নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শুভঙ্করের ফাঁকি-১ (ডিটেকটিভ গল্প)

০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:১৮


রক্তিম ভবন
উদ্যম-১৯০, লামাবাজার, সিলেট

উপরের ঠিকানাটা দেখে ভ্রু কুঁচকানোর কোনো দরকার নেই। হয়তো ভাবছেন, এটা রঘুদার পরবর্তী কেসের সাথে সম্পৃক্ত কিছু হবে। আসলে সেরকম কিছুই নয়। এটা রঘুদার নতুন বাড়ির ঠিকানা। অনিমেষের ফাইনাল পরীক্ষার আগেই রঘুদা এই বাড়িতে উঠেছেন।
আগের বাড়িটাও খারাপ ছিল না। কিন্তু সেখানে একঘরে দু’জন মানুষের থাকাটা বেশ অসুবিধাজনক। তাছাড়া রঘুদার কাছে এখন অনেক টাই-কোট পরা মক্কেলও আসেন। তাদের বসতে দেওয়ারও একটা অসুবিধা ছিল সেখানে।
রঘুদার এই নতুন ঠিকানায় আজ প্রথমবারের মতো একটা চিঠি এসেছে। খামের উপর প্রেরকের জায়গায় লেখাÑ কামনা মিত্র, বাড়ি নং-২২৫, রাস্তা নং-০৭, গুলশান-১, ঢাকা।
রঘুদা খামটা না ছিঁড়ে প্রেরকের ঠিকানা নিয়েই মিনিটখানেক ভাবলেন। ঢাকা থেকে চিঠি? এটা যেন রঘুদার বিশ্বাসই হচ্ছে না। রঘুদার কোনো আত্মীয়ই তো ঢাকায় থাকে না। তাহলে এই চিঠির প্রেরক কামনা মিত্র কে?
রঘুদা একটু হলেও আন্দাজ করতে পারলেন এটা তাঁর কোনো মক্কেলের চিঠি। কারণ প্রাপকের অর্থাৎ রঘুদার নাম লেখার সময় ভদ্রমহিলা পি.আই. রঘুনাথ দাস লিখেছেন। যার অর্থ দাঁড়ায় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর রঘুনাথ দাস।
রঘুদা চিঠিটা খুলে পড়া শুরু করলেন।
প্রিয় রঘুবাবু,
পত্রের প্রথমেই আমার নমস্কার নিবেন। আশা করি ভালো আছেন। আসলে অনেক বড় একটা বিপদে পড়ে আজ আমি আপনার শরণাপন্ন হয়েছি। তার আগে আমার পরিবার সম্পর্কে দু’একটা কথা বলে নিই।
আমার নাম কামনা মিত্র। স্বামীর নাম চন্দ্রশেখর মিত্র, তিনি গুলশান-১ এলাকার কাউন্সিলর। আমার সংসারে আরো একজন আছে-আমার মেয়ে। ক্লাস এইটে পড়ে। গত মাসে আমরা সিলেটে বেড়াতে এসে বেশ কয়েকজনের কাছে আপনার খুব প্রশংসা শুনি। আপনি নাকি গোয়েন্দা হিসেবে অল্প সময়ে ভালোই সুনাম কুঁড়িয়েছেন। তাই আমার এই বিপদের দিনে আশা করি আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।
চলতি মাসের ৪ তারিখের কথা বলছি। তারিখটা অনেকের জন্য সুখের আবার অনেকের জন্য দুঃখের ছিল। কিন্তু আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ছিল এই দিনটি। যেদিন আমার স্বামীকে মিথ্যা খুনের দায়ে অভিযুক্ত করে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়।
কিন্তু আমি যতটুকু জানি, আমার স্বামী সেরকম লোক নন। তিনি কোনোভাবেই এই কাজ করতে পারেন না। তাই আপনাকে আমি হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, আপনি একটু কষ্ট করে ঢাকায় এসে পুরো বিষয়টা একবার তদন্ত করে দেখুন।
আপনার অপেক্ষায় রইলাম।
ইতি
কামনা মিত্র

অনিমেষ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে গত পরশু দিন তার বন্ধুদের সাথে কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। সপ্তাহখানেক সেখানে বন্ধুদের সাথে থাকবেও। তাই রঘুদার যদি ঢাকা যাওয়াও হয় তবে একাই যেতে হবে। অনিমেষ সাথে থেকে কেসের ক্লু ধরতে সহায়তা করবে এরকম পর্যায়ে সে কিন্তু এখনো পৌঁছায়নি। তারপরেও অনিমেষের ছন্নছড়া কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে রঘুদার ভালো লাগে।
রঘুদা অবশ্য অনিমেষের যাওয়া, না যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে একদম ভাবছেন না। তিনি ভাবছেন, আদৌ তিনি ঢাকায় যাবেন কি না। কামনাদেবী যে চিঠিটা পাঠিয়েছেন তাতে আবেগের মাত্রাটাই বেশি।
মানুষ সামাজিক জীব। তার মধ্যে আবেগ থাকবে এটা অতি সাধারণ বিষয়। কিন্তু ভদ্রমহিলার এই আবেগের উপর ভিত্তি করে ঢাকায় যাওয়াটা কি যুক্তি সংগত হবে?
