নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভালোবাসা

০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৪

এতক্ষণ একটা নিঃশঙ্ক ঘুমে মগ্ন ছিলেন আনোয়ার সাহেব। বাসে যাত্রীও কেন জানি আজকে অনেক কম। পুরো বাস মিলে যাত্রী সংখ্যা জনা দশেকের বেশি হবার নয়। সারাটা দিন থসথসে গরমে পুরো শহরের মানুষ ঘেমেছে। আনোয়ার সাহেবের বাড়ির পুরোটাই এসি দিয়ে মোড়ানো। প্রখর গ্রীষ্মের এই তপ্ত আবহাওয়া তাকে মোটেও স্পর্শ করতে পারেনি। বাড়িতে এখন আনোয়ার সাহেব একাই থাকেন। এক ছেলে ব্যবসার সুবিধার্থে ঢাকায় ফ্লাট কিনেছে, আরেক ছেলে সুইজারল্যান্ড সেই যে কবে গিয়েছিলো আর দেখা নেই। মাস খানেক আগে স্ত্রীর মৃত্যু আনোয়ার সাহেবকে একেবারে একা করে দেয়।
আনোয়ার সাহেবের পাশের সিটটা ফাঁকা। তার পাশের সারিতে তার সিটের সমান্তরালে একটু মোটা বেঁটে গোছের এক ভদ্রলোক বসা। ভদ্রলোকেরও পাশের সিটটা ফাঁকা। জায়গা একটু বেশি পাওয়াতে পুরো জায়গাটা জুড়েই দু পা ছড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছেন আবার। এরকম মাঝ রাস্তায় ঘুম ভাঙাতে আনোয়ার সাহেবের মনের মধ্যেও বিরক্তির আঁচড় টানছে। কীভাবে কাটাবেন বাকিটা সময়? বাইরে নীলাভ অন্ধকার। কোনো জোনাকিও দেখা যাচ্ছে না সেখানে। খুব বিশ্রী দেখাচ্ছে অন্ধকারটাকে। কেমন আবহাওয়া বাইরে? হয়তো এখনো অনেক গরম। এই গরমে অনেকের শরীরের বিনবিনে ঘামে ভিজছে তার বেডশিট। গাড়ির ভেতরে এসি চলছে। প্রকৃতি আনোয়ার সাহেবকে স্পর্শ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ পাচ্ছে না। আনোয়ার সাহেবের ইচ্ছে হলো গাড়ির গ্লাসটা খুলে চলন্ত গাড়িতে বাইরের ঝাপটা বাতাস উপভোগ করবেন। গ্লাসে হাত দিতেই তার সমান্তরালে যে লোকটি বসা ছিলো কেমন যেনো আর্তনাদ করে উঠলো হুট করে।
“আরে মিস্টার, চলন্ত গাড়ি। এসি চলছে। আপনি গ্লাস খুলছেন কেনো?”
লোকটার এই আর্তনাদে সবাই একটু বিরক্তি ভরা চোখে আনোয়ার সাহেবকে দেখে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলেন। সবার এরকম সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ায় আনোয়ার সাহেব বসে পড়লেন। মুখে বিষণœ হাসি। বাসের পরিবেশটাকে অসহ্য মনে হচ্ছে তার কাছে। এক অকারণ যন্ত্রণা আনোয়ার সাহেবকে আরো জীর্ণ করে ফেলেছে। আনোয়ার সাহেব জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরের অস্পষ্ট দৃশ্যগুলো বোঝার চেষ্টা করছেন। গাড়িটি যাচ্ছে বিস্তীর্ণ হাওরের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে দিয়ে। হাওড়ে বেশ কিছু প্রজ্জলিত শিখা কাঁপতে কাঁপতে জ্বলছে। নিশ্চয়ই জেলেরা মাছ ধরছে খোশ মেজাজে। আনোয়ার সাহেব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন সেদিকে। উনার মনের মধ্যে বেজে ওঠে এক নিষ্ঠুর ভালোবাসার ঝংকার।
একটু ঘাড় ফেরাতেই আনোয়ার সাহেব দেখেন যে লোকটি জানালা খুলতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিলো সে তার পাশের সিটে বসে খানিকটা তার দিকে ঝুঁকে আছে।
“এত মুগ্ধ হয়ে কী দেখছেন বাইরে?”
