নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ভিনদেশী আর্য বনাম গৌতম বুদ্ধ : ভারতবর্ষে টান টান উত্তেজনা

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৪৫

আর্যদের আগমন কাল থেকে শুরু করে খ্রিষ্ট পূর্ব আনুমানিক ৬০০ অব্দ পর্যন্ত সময়কালকে বৈদিক যুগ বলা হয়। এই সময়ের মধ্যে তেমন কোনো ঐতিহাসিক পরিবর্তন ঘটেনি যা পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো। অর্থাৎ আর্যদের একক কর্তৃত্বেই সমাজ চলছে।
তবে এই সুদীর্ঘ সময়ের ইতিহাস জুড়ে রয়েছে নানান ধরনের অস্পষ্টতা। এই সময়কার ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে অনেক ধোঁয়াশা চোখে পড়ে। অনেক ইতিহাস অস্পষ্ট, অনেক ইতিহাস আবার হারিয়ে গেছে অতল গহ্বরে। তবে বৈদিক যুগের সাহিত্য কর্মগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। সাহিত্য কর্মগুলোর ভেতরে যাই থাকুক এরকম উন্নত সাহিত্য তৎকালীন পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় নি। এই বৈদিক যুগেই ভারতবর্ষ আকার ও আকৃতিতে অনেক বড় হয়। সিন্ধু সভ্যতায় ভারতবর্ষ যে অবয়ব নিয়ে ছিলো, তা ক্রমে বিশাল আকার ধারণ করতে থাকে আর্য রাজাদের যুদ্ধের বদৌলতে। বৈদিক যুগেই এই ভূখন্ড “ভারত” নামটি লাভ করে।
তবে আর্যদের এই ধারাটি মারাত্মকভাবে ধাক্কা খায় গৌতম বুদ্ধের হাতে। আলোচনার শুরুতেই আমরা গৌতম বুদ্ধের পরিচয়টা একটু জেনে নিই।


গৌতম বুদ্ধের জন্ম নেপালের লুম্বিনী গ্রামে খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৬৬ অব্দে। যার নাম প্রথমে রাখা হয়েছিলো সিদ্ধার্থ। গৌতম বুদ্ধের পিতা শুদ্ধোধন ছিলেন শাক্য প্রজাতন্ত্রের নির্বাচিত রাজা। যখন বুদ্ধের নামকরণ করা হয় তখন আট জন ব্রাহ্মণকে বুদ্ধের বাবা আমন্ত্রণ জানান এবং তারা গৌতমবুদ্ধের নাম দেন সিদ্ধার্থ। গৌতম বুদ্ধের জন্মের সাত দিনের মাথায়ই তার মা মারা যান। পরবর্তীতে মাসির কাছে লালিত পালিত হন গৌতম বুদ্ধ। তৎকালীন নিপীড়িত, শোষিত মানুষের জীবন গৌতম বুদ্ধের মনকে তীব্রভাবে আলোড়িত করে এবং গৌতম বুদ্ধ রাজকীয় ভোগ বিলাসিতা ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন সত্যের সন্ধানে।
যে সময়টিতে গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে তাকে বলা হয় “ইতিহাসের কালবিভাজিকা”। কারণ তখন শুধু ভারতবর্ষ নয়, পুরো পৃথিবী এক বিশাল পরিবর্তনের তালে আন্দোলিত হচ্ছিলো। এই সময় থেকেই উল্লেখযোগ্য হারে শুরু হয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, ধর্ম, দর্শন এসবের জয়যাত্রা।
বুদ্ধের আগমন কালে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গার গুণগত পরিবর্তনগুলো একটু দেখে নিই।
যে সময়টিতে নর্ডিক ও আলপীয় নামক আর্যদের দুটি শাখা ভারতবর্ষের দিকে অগ্রসর হয় ঠিক সেই সময় আর্যদের অন্য একটি শাখা যায় ইরানের দিকে। ৫৩৯ খ্রিষ্ট পূর্বে আর্যদের এই শাখারই একটি অংশ পুরো ক্যালদীয় সা¤্রাজ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। আর যে অংশটি এই প্রভাব বিস্তারের কাজটি করে তাদের বলা হয় পার্সীয় (ঢ়বৎংরধহং)। এই পার্সীয়দের হাত ধরেই গড়ে ওঠে পারস্য সভ্যতা। খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৫৯ অব্দে সাইরাস পারস্য গোত্রের রাজা নির্বাচিত হন। নিজ নেতৃত্ব ও কৌশলের গুণে বাড়তে থাকে সাইরাসের আধিপত্য এবং ক্রমে সাইরাস পুরো পারস্যের স¤্রাট হয়ে উঠেন। সাইরাসের মধ্যে ক্ষমতা লিপ্সা ছিলো প্রবল। একের পর এক রাজ্য দখলের পরেও সাইরাসের তৃষ্ঞা মেটার বিন্দুমাত্র লক্ষণ দেখা যায় না। অবশেষে ৫২৯ খ্রিষ্ট পূর্বে এক বর্বর জাতির হাতে প্রাণ দিতে হয় সাইরাসকে।
সাইরাসের মৃত্যুর পর সাইরাসের পুত্র ক্যাম্বিসেস সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু বিভিন্ন বিদ্রোহের কারণে ক্যাম্বিসেসের আসন খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। মাত্র সাত বছর ক্ষমতার ছিলেন ক্যাম্বিসেস ( খ্রিষ্ট পূর্ব ৫২৯-৫২২ অব্দ পর্যন্ত)। এই বিদ্রোহ চলাকালে দারায়ূস নামক একজন ক্যারিশম্যাটিক লিডারের আবির্ভাব ঘটে। তিনি এসব বিক্ষোভ বিদ্রোহ দমন করে বিস্তার ঘটাতে থাকেন পারস্য সা¤্রাজ্যের। দারায়ূসের নেতৃত্বে পারস্য সা¤্রাজ্য পূর্ব দিকে ভারতের সিন্ধু নদের তীর, পশ্চিম দিকে দানিয়ূব, উত্তরে গ্রীসের একাংশ নিয়ে বিস্তৃত ছিলো।


