নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

প্রাচীন ভারতের ক্লাসিক্যাল যুগঃ ব্রাহ্মণ্যবাদের জয়জয়কার

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:০৪

মৌর্য সা¤্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষের অঞ্চলগুলো আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু একই সময় পাশ্ববর্তী চীনে হুন, টে ও মুং নামক তিনটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যর উত্থানের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত বলা হয় ভারতবর্ষের মধ্যে কোনো রাজনৈতিক ঐক্য ছিলো না। তাই বলে কি এই সুদীর্ঘ সময় ভারতবর্ষে কোনো শাসন ছিলো না ? কোনো শোষক ছিলো না? ছিলো তবে ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থার মতোই শাসকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার পরিমাণ ছিলো বেশি।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষে বিচ্ছিন্ন ভাবে অনেক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। অনেক দেশি বিদেশি রাজবংশের শাসনের কথা পাওয়া যায় তৎকালীন শিলালিপি, কয়েন, বিভিন্ন ধরনের সাহিত্যের মাধ্যমে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- শূঙ্গ বংশ, কলিঙ্গের চেদি বংশ, শক- ক্ষত্রপদের সা¤্রাজ্য, পার্থিয়ান বা পহ্লব রাজবংশ, চোল সাম্রাজ্য, সাতবাহন সাম্রাজ্য, কুষাণ সাম্রাজ্য। অর্থাৎ শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিলো না বলেই যে ভারতবর্ষ সাম্রাজ্যবিহীন হয়ে গিয়েছিলো বিষয়টা এরকম ছিলো না। বিভিন্ন রাজবংশ বিচ্ছিন্নভাবে ভারতবষের্র একেকটি অঞ্চলে রাজত্ব করেছেন। অনেক রাজবংশ আবার ভারতবর্ষের বাইরে থেকে এসে অর্থাৎ অনেক বিদেশিদের শাসনও ভারতবর্ষের মাটিতে জন্ম নেয়া শুরু করে। তাদের অনেকে আবার ভারতবর্ষের সংস্কৃতির সাথেও ওতপ্রোতভাবে মিশে যেতে সক্ষম হয়েছেন। শক, পহ্লব বা পার্থিয়ান, কুষাণরা এভাবেই ভারতবর্ষের সাথে মিশে গিয়েছিলো। এরা এত গভীরভাইে এখানে মিশে গিয়েছিলো যে এক পর্যায়ে এরা এদেশীয় মানুষ হিসেবেই পরিচিতি পেতে শুরু করে। তাদের বিদেশি তকমাটা আর থাকলো না।
মৌর্য পরবর্তী যুগ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হয়, এ সময়টা বৌদ্ধ ধর্মকে হটিয়ে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের পুণরুত্থানের সময়। মৌর্য সা¤্রাজ্যের পতনের পর ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পুণরায় সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। আর্য ব্রাহ্মণদের পৃষ্ঠপোষক পুষ্যমিত্র শূঙ্গ যিনি মৌর্য সা¤্রাজ্যের চূড়ান্ত বিলুপ্তি ঘটান তার হাত ধরেই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে। পুষ্যমিত্র শূঙ্গই মৌর্য যুগের পর প্রথম রাজা যিনি ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থানে রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছেন। পুষ্যমিত্র শূঙ্গের হাত ধরে শূঙ্গ রাজবংশ ভারতবর্ষে প্রতিষ্ঠিত হলেও পুষ্যমিত্র শূঙ্গ যতদিন রাজত্ব করছিলেন ততদিনই শূঙ্গ বংশের সবল অবস্থান ছিলো। পুষ্যমিত্র শূঙ্গ ১৮৭ খ্রিষ্ট পূর্ব থেকে ১৫১ খ্রিষ্ট পূর্ব পর্যন্ত মগধ শাসন করেন। তবে পুষ্যমিত্র শূঙ্গ মগধের আশেপাশের কিছু জায়গা জুড়েই রাজত্ব করেছিলেন। পুরো মৌর্য সা¤্রাজ্যকে একীভূত করে শাসন করা তার পক্ষে সম্ভব হয় নি। পুষ্যমিত্র শূঙ্গ উত্তর পশ্চিমে ভারতে বিদেশি শক্তি ব্যকট্রীয় গ্রীকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এটা না হলে তখন হয়তো ভারতবর্ষের বড়ো একটি অংশ নতুন কোনো বিদেশি শক্তির হাতে গিয়ে পড়তো।
পুষ্যমিত্র শূঙ্গের রাজত্বকালে সংস্কৃত ভাষা রাষ্ট্রীয় মর্যাদা লাভ করে। এ সময়ই হিন্দু আইন ও স্মৃতি শাস্ত্রের গ্রন্থ “মনুস্মৃতি” রচিত হয়েছিলো।



