নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

গোলাপীর ধর্মান্তর

২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:১০

হেমন্তের কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারপাশ। রাত্রিবেলা। গুমোট অন্ধকার। এর মধ্যে আলতো বাতাস বইছে। এরকম হাড় কাঁপানো শীতের মধ্যে বাতাসের এই মৃদু স্পন্দন শরীরের লোমকূপগুলোকে মুহূর্তে খাড়া করে তোলে। সুব্রতবাবু হাঁটছেন একটি প্রকান্ড বাড়ির সামনে দিয়ে। আবছা অন্ধকারে বাড়ির ভেতরকার লাইটগুলোকে জোনাকির মতো মনে হচ্ছে। বাড়ির গেটেও একটা লাইট রয়েছে। ঝিম ধরা একটা ভাব নিয়ে জ্বলছে। সুব্রতবাবু এসেছেন তার পিএইচডি থিসিসের কিছু ডাটা কালেকশন করার জন্য। গ্রামটির নাম নন্দপুর। হিন্দু অধ্যুষিত একটি গ্রাম। সুব্রতবাবুর বন্ধু প্রভাত ঘোষের এক আত্মীয় থাকেন গ্রামটিতে। সেই আত্মীয়ের বাড়িতেই উঠবেন সুব্রতবাবু।
ট্রেন পাক্কা তিন ঘন্টা লেটে পৌঁছেছে। পৌঁছার কথা ছিলো সন্ধ্যে ৬টার দিকে। সুব্রতবাবু পৌঁছেছেন রাত নয়টার দিকে। এর মধ্যে এসেছেন লোকাল ট্রেনে করে। ধূলো-বালি, উৎকট গন্ধ, মানুষগুলোর অযথা কথাবার্তা, তর্কাতর্কিতে ভদ্রলোকের পুরো শরীরটা বেজায় বিষণœ দেখাচ্ছে। এক গাধা অগোছালো চুল তার পুরো কপালটাকে ঘিরে রেখেছে।
প্রকান্ড বাড়িটা পেরিয়ে একটু সামনে গিয়ে সুব্রতবাবু একটা পরিত্যক্ত ব্রেঞ্চিতে বসলেন। ঘড়িতে সময়টা দেখে নিলেন। কাঁটায় কাঁটায় এগারোটা বাজে। শরীরের মধ্যে একটা শিরশিরে কাঁপুনি অনুভব করছেন সুব্রতবাবু। টানা দু’ঘন্টা হাঁটার পর একটা মানুষকেও রাস্তায় পেলেন না। বাড়িটা তাহলে খুঁজে বের করবেন কিভাবে? কাঁপুনিটা যেনো শরীর বেয়ে একবার উঠছে, একবার নামছে। হৃদপিন্ডের কাছে এসে মাঝে মাঝে আছাড় খাচ্ছে। খানিকটা ভয়ও হচ্ছে সুব্রতবাবুর। একদম একা এসেছেন তিনি। সুব্রতবাবুর বন্ধু প্রভাত ঘোষের আসার ব্যাপারে সবকিছুই ঠিকঠাক ছিলো। কিন্তু গতকাল প্রভাত ঘোষের বসের মৃত্যুর কারণে উনাকে অফিসেই আটকে থাকতে হলো। আর সুব্রতবাবু ঘুটঘুটে অন্ধকারে এরকম অচেনা অজানা জায়গায় ঠিকানা হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। গ্রামে ঠিকানা বের করা যেমন সহজ তেমনি আবার কঠিনও। কঠিন একারণেই, গ্রামে শহরের মতো বাড়ি বাড়ি নাম্বার প্লেট লাগানো থাকে না। প্রভাত ঘোষ সুব্রত বাবুকে বলেছিলেন, “গ্রামে গিয়ে মমতা মাসির নাম বললেই যে কেউ চিনিয়ে দিবে।”
কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়েছিলেন সুব্রতবাবু। জিজ্ঞেস করলেন, “এরকম মহিলাদের নামে বাড়ির নামকরণ হলো যে বন্ধু? সচরাচর তো এরকম হয় না।”
“আরে আমার মাসি তো গ্রামের বাচ্চাকাচ্চাদের পড়ায়। তাই সবাই চিনে। আর মেসোমশাই তো ব্যাংকে চাকরি করে। সকালে যায় বিকেলে ফিরে।”
“এটা ঠিক হলো বন্ধু? একটা মানুষ ছোটবেলা থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বড় হলো, আর বাড়িটা চিনবে অন্য জায়গার এক মহিলার নামে?”