ঠিক একই সময় চীনে গড়ে ওঠে “কনফুসীয় মতবাদ”। কনফুসিয়াস নামক একজন দার্শনিক ছিলেন এই মতবাদের প্রবক্তা। কনফুসিয়াসের জন্ম খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৫০ অব্দে এবং মৃত্যু খ্রিষ্ট পূর্ব ৪৭৯ অব্দে। চীনে তখন চলছে সামন্তবাদী শাসন ব্যবস্থা। এই সামন্তবাদী শাসন ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হতে মানুষ হয়ে পড়েছিলো খুবই দিশেহারা।
কনফুসিয়াস খুবই প্রতিভাধর ব্যক্তি ছিলেন। তার প্রতিভার জোরেই তিনি ‘লু’ নামক রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি ও পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পান। কনফুসিয়াস তার প্রধানমন্ত্রীত্বকালীন সময়ে লু রাষ্ট্রের ব্যাপক পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হন। তিনি সামন্তবাদী শাসন ব্যবস্থার যাঁতাকলে পিষ্ট মানুষগুলোর আর্তনাদ শুনতে সক্ষম হয়েছিলেন। এজন্যই কনফুসিয়াস যোগ্যতা অনুসারে শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনেক আগেই কনফুসিয়াস সমাজে শিক্ষার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। সেই অনুধাবন থেকেই তিনি নিজ উদ্যোগে স্থাপন করেন বিদালয়। সেখানে চলতে থাকে নানান ধরনের শিক্ষা দান। কনফুসিয়াসের এই নিঃস্বার্থ অবদানগুলিই তাকে জনপ্রিয় করে তুলে সাধারণ জনগণের মধ্যে। যা রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপরের মহল খুব একটা সুনজরে নেয় নি। ফলশ্রুতিতে কনফুসিয়াসকে অব্যাহতি বরণ করতে হয়।
কিন্তু কনফুসিয়াস থেমে যান নি। তিনি বিভিন্ন এলাকায় এলাকায় ভ্রমণ করে প্রচার করতে লাগলেন শিক্ষা, সততা ও মহানুভবতার বাণী। তাছাড়া চীনে আর্যদের কোনো শাখার আগমন না ঘটায় সেখানে মানুষরূপী দেবতাদের তোষামোদমূলক পূজা অর্চনার তেমন প্রচলন গড়ে উঠে নি। কনফুসিয়াস নিজেও এসবের ব্যাপারে ছিলেন নির্লিপ্ত। মানুষের জীবনকে সুন্দর, সুশৃঙ্খল করার এক কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন কনফুসিয়াস।
খ্রিষ্ট পূর্ব ২০৬ অব্দের দিকে কনফুসিয়াসের শিক্ষা চীন, জাপান, কোরিয়া, ভিয়েতনাম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

ইতিহাসের কালবিভাজিকায় আমরা গ্রীসেও প্রচুর তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখতে পাই। এই সময়টাতেই গ্রীস উপদ্বীপে পিথাগোরাস, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এর মতো জ্ঞানী ব্যক্তিদের আবির্ভাব ঘটে।
এবার আমরা ফিরে আসি আমাদের ভারতবর্ষে। যে ভারতবর্ষকে আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি একটি বিদেশী জাতির নিকট পরাজিত হতে।
আর্যদের নিষ্ঠুর কালো থাবায় যে ভারতবর্ষ বসে গিয়েছিলো তা এখনো উঠে দাঁড়াতে পারে নি। যতটুকু পেরেছে তা হলো সামরিক দিক দিয়ে। কৃষিক্ষেত্রে সামান্য পরিবর্তন সাধিত হলেও তা পুরো ভারতবর্ষের মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশা মেটাতে অক্ষম ছিলো। ৭০০ খ্রিষ্ট পূর্বে লৌহের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয় ভারতবর্ষ জুড়ে। কিন্তু এই লৌহ মানুষের কল্যাণের চেয়ে মানুষ ও জনপদ ধ্বংস করে দখলদারিত্ব কায়েমের লক্ষ্যেই বেশি করে ব্যবহৃত হয়েছে। যার ফলে জ্ঞান, বিজ্ঞান, উন্নয়ন সব দিক দিয়ে পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে তখন একটা নিশ্চল অবস্থা বিরাজিত ছিলো।
গৌতম বুদ্ধের আগমনকালে পুরো ভারতবর্ষ জুড়ে এই নিশ্চল অবস্থার আড়ালে চলছিলো সম্পদের টানাটানি। কে কার থেকে বেশি সম্পদশালী ও শক্তিশালী হতে পারে তার এক তীব্র প্রতিযোগিতা। তাছাড়া সমাজে উঁচু জাত, নিচু জাত বৈষম্যও তখন চরমে। অন্যদিকে নর্ডিক আর্যরা যে আধিপত্যের জোরে নিজেদের দেবতা হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলো, সেই দেবতাদের প্রভাবও জনগণের মধ্যে কমতে থাকে। জনগণ বর্ণবাদ নামক অমানবিক বিধি আর মানতে পারছিলো না। তাছাড়া আর্যদের যাগযজ্ঞসহ নিষ্ঠুর বলি প্রথার বিরুদ্ধেও জনমনে ব্যাপক প্রতিরোধ সৃষ্টি হতে থাকে।
তখন ভারতবর্ষের অর্থনীতিতেও বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। লৌহের ব্যবহারের পরে কৃষিতে মোট উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এই বৃদ্ধি পাওয়া উৎপাদনই তৎকালীন বাণিজ্যের রাস্তা সম্প্রসারিত করে দেয়। বাণিজ্যের সাথে বেশ ভালো অংশের একটা জনসংখ্যা যুক্ত হয়ে পড়ে। এই বাণিজ্য ভারতবর্ষ পেরিয়ে ভারতবর্ষের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায়ও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু সমাজের মূল চাবিকাঠি ব্রাহ্মণদের কব্জায় থাকায় এই ব্যবসায়িক শ্রেণীটি খুব একটা সুবিধে করতে পারছিলো না। তাদের কারণে অকারণে অতিরিক্ত মাত্রায় রাজস্ব দিতে হতো। অন্যদিকে কৃষি জমিতে গরুকে দিয়ে লাঙল চালানোর টেকনিক আবিষ্কারের ফলে গরুর উপযোগিতা অনেক বেড়ে যায়, বিশেষত খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ এবং তাদের থেকে একটু উন্নত ব্যবসায়ী শ্রেণীর কাছে। কিন্তু গরু বলিদান প্রথার ফলে গরুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কমতে থাকে এবং কৃষি ফলনের উপরও এর সুস্পষ্ট প্রভাব পড়ে। জনগণ আর এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না।