এবার তৎকালীন রাজ্যগুলোর অবস্থা দেখে নিইঃ

চোল সা¤্রাজ্য
সম্রাট অশোকের লিপিগুলোর কথা আমরা “মৌর্য সা¤্রাজ্যের উত্থান পতন” অংশে দেখেছি। যেগুলোকে অশোক লিপি বা ব্রাক্ষীলিপি নামে অভিহিত করা হতো। এই লিপিগুলোই ইতিহাসের পাঠশালায় আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয় চোল সাম্রাজ্যের সাথে। চোল রাজবংশ মূলত একটি তামিল রাজবংশ। গুপ্ত শাসনামলে চোল সা¤্রাজ্য গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিলো না। তবে পরবর্তীতে প্রথম রাজ রাজ চোল ও তার পুত্র প্রথম রাজেন্দ্র চোলের শাসনামলে চোল সা¤্রজ্য দক্ষিন এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিতে পরিণত হয়।
কলিঙ্গের চেদি বংশ
এটা হচ্ছে সেই কলিঙ্গ যেখানে স¤্রাট অশোকের নেতৃত্বে মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক বীভৎস যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিলো। এই যুদ্ধের পরেই অশোক বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু কলিঙ্গবাসীরা পরাধীনই থেকে গেলো। স¤্রাট অশোকের মন গললেও সিংহাসনের প্রতি মায়া কিন্তু কমেনি। ফলে তাদের মৌর্য সা¤্রাজ্যের অধীনস্থ হয়েই থাকতে হয়। অশোক যখন কলিঙ্গ আক্রমণ করেন তখন কলিঙ্গে চেদি বংশের রাজত্ব চলছিলো। অশোকের মৃত্যুর পর পুণরায় চেদি বংশের উত্থান ঘটে। ফলে কলিঙ্গ মৌর্য সা¤্রাজ্যের বলয় ছিঁড়ে স্বাধীন হয়ে পড়ে। কলিঙ্গের পশ্চিম দিকে ছিলো সাতবাহন রাজ্যের অবস্থান। কলিঙ্গের এই নতুন স্বাধীনতা লাভের সময় সাতবাহন রাজা ছিলেন সাতকর্ণি।
কুষাণ সাম্রাজ্য
চীনা বিভিন্ন তথ্য সূত্র থেকে কুষাণদের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়। তাছাড়া আফগানিস্তান ও উত্তর পশ্চিম ভারতে পাওয়া কিছু শিলালিপির মাধ্যমেও কুষাণদের ইতিহাসের অনেক অজানা তথ্য পাওয়া যায়। “কুষাণ” শব্দটি এসেছে মূলত “কিউই-শাং” শব্দটি থেকে। কিউই-শাং শব্দটি এসেছে একজন উপজাতি নেতা কিউ সিউ-কি এর নাম থেকে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর এরা কাবুল উপত্যকা পেরিয়ে পাঞ্জাব সমভূমিতে প্রবেশ করে। এর পূর্বে এদের বসতি ছিলো ব্যাকট্রিয়া (আধুনিক আফগানিস্থানের উত্তরাঞ্চলে) ও পার্থিয়ায় (দক্ষিণ তাজাকিস্তান)। এরও আগে এরা ছিলো মূলত একটি উদ্বাস্তু গোষ্ঠী। তখন তাদের বলা হতো ইউ চি গোষ্ঠী। ১৬৫ অব্দের কাছাকাছি সময়ে উত্তর পশ্চিম চীনে ইউ চি দের বসবাস ছিলো। তারা উদ্বাস্তু হয় মূলত হিয়ুঙ-নু নামের যাযাবর জাতির কাছে পরাজিত হয়ে। তারপরই মূলত তারা ব্যকট্রিয়া ও পার্থিয়ায় এসে বসতি গড়ে তুলে। এসময় তাদের অভ্যন্তরেও ফাটল দেখা দেয়। ইউ চিরা বেশ কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। “কুষাণ” গোষ্ঠী ছিলো সেই গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটি। এই কুষাণ গোষ্ঠীই বাকি গোষ্ঠীগুলোকে একত্রিত করে ঐক্যবদ্ধ একটি শক্তি সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। প্রথম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর-পশ্চিম ভারতে প্রবেশ করে কুষাণরা পেশওয়ার থেকে মধ্য সমভূমি তথা পর্যন্ত এক সুবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। যে জায়গায় তাদের পূর্ববর্তী বাসস্থান ছিলো অর্থাৎ ব্যাকট্রিয়া (আধুনিক আফগানিস্থানের উত্তরাঞ্চলে) ও পার্থিয়া (দক্ষিণ তাজাকিস্তান) কুষাণদের এই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিলো। কুষাণ রাজবংশ প্রায় দুশ বছর তার সা¤্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
কুষাণদের ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ট রাজা ছিলেন কণিষ্ক। এসময়েই কুষাণরা উন্নতির স্বর্ণ শিখরে পৌঁছে। বিভিন্ন লিপি প্রমাণের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়- বর্তমান উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং উত্তর পশ্চিম প্রদেশ ও ভাওয়ালপুর রাজ্য নিয়ে ছিলো কণিষ্কের রাজত্ব। রাজপুতনা, মালব, কাথিয়াবাড় সৌরাষ্ট্র) তার করদ রাজ্য ছিলো। ১০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কণিষ্ক কুষাণ সামাজ্য শাসন করেন। এরপরেই কুষাণ সামাজ্য ভেঙে পড়ে।
শকদের উত্থান
শকদের আধিপত্য ছিলো পশ্চিম ভারতে। তবে শকদের আরো দুটি শাখা তক্ষশীলা ও মথুরায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু শকদের শাসন সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হয় পশ্চিম ভারতে। প্রায় চারশো বছরের মতো (খ্রিষ্টীয় এক দশক থেকে চার দশক পর্যন্ত) পশ্চিম ভারতে শকদের শাসনের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। পশ্চিম ভারতে শকদের মধ্যে শ্রেষ্ট রাজা ছিলেন রুদ্রদামন। শিলালিপির মাধ্যমে যতটুকু জানা যায়, ১৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি আর তার পিতা এক সাথে রাজ্য শাসন করেছিলেন।
পার্থিয়ান বা পহ্লব বংশ
শকদের পরেই মূলত উত্তর পশ্চিম ভারতে পহ্লব বা পার্থিয়ানরা শাসন ক্ষমতায় আসে। পহ্লবরা ছিলো মূলত ইরানী বংশোদ্ভুত। আনুমানিক খ্রিষ্ট পূর্ব ২৭৩ অব্দের দিকে এই বংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ইরান থেকে ভারতবর্ষে আসে তারা। তবে অন্যান্য বংশগুলোর মতো পহ্লবদের ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে অতটা গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা হয় না। প্রথম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যভাগে তারা তক্ষশীলায় রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলো। এতটুকুই ছিলো তাদের রাজ্যের বিস্তৃতি।
সাতবাহন সাম্রাজ্য
সাতবাহন রাজ্য সম্পর্কে আমরা জানতে পারি মূলত বিভিন্ন মিথ (সুঃযং) এবং সেই সময়কার বিভিন্ন কয়েন থেকে। সাতবাহন সাম্রাজ্যটি অন্ধ্র প্রদেশকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সম্রাট অশোকের আমলে সাতবাহনের দিকে অন্যান্য অঞ্চলের মতো অতটা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। সম্্রাট আশোকের মৃত্যুর পর এই পুরো অঞ্চলই মৌর্য সাম্রাজ্যের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই সুযোগে সাতবাহন বংশের আবির্ভাব ঘটে। সাতবাহন সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটে আনুমানিক খ্রিষ্ট পূর্ব ২৩০ অব্দের দিকে। সাতবাহনে প্রচুর পরিমানে উপজাতির (ঃৎরনব) লোকের বসবাস ছিলো। সিমুক ছিলেন সাতবাহন বংশের প্রতিষ্ঠাতা, সাতবাহন রাজারা প্রায় প্রত্যেকেই ছিলেন হিন্দু ধর্মের পৃষ্ঠপোষক। আর বেশির ভাগ রাজারাই ছিলেন বর্ণগতভাবে ব্রাহ্মণ। প্রায় ৩১ জন রাজা মোটামুটি ৪২০ বছরের মতো এই সাম্রাজ্য শাসন করেন।
সিমুক কর্তৃক সাতবাহন রাজবংশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই ভারতে আদি মধ্য যুগীয় রাজাদের শাসনের সূচনা ঘটে। এই যুগকে তাই ভারতের ধ্রুপদি যুগ নামে পরিচিত।
যদিও সিমুক সাতবাহন বংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন এবং সাতবাহন সাম্রাজ্যের গোড়পত্তন করেন তারপরেও সাতবাহন সাম্রাজ্যের সবচেয়ে বড় সম্্রাট ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্নী। তিনি শক, গ্রিক ও পহ্লবদের শক্তি খর্ব করতে সক্ষম হন। গৌতমীপুত্র শুধু শক, গ্রিক কিংবা পহ্লবই নয়, এদের ছাড়াও যেসকল ক্ষত্রিয় বংশগুলো ছিলো সেগুলোকে তিনি নির্মূল করেন। নাসিকে নহপানের যে ৮০০০ স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া যায়, সেগুলোর উপর সাতবহন রাজাদের ছাপ পাওয়া যায়। অর্থাৎ গৌতমীপুত্র তাঁর শত্রু নহপান এর ক্ষহরাত বংশকেও নির্মূল করেন। শুধু তাই নয় গৌতমীপুত্র নিজেকে ব্রাক্ষণ সম্প্রদায়ের রক্ষক হিসাবে ঘোষণা করেন। বর্ণপ্রথাকে গৌতমীপুত্র নতুন জীবন দান করেন এবং গৌতমীপুত্রের কল্যাণে আরো কঠোরভাবে সমাজে বর্ণপ্রথা আরোপিত হয়।
সাতবাহন রাজাদের শাসনামলে দেবতাপূজাও বর্ণপ্রথার মতোই নবজীবন লাভ করে। অনেক নতুন পুরাতন দেব-দেবীর পূজা নতুন আঙ্গিকে শুরু হয়। শুরু হয় দেবতার আড়ালে একদল মানুষের পূজা- ব্যক্তিপূজা!। ব্রাহ্মণ সমাজের আয়ের রাস্তাও ব্যাপক হারে সম্প্রসারিত হয়ে যায়।
সাতবাহন সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালোই ছিলো। এ সময় কয়েনের প্রচলন ছিলো এবং কয়েন দিয়েই লেনদেনের কাজ পরিচালিত হতো। কয়েনগুলোতে রাজাদের নাম প্রাকৃত ভাষায় (দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা) উল্লেখ করা থাকতো। কয়েনগুলোর বেশির ভাগই ছিলো সোনার তৈরি। কৃষির পাশাপাশি ব্যবসা বানিজ্যও এসময় জনপ্রিয় হয়ে উঠে। দেশের বাইরেও বিভিন্ন জায়গায় ব্যবসা বাণিজ্য ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। গ্রীক রোমানদের সাথে এসময় ব্যবসায়িক সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়।
একজন গ্রীক ভ্রমণকারীর বর্ননা মতে সাতবাহন সামরিক বাহিনীও বেশ শক্তিশালী ছিলো। ৫০,০০০ ফুট সলিডার এবং ৪০০ টি হাতি ছিলো তাদের। এই শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর কারণেই বোধ হয় সাতবাহন সম্রাটরা বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিহত করে তাদের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। শক, পাহ্লব প্রভৃতি বৈদেশিক শক্তি বারবার তাদের সাম্রাজ্যে আক্রমণ করছিলো। কিন্তু সাতবাহন সামরিক বাহিনী বেশ সফলতার সাথে এসব আক্রমণ মোকাবেলা করে।
সাতবাহন সাম্রাজ্যের পতন মূলত শুরু হয় যজ্ঞশ্রী সাতকর্নীর পর থেকে। যজ্ঞশ্রী সাতকর্নী তার পূর্বে হাতছাড়া হয়ে যাওয়া কয়েকটি অঞ্চল পুনরুদ্ধার করতে পারলেও তার মৃত্যুর পর সাতবাহন সাম্রাজ্যের দ্রুত পতন শুরু হয়। এর পর সাতবাহন সাম্রাজ্য আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। ২২০ খ্রিষ্টাব্দে সাতবাহন সা¤্রাজ্য একেবারে ভেঙে পড়ে।