“তুই আমার মাসিকে দেখিসনি তো তাই এরকম বলছিস। উনি যে মানুষের সাথে কী পরিমাণ মিশতে পারে এবং কী পরিমাণ সাংগঠনিক তাতে তোর মনে হবে পুরো গ্রামের নাম উনার নামেই দেয়া উচিত। এক সময় লেফট পলিটিক্সও করেছেন তিনি।”
কিন্তু গ্রামটিতে এসেই এরকম শব্দহীন, জিরজিরে পরিবেশে মানুষের খোঁজে বেরুতে হবে এটা কে জানতো? সুব্রতবাবু বসে বসে ভাবতে লাগলেন কী করবেন? স্টেশনে ফিরে গেলে কেমন হয়? চা খেতে খেতে চাওয়ালার সাথে গল্প করেই রাত কাটানো যাবে।
হঠাৎ করেই ক্ষিপ্র গতিতে কারো হাঁঠার শব্দ সুব্রতবাবুর কানে আসলো। হাঁটার সাথে সাথে নুপুরের শব্দ। অর্থাৎ কোনো মহিলা এদিকে আসছে। কুয়াশা আর অন্ধকারের ঘোলাটে আবহাওয়ায় সামান্য দূরের গাছটার অস্তিত্ব বোঝাও দায়। সুব্রতবাবু উঠে দাঁড়ান। শরীরটা এবার ঝড়ঝড়ে লাগছে। যাক, অবশেষে একটা ব্যবস্থা হতে চলেছে।
হাঁটার শব্দ প্রায় কাছাকাছি চলে আসছিলো এমন সময় সুব্রতবাবু দড়াম করে কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনলেন। হাতের টর্চটা জ্বালিয়ে তড়াং করে লাফিয়ে উঠে দুদ্দাড়িয়ে চললেন সামনের দিকে।
সুব্রতবাবু দেখলেন, একটা মেয়ে বেশ বড়সড় একটা পাথরে ধাক্কা খেয়ে চিৎপটাং শুয়ে আছে। মেয়েটিকে দেখেই সুব্রতবাবু দু’পা পিছিয়ে এলেন। ভয়ে তার ঠোট মুখ শুকিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। মেয়েটার মুখ থেকে গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। কপাল থেকে রক্ত ঝড়ছে অবিরল ধারায়।
সুব্রতবাবু কেটু ভালোভাবে মেয়েটিকে লক্ষ্য করলেন। পরনের শাড়ি একটু নোংরা, ব্লাউজের পেছনের অংশ খানিকটা ছেঁড়া। মাথার চুলগুলো ঈষৎ কোঁকড়ানো। ব্লাউজের পেছনের অংশটা সম্ভবত এই মাত্র ছিঁড়েছে। তার পুরো পিঠ উন্মোক্ত হয়ে আছে সেখানে। পেটে চর্বি জমে সুন্দর দু তিন খানা ভাঁজের সৃষ্টি হয়েছে। মুখটা পুরোপুরি নিষ্পাপ।
সুব্রতবাবু একটু জোরে ডাক দিলেন, “এই যে, শুনতে পাচ্ছেন?”