এত কিছুর পরেও আর্যদের প্রতিষ্টা করে দেওয়া নিয়মকানুন, আচার- অনুষ্ঠান তৎকালীন ভারতবর্ষের জনগণের মধ্যে এতটাই ঝেঁকে বসেছিলো যে তা থেকে মানুষকে বের করে নিয়ে আসা বেশ দুঃসাধ্যই ছিলো। মানুষের মনের মধ্যে রাগ- দুঃখ- ক্ষোভ ছিলো ঠিকই কিন্তু এই মানুষগুলোকে এক করে আর্য সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা এক প্রকার অলীক কল্পনাই ধরা যায়। তবে গৌতম বুদ্ধ অনেকাংশে এটা পেরেছিলেন। তিনি আর্য সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিলেন। গৌতমবুদ্ধ চারটি মূল সত্যকে নির্দিষ্ট করে তা প্রচার করেন।
১. সংসার দুঃখময়
২. দুঃখের নিশ্চয়ই কারণ আছে; আকাঙ্খা থেকেই এই দুঃখের সৃষ্টি
৩. দুঃখ থেকে মুক্তি সম্ভব
৪. মুক্তির জন্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ (সম্যক দৃষ্টি, সৎ সংকল্প, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ জীবন, সৎ চেষ্টা, সৎ স্মৃতি, সম্যক সমাধি) অবলম্বন করা উচিত।
গৌতম বুদ্ধের এই চারটি সত্যের চেয়ে যে বিষয়টা মানুষকে বেশি আকর্ষণ করে তা হলো বেশ সফল ভাবে আর্যদের ভন্ডামির একবারে মূলে সক্ষম আঘাত করা। তিনি এত দিনের সামাজিক ব্যাধি বর্ণ প্রথাকে এক বাক্যে অস্বীকার করেন।
“যে দাসীটি আত্মহত্যার চেষ্টা করে, স্বয়ং বুদ্ধ তাকে রক্ষা করেন, তাঁর প্রভুর সঙ্গে কথা বলে একটা মীমাংসা করে দেন। যে দাসীটির নাক ও কান কেটে নেয়া হয়েছিলো, তার ক্ষেত্রেও বুদ্ধ তার আপত্তি জানিয়েছিলেন। আপত্তি জানানো ছাড়াও দাস ও ভৃত্যদের কাজকর্মের ওপরেও বুদ্ধ গুরুত্ব দেন। তার মতে, সমাজের নি¤œ বর্গ গঠিত ছিলো দাস ও ভৃত্যদের নিয়ে। অর্থাৎ মনে হয়, নীচ নয়, বরং তারাই সমাজের ভিত্তি- মনে মনে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলেন।”
-প্রাচীন ভারতে দাসপ্রথা, লেখক- দেবরাজ চানানা
বর্ণপ্রথার পাশাপাশি মানুষ নামক যে সম্প্রদায়টি নিজেদের দেবতা হিসেবে দাবি করে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিলো, আর মানুষজনকেও তাদের প্রতিনিয়ত পূজা করার উপযোগী করে তুলছিলো সেই দেবতাদের ভন্ডামিকেও গৌতম বুদ্ধ অস্বীকার করেন।
ফলে গৌতম বুদ্ধের উত্থানের মুহূর্তেই শুরু হয়ে গেলো আর্যীয় ষড়যন্ত্র। তারা গৌতম বুদ্ধকে নিচু জাত হিসেবে আখ্যায়িত করা শুরু করে। যদিও গৌতম বুদ্ধের জন্ম ক্ষত্রিয় পরিবারে, কিন্তু গৌতম বুদ্ধের চিন্তাধারার সাথে পুরো ভারতবর্ষের সাধারণ জনগণ চলে গেলে বন্ধ হয়ে যাবে “রাজা” নাম করে জনগণের ফসলের উপর আরোপিত কর, বাধ্যতামূলক শ্রম, রাজার জন্য ফসলের অংশ সংগ্রহ, রাজাকে দেয়া আবশ্যিক কর ইত্যাদি অভিনব শোষণের রাস্তা। কিন্তু আর্যদের এই নিচু জাত নামক মিথ্যাচার গৌতম বুদ্ধের চলার পথে বিন্দুমাত্র বাধার সৃষ্টি করতে পারে নি। গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে জাত পাত নির্বিশেষে সকলে যুক্ত হতে থাকে। নারীদের গৃহে জব্দ করে রাখার “মনুসংহিতা” তে যে ফতুয়া জারি করা হয়েছিলো সেই ফতুয়াকে অস্বীকার করে নারীদেরও গৌতম বুদ্ধ তার সংঘে প্রবেশের অনুমতি দেন। এক পর্যায়ে উপায়ন্ত না দেখে অনেক ব্রাহ্মণও গৌতম বুদ্ধের সংঘে যোগদান করেন।
প্রশ্ন জাগাটা স্বাভাবিক যে এই প্রভাব ও এতো আলোড়ন সৃষ্টির পর কী হলো? গৌতম বুদ্ধ একটা প্রভাব ও আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন ঠিকই কিন্তু এর পূর্ণাঙ্গ কোনো ফলাফল গৌতম বুদ্ধ দিয়ে যেতে পারেন নি। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে- গৌতম বুদ্ধ পারলেন না কেনো? কী গলদ ছিলো তার মধ্যে কিংবা তার প্রচারিত মতের মধ্যে?
গলদ নিশ্চয়ই ছিলো। সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়া একটি মতাদর্শ কখনোই পথভ্রষ্ট হতে পারে না।
বুদ্ধের শুরুটা দারুণ ছিলো। বুদ্ধের চাওয়ার মধ্যেও সঠিকতা ছিলো। তৎকালীন অন্যায়, অত্যাচার, বৈষম্য, নিপীড়ন দেখেই গৌতম বুদ্ধ মানবতার বাণী নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু অনুসারীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় এদেরকে নিজের আদর্শে প্রভাবিত করা, এদের চাল চলনে একটা নিয়ন্ত্রণ আরোপে বুদ্ধকে হিমশিম খেতে হয়। এ সুযোগে নানান ধরনের অনিয়ম জন্ম নিতে শুরু করে।
গৌতম বুদ্ধ জন্ম গ্রহণ করেছিলেন নেপালের লুম্বিনী গ্রামে। জায়গাটির অবস্থান উত্তর- পূর্ব ভারতে। যেখানে অনার্যদের দুঃখ, দুর্দশা, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ ও নিপীড়ন বুদ্ধ খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন এবং তা তার মনকে ব্যাপক মাত্রায় আলোড়িত করেছিলো। এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়েই বুদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন। অন্যদিকে বুদ্ধের এই জনপ্রিয়তা শাসক গোষ্ঠীকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তোলে। তার উপর যখন বিশাল বণিক গোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদের (এই ব্রাহ্মণবাদের হাতে সমাজের চাবিকাঠি থাকায় বণিক সম্প্রদায়ের পুঁজি বিকশিত হচ্ছিলো না, যেটা বণিকদের স্বার্থ বিরোধী ছিলো।) বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একটা জায়গা পেয়ে গৌতম বুদ্ধকে গুরু মানা শুরু করে তখন অনেক শাসকও উপায় অন্ত না দেখে বুদ্ধের পায়ে এসে পড়ে।
এটি বুদ্ধকে এক বিশাল সংকটের মধ্যে ফেলে দেয়। গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়ে যান শাসক শ্রেণী ও শোষিত শ্রেণীর ঠিক মধ্যিখানে। কোন দিকে যাবেন বুদ্ধ? কাকে ছেড়ে কাকে বেছে নিবেন গৌতম বুদ্ধ? শাসক না শোষিত? গৌতম বুদ্ধ কাউকে যেমন ছাড়েন নি, তেমনি কাউকে গ্রহণও করেন নি। বরং খানিকটা শোষক শ্রেণীর দ্বারা বুদ্ধকে প্রভাবিত হতে দেখা যায়।
“জানা যায় যে, প্রারম্ভিক যুগে দারিদ্র ও দাসত্ব কিছুটা হালকা করার প্রবৃত্তি বৌদ্ধ সঙ্গগুলোর মধ্যে ছিলো। সেই সময়ে ঋণী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধে অক্ষম হলে ঋণদাতা তাকে কিনে নেয়ার অধিকারী পর্যন্ত ছিলো, তাই কতিপয় ধনী ব্যক্তির হাত থেকে পরিত্রাণের আশায় অনেকে ভিক্ষু হন। কিন্তু মহাজনদের বিরোধিতায় বিপদের সম্মুখীন হয়ে ঘোষণা করেন: “ঋণী ব্যক্তিকে প্রব্রজ্যা (=সন্ন্যাস) দেওয়া চলবে না।” (মহাবগগ ১/৩/৪/৮)
এই ভাবে দাসগণকে প্রব্রজ্যা দেওয়াতে দাস মালিকেরা নিজেদের স্বার্থে আঘাত লাগতে দেখে আন্দোলন শুরু করে। বুদ্ধ তখন ঘোষণা করেন, “ভিক্ষুগণ! দাস শ্রেণীকেও প্রব্রজ্যা দেওয়া চলবে না।” (মহাবগগ ১/৩/৪/৯)
--দর্শন দিগদর্শন, রাহুল সাংকৃত্যায়ন

