নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রঘুদার প্রথম কেস......( দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:১৮


প্রিয়জিৎবাবু আসার সময় রায় পাড়ার দিকে চলে যান। আর আমরা আমাদের বাসার দিকে চলে আসি। আমার মাথায় কিন্তু অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। মনস্তির করলাম যে, বাসায় যাওয়ার সাথেসাথেই রঘুদার পেট থেকে সব প্রশ্নের উত্তর বের করব। অবশ্য রঘুদার যদি সেই মুড থাকে। কারণ মাঝে মাঝে সে এমন গোমড়া মুখ করে থাকে যেন সে এক জায়গায় আর দুনিয়া আরেক জায়গায়। আর সেটা হয় তখনই যখন জটিল কেস আসে।
বাসায় পেীঁছলাম সোয়া ছয়টার দিকে।তখন প্রায় সন্ধ্যা। হাত-মুখ ধোঁয়া পর্যন্ত অপেক্ষা না করে প্রথমেই রঘুদাকে প্রশ্ন করলাম, ‘রঘদা, তুমি মোবাইল নিয়ে এই নাটকটা করলে কেন?’
-‘আমি কি শুধু মোবাইল নিয়েই নাটক করলাম?’ বলে রঘুদা হাসি মুখে আমার দিকে তাকাল।
‘আরে বোকা, নাটক একটি নয়, নাটক হয়েছে তিনটি।’ রঘুদা বলল।
আমি তো একেবারে হতভম্ভ হয়ে গেলাম। মুখে নানান কেীতুহল নিয়ে রঘুদাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’
`মানেটা পরে বুঝবি।যখন ফাইনাল খেলে ট”ফিটা ঘরে আনব। এখন কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে সেমি ফাইনালে এসে গেছি। শুধু এটুকুই বলতে পারব।’
রঘুদার কথাটা থেকে বেশি কিছু না বুঝলেও এটা ধরতে পেরেছি যে, রঘুদা আলোর আভাস পাচ্ছে। রঘুদা আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার চান্স না দিয়ে হাত মুখ ধুতে বাথরুমে চলে গেল। রঘুদা ফিরে এলে আমিও হাত-মুখ ধুয়ে নিলাম। এরপর বেশ কিছুক্ষণ মামলাটা নিয়ে আর কথা হল না। তবে আমি যখন পড়তে বসেছি তখন রঘুদা আমার টেবিলের পাশে এসে বলল, ‘তোর কি মনে হয়?’
‘কেসটা সম্পর্কে?’
‘হ্যাঁ।’
আমি একটু ভেবে বললাম, ‘আমার ধারণা পুলিশের সিদ্ধান্তই সঠিক। কারণ ম্যানেজারের অর্থাৎ রাজকুমারবাবুর সংসারে যে অভাব আছে সেটা তো তার লাইফ স্টাইল দেখেই বোঝা গেল। নইলে স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে সিলেটে এসে কাজ করে? ধরলাম কুঁড়ি বছর ধরে সিলেটে আছে, তাহলে তো তার স্ত্রী-সন্তানদেরও এখানে আনতে পারে। কিন্তু আনছে না। আর কারণটা হল দারিদ্রতা। আর দারিদ্রতা ঘোচাতে কি দরকার? নিশ্চয়ই টাকা। অনেকে সেটা সৎ পথে উপার্জন করে, আর অনেকে অসৎ পথে। এখানে রাজকুমারবাবু কাজটা করেছেন অসৎ পথে।’
` বুঝলাম, কিন্তু তাহলে টাকাগুলো কোথায় গেল?’ রঘুদার প্রশ্ন।
আমি বললাম, ‘হয় তো ভদ্রলোক টাকাগুলো কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। তাছাড়া তিনি এভাবে ফেঁসে যাবেন সেটাও হয় তো ভাবেন নি। তিনি ভেবে থাকতে পারেন, দেবাংশবাবুসহ তাঁর দুই ছেলে তার পক্ষে কথা বলবে। যদিও বাস্তবে সেটা ঘটে নি। আর সেজন্যই তিনি এখন জেল খাটছেন।’
রঘুদা বলল, ‘হুৃ.। তোর কথা মেনে নিতাম। কিন্তু পারছি না এই ‘হয় তো’ শব্দগুলোর কারণে। সঠিক যুক্তি ছাড়া তো আর আসল ঘটনা বের করা সম্ভব নয়, তাই না?’