কোনো সাড়া শব্দ নেই। তবে আগের মতো গোঙানির শব্দ শোনা যাচ্ছে কেবল। সুব্রতবাবু তার ব্যাগ থেকে গামছা আর পানির বোতলটা বের করেন। মেয়েটার মাথাকে নিজের হাঁটুর উপর তুলে গামছার একটা টুকরো ছিঁড়ে মেয়েটির কপালে বেঁধে দেন। রক্ত ঝড়া আগের থেকে অনেকখানি কমেছে এর মধ্যে। মেয়েটিও চোখ খুলে বড় বড় চোখে তাকাচ্ছে সুব্রতবাবুর দিকে।
“আপনি পড়ে গিয়েছিলেন। এই পাথরের সাথে ধাক্কা খেয়ে।”
সুব্রতবাবুর হাঁটুর উপর থেকে মাথা সরিয়ে মেয়েটি বসলো। পিটপিট চোখে সুব্রতবাবুকে কিছুক্ষণ দেখে বললো, “আপনি কে?”
সুব্রতবাবু বললেন, “আমি হলাম আরেক হতভাগা। এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে যাবো কিন্তু বাড়ি খুঁজে পাচ্ছি না।”
“এর আগে আর আসেন নি?”
“না, এই প্রথম।”
“নাম-টাম কারো জানেন?”
ঝটপট করে সুব্রতবাবু বললেন, “মমতা, মমতা মাসি।”
“মমতাদির বাড়ি! চলুন, চলুন, আপনাকে আমি দেখিয়ে দিচ্ছি। উনাদের পাশের বাড়িতেই আমি কাজ করি। আজ ওখানে একটা অনুষ্ঠান ছিলো বলে আসতে দেরি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আবার এই দুর্ঘটনা।”
মিনিট পাঁচেক হেঁটেই আমরা গন্তব্যে চলে আসলাম। টিনশেডের বেশ ছিমছাম বাড়ি। মেয়েটি রাস্তা থেকেই আচমকা চিল্লানো শুরু করলো, “মমতাদি, ও মমতাদি।”
“কে?” বাড়ির ভেতর থেকে জবাব আসলো।
“আমি গোলাপী গো, এই তোমার কোন আত্মীয় এসেছে। তাড়াতাড়ি এসে নিয়ে যাও। আমি গেলাম।”
গোলাপী মমতা মাসির জন্য আর অপেক্ষা না করে চলে যাচ্ছে। কুয়াশার প্রকোপ প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। গোলাপী অল্পক্ষণের মধ্যেই কুয়াশার আড়ালে মিইয়ে গেলো। সুব্রতবাবু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন গোলাপীর দিকে। গোলাপীকে ডেকে অন্তত ধন্যবাদটা তো দেয়া উচিত। সুব্রতবাবু ডাকতে গিয়েই অনুভব করলেন তার গলা থেকে ভাঙা ভাঙা স্বর ছিটকে ছিটকে আসছে।
“ঠান্ডা লেগেছে মনে হচ্ছে?”
গোলাপী ফিরে এসে সুব্রতবাবুর দিকে একটু সময় তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
সুুব্রতবাবু বললেন, “হু...।”
“মমতা মাসিকে আদা দিয়ে রং চা বানিয়ে দিতে বলবেন। তাহলে ভালো লাগবে।”
“আপনাকে ধন্যবাদ।”
“ধন্যবাদ, কী জন্য?”
