নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রবাসীর প্রত্যাবর্তনঃ অল্প স্বল্প- ৪

০৬ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:২৮

(প্রকাশনা সংক্রান্ত জটিলতার কারণে উপন্যাসটির অল্প স্বল্প আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।)
........মাসুদ কর্মচারিটির সাথে হাঁটতে লাগলো। হাঁটার সময় মাসুদ লক্ষ্য করলো ফ্যাকাল্টির ছাত্র শিক্ষক কর্মচারি সবাই মোটামুটি তাকে চিনে নিয়েছে। এদিক ওদিক থেকে অনেকেই সালাম দিচ্ছে তাকে। সেদিন যে মেয়েগুলো তাকে নিয়ে পিছনে পিছনে আপত্তিকর মন্তব্য করছিল তারা কেমন যেনো চুপসানো আর বিবর্ণ মুখে সালাম দিচ্ছে মাসুদকে। মাসুদ দৃশ্যটা খুব উপভোগ করলো।
কর্মচারিটি মাসুদকে জিজ্ঞেস করলো, “স্যার, ক্লাসগুলো কেমন লাগছে?”
“ভালো।”
“ছাত্রদের মনমানসিকতা?”
মাসুদ একটু ভেবে বললো, “এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। ছাত্ররা কেমন জানি হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। উদাসিন মন মানসিকতা সবার।”
“আপনি কি শিট-টিট দেয়া শুরু করেছেন?”
“এখনো শুরু করিনি। তবে না দিয়ে আর উপায় আছে বলে মনে হচ্ছে না।”
“খুব খিস্তি করছে, না? বিদেশ থেকে আসলে সবাই এই বিড়ম্বনায় পড়ে। মনে করে ছাত্ররা জ্ঞানের তৃষ্ঞায় কাতর হয়ে আছে। যা দান করা হবে তাই আগ্রহের সাথে গ্রহণ করে নিবে। কিন্তু এদের যে আদৌ কোনো তৃষ্ঞা নেই সেটা বুঝতে পেরেই পরে সবাই শিট দেওয়া শুরু করে।”
“সেটাই তো দেখছি। জানার জায়গাটা একেবারে সংকুচিত হয়ে পড়ছে সবার। জানার প্রতি কারো কোনো আগ্রহ দেখি না। এতো আয়োজন, তারপরেও ছাত্ররা কেমন যেন যান্ত্রিক জীবন যাপন করছে।”
“কিন্তু আমার কাছে মনে হয় ইচ্ছে করেই এটাকে সংকুচিত করা হচ্ছে। এই বিগত বাজেটগুলোর কথাই বলি না, চার বছর আগে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিলো মোট বাজেটের ১৩.৬১%, তার পরের বছর ১৩.১৩% ,তারপরের বছর ১২.৩২%, আর এই বছর ১১.৫২% এ দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ যদি বুঝতাম শিক্ষাকে নিয়ে হার্ট এন্ড সোল চেষ্টা করা হচ্ছে তারপরেও কোনো ফল আসছে না তাহলে একটা বিষয় ছিলো। কিন্তু এদেশে তো সেরকম কোনো চেষ্টাই করা হচ্ছে না। বরং চেষ্টা করে শিক্ষাকে ক্রমশ সংকুচিত করে দেয়া হচ্ছে।”
মাসুদ মুগ্ধ হয়ে কর্মচারিটির কথা শুনছে। এই মানুষটিকে আর পাগলাটে বলা যাবে না। দেশকে নিয়ে যার এরকম সূক্ষাতিসূক্ষ বিশ্লেষণ থাকতে পারে সে মানুষটি আর যাই হোক একেবারে ফালতু বলে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়।
“এই স্যার আমি যদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরি তাহলে দেখবেন, এখন যারা টিচার আছেন, কালো দাঁড়ি পাকিয়ে সাদা বানিয়েছেন, তারা যখন এখানে পড়াশুনা করেছিলেন একেবারে বিনামূল্যে করেছিলেন। তাদের বৃত্তিও দেয়া হতো। সেই বৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশুনার খরচ চালিয়ে বাড়িতে পর্যন্ত টাকা পাঠাতে পারতেন।”
মাসুদ একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “তাই নাকি?”