আমিও মাথা নেড়ে রঘুদার কথায় সায় দিলাম।
‘আগুন ধরার বিষয়টা থেকে কিছু বুঝলি?’ রঘুদা জিজ্ঞেস করল।
আমি মাথা চুলকাতে লাগলাম। আসলেই তো। রঘুদাকে ‘হয় তো’ ‘হয় তো’ বলে অনেক কথাই বলে ফেললাম, কিন্তু আগুন ধরার কোনো কারণই মাথায় আসছে না। আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বললাম, ‘আমার মনে হয় আগুন ধরাটা তদন্তের সাথে জড়িত নয়।’
কিন্তু আশ্চর্য! রঘুদা আমার কথা উড়িয়ে না দিয়ে বলল, ‘আমার তাই মনে হয়। কিন্তু আগুন ধরার ধরণটা দেখেছিস?’
‘তাতে তো মনে হয় কেউ ইচ্ছে করে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
‘এতেও আমি তোর সাথে একমত। যখন সেখানে ছিলাম তখন আধাপুরা কিছু খড় আমার নজরে পড়ে। তখনই সন্দেহ হয়েছিল। কিন্তু এমনটা কেন হল?’
‘মানে?’
রঘুদা বলল, ‘আমি বলতে চাচ্ছি যে, পাঁচ-ছয় লিটার কেরোসিন ঢেলে দিলে তো দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠত। সেখানে খড়ের প্রয়োজন হল কেন? আর খোলা মাঠে আগুনই বা ধরানো হল কেন?’
‘তাহলে তো এটা ধরে নিতে হয় যে, আগুনটা ধরানো হয়েছে দেবাংশবাবুর দোকানটা জ্বালানোর জন্য। অর্থাৎ আগুন ধরাটা তদন্তের সাথে জড়িত।’
একটু থেমে রঘুদাকে বললাম, ‘তুমি মনে হয় দেখেছ, দেবাংশবাবুর দোকানে কতসব জিনিস-পত্তর রাখা। ’
‘হ্যাঁ।’ রঘুদা জবাব দিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাতে কি বুঝা যায়?’
‘ভদ্রলোকের ব্যবসা ভালো হয়। তাই তো। নইলে তো আর এসব এখানে রেখে পঁচানোর প্রশ্নঈ উঠে না।'
‘হ্যাঁ, আর সেজন্যই হয় তো আশেপাশে যাদের দোকান ছিল তারা ঈর্ষা বোধ করত। আর তাদের মধ্যেই একজন কিংবা তারা সম্মিলিতভাবে আগুনটা ধরিয়েছে।’
‘কিন্তু অনিমেষ, খড়ের বিষয়টা তো কিয়ার হচ্ছে না।’
আমি অনেক চেষ্টা করেও বিষয়টা ক্লিয়ার করতে পারলাম না। না পারাটাই স্বাভাবিক। যে জায়গায় একজন গোয়েন্দাকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সেখানে আমি তো একটা পিঁপড়ে মাত্র!
রঘুদা বলল, ‘ঘাবড়াস নে। মাথাটাকে একটু কাজে লাগাতে হবে।’
পরদিন সকালে আমি কলেজে চলে গেলাম। যেতেও ইচ্ছে করছিল না। ভাবছিলাম, কেসটা শেষ হওয়া পর্যন্ত রঘুদার সাথে থাকব। কিন্তু কি আর করার? অমরনাথ স্যারের ক্লাস আছে (আমাদের কলেজের সবচেয়ে রাগী টিচার)। তাই বাধ্য হয়েই যেতে হল। কলেজ থেকে বাসায় আসলাম বেলা তিনটার দিকে। এসে দেখি রঘুদা বাসায় নেই। এরকমই কিছু একটা ভেবেছিলাম। কারণ রঘুদা কখনোই গুটিয়ে থাকার পাত্র নয়। কেসটা তাড়াতাড়ি শেষ করার জন্য সে যে উঠে পড়ে লেগে যাবে সেটা আমি ভালো করেই জানতাম। তাই রঘুদার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে স্নানটা সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম। রঘুদা আসল সাড়ে চারটায়। দেখলাম বেশ হাসিখুশি মুখ। আমাকে দেখেই রঘুদা বলল, ‘অনিমেষ মনে হয় ট্রফিটা পেয়ে যাব।’
আমি ইতস্ত করে বললাম, ‘তুমি কি চোরটাকে ধরে ফেলেছ?’