এতক্ষণ আমরা দেখলাম, শক্তিশালী কোনো কেন্দ্রীয় শাসনের অভাবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সা¤্রাজ্যের ইতিহাস। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর মধ্যেও যে রাজ্য দুটির নাম একটু জোরেসোরে উচ্চারিত হয় তা হলো উত্তর ভারতে কুষাণ রাজাদের রাজত্ব আর দক্ষিণ ভারতে সাতবাহন রাজাদের রাজত্ব। এই দুই রাজবংশই ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষগুলোর উপর একক আধিপত্য বিস্তার করতে না পারলেও দুই রাজবংশই দুই গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় একক আধিপত্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ আবার এগুতে থাকে একক কোনো সা¤্রাজ্যের দিকে। আবির্ভাব ঘটে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের। গুপ্ত সা¤্রাজ্যের কথা শুরু করার আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুপ্ত রাজাদের তালিকাটি একটু দেখে নিই।
শ্রী গুপ্ত (২৪০-২৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
ঘটোৎকচ (২৮০-৩২০ খ্রিষ্টাব্দ)
চন্দ্রগুপ্ত প্রথম (৩২০-৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ)
সমুদ্রগুপ্ত (৩৩৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
রামগুপ্ত (৩৮০-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
২য় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৫ খ্রিষ্টাব্দ)
কুমার গুপ্ত (৪১৫-৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দ)
স্কন্ধ গুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দ)
পুরুগুপ্ত (৪৬৭-৪৭৩ খ্রিষ্টাব্দ)
২য় কুমারগুপ্ত (৪৭৩-৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দ)
বুদ্ধগুপ্ত (৪৭৬-৪৯৫ খ্রিষ্টাব্দ)
নরসিমহা গুপ্ত (৪৯৫-৫১০ খ্রিষ্টাব্দ)

মৌর্য সাম্রাজ্যের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যই একমাত্র সা¤্রাজ্য যখন পুরো ভারতবর্ষ আবারো একই ছাতার নিচে আসে। ইতোপূর্বে শূঙ্গ বংশ, চেদি বংশ, শক বংশ, চোল সাম্রাজ্য, সাতবাহন সাম্রাজ্য, কুষাণ সাম্রাজ্য নামক যে সাম্রাজ্যের উল্লেখ আমরা পেয়েছি তার ব্যাপ্তি ছিলো একেকটা অংশ জুড়ে। পুরো ভারতবর্ষকে একটি প্রশাসনিক যন্ত্রের নিয়ন্ত্রনাধীনে নিয়ে আসা মৌর্য সাম্রাজ্যের পর গুপ্ত সাম্রাজ্যেই সম্ভব হয়।
ভারতবর্ষের বুকে গুপ্ত সাম্রাজ্য মাথা তুলে উড়ায় ৩২০ খ্রিষ্টাব্দে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। প্রাথমিক অবস্থায় উত্তর প্রদেশের পূর্বাংশ এবং বিহার নিয়েই ছিলো গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিধি। এ সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাট ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবী রাজবংশের কণ্যা কুমারদেবীকে বিয়ে করেন। এই বিয়ে ছিলো মূলত রাজনৈতিক। চন্দ্রগুপ্ত তার রাজ্যের সীমা বাড়াতেই মূলত এ বিয়ে করেন। এ বিয়ের মাধ্যমেই চন্দ্রগুপ্ত লিচ্ছবি রাজবংশের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। তিনি ৩২০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আনুমানিক ৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই সাম্রাজ্য শাসন করেন।

