নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

রাসেল নামের ছেলেটি............ :( :(

২৮ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ১১:২৯

আকাশ স্পষ্টত দুভাগে বিভক্ত। একপাশ প্রশান্ত প্রভাতের মতো দাউ দাউ করে জ্বলছে। অন্যপাশে নিস্তরঙ্গ কালো মেঘের ছড়াছড়ি। আকাশে এরকম দৃশ্য বিরল। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে সর্বক্ষণ।
আমি আর আমার এক বন্ধু অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁতস্যাঁতে একটা চায়ের দোকানের সামনে দু’খানা চেয়ার নিযে বসে আছি। দুজনেই বেকার। চাকরির নেশায় দুজনেরই ভেতরটা মরুভূমির মতো শূন্যতায় হাহাকার করে প্রতিক্ষণ। প্রতিদিন বিকেলে এই চাযের দোকানের সামনে ঘন্টা দুয়েক বসে মনটায় একটু দখিনে হাওয়া লাগানোর চেষ্টা করি। কখনো সিগারেট ফুঁকে রাস্তায় সুন্দরী মেয়েদের দিকে প্রলুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, কখনো বাদাম চিবুই, চা খাই, যদি পকেটে কিছু না থাকে হাবলার মতো খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ইচ্ছে না করলেও তাকাই। তবে আজকের আকাশটা পুরোপুরি অন্যরকম। এরকম সাজতে আমি আর দেখিনি বললেই চলে।
কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকানোর পর রাস্তার দিকে নজর গেল। রাস্তা দিয়ে অদ্ভুত ভঙ্গিমায় একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখতে দুধের মতো ফর্সা। বাতাসের মৃদু মৃদু আঘাতে তার জামার পেছনের অংশটা দুলতে থাকায় সেখানকার লোভনীয় অংশটা আমার নজরে পড়ে যায়। আমার ভেতরে সাথেসাথেই আতসবাজির মতো দহন শুরু হয়ে যায়। আমি সকলের অগোচরে মাতালের মতো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থাকি। মুহূর্তের মধ্যে আমার সারা শরীর রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। আমার লোলুপ দৃষ্টি মেয়েটার দিক থেকে সরাতে পারছি না কোনো মতেই। এ যেন জ্বালাময়ী এক যন্ত্রণা আমাকে ত্ড়াা করে বেড়াচ্ছে।
“মেয়েটা হিন্দু!” আচমকা আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলল নিরন্ন চেহারার রাসেল। মুখে মৃদু মৃদু শয়তানি হাসি। রাসেল এই দোকানটিতে কাজ করে। মাগনায়। হাশেম আলী রাসেলকে কাজ শেখাবে বলে এখানে নিয়ে এসেছে।
অর্থাৎ আমার এই মেয়ে দেখার বদমায়েশি কাহিনী কেউ না পারলেও রাসেল ঠিক মতোই ধরে ফেলেছে। অন্য কেউ হলে নির্ঘাত রাসেলের পিঠে কয়েকটা বসিয়ে দিত। কিন্তু রাসেলকে দেখলে কেন জানি আমার এই পাষাণ হৃদয়েও মমতার ঝড় বয়ে যায়। আমি একটু মুচকি হেসে বললাম,“মেয়েটা হিন্দু তুই বুঝলি কিভাবে?”
“ঐ যে ডান হাতে ফিতার মতো লাল একটা বাঁধা।”
একটু অবাক হতে হল। রাসেল ছেলেটা পড়াশুনা করেনি- গন্ডমূর্খ। তারপরেও আমাদের সমাজ মানুষকে আলাদা দেখার নিয়মগুলো কত সহজে তাকে শিখিয়ে দিয়েছে।
আমার বন্ধু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,“ কি বলল ও?”
“আরে কিছু না। ছাড়!”
আমার বোকা বন্ধুটা বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেনি।
এখানকার পরিবেশটা একটু গিঞ্জি ধরনের। যে যেভাবে পারে দখল করে একটার পর একটা দোকান বসিয়ে নিয়েছে। হাশেম আলীর দোকানের পিছনে একটা পানের দোকান, সামনে পত্রিকার দোকান, ডানে বামে জুতা সেলাইয়ের সরঞ্জাম নিয়ে দুজন বসা। এরমধ্যে হাশেম আলীর চা-ই বেশি জনপ্রিয়।
হঠাৎ চপাত চপাত মারের শব্দে আমাদের দৃষ্টি ফেরাতে হল। দোকানের মালিক হাশেম আলী রাসেলকে অমানসিকভাবে পেটাচ্ছে। চড়, থাপ্পর, কিল, ঘুষি সবকিছু একসাথে পড়ছে রাসেলের গায়ে। আশেপাশের লোকজন দৌঁড়ে এসেও আটকাতে পারছে না হাশেম আলীকে। উন্মাদের মতো পেটাচ্ছে তো পেটাচ্ছেই। যেন সাত জন্মের সবচেয়ে বড় শত্রুকে পেয়েছে সে। মেরে শেষ করে দিতে হবে একেবারে। আর রাসেল নিষ্প্রভের মতো সব সহ্য করে যাচ্ছে। তার ভাবভঙ্গি পুরোপুরি প্রতিবাদহীন।
সবার ধস্তাধস্তিতে এক পর্যায়ে হাশেম আলীকে থামানো হল। থামানোর পরও হাশেম আলীর ফুঁসফুঁসানি কমে নি। সে এখনও তৃপ্ত হতে পারে নি।
কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম আসল ছুঁতোটা কী। রাসেলকে হাশেম আলী চুলোয় আগুন ধরাতে বলেছিল। রাসেল বুঝতে পারেনি সে কথা। তারপর হাশেম আলী যখন এসে দেখল কেটলির জল কনকনে ঠান্ডা- ব্যস , হয়ে গেল।
হাশেম আলী রাসেলের জন্য খুব বদমেজাজী। কথায় কথায় রাসেলকে ধমকায়, ধাবড়ানি দেয়। রাসেল সবসময়ই নিষ্প্রভ থাকে। তার মুখ দেখে এসব বুঝার কোনো উপায় নেই। তার মুখে দুঃখ সংবরনের কোনো চিহ্নও যেমন নাই, তেমনি রাগে ফুসফুস কোনো ভাবভঙ্গিও নাই। অদ্ভুত একটা ছেলে!
এখানকার সবার মধ্যে রাসেলকে মনে হয় আমিই একটু বেশি প্রশ্রয় দিই। আমার কাছে এসেই সে প্রসন্ন মুখে একফালি হাসি ছাড়ে। বলে, “কেমন আছেন স্যার?”
আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলি, “ভালো রে, তুই ভালো আছিস?”
“হ্যাঁ।”
এটুকুতেই তুষ্ট থাকে রাসেল।
রাসেলের জন্য কেন জানি মাঝে মধ্যে আমার নিজেরও খুব চিন্তে হত। এতটুকুন একটা ছেলে এই বয়সেই ঘরছাড়া। কী হবে তার পরবর্তী জীবনের? সে কি দাঁড়াতে পারবে? নাকি এরকম গোলামি করেই কাটাবে পুরোটা জীবন। আমরা সবাই তো দরিদ্রকে অপদস্থ করার জন্যই সবসময় ব্যস্ত থাকি।
রাসেলকে আমি প্রায়ই লক্ষ্য করতাম। রাসেল তার ব্যতিক্রমধর্মী কিছু ভাবভঙ্গির কারণে আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছিল। তার স্থির বাক্যহীন চোখ, কাশবনের মতো প্রফুল্ল হাসি, উচ্চসিত কথাবার্তা, অসম্ভব শোক সংবরন ক্ষমতা আমার দৃষ্টিকে তার দিকে অবনত করেছিল। মাঝে মাঝে আমার বন্ধুটি না আসলে আমি রাসেলের সাথেই তার কাজের ফাঁকে ফাঁকে গল্প করে নির্দিধায় পুরো বিকেলটা কাটিয়ে দিতাম। রাসেল আমাকে অনেক গল্প বলত। তার বাবার গল্প, তার মায়ের গল্প। সে যখন চলে আসে তখন তার বছর দুয়েকের একটা বোনকে রেখে এসেছিল। তার গল্পও। রাসেলের গল্পগুলো আবেগের, কেবলই আবেগের। কোনো বেদনার আর্তস্বর নয়।
জীবনকে নিয়েও রাসেলের বিন্দুমাত্র আক্ষেপ নেই। লুডু খেলার মতো এই জীবনটাকেও সে ফেলে দিয়েছে অনিশ্চয়তার দোলচোলে। স্রোত যেদিকে টেনে নিয়ে যায় সেদিকেই সে ভেসে বেড়াবে।