অনেক ভেবেচিন্তে রঘুদা কামনাদেবীকে একটা চিঠি পাঠিয়ে বলে দেন, কামনাদেবীর স্বামী অর্থাৎ চন্দ্রশেখরবাবুকে জেলে নেওয়ার পেছনের সব ঘটনা খোলাসা করে বললে রঘুদা ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্বান্ত নিতে পারবেন। অন্যথায় , এই আবেগপ্রবণ একটা চিঠির উপর ভিত্তি করে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে তিনি কোনো সিদ্বান্ত নিতে পারছেন না।
রঘুদার চিঠি পাঠানোর দু’ দিন পরেই কামনাদেবীর আরেকটা চিঠি আসল। সেখানে রঘুদার কথামতোই চন্দ্রশেখরবাবুকে জেলে নেওয়ার পেছনের সব ঘটনাই তিনি খোলাসা করে বলেছেন।
প্রিয় রঘুবাবু,
নমস্কার নিবেন। আপনার চিঠি পাওয়ার পরই আমি এই চিঠিটা লিখতে শুরু করি। আপনার কথামতো পুরো ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপ:
যাকে খুনের দায়ে আমার স্বামীকে জেলে নেওয়া হয় তিনি আমাদের বাড়িরই একজন ভাড়াটে। একাই থাকতেন আমাদের বাড়িতে। ভদ্রলোকের নাম ছিল শুভঙ্কর দত্ত। শতদল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। দেখতে বেশ লম্বা, গায়ের রং শ্যামলা, মুখ ভর্তি দাঁড়ি। কথা বলতেন খুব কম।
উনি সচরাচর আমাদের ঘরে আসতেন না। গত ৪ তারিখ সকালে হঠাৎ কী মনে করে আমাদের ঘরে আসলেন। আমার স্বামী তখন ঘরেই ছিলেন। শুভঙ্করবাবু আমার স্বামীকে বললেন,“দাদা, রাতের দিকে আমার ঘরে একটু আসতে পারবেন?”
“ কোনো দরকার?” বলে আমার স্বামী জিজ্ঞেস করেছিলেন।
“একটু পার্সোনাল কথা ছিলো।”
“ঠিক আছে আসবো।”
এই ছিলো সকাল বেলায় তাদের দুজনের মধ্যকার কথোপকতন। রাত নয়টার দিকে আমার স্বামী ভাত-টাত খেয়ে শুভঙ্করবাবুর ঘরে যান। সেখান থেকে আধাঘন্টা পর ফিরেও আসেন। আমি তখন আমার স্বামীকে তাদের দু’জনের মধ্যকার কথাবার্তা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। তিনি বললেন,“শুভঙ্করবাবু মনে হয় এমাসেই আমাদের বাড়িটা ছেড়ে দিবেন। এখান থেকে উনার অফিসে যেতে বেশ সমস্যা হয়। তাছাড়া অফিসের পাশে একটা বাড়িও পেয়ে গেছেন।”
এরপর আমি আর কথা বাড়াইনি। কিন্তু একটু পরেই অন্যান্য ভাড়াটে ফ্যামিলির লোকজনদের চিৎকার আমাদের কানে আসে।
সেখানে গিয়ে দেখি শুভঙ্করবাবু নিজের ঘরে নেই, আর তার ঘরের মেজের বিভিন্ন স্থানে রক্তের স্রোত। বুঝতে বাকি রইল না-শুভঙ্করবাবুকে খুন করা হয়েছে! আর যেই খুনটা করুক না কেন সে নিশ্চয়ই লাশটা গুম করে রেখেছে!