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পর সিংহাসনে আরোহণ করেন তাঁরই পুত্র সমুদ্রগুপ্ত। সমুদ্রগুপ্তের সিংহাসন আরোহনের পর গুপ্ত সাম্রাজ্য জুড়ে যেনো দখিনে হাওয়া বইতে থাকে। এই সময় গুপ্ত সাম্রাজ্য আয়তনের দিক দিয়ে অনেক বৃদ্ধি পায়। সমুদ্রগুপ্ত ৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত টানা ৪৫ বছর গুপ্ত সাম্রাজ্য শাসন করে। এই সুদীর্ঘ কালের শাসনাকালে সমুদ্র গুপ্ত ছোট বড় সব মিলিয়ে মোট ২০ টি রাজ্য দখল করেন। বাংলা অঞ্চলটি সমুদ্রগুপ্তের আমলেই গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হয়। তাছাড়া সমুদ্রগুপ্তের দখলকৃত অঞ্চল গুলোর মধ্যে রয়েছে- গঙ্গা যমুনার মধ্যবর্তী এলাকার রাজ্য সমূহ, হিমালয়ের আশেপাশের রাজ্যসমূহ, নেপাল, আসাম, দক্ষিণ ভারতের একাংশ, শক ও কুষাণ রাজ্য। সমুদ্রগুপ্তের শক্তি দেখে বর্হিভারতের রাজারাও ভড়কে গিয়েছিলেন। অনেকে আবার সমুদ্র গুপ্তের আক্রমণের ভয়ে নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে সংকটে পড়ে যান। তাই অস্তিত্ব রক্ষার্থে মালব, সৌরাষ্ট্র, সিংহল (বর্তমান শ্রীলংকা) রাজাগণ সমুদ্রগুপ্তের নিকট উপঢৌকন প্রেরণ করে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। অর্থাৎ প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সেই ক্ষুদ্র সা¤্রাজ্যটিকে এক সুবিশাল সা¤্রাজ্যে পরিণত করেন সমুদ্রগুপ্ত। সমুদ্রগুপ্তের পরবর্তীতেও যারা গুপ্ত সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেছেন সকলের মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ স¤্রাট হিসেবে সমুদ্র গুপ্তকেই ধরা যায়। সমুদ্র গুপ্তের জীবনকালের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধের ইতিহাস। উত্তর ভারত, দক্ষিণ ভারত দুদিকেই সমুদ্র গুপ্ত চালিয়েছেন তার সামরিক অভিযান। এলাহাবাদের স্তম্ভগুলোতে উৎকীর্ণ শ্লোকগুলোতে সমুদ্রগুপ্তের এসব অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। সামরিক নৈপুণ্যের কারণে এই সমুদ্রগুপ্তকেই ঐতিহাসিক ভি. স্মিথ “ ভারতীয় নেপোলিয়ান” বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।
সমুদ্রগুপ্ত মারা যান ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে। সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। কিন্তু রাজ্য চালনোর ক্ষেত্রে সমুদ্রগুপ্ত যতটা চৌকস ছিলেন, রামগুপ্ত মোটেই সেরকম ছিলেন না। রামগুপ্ত যে সময়টাই সিংহাসনের ছিলেন গুপ্ত সাম্রাজ্যে তা তেমন গুরুতর কোন প্রভাব ফেলতে পারেননি। রামগুপ্ত একবার এক শক রাজার সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। রাজার নাম ছিলো ২য় রুদ্রসেন। ২য় রুদ্রসেনর সাথে অতি সহজেই পরাজিত হয়ে যান রামগুপ্ত। পরাজিত হয়ে রামগুপ্ত তার স্ত্রী ধ্রুবদেবীকে ২য় রুদ্রসেনের হাতে সমর্পন করে দেন অবলীলায়। শুধু সমর্পন নয়, এর সাথে পুরো গুপ্ত সাম্রাজ্যের মান ইজ্জত সব ধূলোয় মিশিয়ে দেন রামগুপ্ত।
এরকম অবস্থায় গুপ্ত সাম্রাজ্য লাভ করে একজন কারিশম্যাটিক লিডারকে। নাম- দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। সমুদ্র গুপ্তেরই আরেক ছেলে। এই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই ছদ্মবেশ ধারণ করে যান শক শিবিরে। সেখান গিয়ে নানান কৌশলে শক রাজা ২য় রুদ্রসেনকে হত্যা করে ধ্র“বদেবীকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। এরপর নিজের সিংহাসন দখলের রাস্তাকে পরিষ্কার করতে হত্যা করেন নিজ ভাই রামগুপ্তকে এবং ধ্র“বদেবী তিনি নিজেই বিবাহ করেন। এর মধ্য দিয়ে গুপ্ত সা¤্রাজ্যে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নতুন সম্রাট রূপে আবির্ভূত হন।
আবারো সচল হয় গুপ্ত সা¤্রাজ্যের শাসনের চাকা। এ সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের পরিধি আরো বৃদ্ধি পায়। যে শকদের সাথে যুদ্ধে তার বড় ভাই প্রয়াত রামগুপ্ত পরাজিত হয়ে নিজের স্ত্রীকে ওদের হতে তুলে দিয়ে আত্মসমর্পন করেছিলেন সেই শকদেরই যুদ্ধে পরাজিত করেন ২য় চন্দ্রগুপ্ত। ২য় চন্দ্রগুপ্তের এই যুদ্ধজয় ভারতবর্ষের পুরো অর্থনীতির উপরেও একটা ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করেছিলো। শকদের মূল আস্তানা ছিলো ভারতবর্ষের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল। এই অঞ্চলটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত হওয়ায় ভূমধ্যসাগর অঞ্চলে ভারতীয় বণিকদের ব্যবসা বাণিজ্যের রাস্তা উন্মোক্ত হয়। তাছাড়া নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিয়ে দেয়ার পেছনেও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অসাধারণ কিছু রাজনৈতিক কৌশল লুকায়িত ছিলো।

২য় চন্দ্রগুপ্তের আমলেই চৈনিক পর্যটক ফা হিয়েন ভারতবর্ষে এসেছিলেন। এই ফা হিয়েনের রেখে যাওয়া বক্তব্য গুলোর মধ্যে দিয়েই আমরা জানতে পারি ২য় চন্দ্রগুপ্ত তথা গুপ্তযুগের অনেক অজানা ইতিহাস।
ফা হিয়েন ৪০১- ৪১০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতে অতিবাহিত করেন। তার ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিলো বৌদ্ধ পবিত্র স্থানসমূহ ভ্রমণ এবং বৌদ্ধ ধর্ম পুস্তক “বিনায়াপিটক” এর মূল রচনা সংগ্রহ করা। ফা হিয়েন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছিলেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ সংক্রান্ত “ফো কুয়ো কিং” নামক বই লিখেন ফা হিয়েন। ফা হিয়েনের এই বইটিতে বিভিন্ন জায়গার বর্ণনার আড়ালে ফুটে ওঠে গুপ্ত শাসনামলের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক নানান দিক।
২য় চন্দ্রগুপ্ত গুপ্ত যুগের ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ একারনেই যে, রামগুপ্তের মতো অযোগ্য, অদক্ষ, আনাড়ি শাসকদের হাত থেকে রাজ্য ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তিনি এই সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন পতনের মুখ থেকে। হয়তো সমুদ্রগুপ্তের মতো অতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি কিন্তু গুপ্ত বংশের প্রভাব অক্ষুন্ন রাখতে তিনি যে ভূমিকা পালন করেছেন তা অবশ্যই তাৎপর্যতার দাবি রাখে।
৪১৫ খ্রিষ্টাব্দে ২য় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র কুমারগুপ্ত গুপ্ত সম্রাজ্যের দ্বায়িত্ব নেন। কুমার গুপ্তের শাসনকাল কিছু কারণে বেশ গুরুত্ব বহন করে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নামক তৎকালীন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-বিজ্ঞানের পীঠস্থান এই সম্রাট কুমারগুপ্তের আমলেই বিকাশ লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসাবশেষ থেকে প্রাপ্ত একটি সিল মোহর এমনই সাক্ষ্য বহন করে।
সম্রাট অশোকের ৮৪ হাজার বৌদ্ধ বিহারের মধ্যে নালন্দা ছিলো অন্যতম একটি। তখন মূলত বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসন সংক্রান্ত পাঠ দান চলতো নালন্দায়। কিন্তু কুমার গুপ্তের আমলে বৌদ্ধ ধর্মের গন্ডি পেরিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত নালন্দা বিকশিত হয়েছিলো। এটি সকল দেশের সকল ধর্মের মানুষের জ্ঞান আহরণের জায়গা হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করে।
বর্তমানে ইউরোপ কিংবা আমেরিকার দেশগুলোতে পড়াশুনা করার জন্য আমাদের দেশের শিক্ষার্থীরা মুখিয়ে থাকে। ইস! যদি ঐ দেশে গিয়ে গ্রাজুয়েশন কিংবা আন্ডার গ্রাজুয়েশন শেষ করতে পারতাম। তার অবশ্য কারণ আছে। ঐ সব দেশে শিক্ষাকে কেন্দ্র করে যে নানাবিধ আয়োজন তার তুলনায় আমাদের দেশ অনেক পিছিয়ে বলে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা ওসব দেশের দিকে পা বাড়ায়। নালন্দা তৎকালীন পৃথিবীর জ্ঞান পিপাসুদের কাছে এমনই একটি জায়গা ছিলো। এখানে পড়াশোনা করার জন্য বিশ্বের হাজার শিক্ষার্থীই মুখিয়ে থাকতো। খুবই প্রতিদ্বন্দ্বীতামুলক মৌখিক পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাদের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত। তাই মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় দক্ষতাও ছিলো বাধ্যতামূলক। বাইরে পড়তে গেলে আমাদের এখন যেমন ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক ঠিক তেমনি। তবে সংস্কৃত ভাষা কখনোই ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা ছিলো না। এটি ছিলো আর্য ব্রাক্ষণদের সাহিত্যের ভাষা। এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতার মাধ্যমে সংস্কৃত ভাষাটিও ভারতবর্ষের মাটিতে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে সক্ষম হয়।