‘এক রকম সেটাই। তবে তার আগে ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জীকে একটা ফোন করতে হবে। অনেক কষ্টে ব্যাটার মোবাইল নাম্বারটা পেয়েছি।’ (এই ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জীই তার বাহিনী নিয়ে দেবাংশবাবুর দোকানে চুরির বিষয়টা নিয়ে তদন্ত করেছিলেন এবং ম্যানেজার রাজকুমার সাহাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।) রঘুদা প্রকাশবাবুকে ফোন করে বলে দিল যে, আগামীকাল বিকেল পাঁচটায় দেবাংশবাবুর বাসায় আসতে হবে। আমার বুঝতে বাকি রইল না যে, মামলার চূড়ান্ত ফলাফল কালই উদঘাটিত হবে। আমি রঘুদাকে আর কিছুই জিজ্ঞেস করলাম না। কারণ আমি জানি ওঁ বলবে, ‘আগামীকালই সব নিজের চোখে দেখতে পারবি।’ গত পাঁচটি মামলায় ওঁ কিন্তু এরকমই বলেছিল। তাই আমি সময় গুণতে শুরু করলাম। কখন যে কালকের দিনটা আসবে? কখন যে বিকেল হবে? ইত্যাদি।



পরদিন আমি আর রঘুদা সময় মতোই দেবাংশবাবুর বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জী আমাদের আগেই হাজির। আমরা আরো ভেবেছিলাম, সেখানে গিয়ে উনার জন্য আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। যাই হোক। সেটার আর দরকার হল না।
রঘুদা প্রথমেই ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জীকে নমস্কার করে তাঁর কার্ডটা দেখাল।
প্রকাশবাবু কার্ডটা দেখে একটু রসিকতা করে বললেন, ‘দেখেছি মশাই, দেখেছি। এত প্রমাণ দিতে হবে না। এবার বসুন তো।’
আমি আর রঘুদা সোফায় বসে পড়লাম। রুমের মধ্যে আরো যারা রয়েছেন তারা হলেন দেবাংশবাবু, তাঁর দুই ছেলে বিপ্লববাবু ও প্রিয়জিৎবাবু।
‘আরে মশাই, আপনি চোরটাকে ধরতে পেরেছেন কি না সেটা একটু বলবেন কি? আমি আর ধৈর্য্য ধরে রাখতে পারছি না।’ দেবাংশবাবু হঠাৎ করেই বলে উঠলেন।
বুঝাই যাচ্ছে, দু’ল টাকা খুইয়ে ভদ্রলোক বেশ চিন্তায় রয়েছেন। রঘুদা বলল, ‘চোরটাকে মোটামুটি ধরেই ফেলেছি। কিন্তু টাকাটা এখনও চোরের কাছে কি না সেটা বলতে পারছি না।’
একটু থেমে রঘুদা শুরু করল, ‘আমি গত পরশুদিন দেবাংশবাবুর দোকানটা দেখতে যাই। আমি যখন যাই সেটা ছিল ঘটনার পরের দিন। তাই মোটামুটি আশাবাদী ছিলাম যে, ভালো কিছু আলামত পাওয়া যেতে পারে যেটা তদন্তে সহায়তা করবে। সত্যিই তাই হল। এজন্য অবশ্য আমাকে তিনটা নাটক করতে হয়েছিল। এক নাম্বার. প্রিয়জিৎবাবুর মোবাইলের রিসিভ কলের লিস্টটা দেখতে প্রয়োজন ছিল উনার মোবাইল। কারণটা পরে বলছি। তবে জেনে রাখুন, এটা ছিল নাটক নাম্বার এক। দুই নাম্বার. দোকানের পাশে যেখানে আগুন ধরেছিল সেখানে অব্যবহৃত একটা ম্যাচের কাটি আর এক টুকরো কাগজ পাই, যাতে কিছু