“এতটা আহত হয়েও আমার জন্য এটুকু করার জন্য।”
গোলাপী কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেলো। কিন্তু চলে যাবার সময় গোলাপীর চোখের চাহনি সুব্রতবাবুকে প্রবল ধাক্কা দেয়। প্রায় থ বনে যান সুব্রতবাবু। তার চাহনির ভেতর দিয়ে সুব্রতবাবু দেখতে পান তার ভেতরে প্রোথিত একটি নির্যাতিত সত্ত্বার শিকড়। মাঝে মাঝে মানুষ মুখের থেকে চোখ দিয়েই ভালো করে অনেক জটিল অজানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে। সুব্রতবাবু বিষয়টা বেশ ভালো ভাবেই টের পেলেন।
মমতা মাসির বাড়িতে রাতটা জম্পেশ কাটলো সুব্রতবাবুর। ঝটপট ইলিশ মাছের ভাজি, আলু ভর্তা আর ডিম ভাজি কওে ফেলেন মমতা মাসি। খুবই হাশিখুশি মহিলা। ওনার কথার মধ্যেও কোথায় যেনো আত্মীয়তার টান আছে। রোগা-সোগা শরীর, গায়ের রং অনেকটা শ্যামলা। গলাটা নিয়ে সুব্রতবাবু বেশ সমস্যায় পড়ে যান। কাল যদি মুখ দিয়ে আওয়াজই না বের হয় তাহলে ডাটা কালেকশন করবেন কিভাবে। তাছাড়া মমতা মাসির কাছে এই আবদারটা করতেও লজ্জা লাগছিলো ভদ্রলোকের। অবশেষে কোনো উপায় না দেখে বলেই ফেললেন সুব্রতবাবু, “মাসিমা, একটু রং চা দিতে পারবেন? ঠান্ডায় গলাটা বসে গেছে।”
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চাও চলে আসলো। আদার সুন্দর রসালো গন্ধ বেরুচ্ছে চা থেকে। একেবারে অচেনা অজানা একটা মানুষকে কত সহজে নিজের খুব কাছের মানুষ বানানো যায় মমতা মাসি খুব ভালোই পারেন সেটা। চা শেষ করে মেসো মশাইয়ের সাথে একটু আলাপচারিতা করে সুব্রতবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙলো একদল পিচ্ছি পাচ্ছার আওয়াজে। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিলো না সুব্রতবাবুর। মমতা মাসির বাড়িতে এতো বাচ্চা কাচ্চার শব্দ কেনো? বাচ্চা কাচ্চা বলতে মমতা মাসিদের এক ছেলে। সে এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে। তাহলে? ঘুমও লাগছে না আর। আবার ঘুমের অতৃপ্তি স্বরূপ একটা ফোলা ফোলা ভাবও রয়ে গেছে মুখের মধ্যে।
মমতা মাসিদের ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে উঠোনের দিকে তাকাতেই সুব্রতবাবুর চক্ষু চড়কগাছ। উঠোন ভর্তি প্রায় ২০-৩০ টা পিচ্ছি ছেলে মেয়ে বসে আছে আর মমতা মাসি তাদের পড়াচ্ছেন। বিস্ময়ে সুব্রতবাবুর মুখের ফোলা ফোলা ভাবটা মুহূর্তেই হাপিশ। সুব্রতবাবুকে দেখে মমতা মাসি পড়ানো বাদ দিয়ে তার দিকে এলেন।
“কী সুব্রত, ঘুম হয়েছো তো ভালো?”
“হ্যাঁ মাসিমা।”
মাসিমার মুখের তৃপ্তির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবেই মিথ্যেটা বললেন সুব্রতবাবু।
মমতা মাসি বললেন, “বাচ্চাগুলো খুবই গরিব। স্কুলে যেতে পারে না, পরিবারেরও সামর্থ্য নাই। সকাল দশটা হলেই এরা একেকজন একেক কাজে চলে যায়। এদের নিয়েই আমার সকাল বেলাটা কাটে। তুমি হাত মুখ ধুয়েছো?”
“না মাসিমা, এই যাচ্ছি।”
“তাহলে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তাটা খেয়ে নিয়ো। আমি খাবার ঘরে রেখে এসেছি। আর তোমার গলার কি অবস্থা?”