নালন্দার অবস্থান ছিলো ভারতের বিহারের রাজধানী পাটনা (এই পাটনাই ছিলো মৌর্যদের রাজধানী পাটালিপুত্র!) শহর থেকে ৫৫ মাইল দক্ষিণে। মোট ১৪ হেক্টর আয়তনের এক বিশাল পরিসর নিয়ে বিস্তৃত ছিলো নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। পুরো বিশ্ববিদ্যালয়টি লাল ইটের চত্বর দিয়ে ঘেরা ছিলো। নালন্দায় প্রতিটি শিক্ষার্থীই ছিলো আবাসিক অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের থাকা খাওয়ারও ব্যবস্থা ছিলো।
নালন্দার পাঠাগারটি ছিলো ৯ তলা বিশিষ্ট। সেখানে ছিলো বইয়ের বিশাল সংগ্রহশালা। নালন্দার সংগ্রহশালায় হাজার হাজার পুঁথি ছিলো। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ১০,০০০ এর মতো ছাত্র এবং ২,০০০ এর মতো শিক্ষক ছিলেন। বর্তমান কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, গ্রীস, পারস্য, চীন,পার্শিয়া, জাপান, তিব্বতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশুনা করতে আসতো। মোট ১৮ টি মেজর সাবজেক্টের উপর শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশুনা করতে পারতো। যার মধ্যে ছিলো যুক্তি বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান ভাষাতত্ত্ব, ব্যকরণ, হিন্দু দর্শন, বেদ, ধর্মতত্ত্ব, বিজ্ঞানের নানান বিষয়।
যদিও কুমার গুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবয়ব এক ইঞ্চিও বাড়াতে পারেননি, তবুও এত বড় সাম্রাজ্যকে বেশ ভালোভাবেই সংরক্ষণ করেন। পাশাপাশি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিকাশের জন্য কুমারগুপ্ত অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। তবে বিপত্তি বাঁধে তার শাসনামলের শেষের দিকে এসে। দক্ষিণ দিক থেকে পুষ্যমিত্র বংশের একেরপর এক হুমকি, অন্য দিকে পশ্চিমে হূনদের (হূনরা ইতোমধ্যে ব্যকট্রিয়াতে (আধুনিক আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চল) নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে এবং ক্রমে শক্তিশালী হয়ে উঠার চেষ্টা করছিলো) আক্রমণের কারণে কুমারগুপ্তের শেষ সময়টি একদম ভালো যায় নি। তবে নালন্দার বদৌলতে এ সময় শিক্ষা দীক্ষায় ভারতবর্ষ অনেক অগ্রসর হয়ে যায়।
কুমারগুপ্তের পর স্কন্ধগুপ্ত সিংহাসনের আরোহণ করেন। যে পুষ্যমিত্র বংশ (পুষ্যমিত্র বংশ হচ্ছে মধ্যে ভারতের একটি উপজাতি (ঃৎরনব) বংশ) কুমারগুপ্তকে এতদিন হুমকি দিয়ে আসছিলো স্কন্ধগুপ্ত তাদের পরাজিত করতে সক্ষম হন। ৪৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হূনদের সাথে এক তীব্র যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে হূন আক্রমণকেও প্রতিহত করতে সক্ষম হন। তবে এসময়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক ক্ষতির মুখোমুখি হয়। হূনদের রাজা মিহিরকুলা ছিলো চরমভাবে বৌদ্ধ বিদ্বেষী। মিহিরকুলার নেতৃত্বে প্রচুর বৌদ্ধ ছাত্র ও বৌদ্ধ ধর্ম গুরুদের নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। তাছাড়া অবকাঠামোগত দিক দিয়েও এসময় নালন্দা ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পরে স্কন্ধ গুপ্ত ও অন্যান্য রাজাদের সহযোগিতায় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুণরায় গঠন করা হয়। এসময়ই সুদর্শন হ্রদের বাঁধ পুণর্নিমাণ করা হয়। স্কন্ধগুপ্তই ছিলেন গুপ্ত বংশের শেষ গুরুত্বপূর্ণ রাজা।
স্কন্ধগুপ্ত ৪৬৭ খ্রিষ্টব্দে মারা যান। তারপর তার ভাই পুরুগুপ্ত সিংহাসনে বসেন (৪৬৭-৪৭৩), তবে পুরুগুপ্ত এবং স্কন্ধগুপ্তের মধ্যে সিংহাসনে আরোহণ নিয়ে অনেক ঐতিহাসিক বিতর্ক রয়েছে। অনেকের মতে কুমারগুপ্তের পর পুরুগুপ্তই নাকি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সম্রাট হয়েছিলেন। এরপর তাকে হটিয়ে স্কন্ধগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। তারপর স্কন্ধগুপ্তের মৃত্যুর পর পুরুগুপ্ত পুনরায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু কুমারগুপ্তের সময়েই স্কন্ধগুপ্ত যেভাবে হূনদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এবং স্কন্ধগুপ্ত যে পরিমাণ কৌশলী ছিলেন সে দিক বিবেচনা করলে স্কন্ধগুপ্তের আগে পুরুগুপ্তের স¤্রাট হওয়ার কোনো যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায় না।। তাছাড়া আর্য মঞ্জুশ্রী-মূল কল্পও এমনটি বলে-স্কন্ধগুপ্তকেই উত্তবাধিকারী হিসাবে মনোনয়ন দিয়েছিলেন কুমারগুপ্ত।
পুরুগুপ্তের পর (৪৬৭-৪৭৩), ২য় কুমার গুপ্ত (৪৭৩-৪৭৬), বুদ্ধগুপ্ত (৪৭৬-৪৯৫), এবং এরপর নরসিমহা গুপ্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য শাসন করেন। কিন্তু স্কন্ধগুপ্তের সময় পর্যন্ত আমরা একটি যুদ্ধাংদেহী মনোভাবের সাথে হূনদের প্রতিহত করার যে দৃষ্টান্ত দেখি তা ধীরে কমে আসে এবং হূনদের একের পর এক আক্রমণের কারণে স্কন্ধগুপ্ত পরবর্তী শাসন নাস্তানাবুদ হতেই দেখা যায় সবচেয়ে বেশি।
হূনরা মূলত ছিলো হিমালয়ের নিকটবর্তী একদল উপজাতি (ঃৎরনব) । তারা জম্বু কাশ্মীরের পূর্ববর্তী চীনের তিনজাং (ঃরহমললধহম) প্রদেশের আধিবাসী ছিলো। হূনরা ভারতবর্ষে প্রবেশের পূর্বে দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি অংশ যায় রোমান সাম্রাজ্যের দিক আরেকটি অংশ আসে ভারতবর্ষের দিকে। ভারতবর্ষের দিকে যে অংশটি এসেছিল তাদের বলা হত শ্বেত হূন (যিরঃব যঁহধং) । সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পরপরই দূর্বল হতে থাকে পুরো গুপ্ত সাম্রাজ্য। শক্তিশালী কোনো শাসক যেমন আসেনি তার পাশাপাশি পুরো সাম্রাজ্যের উপর শাসকদের নিয়ন্ত্রণ কমতে থাকে। এই সুযোগে হূনরা আক্রমণ চালায় গুপ্ত সা¤্রাজ্যের উপর এবং অতি সহজেই তারা জম্বু - কাশ্মœীর, হিমাচল, রাজস্থান, পাঞ্জাব এবং মাওলা এর কিছু অংশ জয় করে নেয়। এভাবেই তারা তাদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা শুরু করে। এসময় হূনদের নেতা ছিলেন টরমানা (ঃড়ৎসধহধ) । স্কন্ধগুপ্ত যুদ্ধের মাধ্যমে হুনদের পরাজিত করার আগ পর্যন্ত ভারতবর্ষে হূনদের আক্রমন অব্যাহত ছিল। স্কন্ধগুপ্তের কেেছ পরাজিত হয়ে হূনরা খানিকটা ক্ষান্ত হয়। তবে স্কন্ধ গুপ্তের পতনের মূলে আরেকটি কারণ ছিলো গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অন্তর্গত সামন্ত রাজাদের মধ্যে বিদ্রোহ। অনেক রাজা আবার স্বাধীনতাও ঘোষণা করে বসেন। সর্ব প্রথম স্বাধীনতা ঘোষণা করেন কাথিয়াবাড়ের মৈত্রকরা। ধীরে ধীরে অন্যান্য অঞ্চলের সামন্ত রাজারাও স্বাধীনতা ঘোষণা করতে শুরু করেন।
এটা সত্য যে, স্কন্ধগুপ্তের মুত্যুর আগ পর্যন্ত হূনরা আর এগুতে পারেনি। কিন্তু ইতোমধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্যের নানান ক্ষতি হয়ে গেছে হুনদের কারণে। হূনরাও অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকলো কখন স্কন্দগুপ্তের সিংহাসনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। স্কন্ধগুপ্ত মারা গেলে (৪৬৭ খ্রিষ্টাব্দে) হূনরা যেনো সোনার চাঁদ হাত পেয়ে গেল। ততদিনে হূনদের নেতৃত্বেও আসলো বিশাল পরিবর্তন। টরমানা (ঃড়ৎসধহধ) এর পুত্র মিহিরকুলা এখন হূনদের নতুন নেতা। তিনিও টরমানার মতো কৌশলী। মিহিরকুলার নেতৃত্বে হূনরা এবার গুপ্ত সাম্রাজ্যের উপর আক্রমণ করে সা¤্রাজ্যকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়। পতন ঘটে ভারতবর্ষে একক আধিপত্য বিস্তার করা আরেকটি বৃহৎ সা¤্রাজ্যের।
হূন রাজা মিহিরকুলা শকাল (ংড়শধষ) কে রাজধানী বানিয়ে শাসন করা শুরু করেন। শকাল (ংড়শধষ) হচ্ছে বর্তমান শিয়ালকোট। তবে হূনদের শাসনকাল ভারতবর্ষে খুব একটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। অতি অল্প সময়ে জন্য হূনরা ভারতবর্ষে শাসন করতে পেয়েছিলো। মিহিরকুলার মৃত্যুর পরপরই হূনদের পতন ঘটে। এরপর হূনরা আর ভারতবর্ষের বুকে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে পারে নি।