লোকটার মুখে মিটিমিটি হাসি। গলার মধ্যে কেমন যেনো তোষামোদী ভাব।
লোকটার দিকে তাকিয়েই আনোয়ার সাহেবের চোখ লাল হয়ে গেলো। একটু আগে যে লোকটা এক প্রকার অপমান করেই আনোয়ার সাহেবকে বসিয়ে দিয়েছে সেই এসে এখন রঙ্গ তামাশা শুরু করেছে। আনোয়ার সাহেব লোকটার দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেন। মুখের হাবভাব অসহ্য, বিরক্তিকর।
“রাগ করলেন নাকি আপনি?”
“আপনি কিছু বলবেন?”
“না, এই পাশাপাশি সিটে বসে আছি। একটু গল্প গুজব না করলে হয়?”
“আমার সাথে গল্প গুজব কওে আপনি মজা পাবেন না।”
“কেনো?”
“এটার উত্তর দিতে পারবো না। আমার মনটা এখন ভালো নেই। আপনি একটু চুপ থাকলে আমিও একটু একাকী থাকতে পারি।”
“কেন মিস্টার? একা থাকবেন কেনো? কী কষ্ট আপনার? শেয়ার করুন আমার সাথে। জানেন তো, কষ্ট ভাগাভাগি করলে মানুষের কষ্ট অনেক কমে যায়।”
লোকটির কথার উত্তর দিতে গিয়েই যেন শক খেলেন আনোয়ার সাহেব। মুখ দিয়ে “ভালো” শব্দটা বলেই বাকিটুকু কোনো এক অজানা কারণে তার মুখের ভেতর আটকে গেলো। পাশে বসা লোকটার উৎসুক দৃষ্টি ঝুঁকে আছে আনোযার সাহেবের দিকে। শকটা খেয়েই আনোয়ার সাহেব হু হু করে হেসে উঠলেন। হাসির মাত্রাটা এতই উচ্চ ছিলো যে গাড়ির যাত্রীরা কপট বিরক্তির সাথে পেছনে একবার করে তাকালেন। অভিযোগ দেয়ার মানুষটি আনোয়ার সাহেবের পাশে বসে আছে বলে কেউ অভিযোগও দিতে পারছে না।
“একটা গল্প মনে পড়ে যাচ্ছে। শুনবেন?” আনোয়ার সাহেবের হঠাৎ হাসোজ্জল মুখ।
পাশের ভদ্রলোকটি অনেকখানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “গল্প?”
আনোয়ার সাহেব বললেন, “হ্যাঁ, আমার ছোটবেলার গল্প। সত্যি গল্প। গল্পের শেষটা আপনার প্রশ্নগুলোর ধাক্কায় এই মাত্র আমার কাছে পরিষ্কার হলো।”
“কী সেটা?”
“ভালোবাসা।”
“ভালোবাসা?”
“হু..। আপনার শোনার ধৈর্য্য থাকলে আমি বলতে পারি।”
“হুম..শুরু করুন।”
আনোয়ার সাহেব শুরু করলেন, “সেটি ছিলো জানুয়ারি মাসের ৭ তারিখ। সালটা ঠিক মনে নেই। কøাসজুড়ে শব্দহীন একটা গুমোট পরিস্থিতি। কøাস নিচ্ছিলেন লাকি ম্যাডাম। যার নাম শুনলে স্কুলের পিলার পর্যন্ত কেঁপে উঠতো। একটা কথার মধ্যে হাজারটা ফ্যাঁকড়া বাঁধাতে জানতেন ম্যাডাম। আর সে কী রাগ রে বাবা! রাগের সময় এমনভাবে দাঁত কিড়মিড় করতেন মনে হতো সবাইকে বাঘের মতো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবেন। ছোটবেলায় আমার এক দুঃসম্পর্কের বোন সম্পর্কে আমার দাদী বলেছিলেন রোগা সোগা মেয়েদের হাড়ের জয়েন্টে জয়েন্টে রাগ জমা থাকে। কথাটা সেদিন বুঝতে না পারলেও ক্লাসে আমার শরীরের প্রতিটি জয়েন্ট উনার বেত্রাঘাতে যে পরিমাণ নিষ্পেষিত হয়েছিলো তা পুরো স্কুল জীবন পর্যন্ত প্রতিটি জয়েন্ট দেখে প্রমাণ মিলতো।
‘ম্যাডাম আসতে পারি।’
ম্যাডাম তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন। ম্যাডামের মুখের একেকটা শব্দের সাথে মনে হচ্ছিলো এটম বোমা বিস্ফোরিত হচ্ছে। এমন সময় ক্লাস রুমের দরজাটা ফাঁক করে একটা অচেনা অজানা ছেলের এই আবেদন।