ও তাই তো। ঘুম থেকে উঠে সুব্রতবাবু একবারও চেক করেননি। গলা দিয়ে একটু জোরে কেশে নিলেন সুব্রতবাবু।
“না মাসিমা, আর কিছু লাগবে না। সেরে গেছে প্রায়। আজকের কাজটা ভালোয় ভালোয় করতে পারলেই হলো।”
সুব্রতবাবু তন্ময় হয়ে দেখলেন মমতা মাসিকে। কী সুন্দর হাশিখুশী চেহারা। চেহারা মধ্যে কোনো তাপ-উত্তাপ নেই, কোনো বিরক্তির চিহ্ন নেই। বিমোহিত শ্রোতার মতো কিছুক্ষণ মমতা মাসির পড়ানো শুনলেন। সত্যিই অসাধারণ। প্রভাত ঘোষ যে ঢপ মারেননি সুব্রত বাবু আজ স্বচক্ষে দেখলেন।
সকাল দশটা থেকেই সুব্রতবাবুর ডাটা কালেকশনের কাজ শুরু হয়ে গেলো। এসব কাজের জন্য একটু গুলবাজ মানুষই বেশি পরিপক্ক হয়। সুব্রতবাবুর মতো রস-কসহীন মানুষ এক জায়গায় বসে গুতিয়ে গুতিয়ে মানুষের পেট থেকে আসল তথ্যটা বের করতে গিয়ে প্রায়ই ব্যর্থ হন। বিষয়টা সুব্রতবাবুর থেকে সুব্রতবাবুর গাইড স্যার আরো ভালো ভাবে জানেন। কিন্তু ছাত্রকে কিছু না শিখিয়ে তিনি ছাড়তেও পারেন না। সেজন্যই এখানে আসা। কিন্তু ফ্যাঁকড়াটা বাঁধলো প্রভাত ঘোষ না আসার কারণে। প্রভাত ঘোষ আবার এসব কাজ খুব ভালো পারে। যাই হোক। সারাদিনে বিশটার মতো কোয়েশশনিয়ার শেষ করলেন সুব্রতবাবু। বিশটাতে মোটামুটি গাইড স্যারের মন ভরানো যাবে বলে আশা করছেন তিনি। তারপরেও আগামীকাল সকালে আরো চার পাঁচটার মতো কোয়েশশনিয়ার কমপ্লিট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে রওয়ানা দেয়া যাবে।
রাত্রিবেলা খেতে বসেছেন সুব্রতবাবু এবং উনার মেশো মশাই। খাবার দিচ্ছেন মাসিমা। মেসোমশাই মানুষটা একটু গম্ভীর প্রকৃতির। একেবারে অল্প কথা বলেন। তবে সিগারেটের বাতিক মারাত্মক। সরকার সিগারেটের দাম বাড়ালেও উনার খাওয়া বিন্দু বিসর্গও কমাতে পারেনি। ঘরে বাইরে সময় পেলেই সিগারেট টানেন।
খাওয়া দাওয়ার মধ্যেই একটা বিকট চিৎকারে সুব্রতবাবু এবং উনার মেশোমশাই দুজনেরই মুখে ভাত আটকে গেলো। কান খাড়া কওে সুব্রতবাবু আবার শোনার চেষ্টা করলেন। হ্যাঁ, কোনো মহিলার আর্ত চিৎকার। চিৎকারটা এতোই হৃদয় বিদারক যে সুব্রত বাবুর পুরো দেহ পাথর হয়ে বসে আছে। মেসোমশাইও নিঃসাড়। চোখ সরু করে মেসোমশাই মমতা মাসিকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে গো?”