গুপ্ত শাসন এবং বাংলাঃ গুপ্তদের রাজনৈতিক সম্প্রসারনের সময় বাংলায় সম্ভবত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন শক্তির অস্তিত্ব ছিলো। পশ্চিম পাশের বাঁকুড়া শহর থেকে ১৯৫ কি.মি. উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত মুসুনিয়ার পর্বত গাত্রে খোদিত লিপিতে পুষ্করণাধিপ সিংহবর্মা ও তাঁর পুত্র চন্দ্রবর্মার উল্লে¬খ আছে। পুষ্করণাধিপ চন্দ্রবর্মাই খুব সম্ভবত এলাহাবাদ প্রশস্তি লিপিতে উল্লে¬খিত সমুদ্রগুপ্ত কর্তৃক পরাজিত চন্দ্রবর্মা।
দিলি¬র মেহরাওয়ালী এলাকায় কতুব মিনার সংলগ্ন কুওয়াতুল ইসলাম মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত লৌহ সÍম্ভ গাত্রে খোদিত লিপির বক্তব্য বাংলায় গুপ্তদের রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্প্রসারনের ওপর কিছুটা আলোকপাত করে। এ লিপিতে চন্দ্র নামধারী একজন রাজার নাম উল্ল¬খ করা হয়েছে। খুব সম্ভবত এ লিপিতে উল্লেখিত রাজা “চন্দ্রই” প্রথম চন্দ্রগুপ্ত অথবা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত।
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি লিপি সূত্রে জানা যায় যে, তিনি সমতট ব্যতীত বাংলার অন্য সব জনপদ তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। অর্থাৎ বাংলা তখন গুপ্ত সা¤্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণেই ছিলো। তবে সমুদ্র গুপ্তের মৃত্যুর পর বাংলার উপর গুপ্ত স¤্রাটরা আর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারেন নি।