ম্যাডামসহ পুরো ক্লাসের দৃষ্টি এখন ছেলেটির দিকে। ছেলেটি দেখতে কালো কুঁচকুঁচে, চুলগুলো কোঁকড়ানো, মুখের গড়ন অতিশয় কুৎসিত, দাঁতগুলো মাসের পর মাস না মাজার ফলে হলদেটে হয়ে আছে। পরনের পোশাকের মধ্যেও একটা অদ্ভুত ধরন। আঁট-সাঁট প্যান্ট, ঢোলা শার্ট। সবকিছু মিলে অনেকটা এলিয়েন টাইপ চেহারা।
“কী চাই?”
লাকি ম্যাডাম এতই বিরক্তি ছড়িয়ে প্রশ্নটা করলেন মনে হলো পুরো বার্লিনের প্রাচীর বুঝি খসে পড়লো।
“ম্যাডাম, মাহবুব স্যার আমাকে এই ক্লাসে আসতে বললেন।”
লাকি ম্যাডামের প্রশ্নের ভারে ইতোমধ্যে তার পা দুটিতে মৃদু কাঁপুনি সৃষ্টি হয়ে গেছে।
“তুমি কি এই ক্লাসের ছাত্র?”
“জি ম্যাডাম।”
ছেলেটির উত্তর শুনে সবার আক্কেল গুড়–ম অবস্থা। ছেলেটি তাহলে এই ক্লাসেরই ছাত্র! হয়তো নতুন ভর্তি হয়েছে। কিন্তু সে যে এখানকার ছাত্র তার চলন বলনে বোঝা সত্যিই কষ্টকর।
“কবে ভর্তি হয়েছো তুমি?”
“আ-জ-কে-ই।”
ম্যাডামের এই ধমক প্রবণ প্রশ্নে তার উত্তরগুলো মুখে আটকে যাচ্ছিলো বার বার।
“তো ক্লাসে কিভাবে আসতে হয় তুমি জানো না? এরকম গুন্ডা মাস্তানের মতো ক্লাসে এসেছো কেনো?”
মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। মাথাটা নিচু। চোখের পাতা ফেলছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। তার পায়ের কাঁপুনিটা বেড়েছে।
“আগে কোন স্কুলে পড়েছো তুমি?”
“ধা-ক-কা।”
“ভালো করে বলো।”
“ধাক্কামারা উচ্চ বিদ্যালয়।”
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ, নামের কি ছিরি। স্কুলের ওমন নাম কোন মূর্খ রেখেছে?”
“ম্যাডাম, আমি রাখি নি।”
অতি সরল স্বীকারোক্তি ছেলেটার।
ছেলেটার এরকম হাস্যরসাত্মক উত্তরেপুরো ক্লাস জুড়ে একটা মৃদু এবং চাপা হাসির ধারা বয়ে গেলো।
“এই কে হাসছে? ওর সাথে আমি কথা বলছি না তোমরা কথা বলছো। মেরে সব কয়টার পিঠের ছাল তুলে নেব।”
আমাদের সবাইকে একটু শাসিয়ে ম্যাডাম আবার ছেলেটার দিকে নজর দিলেন।
“এই ছেলে, কান খাড়া করে শোন, এরকম গুন্ডা মাস্তানের মতো আর আসলে তোমাকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়া হবে। এটা একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভালোভাবে স্কুল ড্রেস পড়ে আসবা। আজ প্রথম দিন বলে ছেড়ে দিচ্ছি। যাও বসো গিয়ে।”
ছেলেটা পিছনের একেবারে ফাঁকা ব্রেঞ্চটিতে বসলো। হাতে স্কুলের পাশের কবির চাচার দোকান থেকে কেনা স্পাইরাল খাতা ও একটা কলম। সবাই বেশ কৌতুহলের সাথে আড়চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। বেচারার বড়োই দুর্ভাগ্য। একে তো প্রথম ক্লাস। তাও আবার লাকি ম্যাডামের। এর মধ্যে এরকম হাবিজাবি পোশাক পড়ে এসেছে।
ছেলেটির নাম পরে আমরা জানতে পারলাম মামুন। গ্রাম থেকে শহরে এসেছে পড়াশুনা করার জন্য। এখানে তার ভাইয়ের সাথে একটা মেসে উঠেছে। তাদের গ্রামের স্কুলে নাকি খুব ভালো একটা পড়াশুনা হয় না। পর্যাপ্ত টিচার নেই, ক্লাসরুম নেই। কারো কাছে গিয়ে একটু প্রাইভেট পড়বে সে ব্যবস্থাও নেই। তাই মামুনের ভাই তাকে শহরে নিয়ে আসেন।