ঘন্টাখানেকের ভেতরেই পুলিশ আসল। তারা ভাড়াটেদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারে আমার স্বামী একটু আগেই শুভঙ্করবাবুর ঘরে আসেন। সেজন্য সন্দেহের তীর তারা আমার স্বামীর দিকে ছুঁড়ে এবং তাকেই ধরে নিয়ে যায়। তাছাড়া কাউন্সিলর হিসেবে অনেক ক্ষমতা থাকার পরেও সেই ক্ষমতা প্রয়োগের মতো অবস্থাও তখন ছিল না, যেহেতু নিজের বাড়ির ভাড়াটেরা বলছে বাড়ির মালিক একটু আগেই শুভঙ্করবাবুর সাথে দেখা করতে এসেছিলেন।
এই হচ্ছে মোটামুটি আমার স্বামীকে জেলে নেওয়ার পেছনের ঘটনা। প্লিজ রঘুবাবু, আমার এই বিপদের দিনে আমাকে একটু সাহায্য করুন, প্লিজ।
ইতি
কামনা মিত্র
সম্পূর্ণ চিঠিটা পড়ে রঘুদা বেশ কৌতুহল বোধ করলেন। ভাবলেন, এই কেসে বেশ কয়েকটা প্যাঁচ রয়েছে। যাই, গিয়েই দেখি । হয়তো ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটবে।
তার মানে রঘুদা ঢাকায় যাচ্ছেন। আর অনিমেষ কক্সবাজার থাকার কারণে খুব সম্ভবত এই কেসে থাকছে না।






২..

“হ্যাঁলো অনিমেষ।”
“হ্যাঁ রঘুদা, বলো।”
“আজ রাতে ঢাকায় যাবো ,বুঝলি?”
“ঢাকায়? কেন?”
“একটা কেসের জন্য । ট্রেনে করেই যাব ভাবছি। তোর কি অবস্থা?”
“একদম ফাটাফাটি। আসলে রঘুদা বাংলাদেশ যে কত সুন্দর এই কক্সবাজারে না এসে তুমি বুঝতে পারবে না।”
“তাই নাকি?”
“হ্যা রঘুদা, নেক্সট টাইম এই এলাকার কোনো মক্কেল এলে একদম ছাড়বে না। একদিকে কেস অন্য দিকে সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য দুটোই উপভোগ করতে পারবে।”
“ভেবে দেখব।”
“আচ্ছা রঘুদা, যে কেসের জন্য ঢাকায় যাচ্ছ সেটা কিরকম মনে হচ্ছে?”