একটা পড়ে ছোটখাটো একটা দাগের সৃষ্টি হয়েছে। এই আলামত দুটি সংগ্রহ করার জন্য আমি দুই নাম্বার নাটকটি করি। তিন নাম্বার. এবারে যেটি করলাম সেটাকে নাটক বলা যেতে পারে, আবার রসিকতাও বলা যেতে পারে। কারণ আমাদের ফেরার পথে প্রিয়জিৎবাবু সিগারেট ধরাচ্ছিলেন। তখন তার ম্যাচের কাটিগুলো পর্যবেক্ষণ করার জন্য আমার প্রয়োজন ছিল তৃতীয় নাটকটির।’
এমন সময় প্রিয়জিৎবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘রঘুবাবু, একটা কথা বুঝতে পারছি না। আপনি সবকিছুতে আমাকে জড়াচ্ছেন কেন?’ ‘প্রিয়জিৎবাবু, আপনি আর কিছুক্ষণ ধৈর্য্য ধরে আমার কথাগুলো শুনুন। আশা করি আপনার মনে কোনো সন্দেহ থাকবে না।’ রঘুদার কথায় প্রিয়জিৎবাবু শান্ত হলেন বটে কিন্তু তার মুখে একটা আতঙ্কের ছাপ রয়ে গেছে।
রঘুদা এবারে ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জীকে একটা প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা প্রকাশবাবু, আমার মনে হয় তদন্তের সময় আপনারা দোকানের পাশে আগুন ধরার বিষয়টিকে অ্যাভয়েড করেছেন। তাই না?’
‘আরে, সে তো অ্যাভয়েড করারই বিষয়। আগুন তো মশাই যে কোনো কারণেই লাগতে পার। এর সাথে একটা চুরির ঘটনাকে জড়ানোর তো প্রশ্নই উঠে না।’
‘ঠিক আছে, আমি বলছি’ বলল রঘুদা, ‘আসলে প্রকাশবাবুর কথাই ঠিক। কিন্তু আমার সন্দেহটা হল তখনই যখন এই দুটি জিনিস দেখলাম।’
বলে রঘুদা তার পকেট থেকে একটি খামে মোড়া ছোট একটা কাগজের টুকরো আর অব্যবহৃত একটি ম্যাচের কাটি প্রকাশবাবুর দিকে এগিয়ে দিল।
‘প্রথমে কাগজের টুকরোটা নাক দিয়ে ভালো করে শুঁকে দেখুন।’
রঘুদার কথামত প্রকাশবাবু কাগজের টুকরোটা নাকের সামনে ধরলেন।
‘ছ্যা, ছ্যা, এ তো কেরোসিনের গন্ধ!’
‘হ্যাঁ, আমি যখন কাগজটা পাই তখন এ গন্ধটা অনেক টাটকা ছিল। এতে কি বুঝা যায় না যে, আগুনটা কেউ নিজের ইচ্ছাতেই ধরিয়েছে? আর সেটা কেরোসিন দ্বারা এবং কেরোসিনের বোতলটা কোনো এক সময় এই কাগজের উপর রেখে মাঠের মধ্যে কেরোসিন ঢালা হয়েছিল, যার জন্য এই কাগজটায় কিছু কেরোসিন ছড়িয়ে পড়ে। আর আগুন ধরানোর সময় তারই হাত থেকে ভুলবশত এই অব্যবহৃত ম্যাচের কাটিটা পড়ে যায়।’ দেখলাম প্রকাশবাবু মাথা নেড়ে রঘুদার কথায় সম্মতি জানালেন। রঘুদা শুরু করল, ‘কিন্তু এভাবে খোলা মাঠে আগুন ধরানো হল কেন? তাছাড়া এমন কেীশলে আগুনটা ধরানো হয়েছে যাতে দেবাংশবাবুর দোকানের থেকে সামান্য দূরেই সেটা নিভে যায়। যদিও ঘটনার দিন আশেপাশের কিছু লোকজন আগুন নেভাতে সহায়তা করেছে। ফলে আরো আগেই সেটা নেভানো সম্ভব হয়। এতে একটি বিষয় আমার মাথায় আসে যে, যার দ্বারাই আগুনটা ধরানো হোক না কেন সে চাইছে দেবাংশবাবুর দোকানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় আর এই আগুন ধরানোর দ্বারা সে তার কোনো একটা উদ্দেশ্য হাসিল করবে। এখানে উদ্দেশ্যের কথা বলতে গেলে প্রথমেই আসে দু’লক্ষ টাকা।