তারপর কেটে গেছে অনেক দিন। রাসেলের সাথে আমার আর দেখা হয়নি। আমার স্মৃতির পৃষ্টা থেকে আমার অজান্তেই মুছে গেছে রাসেলের ছবি। কিন্তু সেদিন রাসেল আমায় বাধ্য করেছিল তাকে চিনে নিতে। আমিও চিনে নিয়েছি ভালো করে।
আমি এখন আর আগের মতো ভবঘুরে নয়। ভালো একটা চাকরি করছি। একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। এক প্যাকেট বাদাম নিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গুনগুন করে একটা রাস্তার পাশ দিয়ে হাঁটছি।
প্রকান্ড একটা চপেটাঘাতের শব্দে আমাকে থামতে হল। পাশ ফিরে দেখি একটা চায়ের দোকানের মালিক একটা ছেলেকে পেটাচ্ছে। ছেলেটার বয়স খুব বেশি নয়, একেবারে অল্প। আর যে পেটাচ্ছে তাকে চিনতে আমার খুব একটা কষ্ট হয়নি। তাকে আমি সেই হাশেম আলীর চায়ের দোকানে দেখেছিলাম। সেই রাসেল। সেই নিরন্ন ছেলেটি। আজ চেহারাটা কতো হৃষ্টপুষ্ট হয়েছে। মুখে হালকা হালকা দাঁড়িও উঠেছে।
হাশেম আলী রাসেলের মা বাবাকে দেয়া কথা রেখেছে। সে রাসেলকে শুধু চা বানানোই শেখায়নি, চা ওয়ালার চরিত্রটাও শিখিয়ে দিযেছে ভালো করে।
হয়তো রাসেলও ্রকম কোনো প্রতিজ্ঞায় বন্দি হয়ে এই ছেলেটিকে নিয়ে এসেছে। সেও তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা রাখবে।
তাই আবারও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আমরা সবাই দরিদ্রকে অপদস্থ করার জন্যই সবসময় ব্যস্ত থাকি।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.