এই ছিলো মোটামুটি ভারতবর্ষে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের ইতিহাস। এই সুদীর্ঘ সময়ে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতি। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, মৌর্য সা¤্রাজ্যের পর প্রায় চারশো বছর পরে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের উত্থান হলেও মৌর্য সা¤্রাজ্যের অর্থনীতির নিয়ম কানুনের সাথে গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অর্থনৈতিক নিয়মগুলোর মধ্যে অনেক মিল পাওয়া যায়। মৌর্য সা¤্রাজ্যের অর্থনৈতিক গতি পথ পরিচালিত হয়েছিলো চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের উপর ভিত্তি করে। গুপ্ত যুগেও এ বিষয়টা লক্ষণীয়। মৌর্য যুগের মতো গুপ্ত যুগের রাজারাও ছিলেন একনায়কতন্ত্রে বিশ্বাসী। রাজারা পুরোপুরি এক নায়কের মতোই আচরণ করতেন। রাজার কথার উপর দ্বিতীয় কোনো কথা ছিল না। চাণক্য যেমনটি বলেছিলেন, অঞ্চলগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ জোরালো করা প্রয়োজন। গুপ্ত রাজারা মৌর্য রাজাদের মতো না পারলেও অঞ্চল গুলোর উপর শক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যতীত যে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় শাসন গড়ে উঠবে না এটা তারা সকলেই বুঝতেন, বিশ্বাস করতেন এবং প্রয়োগের চেষ্টা করতেন।
বেশির ভাগ জনগণ যেহেতু গ্রামে বসবাস করতো এবং গ্রামের অর্থনীতি স্বভাবতই ছিলো কৃষি নির্ভর তাই গুপ্ত রাজার কৃষির প্রতি বেশ ভালোই গুরুত্ব দিয়েছিলো এবং মৌর্য যুগে কৃষকদের বেশি উৎপাদনের জন্য ড্রেইনেজ ফ্যাসিলিটি দেয়ার যে নিয়ম চালু সেই নিয়মটাও অব্যাহত রেখেছিলেন। কারণ এর মাধ্যমে যে শুধু কৃষকেরই গোলা ভরত তা না, রাষ্ট্রের রাজস্বের পরিমাণও বাড়ত প্রচুর পরিমাণে। তাছাড়া এই ড্রেইনেজ ফ্যাসিলিটি বাবদ আলাদা কর আদায় তো অব্যাহত ছিলোই। তাছাড়া জমির উপর কর আরোপ করে ল্যান্ড রেভিনিউ (ষধহফ ৎবাবহঁব) নামক সরকারের যে আয়ের উৎস ছিলো সেটিও অব্যাহত ছিলো। গুপ্ত সম্রাটরা কৃষি জমির উপর ২৫% হারে কর আরোপ করতো। তাছাড়া নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো খরচ নালন্দার আশেপাশের ১০০ টি গ্রাম থেকে আদায় করা করের পরিমাণ দিয়ে মেটানো হত।
জনগণের উপর এই বিপুল মাত্রায় কর আরোপের মধ্যে দিয়েই চলতো গুপ্ত সম্রাটদের সকল ভোগ বিলাসিতা। গুপ্ত সম্রাটরা নিজেদের সাম্রাজ্য রক্ষার্থে একের পর এক যুদ্ধ করতো আর এই সাধারণ মানুষগুলোর উপর পড়তো করের বোঝা, লাশ পড়তো এই সাধারণ মানুষগুলোর একেকটি পরিবারের কর্ণধারের। করের পাশাপাশি গুপ্ত যুগে ভূমি দাস প্রথার বিকাশ একটু বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এ সময় ভূমি দাসপ্রথা খুবই সক্রিয় ছিলো। জমি হস্তান্তরের সাথে সাথে ভূমি দাসও তখন হস্তান্তর হতো।
এ সময় ব্যবস্যা বাণিজ্যের দিক দিয়ে ভারতবর্ষ ভালোই উন্নতি লাভ করে। গুপ্ত যুগে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসারের ফলে রাজ্যের মানুষগুলোর জীবন কাঠামোতে আসে পরিবর্তন। এই সময়েই উচ্চ বিত্ত শ্রেণীটি উন্নত জীবনযাত্রার সান্নিধ্যে এসেছিলো। কোম্পানির ধারণা এই সময়েই আসে । এসময় রোমান সাম্রাজ্য , এশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার সাথে ভারতীয় ব্যবসায়িদের ব্যবসায়িক সর্ম্পক ছিল । বর্বর আক্রমণে রোমান সাম্রাজ্য পতনের পরে সেখানে অবশ্য ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ব্যবসা অনেক খানি কমে যায় । যার পরোক্ষ প্রভাব পরে পুরো গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতির উপর । এটি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতিকেও অনেক খানি দুর্বল করে দেয় এবং গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের অন্যতম একটি কারণ হিসেবে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয়কেও হিসেব করা হয়। এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অর্থনীতিকে অনেকখানি সংকুচিত করে ফেলে। দেশের শিল্পগুলো একের পর এক বন্ধ হওয়া শুরু করে। ফলে এ শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত অনেকেই জায়গা বদল করে, অনেকে নিঃস্ব হয়ে যায়। গুপ্ত স¤্রাটগণ এ সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে মুদ্রায় খাঁটি সোনা ব্যবহারের পরিমাণ কমিয়ে দিয়ে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ধরে রাখার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা আর হয় নি। গুপ্ত সা¤্রাজ্যের অর্থনীতি ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হতে থাকে।