কিন্তু তার জন্য আগুন ধরানোর প্রয়োজন হল কেন? প্রশ্নটার উত্তর বের করতে আমাকে বেশ মাথা খাটাতে হয়।এবার প্রয়োজনটা বলছি।
আগুন ধরানোর জায়গাটা পরিদর্শনের সময় কিছু আধাপুরা খড় আমার নজরে পড়ে।শহরাঞ্চলে কিন্তু সচরাচর খড় মিলে না।অর্থাৎ যে আগুনটা ধরিয়েছে তাকে কষ্ট করে হলেও কিছু খড় জোগার করতে হয়েছে।আর আমি নিশ্চিন্তে বলতে পারি আগুনে খড় দেওয়া হয়েছে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বৃদ্ধি করার জন্য।কারণ, তাহলে সেটা দোকানের দোতলায় থাকা ম্যানেজারের নজরে আসবে।আর ম্যানেজার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আগুন নেভাতে চলে যাবে।বাস্তবেও সেটা ঘটেছিল।আর সেই সুযোগেই দোকানের ক্যাশে থাকা টাকাগুলো হাতিয়ে নেয়া হয়।অন্যথায়, যেহেতু আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে সেহেতু দোকানের ভিতরেও কারো আসার সম্ভাবনা নেই।কারণ সবার দৃষ্টি থাকবে আগুন নেভানোর দিকে।তাই দোকানের দিকে কারোই নজর পড়ার কথা নয়, অন্তত চোর ছাড়া।অর্থাৎ বুঝাই যাচ্ছে অনেক বুদ্ধি খাটিয়ে এই চুরি করা হয়েছে।'
‘কিন্তু রঘুবাবু, চুরিটা তো হয়েছে রাত বারোটার দিকে।তাহলে চোর কি করে জানল এত রাতেও ম্যানেজার সজাগ থাকবে? যার জন্য চোরকে আগুন ধরানোর কেীশলটা বেছে নিতে হয়।’
বললেন ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জী।
রঘুদা বলল, ‘দেখুন, যে চোর এত প্ল্যান করে চুরি করতে পারে তার পক্ষে ম্যানেজারের দৈনিক রুটিন, আই মীন কখন দোকান বন্ধ করে, কখন খোলে, কখন ঘুমুতে যায়, কখন জেগে উঠে ইত্যাদি আগে থেকে ফলো করা কি অস্বাভাবিক কিছু?’
‘তা বুঝলাম, কিন্তু চোরটা কে?’
মুখে অনেক উত্তেজনা নিয়ে প্রকাশবাবু রঘুদাকে প্রশ্ন করলেন।
রঘুদা জবাব দিল,‘চোর যে দেবাংশবাবুর নিজের মধ্যে কেউ এটা নিশ্চিন্তে বলতে পারি।কারণ ক্যাশে দু’লক্ষ টাকা আছে, এটা নিশ্চয়ই বলে বেড়ানোর বিষয় নয়।এটা মালিকের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।তাহলে চোর কি করে জানল যে, ক্যাশে দু’লক্ষ টাকা আছে।এটা সম্ভব হতে পারে তখনই যদি ম্যানেজার চোরকে নিমন্ত্রণ করে আনে।এজন্য ম্যানেজারকে সন্দেহের তালিকায় রাখতে হয়।তার আগে দেবাংশবাবুকে একটা প্রশ্ন করছি।আচ্ছা, আপনি তো আমায় বলেছিলেন, যে রাত্রে আগুনটা ধরে সেই রাত্রেই দোকানের ম্যানেজার আপনার ছোট ছেলে প্রিয়জিৎবাবুকে ফোন করে খবরটা দেয়।তাই তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ দেবাংশবাবু জবাব দিলেন।