“মনে হচ্ছে ইন্টারেস্টিং কিছু আছে। সেজন্যই তো যাচ্ছি।”
“ও!” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অনিমেষ।
রঘুদা বললেন, “আসলে আমারও ইচ্ছে ছিল তোকে নিয়ে যাই। কিন্তু তুই তোর এতগুলো বন্ধুদের নিয়ে এক জায়গায় গেছিস তাই আমি আর অনুরোধ করছি না।”
“সমস্যা নেই, আমি আসলে ফার্স্ট টু লাস্ট সবকিছু বললেই হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
সিলেট টু ঢাকা সাত ঘন্টার ট্রেন জার্নি। রাত্রিবেলা ট্রেনে করে রওয়ানা দিলে পরদিন সকালবেলায়ই ঢাকায় পৌঁছা সম্ভব। ফলে ইনভেস্টিগেশনের জন্য পরের দিনটা পুরোপুরি হাতে থাকে। তাই রঘুদা জার্নির জন্য রাত্রিবেলাটাই বেছে নিয়েছেন।
রাত সাড়ে দশটায় রঘুদা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলেন। স্টেশনে পৌঁছে গেলেন আধঘন্টার ভেতরেই। আজ রাত সাড়ে এগারোটায় উপবন এক্সপ্রেস আছে। সেটা করেই রঘুদা যাবেন। কাউন্টারে তেমন ভিড় না থাকায় টিকেট কাটতেও তেমন কোন অসুবিধা হয়নি। একটা প্রথম শ্রেণীর টিকেট কেটে রঘুদা ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।
নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট পর ট্রেন আসলেও আসার পাঁচ মিনিটের মধ্যে ট্রেনটা সিলেট ছেড়ে ঢাকার দিকে চলতে শুরু করল। রঘুদা ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে রেখে নিজের সিটের মধ্যে বসা অবস্থায়ই ঘুমানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু ট্রেনে খুব ঘুম কাতুরে না হলে ঘুমানোটা কষ্টকর। তাই রঘুদারও ঘুম এলো না । তারপরেও চোখ দুটি বুজে রইলেন।
রঘুদার পাশে যে লোকটি বসা, সেও কেমন জানি মুড ধরে বসে রয়েছে। এই ধরনের লোককে রঘুদা একদম সহ্য করতে পারেন না। কথা বলা তো দূরের কথা ! এককথায়, কথাবার্তাহীন একটা নিরামিষ পরিবেশের মধ্যে চলতে লাগল রঘুদার সাত ঘন্টার এই লং জার্নি।
রঘুদা ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছলেন সকাল সোয়া সাতটায়। ট্রেন থেকে নামার সাথেসাথেই রঘুদা কেমন যেন ভড়কে গেলেন। তাঁর চোখের সামনে অনিমেষ দাঁড়িয়ে! কিন্তু অনিমেষের তো এই মুহূর্তে কক্সবাজার থাকার কথা। এটা অনিমেষের প্রেতাত্মা নাকি অন্য কিছু?
রঘুদা প্রথমে একটু ভড়কে গেলেও পরে স্বাভাবিকভাবেই হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন, “আরে অনিমেষ, তুই এখানে?”
অনিমেষ বলল, “আসলে রঘুদা তুমি যখন বলেছিলে এই কেসে ইন্টারেস্টিং কিছু আছে তখন আমিও কক্সবাজারের প্রতি ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলি।”
“তাই বলে আমাকে না বলে চলে আসবি?”
“এটাকে একটা সারপ্রাইজ হিসেবে ধরে নাও।”
“সত্যিই অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ দিলি। তোর ফ্রেন্ডরা রাগ করেনি?”
“তা অবশ্যই করেনি। কিন্তু তোমার এইসব কেসের প্রতি আমার আগ্রহ দেখে ওরা বেশ অবাক হয়েছে।”
“হু.............। কিছু খেয়েছিস?”
“না না, এখনো কিছু খাই নি।”
“চল, আগে কিছু খেয়ে নিই, আমারও খুব ক্ষিধে পেয়েছে।”
তার মানে এই কেসেও অনিমেষকে বাদ দেওয়া যাচ্ছে না। রঘুদার কেসগুলোর প্রতি অনিমেষের আগ্রহ অন্যান্যদের তুলনায় একটু হলেও ব্যতিক্রমধর্মী। নইলে কক্সবাজারের মতো জায়গা ছেড়ে স্রেফ একটা কেসের জন্য ঢাকার দূষিত বায়ুর স্বাদ নিতে আসে এত বড় বোকা কি আর হয়!