“এগুলো আর কেউ স্বীকার করতে চায় না স্যার। স্বীকার করলে বিভিন্ন প্রশ্ন চলে আসে। আগে তো আমার রাষ্ট্রের সক্ষমতা কম ছিলো, এখন তো আমার রাষ্ট্র আগের তুলনায় অনেক সক্ষম। বিশ্বের সাথে টেক্কা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাহলে তো শিক্ষার্থীদের আরো বেশি সুযোগ সুবিধা পাওয়ার কথা। আগে বৃত্তি ৫০০ টাকা পেলে এখন ৫০০০ টাকা পাওয়া উচিত। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, আগে শিক্ষার্থীরা বাড়ি থেকে টাকা আনতো না, এখন বাড়ি থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা এনে পড়াশুনা করতে হয়। আগে শিক্ষার্থীদের কোনো সেমিস্টার ফি দিতে হতো না, এখন জোর করে পিটিয়ে তা আদায় করে নেয়া হচ্ছে।”
মাসুদ কর্মচারিটিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। নানান ধরনের মানুষে গিজগিজ করছে রেস্টুরেন্টের ভেতরটি। ভেতরটা বেশ নোংরা। সমাজের উঁচু স্তরের মানুষজন এখানে একদম আসেন না। যারা আসেন তাও রীতিমতো বাধ্য হয়ে। নইলে দুহাতে পেটটা চেপে বসে থাকতে হবে। মাসুদ দেশে আসার পর এই প্রথম বাইরে খাওয়া দাওয়া করছে।
পেছনের দিকে একটা টেবিল থেকে সবেমাত্র দুজন উঠেছে। মাসুদ কর্মচারিটিকে নিয়ে সেখানে বসলো। একটা বড়ো টেবিলে সব খাবার সারি সারি করে সাজানো। সেখানে উদ্দেশ্যহীন ভাবে এক ঝাঁক মাছি ভনভন করছে। মাসুদ তেমন ভোজনপটু নয়। খাবারের ব্যাপারে তার বাছ বিচারও একদম নেই। একেবারেই অল্প খাওয়া দাওয়া করে মাসুদ।
হাত মুখ ধুয়ে, এক প্লেট ভাত আর গরুর মাংসের অর্ডার দিয়ে মাসুদ এসে বসলো।
কর্মচারিটি বললো, “এখানকার খাবার কিন্তু আপনার ভালো লাগার কথা না। খেতে পারবেন তো?”
একটু হেসে মাসুদ বললো, “আরে খাবারের ব্যাপারে আমি একদম উদাসিন। পেটটা ভরাতে হয় তাই খাই।”
“এখন ছাত্রদের তো স্যার অনেক সুবিধে খাওযা দাওয়া করতে। ডানে বামে তাকালেই রেস্টুরেন্ট। আগে তো সবাই হলের ডাইনিং এ-ই খাওয়া দাওয়া করতো।”
“এখন খায় না?” প্রশ্ন করে মাসুদ।
কর্মচারিটি বললো, “খায়, যারা না খেয়ে পারে না। যাদের পকেটে প্রতি মাসে টান পড়ে তারাই খায়।”
“বাকীরা?”
“বাকীরা এসব রেস্টুরেন্টে খায়।”
“কিন্তু হলে খাওয়া দাওয়া করলে তো মনে হয় টাকা পয়সা কম লাগে।”
“কম তো লাগেই। কিন্তু যে খাবার দেয় তাতে রাস্তার ভিক্ষুকও মুখে তোলার আগে একটু বিবেচনা করবে।”
“কি বলেন এসব? স্টুডেন্টরা এসব খেয়ে হলে আছে?”
“তা নয় তো কী? অবশ্য কারণও আছে। প্রতিদিন যদি ৮০-১০০ জন বোর্ডারের মধ্যে ২০-২৫ জনই টাকা ছাড়া খায় তাহলে এটা ছাড়া আর উপায়ই বা কী আছে বলুন। ঐ যে দেখুন-”
বলে একটা ছেলের দিকে ইঙ্গিত করে কর্মচারিটি বললো, “একটু খেয়াল করেন ছেলেটা বিল দেওয়ার সময় কি বলে।”
ছেলেটি সুন্দর করে হাতটা ধুয়ে মাথার চুলগুলো হাত দিয়ে একটু ঠিক করে নিলো। তারপর কাউন্টারে বসা লোকটার দিকে চেয়ে ফিসফিসিয়ে কী একটা বলে চলে গেলো।
“কি বললো বুঝতে পারলেন?”