রঘুদা বলল,‘আমি বিষয়টা যাচাই করার জন্য প্রথম নাটকটা করি।কিন্তু প্রিয়জিৎবাবুর মোবাইলের রিসিভ কলের লিস্টে আমি দেখতে পাই যে, ঐ দিন রাত্রে তো দূরের কথা, ঐ দিন তার মোবাইলে কোনো কলই আসে নি।তখনই আমার মাথায় প্রশ্ন আসে কেন এই মিথ্যের আশ্রয়।তারপর ঘটনাস্থলে গিয়ে এই অব্যবহৃত ম্যাচের কাটি আর কাগজের টুকরো সংগ্রহ করতে আমি দ্বিতীয় নাটকটা করি।কারণ সেই মুহূর্তে প্রিয়জিৎবাবুকে আমি নিরাপদ মনে করতে পারছিলাম না।আর তৃতীয় নাটকটা করি এই অব্যবহৃত ম্যাচের কাটিটার জন্য।কারণ আমি ফেরার পথে দেখলাম, আমি যে কাটিটা পেয়েছি আর প্রিয়জিৎবাবু যে ম্যাচের কাটি দিয়ে সিগারেট ধরাচ্ছিলেন উভয়টির আকৃতিই চিকন।আর এরকম ম্যাচ বাজারে কমই পাওয়া যায়।সেই সাথে কিনতেও হয় একটু দাম দিয়ে।তখনই সন্দেহের তীর প্রিয়জিৎবাবুর দিকে ধরতে হয়।কিন্তু আমার কাছে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রমাণ ছিল না। এই প্রমাণের জন্যই আমাকে গতকাল একটু কষ্ট করতে হয়।যেহেতু কেরোসিন দিয়ে আগুনটা ধরানো হয়েছে আর কাজটা যদি প্রিয়জিৎবাবুই করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাকে রায় পাড়ারই কোনো দোকান থেকে কেরোসিন কিনতে হয়েছে।প্রশ্ন হতে পারে, তিনি রায় পাড়ার দোকান ছাড়া দূরের কোনো দোকান থেকে কেরোসিন কিনবেন না কেন? উত্তরটা সহজ।কারণ জবাবদিহি করতে হবে।যেহেতু তিনি স্থানীয় মানুষ তাই কেরোসিন নিয়ে বাসায় ফেরার সময় বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রশ্ন করতে পারে।আর করাটাই স্বাভাবিক।যেহেতু এটা ইলেকট্রিসিটির যুগ।
ফলে এক সময় না এক সময় তার ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।আর রায় পাড়া থেকে কিনলে সাথেসাথেই রাস্তার পাশে যেকোনো জাযগায় লুকিয়ে রাখা সম্ভব।আমি ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, রায় পাড়ায় মাত্র দুইটা দোকানে কেরোসিন বিক্রি হয়।একটা ‘অনুরাধা ভেরাইটিজ স্টোর’ আর অপরটা ‘জয়লক্ষী ভেরাইটিজ স্টোর’।প্রথমেই আমি গেলাম অনুরাধা ভেরাইটিজ স্টোরে।কিন্তু দোকানদার বললেন, তিনি গত কয়েক দিন ধরে কোনো কেরোসিন বিক্রি করেন নি।তারপর গেলাম জয়লক্ষী ভেরাইটিজ স্টোরে।সেখানে গিয়ে বুঝতে পারলাম, আমার উদ্দেশ্য সফল।অর্থাৎ দোকানদার বিকাশ গাঙ্গুলীকে কেরোসিনের বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, গত পাঁচ দিনে তার দোকান থেকে দশ লিটারের মত কেরোসিন বিক্রি হয়।স্বভাবতই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হল, কে সবচেয়ে বেশি কেরোসিন কিনেছে? উত্তরটা পেলাম, প্রিয়জিৎবাবু।তিনি প্রায় সাত লিটার কেরোসিন কিনেছেন।’ রঘুদা থামল।