যে বিষয়টা গুপ্ত সাম্রাজ্যকে সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ করে তা হলো হিন্দুধর্মের উত্থানের আড়ালে নতুন আঙ্গিকে বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদের উত্থান। আর এরই সাথে ভারতবর্ষে এতদিন বৌদ্ধ মতবাদের আড়ালে চাপা পড়ে থাকা বর্নপ্রথা নামক অভিশাপটি আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। সমাজের মানুষগুলোর মধ্যে ব্রাক্ষণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই শ্রেনীভেদগুলো সুস্পষ্ট রূপ ধারণ করতে থাকে। চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েনও ভারত বর্ষে এ সময় ঘুরতে এসে দেখে গেছেন “চন্ডাল” নামক শূদ্রদের মধ্যে যে উপশ্রেণীটি সৃষ্টি হয়েছিলো সেই উপশ্রেণীটির দুঃসহ জীবন যাপন। এদের সামাজিক কোনো অধিকার তো ছিলোই না, বরং অনেকখানি কুকুর বিড়ালের মতো তৎকালীন সমাজে এরা গৃহীত হতো। এদের সাথে কথা বলা পর্যন্ত তৎকালীন উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণেরা পাপ বলে গণ্য করতো।
গুপ্ত সম্রাট কুমার গুপ্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন, আমরা তা ইতোমধ্যে জেনেছি। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে “সংস্কৃত” নামক যে ভাষাকে নির্বাচিত করা হয় তা ভারত বর্ষের সাধারণ জনগনের কোনো ভাষা ছিলো না। এটি আর্যদের ভাষা। এই ভাষায়ই আর্য ঋষিরা তাদের সাহিত্য রচনা করতেন। অর্থাৎ গুপ্ত রাজাদের হাত ধরে ভিনদেশী “সংস্কৃত” ভাষাটি নতুন জীবন লাভ করে।
গুপ্ত শাসনামলে কমতে থাকে মহিলাদের সামাজিক অধিকার। শুধু কমে যায় তা নয়, ঘটেছিলো ব্যাপক অবক্ষয়। বাল্য বিবাহ নামক ব্যাধিটি এ সময়ই সমাজে বাসা বাঁধতে শুরু করে। শুধু বাল্য বিবাহই নয়, সতীদাহ প্রথাও এ সময় সমাজে প্রকট আকার ধারণ করে। এ সময় মেয়েরা শিক্ষা থেকেও ছিলো পুরোপুরি বঞ্চিত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান পতনের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে রয়েছে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসঙ্গ। সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের পর যে মনোবেদনা সৃষ্টি হয় সেই মনোবেদনা থেকে মুক্তি পেতে তিনি বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। তারপর থেকে স¤্রাট অশোক হয়ে যান একাধারে বৌদ্ধ ধর্মের ভক্ত ও পৃষ্টপোষক। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের পরিধিকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। এর আগে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিলো ঠিকই কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম অশোকের মতো কোনো সম্রাটকে প্রভাবিত করতে পারেনি। কিন্তু মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের উত্থান ও পতন পূর্ব সময় পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই হিন্দুধর্মের মুখোশের আড়ালে বৈদিক ব্রাহ্মণেরা আবারো তাদের পুরনো কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। পুরনো কাজ বলতে আর কিছুই নয়- সমাজকে নিজের নিকট পদানত রাখা ! বৈদিক ব্রাহ্মণদের এই চক্রান্তের সাথে ধীরে ধীরে বিভিন্ন অঞ্চলের রাজারাও হাত মেলাতে থাকেন। যে রাজারা এতোদিন সম্রাট অশোকসহ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত ছিলেন, সেই রাজারাই এ সময় গুপ্ত রাজাদের পা চাটা শুরু করে দেন। এটা আর কিছুই নয়, ক্ষমতা নামক মোহের প্রতি অন্ধ আনুগত্য। যা আমরা আমাদের দেশ কিংবা উপমহাদেশের রাজনীতির মধ্যে বর্তমানে বেশ ভালো করে দেখতে পাই।
যে ধারার প্রতি মানুষজন বিরক্ত হয়ে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো সেই মানুষজনকে ফেরানো যে বেশ কঠিন কাজ, আর্যদের তৈরি করা এই পরজীবী ব্রাক্ষণ সম্প্রদায়টি তা সহজেই আন্দাজ করতে পেয়েছিলেন। সেজন্য তারা তাদের কৌশলগত দিক থেকেও এবার পরিবর্তন নিয়ে আসেন। গৌতম বুদ্ধ বৈদিক ব্রাহ্মণদের ভাত মারার পরেও তারা গৌতম বুদ্ধের সমালোচনা থেকে বিরত থাকলেন। শুধু বিরত না, গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে খেলতে লাগলেন নতুন খেলা। তারা গৌতম বুদ্ধকে আখ্যায়িত করলেন অবতার হিসাবে। গৌতম বুদ্ধ নাকি বিষ্ণুর আরেকটি রূপ নিয়ে পৃথিবীতে শান্তির বাণী নিয়ে এসেছিলেন। তাই গৌতম বুদ্ধ বিষ্ণু অবতার। এভাবে গৌতম বুদ্ধকেও একজন পূজনীয় দেবতা বানিয়ে নেন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। গৌতম বুদ্ধের নাম ব্যবহার করে পুনরায় দেবতা পূজার আয়োজন শুরু হয় জোরেসোরে । দেবতা পূজার আড়ালে চলতে থাকে ব্যক্তির পূজা। হরিষেণের এলাহাবাদ প্রশস্তিতে স¤্রাট সমুদ্রগুপ্তকে কুবের, ইন্দ্র, বরুণ প্রমুখ দেবতার সমতুল্য বলে বর্ণনা করা হয়েছে। স¤্রাটকে জন্ম মৃত্যুর নিয়ন্ত্রক এবং মর্তরাজ্যের ঈশ্বর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ সময়ই শিবের স্ত্রী হিসেবে আরাধ্য দেবীতে পরিণত হন কালী, দূর্গা বা পার্বতী। নতুন নতুন দেবদেবীর আবির্ভাব ঘটতে থাকে। পুণরায় প্রতিষ্ঠিত হয় বলিদান ও যাগযজ্ঞ। এজন্যই দক্ষিণাত্য বিজয় সম্পন্ন করে সমুদ্রগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্ম যেমন সম্রাট অশোকের নেতৃত্বে ব্যাপক রাষ্ট্রীয় পৃষ্টাপোষকতা পেয়েছিলো তেমনি গুপ্তযুগে এই হিন্দুত্ববাদ তথা ব্রাক্ষণ্যবাদের উত্থানের মূল শক্তি ছিলো গুপ্ত রাজাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পৃষ্টপোষকতা। এজন্য অনেক ঐতিহাসিক গুপ্ত যুগকে হিন্দু ধর্মের পুণরভ্যুত্থানের যুগ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
গুপ্ত সাম্রাজ্যের আরেকটি উল্লে¬খযোগ্য বিষয় হলো, এ সময় গুপ্ত রাজাদের জমির মালিকানা (ষধহফ ড়হিবৎংযরঢ়) সিস্টেম প্রবর্তনের ফলে জমির উপর কৃষকের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এতদিন পর্যন্ত জমির মালিকানা সরাসরি সামন্ত রাজাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। কৃষকের কোনো অধিকার ছিলো না জমির উপর।
গুপ্ত শাসনামলে ভারতবর্ষে বেশ কিছু প্রতিভাধর লোকজন লাভ করে যাদের অবদান আজো ভারতবর্ষের বুকে অক্ষত রয়েছে। এই গুপ্ত শাসনামলেই আর্য ভট্টের জন্ম হয় (৪৭৬ খ্রিস্টাব্দ)। আর্য ভট্ট তৎকালীন সময়ের একজন গণিতজ্ঞ ও জ্যোর্তিবিদ ছিলেন। পৃথিবীতে শূণ্য “০” এর ধারনা আর্য ভট্টের মাথা থেকেই সর্ব প্রথম আসে।
সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার কালিদাস গুপ্ত রাজসভারই কবি ছিলেন। ইংরেজ সাহিত্যে উইলিয়াম শেক্সপিয়রের মতো সংস্কৃত সাহিত্যে তার অবদান। তার রচনার মধ্যে রয়েছে “মেঘদূতম”, “কুমারসম্ভবম”, “রঘুবংশম”, “ঋতুসংহার”, “শৃঙ্গাররসাষ্টক”, “শৃঙ্গারতিলক”, “পুষ্পবাণবিলাস” নামক কাব্য, “নলোদয়” ও “দ্বাদশ- পুত্তলিকা” নামে দুটি আখ্যান কাব্য এবং “অভিজ্ঞান শকুন্তলম”, “বিক্রমোর্বশীয়ম”, “মালবিকাগ্রিমিত্রম” নামে তিনটি নাটক রচনা করেন।


বিখ্যাত “কামসূত্র” গ্রন্থটি গুপ্ত আমলেই রচিত। কামসূত্র একটি মানব যৌনাচার সংক্রান্ত গ্রন্থ। যৌনতা সংক্রান্ত ব্যবহারিক উপদেশ সম্বলিত বিষয়গুলো পদ্য ছন্দে রচিত হয়েছে বইটিতে। প্রাচীন ভারতীয় পন্ডিত মল্লনাগ মাৎস্যানায় এই গ্রন্থটির রচয়িতা। মল্লনাগ মাৎস্যান্যায়ের জন্ম কাল নিয়ে বিতর্ক থাকলেও ধারণা করা হয় তিনি চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতাব্দী পর্যন্ত ভারতে বর্তমান ছিলেন।
যদিও হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, শিবের দ্বাররক্ষক নন্দী কামসূত্রের আদি রচয়িতা। তিনি শিব ও তার পত্মী পার্বতীর রমণকালে উচ্চারিত পবিত্র বাণী শুনে মুগ্ধ হন শিবের দ্বাররক্ষক নন্দী । পরে মানবজাতির কল্যাণার্থে সেই বাণী লিখে রাখেন। যদিও এই বিশ্বাসের বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই।

এরকম নানান মানুষ, নানান অবদান, নানান যুদ্ধ, নানান নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে নরসিমহা গুপ্তের পর গুপ্ত সা¤্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন ঘটে।


লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
ময়মনসিংহ।

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৪/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৩৫

রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: প্লাস দিয়ে ভাগলাম। পরে এসে পড়ছি। বড় লেখা। পিসি ছাড়া পড়া কঠিন।

২| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:২৪

মাঘের নীল আকাশ বলেছেন: পুরো বই লিখে দিয়েছেন!

৩| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩৪

প্রণব দেবনাথ বলেছেন: ++++++

৪| ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৬

ঘ্যাচাং বলেছেন: গাজী বলদটা এখনো আসে নাই? আবার যদি কিছু জিগায় কিছু, তাই সেলফ মডারেশন শিখছেন না, ওইটা এপ্লাই কইরেন। মনে রাইখেন আপনার লেখা আবর্জনা প্রমান করাই এইসব কৃমিটাইপ লোকের কাজ। আপনি ভালো লিখেন এইটার কদর করবে না, কেবল দোষ ধইরা বেড়াবে আর বমি করবে। এইগুলাই এদের স্বভাব। আমার ধারনা ওই বুড়া ছাগুটার অল্প কমেন্টেই তার আবর্জনামুলক ব্লগিং মনোবৃত্তির পরিচয় পাইছিলেন।

হ্যাপী ব্লগিং।

২৮ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৪৪

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: ধন্যবাদ। আমাদের কারোই এমন কোন কমেন্ট করা উচিত না যাতে লেখককে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয়।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.