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে কিছু ফাস্টফুডের দোকান থাকলেও সেরকম বড় কোন রেষ্টুরেন্ট নেই। তাই ফাস্টফুডের দোকান থেকেই অনিমেষরা আপাতত খেয়ে নিল।
খাওয়া-দাওয়া শেষে একটা টেক্সি নিয়ে গুলশান-১ এর দিকে তারা রওয়ানা দিলেন। এখন রাস্তাঘাটে গাড়ির চাপ একটু কম থাকায় গুলশান-১ এ পৌঁছাতে ঘন্টাখানেকের বেশি সময় লাগেনি। ট্যাক্সিতে আসার সময় রঘুদা কামনাদেবীর চিঠি সম্পর্কে অনিমেষকে সবিস্তারে বলে নিলেন।
গুলশান-১ এ গিয়ে কোনো প্রকার ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই রঘুদা এই এলাকার কাউন্সিলর চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িটা খুজে বের করলেন। বাড়ির বাইরে গেইট থাকলেও সেখানে কোনো দারোয়ান নেই। রঘুদা গেইট খুলে ভেতরে ঢুকলেন, রঘুদার পর অনিমেষ।
বাড়িটা দেখেই অনিমেষের চোখ ধাধিয়ে গেল। বাড়িতে একটা নয়, দুইটা বিল্ডিং। একটা দু’তলা, আরেকটা তিন তলা। তিন তলা বিল্ডিংয়ের চেয়ে দু’তলা বিল্ডিংটাই একটু বেশি সুন্দর। এই দু’তলা বিল্ডিংয়েই সম্ভবত চন্দ্রশেখরবাবুর ফ্যামিলির লোকেরা থাকেন আর অন্যটিতে ভাড়াটেরা। প্রতিটি বিল্ডিংয়ের সামনে ছোটখাটো ফুলের বাগান রয়েছে।
রঘুদারও বুঝতে বাকি রইল না যে, দু’তলা বিল্ডিংটাতেই চন্দ্রশেখরবাবুর ফ্যামিলির লোকেরা থাকেন। তিনি কলিংবেল চাপতেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক ভদ্রমহিলা। রঘুদা বললেন, “আমার নাম রঘুনাথ দাস, এটা তো চন্দ্রশেখরবাবুর বাসা?”
ভদ্রমহিলা হঠাৎ করেই উৎফুল্ল হয়ে উঠেলেন, “আরে রঘুবাবু! আসুন, আসুন। আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আসলে আপনার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি।”
বুঝা গেল, এই ভদ্রমহিলাই চন্দ্রশেখরবাবুর স্ত্রী কামনাদেবী। যিনি রঘুদার কাছে চিঠি লিখেছিলেন। রঘুদা বললেন, “আপনি কী করে জানলেন আমি আসব?”
“সে জানতাম না। তবে আমার বার বার মনে হচ্ছিল আমাকে সাহায্য করার জন্য আপনি আসবেনই।”
কথা বলতে বলতে এতক্ষণে অনিমেষ ও রঘুদা ড্রয়িং রুমে চলে এলেন। রঘুদা ইতোমধ্যে অনিমেষের পরিচয়টাও কামনাদেবীকে দিয়ে দিয়েছেন।
ভদ্রমহিলা দেখতে বেশ স্বাস্থ্যবতী, গায়ের রং ফর্সা, কথা বলেন গুছিয়ে গুছিয়ে।
রঘুদা সরাসরি কেসের বিষয়েই কামনাদেবীর সাথে কথা বলতে শুরু করে দেন। তিনি কামনাদেবীকে বললেন, “আপনি তো বলছিলেন চন্দ্রশেখরবাবু গুলশান-১ এর কাউন্সিলর। তো কাউন্সিলর হিসেবে উনার দাপট কিরকম ছিল?”
কামনাদেবী বললেন, “দাপটের কথা আমি ঠিক বলতে পারব না। কারণ এখন পর্যন্ত আমি নিজেকে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত করিনি। আর রাজনীতির মাঠ কেমন সেটাও নিজের চোখে দেখিনি। তবে উনার ক্ষমতা সম্পর্কে দু’একটা তথ্য দিতে পারি।”
“বলুন।” বললেন রঘুদা।
কামনাদেবী বললেন, “আমাদের এই গুলশান-১ এলাকায় একটা রাজনৈতিক গ্র“প আছে, গ্র“পটি বেশ শক্তিশালী। নাম- কাশ্মীর গ্র“প। আমার স্বামী এই গ্র“পের সভাপতি।”
“কাশ্মীর” নামটা শুনে রঘুদার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। কিন্তু অনিমেষ ভ্রুকুঁচকে কামনাদেবীকে জিজ্ঞেসই করে ফেলল, “কাশ্মীর?”
