সেটা প্রিয়জিৎবাবুকে দিয়ে দিল। দোকানের দোতলায় কিছু জিনিস পত্তর রাখা। সবকিছুই বস্তায় ভর্তি। তার পাশে একটা রুম। এখন তালা দেওয়া। এখানেই ম্যানেজার রাজকুমার সাহা থাকতেন।
‘রুমটা খোলা যাবে কি?’ রঘুদা প্রিয়জিৎবাবুকে প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, অবশ্যই।’ বলে প্রিয়জিৎবাবু তার পকেট থেকে একটা চাবি বের করে তালাটা খুলে দিলেন। সাথে সাথে আমরা রুমটিতে প্রবেশ করলাম।
অত্যন্ত সাদামাটা রুম। একটা বিছানা, দুটি চেয়ার, একটা ব্যাগে কিছু কাপড় চোপড়, আর রান্নার বাসন-কোসন। এটুকুই । রুমে একটি কাচের জানালা রয়েছে। প্রিয়জিৎবাবু জানালাটা খুললে দেখলাম, দোকানের পিছনের খালি জায়গাটা ভালভাবেই দেখা যায়।
‘আচ্ছা প্রিয়জিৎবাবু, আগুনটা কোথায় লেগেছিল?’ রঘুদা প্রশ্ন করল।
‘ঐ তো ঐ খালি জায়গাটার পাশে।’ বলে প্রিয়জিৎবাবু জানালা দিয়ে জায়গাটা দেখিয়ে দিলেন।
‘চলুন সেখানটায় একটু যাই।’
রঘুদার কথামত আগুন ধরার জায়গাটায় যাওয়া হল। দেখলাম, বেশ কিছু অংশ পুরে একেবারে ছাই হয়ে গেছে। তবে সামান্য হলে দোকানটা জ্বলে যেত। আধাপুরা জায়গাগুলোতে কিছু আধাপুরা খড়ও দেখতে পেলাম। কিন্তু এখানে খড় আসবে কোত্থেকে? এ তো আর গ্রাম নয় যে হাত বাড়ালেই খড় পাওয়া যাবে। আমার মনে হয় বিষয়টা রঘুদার নজরেও পড়েছে। রঘুদা গোয়েন্দা মানুষ। ওঁর নজরে আমার থেকে আরো বেশি ক্লু পড়াটাই স্বাভাবিক। হঠাৎ রঘুদা পকেটে হাত দিল। ‘আরে, আমার মানিব্যাগ কই? রঘুদার চোখে মুখে উত্তেজনা। আমি দেরি না করে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না। প্রিয়জিৎবাবুও আমার সাথে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন।
এমন সময় রঘুদা চেঁচিয়ে উঠল, ‘এই তো পেয়ে গেছি!’ যাক বাঁচা গেল। নইলে এক কেসে এসে দুটি কেসের ফাঁদে পড়তে হত।
‘কি মশাই? মানিব্যাগটা সামলে রাখতে পারেন না?’
প্রিয়জিৎবাবু একটু রাগান্বিত হয়েই রঘুদাকে প্রশ্নটা করলেন। রঘুদা হাসি মুখেই উত্তর দিল, ‘হাঁটতে হাঁটতে কখন যে পড়ে গেছে টেরই পাই নি।’
‘আপনাদের গোয়েন্দাদের এরকম হলে সাধারণ মানুষের কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন?’
রঘুদা প্রশ্নটাকে এড়িয়ে প্রিয়জিৎবাবুকে বলল, ‘ছাড়ুন মশাই। এবার বাসায় যাই। সবকিছুতেই রহস্য রহস্য গন্ধ লাগছে।’
‘ঠিকই বলেছেন। চলুন।’
আমরা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। হঠাৎ দেখি প্রিয়জিৎবাবু সিগারেট জ্বালানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তিনি রঘুদার দিকে চেয়ে বললেন, ‘খাবেন?’
রঘুদা জবাব দিল, ‘অভ্যেস নেই।’
-‘ভালো রঘুবাবু। খুব ভালো। অভ্যেস হলেই বিপদ। এই দেখুন না এক প্যাকেট সিগারেটে দু’দিনের বেশি চলে না। অবশ্য গতকালের ঘটনায় রুটিনটা ওলটপালট হয়ে গেছে। নইলে আজ এই প্যাকেটটা না দেখে নতুন একটা দেখতেন।’ বলে ম্যাচের কাটি দিয়ে প্রিয়জিৎবাবু সিগারেটটা ধরালেন।
ঠিক এই সময় রঘুদা প্রিয়জিৎবাবুর দিকে ঝুঁকে বলল, ‘আপনার সিগারেট খাওয়ার স্টাইলটা কিন্তু খুব ফ্যান্টাসটিক।’
- ‘আপনি তো দেখছি রসিকতাও জানেন।’ বড় একটা হাসি হেসে প্রিয়জিৎবাবু কথাটা বললেন। র
ঘুদাও ছোটখাটো হাসি হেসে ভদ্রলোকের কথায় সায় দিল। কিন্তু রঘুদা প্রিয়জিৎবাবুর সাথে এরকম রসিকতা করল কেন? ওঁ কিন্তু সচরাচর এরকম করে না। তাহলে কি এটা তদন্তেরই একটা অংশ? নাকি স্রেফ গ্যাস মারা? কিছুই বুঝতে পারলাম না।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৩৩

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: খুব চমৎকার এগুচ্ছে। আপনার লেখা আমার বেশ ভালো লেগছে। পরের পর্বের জন্য অপেক্ষা করছি।

২| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:৩৩

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: খুশি হলাম। আশা করছি আরো ভালো লেখা নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হতে পারবো। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

৩| ১৯ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৫:২৩

সাহসী সন্তান বলেছেন: প্রিয়জিৎ বাবুর সিগারেট খাওয়ার স্টাইলের চেয়ে আপনার লেখার স্টাইলটা কিন্তু আরো অনেক বেশি ফ্যানটাস্টিক.......!! সত্যিই অসাধারন........!!



আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছিল যেন, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সমগ্র পড়ছি। দারুন, চালিয়ে যান.......!

৪| ২০ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১২:১৬

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা সমগ্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই লেখা শুরু করি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.