এই ভিক্ষু সম্প্রদায় মূলত গঠিত হয় সংঘের মধ্য দিয়ে। “সংঘ” হচ্ছে বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকায়ই মূলত সংঘের উদ্ভব। সংঘে অবস্থান করা ভিক্ষুদের প্রধান কাজই ছিলো ধর্ম প্রচার করা।
যাই হোক, ধীরে ধীরে গৌতম বুদ্ধ এই শোষিত মানুষগুলোর থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। তার নাকের ডগা দিয়েই বণিক শ্রেণীর পুঁজি ও শোষণ দুটিই বাড়তে থাকে। বুদ্ধ পশু হত্যার যে বিরোধিতা করেছিলেন তাতে দেখা যায় বণিক শ্রেণীটিই লাভবান হয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু হাজার হাজার সাধারণ প্রজাদের স্বার্থের প্রশ্নে বুদ্ধ ধীরে ধীরে নীরব হতে থাকেন। কারণ তিনি দেখেন- যে শ্রেণীর বিপক্ষে তিনি কথা বলেছেন সেই শ্রেণীটি তার ডানে বামে সর্বত্র বিরাজ করছে। গৌতম বুদ্ধকে তখন ঐ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার্থেই ঋণ শোধ না করে দাসত্ব থেকে মুক্তির উপায়কে অন্যায় হিসেবে ঘোষণা করতে হয়। অন্যদিকে বণিক শ্রেণীর সুবিধা অসুবিধাগুলোও গৌতম বুদ্ধ বেশ ভালোভাবে অনুধাবন করতেন এবং নিষ্ক্রিয় থাকতেন। সেজন্যই বণিক সম্প্রদায়ের চিত্ত বিনোদনের খোরাক গণিকা বৃত্তির বিরুদ্ধে টু শব্দও উচ্চারণ করেন নি গৌতম বুদ্ধ।
বুদ্ধের চোখের সামনেই হর্ষঙ্ক রাজ বংশের রাজা বিম্বিসারের পুত্র অজাতশত্রু করে গেলো একের পর এক নারকীয় হত্যাকান্ড। বিদেহ, জাতক, লিচ্ছবি ও বৃজি উপজাতিরা ধ্বংস হয়ে গেলো। বৃজি সাধারণ তন্ত্রের সভাপতি ছিলেন মহাবীরের মামা চেটক। পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে আত্মহত্যা করতে হয় তাকে। তাই নয়, শুধু মাত্র বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্টপোষক ছিলেন বলেই নিজ পিতা বিম্বিসারকে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করে সে। পরে অবশ্য সফল হয় নি। বিম্বিসার এত বড় অন্যায়কেও ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এই ক্ষমা করাটা যে কত বড় ভুল ছিলো বিম্বিসার তা হাড়ে হাড়ে টের পেলেন তখনই যখন অজাতশত্রু বিম্বিসার ও তার উপদেষ্টামন্ডলীকে গৃহবন্দী করে নিজেকে মগধের রাজা ঘোষণা করে। তখন আর হা হুতাশ করে কোনো লাভ হলো না। কারণ তারা অনেক আগেই ট্রেন মিস করে ফেলেছিলেন।
বুদ্ধ তার জীবদ্দশায় কোনো গ্রন্থ রচনা করেন নি। তার মুখের কথাই ছিলো তখন বৌদ্ধ ধর্মের ভিত্তি। বুদ্ধ মারা যাওয়ার পর ভিক্ষুরা ধর্মীয় রীতি নীতি সংক্রান্ত গ্রন্থ রচনার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন। সেই প্রয়োজনীয়তা থেকেই রচিত হয় “ত্রিপিটক”। অর্থাৎ ত্রিপিটক গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক রচিত কোনো গ্রন্থ নয়। তাছাড়া সমাজের শোষিত মানুষগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার এক পর্যায়ে গৌতম বুদ্ধ যখন মারা যান তখন এই ত্রিপিটকই হয়ে ওঠে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য আর্যীয় স্টাইলে সমাজ শোষণের হাতিয়ার। গৌতম বুদ্ধ সাধারণ মানুষগুলো থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে শোষকদের সাথে তাল মিলিয়ে চলেছেন ঠিকই কিন্তু নিজে শোষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন নি। আর এই অভাবটাই বুদ্ধের মৃত্যুর পর তার ভিক্ষুগণ পূরণ করে দেন। তারা সমাজে অবতীর্ণ হন শোষকের ভূমিকায়। হাতে রয়েছে একটি মোক্ষম দাওয়াই- বুদ্ধের বাণী সম্বলিত ত্রিপিটক। তাছাড়া ধীরে ধীরে বৌদ্ধ সংঘগুলোতে অর্থায়নের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা একদিকে যেমন বিলাশী জীবন যাপন শুরু করেন অন্যদিকে হয়ে পড়েন অতিমাত্রায় দুর্নীতিগ্রস্থ। পাশাপাশি মহিলা ভিক্ষুদের সাথে পুরুষ ভিক্ষুদের অনৈতিক মিলনে লিপ্ত হওয়াতে সংঘগুলোতে ব্যাপক নৈতিক অবক্ষয় ঘটে।
তাই সমাজে নিচু শ্রেণীর যে মানুষগুলোর দুঃখ দুর্দশা দেখে গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়েছিলেন ত্রিপিটকের পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ঘেঁটে সেই মানুষগুলোর পক্ষের কোনো বাক্য পাওয়া যায় না। মানুষকে একটি ভাববাদী জগতে মোহাচ্ছন্ন করা ছাড়া ইহজাগতিক সমস্যা সংকট সম্পর্কে ত্রিপিটক নীরব- নির্বিকার। অথচ এই ইহজাগতিক সমস্যা সংকটের হাত ধরেই বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ঘটেছিলো।