এমন সময় প্রিয়জিৎবাবু চিৎকার করে উঠলেন,‘আমি বিশ্বাস করি না।এই সবই আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
‘বিকাশ গাঙ্গুলী যদি নিজে এসে বলেন তাহলে বিশ্বাস হবে তো?’বলে রঘুদা হাঁক দিল, ‘বিকাশবাবু একটু ভিতরে আসুন তো।’
সাথে সাথে বিকাশ গাঙ্গুলী রুমে প্রবেশ করলেন।ভদ্রলোক এতক্ষণ বাইরে অপেক্ষা করছিলেন।আমি তো একেবারে হতবাক! রঘুদা এত কিছুর ব্যবস্থা করেছে, অথচ আমি কিছুই জানি না।রঘুদা বিকাশবাবুকে প্রশ্ন করল,‘আচ্ছা বিকাশবাবু গত কয়েক দিনের ভিতর প্রিয়জিৎবাবু কি আপনার দোকান থেকে কেরোসিন কিনেছিলেন?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।তারিখটা মনে নেই তবে তিন বা চার দিন আগে তিনি আমার দোকান থেকে সাত লিটার কেরোসিন কিনেছিলেন।’ বললেন বিকাশবাবু।
দেখলাম, বিকাশবাবুর কথা শুনে প্রিয়জিৎবাবু মাথা নিচু করে বসে আছেন।রঘুদা বলল, ‘ঠিক আছে।আপনি এবার আসতে পারেন।’
বিকাশবাবু চলে গেলেন।
রঘুদা এবার মুখে একরাশ রাগ ফুটিয়ে প্রিয়জিৎবাবুকে বললেন, ‘টাকাগুলো কোথায় রেখেছেন?’
‘আসলে, আসলে, আমি……..’
‘আমি কোনো কথা শুনতে চাই না প্রিয়জিৎবাবু।এই মুহূর্তে টাকাগুলো নিয়ে আসুন, নইলে জেলে যান।আপনি যে দোষি সেটা এখন পরীক্ষিত।’
প্রিয়জিৎবাবু থতমত খেয়ে বললেন,‘টাকাগুলো আমার রুমেই আছে।আমি নিয়ে আসছি।’
‘আপনাকে দিয়ে আর বিশ্বাস করতে পারছি না প্রিয়জিৎবাবু।’
বলে রঘুদা ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জীর দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি উনার সাথে যান।দেখবেন, আবার যেন ফসকে না যায়।’
এতক্ষণ দেবাংশবাবু আর বিপ্লববাবু একেবারে মূর্তির মতন বসে রঘুদার কেরামতি দেখছিলেন।নিজের ছেলের এরকম কান্ডে দেবাংশবাবুর চোখ অশ্রুতে ভরে গেল।বিপ্লববাবুরও একই দশা।যাই হোক।প্রিয়জিৎবাবু কিছুক্ষণ পরেই টাকা নিয়ে হাজির।ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জী গুণে দেখলেন দু’লক্ষই আছে।
এবারে দেবাংশবাবু প্রিযজিৎবাবুর শার্টের কলার ধরে চড় মারতে লাগলেন। ‘চোর কোথাকার! লজ্জা করে না তোর? বেরিয়ে যা আমার বাড়ি থেকে।’
রঘুদা দেবাংশবাবুকে থামাল।
‘দেবাংশবাবু, আমার মনে হয় প্রিয়জিৎবাবুর কিছু বলার আছে।নইলে তিনি এভাবে পিতৃসম্পদে হাত দিতেন না।প্লিজ, একটু শান্ত হোন।’
দেবাংশবাবু রঘুদার কথায় শান্ত হলেন।
রঘুদা প্রিয়জিৎবাবুকে বলল,‘এবার কি বলা যাবে, কেন এই কাজটা করেছিলেন?’