মামুন খুবই লাজুক প্রকৃতির। মুখের মধ্যেকার হাসিটাও লাজুক লাজুক। কোনো ছেলেকে এতটা লাজুক হতে এর আগে আমি দেখিনি। কোনো প্রশ্ন করলেই কয়েক মুহূর্ত মিটিমিটি হেসে নেয়, তারপর উত্তর দেয়। এটা নিয়ে ক্লাসের অনেক ছেলেই মজা লুটতে থাকে। মামুনের অগোচরে মামুনের হাঁটা চলা, তথা বলার ধরন সবকিছু নিয়ে চলতে থাকে বিদ্রুপের মহোৎসব।
মামুন আসার প্রায় মাসখানেক হয়ে গেলো। মামুন এখনো কোনো বন্ধু খুঁজে পায় না। টিফিন পিরিয়ডে স্কুলের উত্তর পার্শ্বের নীরব নিস্তব্ধ জায়গাটিতে একা একা বসে থাকতো। ক্লাসে এসে একেবারে পেছনের ব্রেঞ্চে বসতো। নীরবে কিছু একটা ভাবতো। কী ভাবতো সে? শহুরে ছেলেগুলো এতো স্বার্থপর, নিষ্ঠুর কেনো? নাকি অন্য কিছু। আমি বুঝতে পারতাম না।
আমাদের ক্লাসে ষন্ডা মার্কা দু একটা ছেলে ছিলো। ক্লাসের ফাঁকে তাদের ষন্ডামি একেবারে চরমে পৌঁছতো গিয়ে। মাঝে মাঝে মামুনই হয়ে উঠতো তাদের লক্ষ্যবস্তু। মামুনকে নিয়েই তারা নানান হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠতো। চান্স পেলেই মামুনের পরনের টাই ধরে মৃদু টান দেয়া, শার্টের ইন ধরে টান দেয়া, নানান বিদ্রুপ করা এক স্বাভাবিক বিষযে পরিণত হয়ে গিয়েছিলো। কøাস নামক জায়গাটি মামুনের কাছে মনে হতে লাগলো চরম বিভীষিকাময়। আমি সরু চোখে সবই লক্ষ্য করতাম।
মামুনের সাথে কারো কোনো বন্ধুত্ব হতে আমি দেখিনি। আমি দূর থেকে লক্ষ্য করতাম মামুনের সরলতা, সততা। আমি নিজ ইচ্ছায় মামুনের প্রতি আমার বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলাম।
একদিন একা বসে আছে দেখে আমি মামুনকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী মামুন, কেমন আছো?”
মামুন স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে একটু হেসে নিলো। তারপর উত্তর দিলো, “আছি, ভালোই আছি। তুমি কেমন আছো।”
“এই চলছে। তোমাদের মেসটা কোনদিকে।”
“এই তো পাশেই। ১২/২ মোহনা। আজ বিকেলের দিকে একবার এসো, কেমন?”
“কেন, কোথাও যাবে নাকি?”
“না, আসলে একটু আড্ডা দিতাম, এসো কিন্তু।”
মামুনের অফারটা আমি লুফে নিলাম ঝটপট। বললাম, “ঠিক আছে মামুন, তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে তোমার সাথে।”
মামুনের মেসের দিকে গিয়েছিলাম বিকেল পাঁচটার দিকে। মেসে পৌঁছার সাথে সাথেই ঠং করে বুকে বাজলো কিছু উত্তেজিত কথাবার্তা। যে রুম থেকে কথাগুলো আসছিলো আমি সেদিকে একটু উঁকি দিলাম। উঁকি দিতেই থ বনে গেলাম- মামুনের প্রাইভেট টিউটর মামুনকে পড়াতে এসেছে। পড়াশুনা ঠিকঠাক না পেয়ে টিউটরের এই উত্তেজিত কথাবার্তা দেখেই মুখ চুন হয়ে গেলো। আমি মেসের বাইরে পায়চারি করতে থাকি। কিছুক্ষণ পর প্রাইভেট টিউটর চলে গেলে আস্তে করে মামুনের রুমে প্রবেশ করলাম। মামুন তখন শার্টের কলার দিয়ে চোখের জল পরিষ্কার করছিলো। মিনিটখানেক দাঁড়িয়ে তারপর মামুনকে ডাক দিলাম, “মামুন।”
আমাকে দেখে মামুন তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো, “আরে কখন আসলে তুমি, বসো বসো।”
“এই মাত্র আসলাম।”
মামুন মুহূর্তের মধ্যেই বদলে গেলো পুরোপুরি। তার মুখের হাসির নিকট চোখের জল মুহূর্তেই যেনো মিইয়ে গেলো। মামুন আর আমি বিস্কুট খেতে খেতে গল্প শুরু করলাম।