যে সময়টিতে বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব ঘটে ঠিক একই সময়ে জৈন ধর্ম নামে আরেকটি ধর্ম ভারতবর্ষে বিকশিত হতে শুরু করে। বয়সের দিক দিয়ে গৌতম বুদ্ধ, জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীরের চেয়ে ২৬ বছরের বড় ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের জন্ম খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৬৬ অব্দে এবং মহাবীরের জন্ম খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪০ অব্দে।
তখন অবশ্য বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম মত ছাড়া আরো অনেক ধর্ম মত ভারতবর্ষে গড়ে ওঠে। এই দুই মতের বাইরে আরো প্রায় অর্ধশতের বেশি ধর্ম মতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। আজীবিক, চার্বাক, নির্গ্রস্থ, মুন্ডশ্রাবক, পরিব্রাজক, অবিরুদ্ধক ইত্যাদি সম্প্রদায়ের মতো বৈদিক প্রভাব মুক্ত নানান ধর্ম মতের অস্তিত্ব এসময় ছিলো। এদের মধ্যে আজীবীক ও চার্বাকদের সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় এই দুই সম্প্রদায়ই ছিলেন নিরীশ্বরবাদী।
আজীবীক সম্প্রদায় গড়ে উঠে মূলত বৈদিক ধর্মের বিরোধিতা করেই। এই সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন “গোশলমস্করিপুত্র”। গোশলমস্করিপুত্র ও জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর এক সাথে তপস্যার মনোযোগী হয়েছিলেন। এই তপস্যারই এক পর্যায়ে তাদের দুজনের মধ্যে মত বিরোধের সৃষ্টি হয়। এই মতবিরোধের পরেই গোশলমস্করিপুত্র আজীবীক সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন আর মহাবীর জৈন ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন। আজীবীকরা ঈশ্বরে বিশ্বাস না করলেও তারা ভাগ্যে বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো আগে থেকে সব ঠিক করা আছে এবং মানুষের ভাগ্যই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। অন্যদিকে চার্বাকরা আবার এদিক দিয়ে একটু আলাদা ছিলো। তারা শুধু নিরীশ্বরবাদীই ছিলো না, ছিলো পুরদস্তুর বস্তুবাদী। তারা কোনো প্রকার প্রত্যাদেশে বিশ্বাস করতো না। প্রমাণই ছিলো এই দর্শনের সকল জ্ঞানের উৎস। ইহ জাগতিক সুখ শান্তিই ছিলো তাদের প্রাধান্যের বিষয়।

গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীর দুজন কেবল সমসাময়িকই ছিলেন না; এরা দুজনেই ছিলেন অনার্য অধ্যুষিত এলাকার বাসিন্দা। দুজনেরই জন্ম হয় ক্ষত্রিয় বংশে, দুজনেই আর্যদের এতদিনকার ভন্ডামি উপলব্ধি করে সেই ভন্ডামির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন।
খ্রিষ্ট পূর্ব ৫৪০ অব্দে উত্তর বিহারের বৈশালীর কাছে বসুকুন্ডু গ্রামে ( বর্তমান মোজাফফর) মহাবীরের জন্ম হয়।
মহাবীর কর্তৃক প্রচারিত জৈন ধর্ম ছিলো মূলত নীতি মূলক ধর্ম। অহিংসার ব্যাপারে এই ধর্মে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এটিই এই ধর্মের প্রচারে ব্যাপক সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিজের মনের অজান্তে একটি মশা কিংবা মাছি মারা গেলেও তা হত্যা এবং পাপ বলে গণ্য হতো। জৈন্যরা অনেকেই এজন্য এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে নাক মুখ ঢেকে রাখে যাতে তাদের অজ্ঞাতসারে কোনো পোকা নাক- মুখ দিয়ে ঢুকে মারা না যায়। এই বিষয়গুলো জৈন ধর্মকে শুরুতেই অনেক পিছিয়ে দিয়েছিলো।
জৈন ধর্ম খুব সুস্পষ্ট দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় তার সৃষ্টির কিছুদিন পরেই। আর এই বিভক্তিটা হয়েছিলো খোদ মহাবীরের চোখের সামনেই। দিগম্বর ও শ্বেতাশ্বর নামক দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় জৈন ধর্ম। জৈন ধর্ম নিয়ে এই বিভক্ত অংশ দুটির চিন্তাগত পার্থক্যও ছিলো বিশাল। দিগম্বর সম্প্রদায় মনে করে একমাত্র মহাবীরের হাত ধরেই জৈন ধর্মের আবির্ভাব ঘটে। মহাবীর ছাড়া আর কারো অবদান তারা স্বীকার করে না। এমনকি মহাবীরের পরবর্তীতে লেখা গ্রন্থগুলো ছাড়া আর কোনো গ্রন্থও এরা অনুসরণ করে না।
অন্যদিকে শ্বেতাশ্বর সম্প্রদায় এদিক দিয়ে দিগম্বরদের ঠিক বিপরীতে। তারা মনে করে মোক্ষ শিক্ষার গুরু হিসেবে ২৪ জন তীর্থঙ্করের আগমন এই পৃথিবীতে ঘটেছে। তার মধ্যে সর্বশেষ তীর্থঙ্কর হচ্ছেন মহাবীর। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস মতে মহাবীরের আগ থেকেই জৈন ধর্মের অস্তিত্ব বিরাজিত ছিলো।
এই সম্প্রদায় দুটি পরবর্তী কালে আরো কিছু উপ সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে যায়। শ্বেতাশ্বররা মূর্তি পূজক, তেরপন্থী ও স্থানকবাসী নামক তিনটি উপসম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়। আর দিগম্বররা বিভক্ত হয় মোট ৫ টি উপসম্প্রদায়ে- বীসপন্থী, তেরপন্থী, তোজপন্থী, তারণপন্থী এবং গুণামপন্থী।
দিগম্বর সম্প্রদায়ের মতাদর্শ এক পর্যায়ে ধামাচাপা পড়তে থাকে এবং শ্বেতাশ্বররাই জৈন ধর্মের প্রধান নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় চলে আসে। বর্তমান ভারতের দক্ষিণ অংশে জৈন ধর্মের প্রভাব এখনো খানিক মাত্রায় লক্ষণীয় আর তা কেবল শ্বেতাশ্বর সম্প্রদায়েরই।
বৌদ্ধ ধর্মের মতো জৈন ধর্মও বিভক্ত ছিলো বিভিন্ন সংঘে। সংঘগুলো ছিলো জৈন ধর্ম পরিচালনার একেকটি স্বতন্ত্র ইউনিট। এই সংঘগুলোর মাধ্যমেই মহাবীর ধর্ম প্রচার করতেন। কিন্তু একটা অবাস্তব ও অসম্ভব চিন্তাকে বাস্তব রূপ দিতে গিয়ে মহাবীরও ছিটকে পড়তে থাকেন সাধারণ মানুষদের থেকে। সাধারণ মানুষজন বনে, জঙ্গলে, মাঠে, ঘাটে বিভিন্ন জায়গায় কাজ করতে যেতো। ফলে তাদের অজান্তে কিংবা কখনো কখনো নিজের পেটের দায়ে ছোটখাটো বন্য পশু হত্যা ছিলো স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু মহাবীর যখন তার অহিংস নীতিকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে যান, যে পর্যায় বলে দেয়, পশু হত্যা অন্যায় তো বটেই কেউ যদি অনাকাঙ্খিতভাবে কোনো পোকা মাকড়ও মেরে ফেলে সেটাও পাপ বলে বিবেচিত হবে। ব্যস, সাধারণ জনগণ পিছিয়ে গেলো। তারা চেয়েছিলো মুক্তি। মহাবীর যে তাদের মুক্তি চান নি তা নয়, কিন্তু মুক্তি দেয়ার আগেই এরকম কঠিন নিয়মের বেড়াজালে আটকে রাখা সাধারণ মানুষজন ভালো চোখে নিতে পারে নি। তারা আর্যদের সাথে মহাবীরের মতাদর্শের পার্থক্যকরণ করতে পারে নি।
তবে যেহেতু জৈন ধর্ম ছিলো আর্যদের অত্যাচারের বিপরীত একটা প্লাটফর্ম তাই বৌদ্ধ ধর্মের মতোই আর্যদের দ্বারা নির্যাতিত অনেকেই জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। প্রচুর বণিক সম্প্রদায়েরও লোকজন মহাবীরের অনুসারী হওয়া শুরু করে। তাছাড়া জৈন ধর্মের নিয়ম কানুন গুলোও বণিকদের জন্য অনেক সহায়ক ছিলো। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, জমি জমা কেনা জৈন ধর্মে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিলো। তাই জমি জমা কিনে শ্রমজীবীদের দিয়ে চাষবাস করিয়ে দু’চার আনা বাড়তি আয়ের রাস্তাটাও বন্ধ ছিলো। এরকম একটা পরিস্থিতিতে বণিকরা তো বটেই, যারা ইতোপূর্বে বণিক ছিলো না তারাও ব্যবসার দিকে ধাবিত হয়।
আর যেহেতু এত ব্যাপক মাত্রায় ব্যবসার চর্চা এর আগে ভারতবর্ষে খুব একটা শুরু হয় নি, তাছাড়া সেই সময় আর্য সমাজ এমন কি গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরাও ব্যবসার দিকে ওতটা কঠোর নজর দেন নি সেই সুযোগে ব্যবসার ক্ষেত্রে জৈন ধর্মের অনুসারীরা প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলো।
এর প্রভাব পড়েছিলো ওদের সংঘগুলোর উপরও। সংঘগুলো ধীরে ধীরে ধর্ম প্রচারের একটি স্বতন্ত্র ইউনিট থেকে ব্যবসার একটি ইউনিট হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অনেকটা ব্যাংকের মতো। ফলে জৈন ধর্ম সংঘগুলো হয়ে যায় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা আর সুদের আড্ডাখানা। তৎকালীন বিভিন্ন শিলালিপিতেও উঠে আসে এ চিত্র- ব্যবসায়ীদের সুদের টাকাই এক পর্যায়ে হয়ে ওঠে সংঘগুলোর অর্থায়নের প্রধান ও একমাত্র উৎসস্থল। সাধারণ মানুষদের থেকে সংঘগুলো তখন পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
বণিক সম্প্রদায়ের কাছে বেশি মাত্রায় আটকে পড়ার কারণেই জৈন ধর্ম বৌদ্ধ ধর্মের মতো অতটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে নি। বণিক সম্প্রদায়ের হাতে জিম্মি হওয়ার পর থেকেই জৈন ধর্মে ভাটার টান শুরু হয়। ফলে ভারতবর্ষের বাইরেও এর কোনো প্রভাব দেখা যায় না। বর্তমান ভারতের গুজরাট, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে জৈন ধর্মের অবশিষ্টাংশ দেখা যায়।
মহাবীর নিজ হাতে জৈন ধর্মাবলম্বীদের জন্য কোনো গ্রন্থ লিখে যান নি। যে সকল গ্রন্থ লেখা হয়েছে তা মহাবীরের মৃত্যুর কয়েকশ বছর পর। কারা লিখেছিলেন এসব গ্রন্থ? এটা আন্দাজ করা খুব একটা কঠিন নয় যে, সবচেয়ে প্রভাবশালী বণিকরা এসব গ্রন্থ রচনায় কলকাঠি নাড়েন। ফলে প্রথম দিকে শোষিত মানুষদের পক্ষে জৈন ধর্মের অবস্থান থাকলেও তারা সেখান থেকে যেমন বিচ্যুত হয়। একারণেই নারী সংক্রান্ত চিন্তা ভাবনায় তাদের সাথে আর্যদের অনেক সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আর্যরা যেমন নারীদের গৃহের পুতুল হিসেবে বিবেচনা করতো তেমনি জৈন ধর্মের মধ্যে এর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তাদের ধর্ম গ্রন্থগুলোতেও বলা হয়েছে- নারীরা কখনা মোক্ষ লাভে সমর্থ নয়। মোক্ষ লাভের জন্য অন্য কোনো জন্মে পুরুষ হয়ে জন্ম গ্রহণ করা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নারীদের জন্য খোলা ছিলো না। এভাবে ভারতবর্ষের নারী সমাজ থেকেও জৈন ধর্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এভাবেই ইতিহাসের কালবিভাজিকায় এ দুটি ধর্ম ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে প্রধান ভূমিকা পালন করে। আর্যদের শাসনের বিপক্ষে এই সময়টা ছিলো ভারতবর্ষের মানুষের প্রতিবাদের সময়।