“হবে আবার কী? ঐ ব্রাহ্মণ পাড়ায় বিচার বসেছিলো আজ। চারিদিকে গুজব রটেছে শ্রীকৃষ্ঞ নাকি গরুর দুধ খাচ্ছেন। তো বেচারি গোলাপী তো জাতে শূদ্র। সেও লুকিয়ে একটু দুধ খাওয়াতে গিয়ে ধরা পড়ে যায়। তাই ওদের পঞ্চায়েত আজ বিচার বসিয়েছে।”
গোলাপীর নামটা শুনেই সুব্রতবাবু খানিকটা বিমূঢ় হয়ে গেলেন। পাশের বাড়িতে তাহলে গোলাপীর বিচার করা হচ্ছে! এ আর্ত চিৎকার তাহলে গোলাপীর! গতকালের সেই অ্যাক্সিডেন্টের পর আজকের এই শাস্তি। গোলাপীর কান্নার স্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ভেঙে খান খান হয়ে যাচ্ছে রাত্রির সকল নৈঃশব্দ।
এর জন্য বিচার করতে হবে কেনো? তাছাড়া একজন হিন্দু মহিলা শ্রীকৃষ্ঞকে গরুর দুধ খাইয়েছে, হতে পারে সে শূদ্র তাই বলে ধর্মের বাইরের তো কেউ নয়।” বললেন সুব্রতবাবু।
মমতা মাসি বললেন, “এসব কী আর ঐ ভন্ডরা বুঝবে? ঐ মনোহর চক্রবর্তী, ব্যাটা শয়তানের পাঠা। যখন শহরের মেসে থাকতো ব্যাটা বামুন হয়ে গো মাংস ভক্ষণ করেছে। তখন ধর্ম যায় নি আর এখন এই গ্রামে এসে মানুষকে ধর্ম শেখাচ্ছে।”
মনোহর চক্রবর্তী নামটা শুনেই সুব্রতবাবু চমকে উঠলেন। আজকের ২০ টা কোয়েশশনিয়ারের একটাতে মনোহর চক্রবর্তীর মতামতও তিনি নিয়েছেন। সুব্রতবাবু বললেন, “মনোহর চক্রবর্তী বলতে ঐ ফর্সা করে লোকটা না? গোঁফও আছে।”
“হ্যাঁ।”
“আজ উনার কাছ থেকেও তো ডাটা কালেকশন করলাম। কথাবার্তা শুনে তো ওরকম কিছু মাথায়ই আসেনি। অথচ-”
“যত রাজ্যেও ঢং! ও বেচারা এসব খুব ভালো পারে। মানুষের সামনে সং সাজা।”
এরপর মনোহর চক্রবর্তীকে নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি। পরদিন আরো চার পাঁচ কোয়েশশনিয়ার কমপ্লিট করে সুব্রতবাবু চলে আসেন। তবে গোলাপীর জন্য তার খুব খারাপ লাগছিলো। একেবারে সহজ সরল একটি মেয়ে। তার উপর দিয়ে এরকম নির্যাতনের খড়গ বয়ে গেলো!

মাস ছয়েক পরের ঘটনা। থিসিস এখনো জমা দিতে পারেননি সুব্রতবাবু। সুব্রতবাবুর গাইড স্যার কী একটা কাজে জাপান চলে গেলেন হুট করে। সুব্রতবাবু এই ফাঁকে এই ফাঁকে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে হাওয়া খেতে লাগলেন। এই হাওয়া খাওয়ার মধ্যেই তার সাথে দেখা হয়ে গেলো তার জীবনের একটি অধ্যায়ের- মনোহর চক্রবর্তী! যিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ঞকে দুধ খাওয়ানোর অপরাধে শূদ্র মহিলা গোলাপীর বিচার করেছিলেন নন্দগ্রামে। মনোহর চক্রবর্তীকে দেখেই এগিয়ে গেলেন সুব্রতবাবু, “আপনি মনোহর চক্রবর্তী না?”
“আরে সুব্রত মশাই যে।”
“আপনি মনে রেখেছেন তাহলে?”
“রাখবো না কেন মশাই? আপনার মতো একজন জ্ঞানীর পায়ের ধূলা আমার বাড়িতে পড়েছিলো আর আমি ভুলে যাবো?”
“আপনাদের ঐ কাজের মহিলাটার কী অবস্থা?”
“গোলাপীর কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, আমি যখন নন্দ গ্রামে যাই মেয়েটা আমাকে খুব সাহায্য করেছিলো।”
“আরে রাখেন মশাই আপনার সাহায্য। মেয়েটা তো এখন বিধর্মী হয়ে গেছে।”
“মানে?”