মামুনের সাথে অনেকক্ষণ ধরে গল্প হলো। মামুনের জীবনে রয়েছে অদ্ভুত এক নির্জনতা। মামুন সেই ছোট্ট বেলা থেকেই মাটির কাজ করতো। সেই মাটির কাজের টাকা দিয়েই চলতো তার পড়াশুনা। মামুনের বড় ভাই তখনো কোনো জায়গায় ভালো কাজ জুটাতে পারেনি। অনেক কষ্টে এই শহরের একটা অফিসে দারোয়ানের কাজটা পেয়ে যায় সে। তারপর মামুনও চলে আসে ভালো পড়াশুনার জন্য।
কিছুদিন পর মামুনের আর কোনো দেখা নেই। ক্লাসে আসে না এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে। সামনে পরীক্ষা বলে আমিও বাড়ি থেকে খুব কম বেরুচ্ছি। একদিন সময় করে মামুনের মেসের দিকে গেলাম। গিয়ে দেখলাম মামুন আর তার ভাইয়ের জায়গায় নতুন দুজন উঠেছে। মামুনের কথা জিজ্ঞেস করতেই বললো, “ওরা তো বাড়িতে চলে গেছে। আর আসবে না।”
মামুনের সাথে এর পরে আমার আর দেখা হয়নি। একটিবারও না।
কিছু চিন্তা সব সময়ই আমার মাথায় ঘুরপাক খেত। মামুন কী জন্য চলে গেলো? যাক, চলে যাবি যখন কাউকে জানাবেও না? অন্তত আমাকে? আর এভাবে হুট করে যাওয়ারই বা কী দরকার ছিলো। মামুন তো ছোট বেলা থেকেই সংগ্রাম করে বড় হয়েছে। শহরে যে স্বপ্ন নিয়ে সে এসেছিলো তা এত সহজেই সে বিসর্জন দিয়ে দিলো?
বেশ কিছুদিন পর আমার নামে একটি কোরিয়ার আসলো। প্রেরকের ঠিকানা দেখেই চমকে উঠলাম- মামুন! পিওনের হাত থেকে চিঠিতা খাবলে নিয়ে হুড়মুড়িয়ে খামটা খুললাম। খামটি খুলতেই আমার চোখ মুখ কুঁকড়ে গেলো। ছোট্ট একটি ছিরকুটে লেখা- ভালোবাসা। যার মানে আমি কোনোদিনও বুঝতে পারিনি।
আনোয়ার সাহেব এবার তার পাশের ভদ্রলোকটিকে লক্ষ্য করে বললেন, “আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনার প্রশ্নগুলোর কারণে আমি বুঝতে পারছি মামুনের চিরকুটটির তাৎপর্য। আজ আমার টাকা পয়সার কোনো অভাব নেই। কিন্তু তারপরেও একটা যন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। সেটা হলো ভালোবাসা। সবাই খুব ব্যস্ত মিস্টার, কিন্তু আমার জন্য কেউই ব্যস্ত নয়।”
যাত্রা বিরতির জন্য গাড়িটি একটি হাইওয়ে হোটেলের সামনে থামলো। ভদ্রলোকটি আনোয়ার সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন, “জানালাটা খুলে দিবো? বাইরে চমৎকার বাতাস বইছে।”
আনোয়ার সাহেবের অনুমতি না নিয়েই ভদ্রলোক জানালাটা খুলে দিলেন। আনোয়ার সাহেব জানালার বাইরে মুখ বের করে উপভোগ করছেন বাতাসের ঝাপটা। এক চিলতে ভালোবাসা!

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩২

আরণ্যক রাখাল বলেছেন: চমৎকার গল্প| ব্যস্ত হয়ে যাচ্ছি| কিন্তু ভালবাসাহীন হলে তো চলবে না| ওটা খুব দরকার

২| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৫৯

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: একদম ঠিক ধরেছেন। আমাদের সমাজ থেকে আবেগ, ভালোবাসা, মানবিক গুণাবলিগুলো কেমন যেনো হারিয়ে যাচ্ছে।

৩| ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৪

ঢাকাবাসী বলেছেন: ভালবাসা টাসা সব কবেই হারিয়ে গেছে! সুন্দর গল্প, ভাল লেগেছে।

৪| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:২২

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.