মোদ্দাকথা, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ছিলো মূলত তৎকালীন বণিক সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ ও সমাজের প্রতিষ্ঠা লাভের একটি প্লাটফর্ম। বিকাশমান কৃষি এবং বিকাশমান কৃষি সংক্রান্ত প্রযুক্তি, সেই সাথে ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন সমাজে বণিক সম্প্রদায়কে ভালোই অর্থনৈতিক ভিত্তি গড়ে দেয়। কিন্তু সমাজে যেহেতু তখনো ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় সম্প্রদায় একচেটিয়া আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছিলো তাই সেখানে এই বণিকরা মোটেই পেরে উঠছিলো না। প্রতিনিয়ত তাদের নানামুখী বাধার সম্মুখীন হতে হতো। তাদের উপর করের বোঝা তো ছিলোই, ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয়রা চাইলেই তাদের পুঁজির উপর ভাগ বসাতে পারতো। এখান থেকে মুক্তি লাভে এই দুই ধর্মের ছায়াতলে দাঁড়ানো ছাড়া বিকল্প কোনো জায়গাও বণিকদের ছিলো না।
তাছাড়া সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয়টি হলো, যে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মুক্তির জন্য হাহাকারই ছিলো বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের উত্থানের মূল কারণ, সেই মানুষগুলো দিনের পর দিন নিমজ্জিত হতে থাকে আরো হতাশায়।
গৌতম বুদ্ধ ও মহাবীরের পরবর্তী প্রজন্ম যারা তাদের মতবাদ প্রচারের গুরু দায়িত্ব নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে একরাশ ভন্ডামি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় নি। আর্যীয় স্টাইলে তারা গৌতম বুদ্ধ এবং মহাবীরের মূর্তি বানিয়ে তাদের ঈশ্বর নামক এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। শুরু হলো নতুন আঙ্গিকে ধর্ম ব্যবসা।
তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে আমরা দেখি, বৌদ্ধ ধর্মের মূল কর্মকান্ড যেনো বুদ্ধের মূর্তির সামনে পূজা পার্বণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে।
এই দুই ধর্মের সাময়িক পরাজয় বরণের পর কী হলো চলুন পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে একটু দেখি।


লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য ৯ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৯) মন্তব্য লিখুন

১| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:১৯

শূণ্য পুরাণ বলেছেন: very descriptive and knowledgeable writing.

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৯

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: মনোযোগ সহকারে পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

২| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৪

নেক্সাস বলেছেন: ভাল পোষ্ট। সময় করে পড়া দরকার। আমি প্রিয়তে নিয়ে রাখলাম। সময় করে পড়ে মন্তব্য জানাবো।

২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩১

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: আপনার গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যের অপেক্ষায় রইলাম।

৩| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৩৩

গেম চেঞ্জার বলেছেন: আপাতত প্রিয়তে-ই থাকুক।

৪| ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৩৬

কল্লোল পথিক বলেছেন: চমৎকার পোস্ট

২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ৯:৫৪

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ধন্যবাদ।

৫| ২৫ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:৩০

ভারসাম্য বলেছেন: ভাল লেখা। দ্রুত আকারে পড়লাম। সময় করে ভাল মত পড়তে হবে আরেকবার। একটা জায়গা একটু কনফিউজিং মনে হল। "গৌতম বুদ্ধের জন্ম গ্রহণ করেছিলেন নেপালের লুম্বিনী গ্রামে। জায়গাটির অবস্থান দক্ষিণ ভারতে।" এখানে দক্ষিণ ভারত না হয়ে উত্তর ভারত হবে সম্ভবত।


+++ এবং প্রিয়তে।

২৬ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:০৮

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ঠিকই বলেছেন।এটা উত্তর পূর্ব ভারত হবে। ভুলটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.