“মানে ও মুসলমান হয়ে গেছে।”
“বিধবা মেয়ে, আদর করে আমার বাড়িতে কাজ দিয়েছিলাম, আর-”
“ও বিধাব ছিলো নাকি?”
“হ্যাঁ মশাই। সেটা দেখেই তো আমি ওকে ঠাঁই দিয়েছিলাম। তারপর যা হয় আর কি। প্রশ্রয় পাওয়া শুরু হয়ে গেলো। আমি ওকে নিষেধ করেছিলাম আমার ঠাকুর ঘরে না যাওয়ার জন্য। সে নাকি প্রায়ই লুকিয়ে লুকিয়ে ঠাকুরের ঘরে যেত। অনেক নিষেধ করেছিলাম শুনেনি। সেদিন করলো কি জানেন, শ্রীকৃষ্ঞ পুরো বিশ্ব¦ ব্রহ্মান্ড জুড়ে তাঁর ভক্তদের সেবা গ্রহণ করছিলেন ঐ পুরামুখী এক চামচ দুধ নিয়ে শ্রীকৃষ্ঞের মুখে ঢেলে দিলো। আর মুসলমান হয়েই ক্ষান্ত হয়নি, শুনছি একটি মুসলিম ছেলেকে নাকি বিয়েও করে ফেলেছে এর মধ্যে। সাহসটা দেখেছেন আপনি?”
সুব্রতবাবুর চোখ মুখ লাল হয়ে গেলো, “হুমম..। সাহস আমি দুজনেরই দেখলাম মনোহর চক্রবর্তী। আপনারটাও দেখলাম, গোলাপীরটাও দেখলাম। আজ আমি আপনার সামনেই বলছি, গোলাপী সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
“কি বলছেন মশাই!” চোখ দুটি কপালে তুলে বললেন মনোহর চক্রবর্তী।
“আপনি যেটা করছেন, কিংবা আপনারা যেটা করেছেন সেটাই হলো বিধর্ম। ধর্মের আড়ালে সমাজের মানুষগুলোকে শোষণ করা। সমাজে ধর্ম ব্যবসা করা, সমাজকে নিজের পায়ের তলায় রাখা। সমাজে নিজেকে প্রভু হিসেবে প্রতিস্থ্াপন করা। মনোহর চক্রবর্তী বামুন হয়ে গো মাংস ভক্ষণ করতে পারে তাতে কোনো সমস্যা নেই আর গোলাপী শূদ্র হয়ে সবচেয়ে পবিত্র জায়গায় গেলেই সমস্যা। মনোহর চক্রবর্তী বামুন হয়ে ইউনিয়ন অফিসে চাকরি করে ঘুষের টাকা খেতে পারে তখন ধর্মের কিছু যায় আসে না আর কিন্তু গোলাপীদের বেলায় যত ধর্ম অধর্ম। ধর্ম কি আপনার বাপ দাদার জমিদারি নাকি যখন যেভাবে ইচ্ছে চাপিয়ে দিলেন?”
মনোহর চক্রবর্তীর মুখ থেকে আর আওয়াজ বেরুচ্ছে না। সুব্রতবাবুর কথার ধাক্কায় তার আর বলার কিছু রইলো না। সুব্রতবাবু রুক্ষ চোখে তাকিয়ে আছেন মনোহর চক্রবর্তীর দিকে। একটি শোষকের দিকে, একটি নিষ্পেষকের দিকে। যাদের জন্য গোলাপীরা হারাতে থাকে অতল গহ্বরে।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ৮:২৬

অবনি মণি বলেছেন: ভালো লাগলো পড়ে !

২০ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৪৫

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ধন্যবাদ ।

২| ২১ শে অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:৪৬

চাঁদগাজী বলেছেন:

ভালো, গোলাপীর জন্য জীবনই ধর্ম

২২ শে অক্টোবর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৪

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ঠিকই বলেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.