কর্মচারিটি মাসুদকে জিজ্ঞেস করলো।
মাসুদ মাথা নাড়িয়ে বললো, “না।”
“বললো- বিলটা বড় ভাই দিবেন। এরকম প্রচুর ছেলে এই ক্যাম্পাসে আছে। এভাবে পেটচুক্তি খেয়ে, খাওয়ার পর বড় ভাই দিবেন বলে বৃহৎ চোখ দুটি পাকিয়ে চলে যায়। কিন্তু ঐ বড় ভাই এর সন্ধান আজ পর্যন্ত কোনো দোকানদারই পাননি। তারা তীর্থের কাকের মতো ওদের বৃহৎ চক্ষুর দিকে তাকিয়ে থাকেন। কখন যে সেই বড় ভাই আসবে, এতটা বছরের লাখ লাখ পাওনা টাকা মিটিয়ে দিবে সেই আশায়।”

মাসুদ যে মিনিট দশেক সে রেস্টুরেন্টে বসা ছিলো তার মধ্যেই এরকম প্রায় দশ জনকে দেখলো যাদের চোখ রাঙানিতে নতশিরে চুপ করে বসে থাকে দোকানদারটি। একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র যে কিনা এক সময় এই দেশকে নেতৃত্ব দিবে, দেশের প্রশাসন থেকে শুরু করে রাজনীতি পর্যন্ত এরা নিয়ন্ত্রণ করবে সেই ছাত্ররা ছাত্রাবস্থায়ই যদি এরকম চোখ রাঙানি দিয়ে অভিশপ্ত বজ্রের মতো মানুষের মনকে আঘাত করতে থাকে তাহলে দেশের ভবিষ্যত আসলে কতটুকু উজ্জল হবে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। একটা সময় ছিলো যখন দেশের প্রতিটি মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের দিকে কতো সম্মানের চোখে তাকাতো। তারা যখন বাড়িতে বেড়াতে যেতো তখন গ্রামের লোকদের উৎসুক দৃষ্টি স্থির হয়ে থাকতো তাদের প্রতি। উৎসাহের মূল উদ্দেশ্য- দেখি তো আমাদের দেশ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কী ভাবছে। তারা চায়ের দোকানে বক্তব্য রাখলে সবার প্রসন্ন বদনে প্রত্যাশার আলো ফুটে উঠতো। সবাই উৎফুল্ল হতো কারণ তখন ছাত্ররা ছিলো সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক স্বরূপ। পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থা কাচের পুরো চশমা দিয়ে সূক্ষাতিসূক্ষ ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পর্যবেক্ষণ করতো। মনে মনে ভাবতো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাহলে এটা ভাবছে, তাহলে এরকম করলে সমস্যা হবে।
আর আজ এই ফাও খাওয়া ছাত্ররা পুরো ছাত্র সমাজকে টানতে টানতে রাস্তার কুকুরের পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। ছাত্রদের এখন আর কেউ সম্মান করে না। চায়ের দোকানে বক্তব্য রাখা তো দূরের কথা, সেই চায়ের দোকানদার উল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এখন কথা শুনিয়ে দিতে পারে নির্দ্বিধায়। এখন আর কেউ ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথাও বলতে পারে না। দেশকে নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। তার দেশ ক্রমাগত বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এটা তাদের বিন্দুমাত্র ভাবায় না। তারা এখন শুধু কর্মচারি হতে চায়। সরকারের পোষা নখদর্পহীন একদল কর্মচারি। যারা সব সময় উন্মুখ হয়ে থাকে উৎকোচের অপেক্ষায়। কখন আসবে সেই অমৃত প্রসাদ আর তারা টেবিলের তলা দিয়ে একটা ক্রিমিনালি হাসি দিয়ে সেটাকে গ্রহণ করবে। স্বার্থক করবে তার কর্মচারি জীবনকে। তার দেশকে, তার জাতিকে।...
.....(আরো অল্প স্বল্প আসবে)>>>

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.