প্রিয়জিৎবাবু নত মস্তকে শুরু করলেন,‘আসলে বছর দুয়েক ধরে আমার মাথায় বিদেশে যাবার একটা প্ল্যান রয়েছে।বাবার এই দোকানের ব্যবসা আমার কিংবা দাদার কারোরই ভালো লাগে না।কিন্তু দাদা নিজেকে কিছুটা মানিয়ে নিলেও আমি কিন্তু পারি নি।আমি চিন্তা করতে থাকি, বিদেশে গিয়ে অনেক টাকা রোজগার করব, আমাদের এই বাসাটা ভেঙ্গে বড় একটা বিল্ডিং তুলব ইত্যাদি।কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন টাকা।আর আমি ভালো করেই জানি, আমার বাবা আমাকে এত দূরে যেতে দিবেন না।কারণ তিনি আমাদের দুই ভাইকেই খুব ভালবাসেন।তাই আমি চুপিসারে বিদেশে যাবার পরিকল্পনা করতে থাকি।যার জন্য এই অসৎ পন্থা অবলম্বন করতে হল।’
বলে প্রিয়জিৎবাবু কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
প্রিয়জিৎবাবুর কথায় পুরো রুম জুড়ে একটা নীরব আবহাওয়ার সৃষ্টি হল।ইন্সপেক্টর প্রকাশ ব্যানার্জী সেই আবহাওয়া ভেঙ্গে বললেন,‘দেবাংশবাবু, আমি আজই আপনার ম্যানেজারকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করব।আর প্রিয়জিৎবাবুর বিষয়টা আশা করি আপনি পারিবারিকভাবেই শেষ করবেন।এই সমাজে আপনার একটা প্রেসটিজ আছে, আমি চাই না সেটা নষ্ট হোক।
আর রঘুবাবু, বেশ কেরামতি দেখলাম।লেগে থাকুন।বছর কয়েকের ভিতরেই টপ পজিশনে চলে আসবেন।আমি এবার আসছি।নমস্কার।’
একটু পরে আমরাও বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।তবে খালি হাতে নয়।পুরো বিশ হাজার টাকা হাতে নিয়ে।রঘুদার মতে, এই প্রথম সে তার চাহিদা মত টাকা পেল।আর এটাই তাঁর প্রথম কেস।
আমি সাথেসাথেই আপত্তি তুললাম, ‘না, না, রঘদা।এটা ছয় নাম্বর।
রঘুদা বলল, ‘ধুর বোকা।আগের পাঁচটা তো কেসের কোনো জাতই ছিল না।সব থার্ড ক্লাস।ওসব আমি হিসাবে ধরি না।’

৭.
কয়েকদিন পর জানলাম, দেবাংশবাবুর ছোট ছেলে প্রিয়জিৎবাবু বিদেশে চলে গেছেন।আর দেবাংশবাবু জেল থেকে ছাড়া পাওয়া ম্যানেজারের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন।কিন্তু ম্যানেজার রাজকুমার সাহা এই কলঙ্কের বোঝা নিয়ে দেবাংশবাবুর দোকানে আর কাজ করতে চাইলেন না।বললেন যে, অন্য কোনো দোকানে কাজ জুটিয়ে নিবেন।সিলেটে তার অনেক জানাশুনা লোক আছে।
ম্যানেজারের চলে যাবার পর বিপ্লববাবুই দোকানের দেখাশুনা করছেন।পুরোপুরি মনোযোগ দিয়ে।ব্যবসাপাতিও ভালো চলছে।তবে জয়লক্ষী ভেরাইটিজ স্টোরের মালিক বিকাশ গাঙ্গুলীর কারণে প্রিয়জিৎবাবুর ব্যাপারটা রায় পাড়ায় সামান্য ছড়িয়ে পড়ে।কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায় নি।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৩৭

উম্মে সালমা কলি বলেছেন: খুব ভালো হয়েছে। লেখা চালিয়ে যান।

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:০৯

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: প্রথম অংশটা পড়েছিলেন?

২| ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:১০

সাহসী সন্তান বলেছেন: খুব সুন্দর হয়েছে। সব থেকে ভাল লাগলো আপনার ফিনিসিংটা। কারন আমি অনেক বড় বড় লেখকের লেখা ডিটেক্টিভ গল্প পড়েছি, কিন্তু তাদের গল্পটাকে ঠিক এভাবে শেষ করতে দেখিনি। অথ্যাৎ আমি আপনার গল্পের ৭ নং পয়েন্টের কথা বলছি। আসলে কোন গল্পের শেষটাই হলো গল্পের প্রাণ। কথায় আছেনা "শেষ ভাল যার সব ভাল তার"!

আপনার আগামী গল্পের প্রতিক্ষায় রইলাম! শুভকামনা জানবেন!!

২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৩:২১

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য। আশা করছি আর ভালো গল্প নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হতে পারব।

৩| ২৩ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৮:০১

তুষার কাব্য বলেছেন: ভালো লেগেছে । শুভেচ্ছা ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.