“হ্যাঁ, গ্র“পটার নাম কাশ্মীর।” বললেন কামনদেবী।
“কিন্তু আমি যতটুকু জানি কাশ্মীর পাক-ভারতের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটি রাজ্য। সেই নামে একটা রাজনৈতিক গ্র“পের নাম-”
কামনাদেবী বললেন, “আসলে আমার স্বামী যখন ছাত্র রাজনীতি করতেন, তখন উনিসহ উনার বন্ধুবান্ধবদের একটা আড্ডা ছিল ‘হোটেল কাশ্মীর’ নামে একটা হোটেলের নিচে। সেই হোটেলের নামেই এই গ্র“পের নামকরণ হয়েছে। অবশ্য হোটেলের নামটা এখন পাল্টে গেছে। নতুন নাম খুব সম্ভবত ‘হোটেল আল-বান্না’।”
রঘুদা বললেন, “এই গ্র“পের মধ্যে চন্দ্রশেখরবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ কারো সাথে আমায় একটু দেখা করিয়ে দিতে পারবেন?”
“ঘনিষ্ঠতার কথা বললে বলতে হবে দেবরঞ্জনবাবুর কথা। তিনি কাশ্মীর গ্র“পের সহ-সভাপতি। আমার স্বামী এবং দেবরঞ্জনবাবু প্রায়ই একসাথে থাকতেন। তাছাড়া আমাদের পাশের বাড়িতেই দেবরজ্ঞনবাবু থাকেন। তাই দেখা করতেও তেমন অসুবিধা হবে না। কিন্তু এরকম কারো সাথে দেখা করার কারণটা-”
“দেখুন একজন মানুষ তার দৈনন্দিন কর্মকাণ্ড যতটুকু না তার ফ্যামিলির লোকের সাথে শেয়ার করে তার চেয়েও বেশি করে তার বন্ধুবান্ধবদের সাথে। আপনি আপনার নিজের কথাই ভাবুন না। চন্দ্রশেখরবাবু আপনার সাথে কি সব শেয়ার করতেন? উনার কাশ্মীর গ্র“প, পলিটিক্যাল ইমেজ, এলাকার উন্নয়ন সবকিছু নিয়েই উনাকে চিন্তা করতে হয়। তখন নিজের ফ্যামিলির লোকজন এমনিতেই অনেকটা গৌণ হয়ে যায়। আর সেজন্যই আমি দেবরঞ্জনবাবুর মতো কারো সাথে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি।”
কামনাদেবী বললেন, “সমস্যা নেই। প্রতি সন্ধ্যায়ই তিনি আমাদের বাড়িতে আসেন। আজ সন্ধ্যায়ও খুব সম্ভবত আসবেন। তখন না হয় আপনার সাথে দেখা করিয়ে দেব। তো আপনারা এবার রেস্ট নিন। দু’তলায় আমাদের গেস্ট রুম রয়েছে। আশা করছি সেখানে আপনাদের কোনো অসুবিধা হবে না।”
“রেস্টের কথা পরে হবে। তার আগে যাকে খুন করার অভিযোগে চন্দ্রশেখরবাবুকে জেলে নেওয়া হয়েছে সেই শুভঙ্করবাবুর ঘরটা আমি দেখতে চাই।”
“এখনই দেখবেন?”
“আপনার যদি অসুবিধে না থাকে।”
“দাঁড়ান আমি ঘরটার চাবি নিয়ে আসি।”
কামনাদেবী চাবি নিয়ে আসলে রঘুদা, অনিমেষ আর কামনাদেবী চললেন প্রয়াত শুভঙ্কর দত্তের ঘরের দিকে। রঘুদা আর অনিমেষ বাড়িতে ঢুকে যে তিন তলা বিল্ডিং দেখেছিলেন তারই নিচ তলায় থাকতেন শুভঙ্কর দত্ত।
কামনাদেবী তালা খুললে তারা তিনজনেই ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন। অনিমেষ দেখল দুইটা বেডরুম, একটা কিচেন রুম রয়েছে সেখানে। দুইটা বেডরুম থাকলেও একটা ঘরেই বিছানাপাতা। অন্যটা খালি। বিষয়টা ঘরের ভেতর ঢুকেই রঘুদার নজরে এসেছিল। কিন্তু তিনি কামনাদেবীকে সে ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করে ঘরের অন্যান্য বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন। অনিমেষ ভেবেছিল বিষয়টা হয়তো রঘুদার নজর এড়িয়ে গেছে। তাই সে কামনাদেবীকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা আন্টি, শুভঙ্করবাবু তো আপনাদের বাড়িতে একা থাকতেন। কিন্তু উনার দুইটা বেডরুমের কী দরকার ছিল? চাইলে তো অন্য কোথাও সিঙ্গেল রুমে থাকতে পারতেন।”
কামনাদেবী বললেন, “সে বিষয়ে আমি তেমন জানি না। উনাকে ভাড়া দেওয়ার সময় বিষয়টা আমার নজরে এসেছিল। কিন্তু উনার ভাবটা দেখে বুঝলাম উনি প্রয়োজনে ডাবল ভাড়া দিবেন কিন্তু এই বাড়িতেই থাকবেন।”
“তার মানে থাকার চেয়ে এই বাড়িটাই উনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল।” বললেন রঘুদা।
“হতে পারে।” বললেন কামনাদেবী।
“আচ্ছা, শুভঙ্করবাবুর কাছে উনার কোনো বন্ধুবান্ধব কিংবা কোনো আত্মীয় স্বজন আসতেন না?”
“না তো। প্রায় দুই মাসের মতো এই ঘরে তিনি ছিলেন, সেরকম কাউকে আসতে দেখিনি।”
“উনার আগের ঠিকানা সম্পর্কে কিছু জানেন?”
“আগের ঠিকানা আর কি বলব! উনার বাড়ি রংপুরের ওদিকে। ঢাকায় শতদল কোম্পানিতে চাকরি পাওয়ার পর এখানেই থাকার সিদ্ধান্ত নেন। মাঝে একবার বাড়িতে ও গিয়েছিলেন।”
“কয়দিনের জন্য গিয়েছিলেন।”
“সম্ভবত চারদিনের জন্য।”
“আপনাদের কাছে উনার কোনো ছবি আছে?”
“আপনাকে আমি চিঠিতেও বলেছি রঘুবাবু, শুভঙ্করবাবু একজন স্বল্পভাষী মানুষ। অন্যান্য ভাড়াটে ফ্যামিলির সাথে উনার ছিল ‘হাই’,‘হ্যালো’র সম্পর্ক আর আমাদের সাথে ভাড়া দেওয়ার। সেজন্য উনার সাথে কেউই ঘনিষ্ঠতা করতে পারেনি। তাই আমার জানা মতে উনার কোনো ছবি এই বাড়িতে নেই।”
“থাকলে অনেকখানি সুবিধে হত। আচ্ছা, ঠিক আছে। তারপরেও আপনি অন্যান্য ভাড়াটে ফ্যামিলিকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন যদি থেকে থাকে।”
“আমি চেষ্টা করব রঘুবাবু।”
এরপর কয়েকটা ভাড়াটে ফ্যামিলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কেসে সহায়তা করে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তাদের কাছ থেকে বলার মতো যে তথ্য পাওয়া গেছে সেটি হল-গত ৪ তারিখ শুভঙ্করবাবুর খুন হওয়ার আগে তারা শুভঙ্করবাবুর ঘরে চন্দ্রশেখরবাবুকে ঢুকতে দেখেছিলেন। যেমনটি তারা পুলিশকেও বলেছিলেন।
কামনাদেবী এসময় তাদেরকে শুভঙ্করবাবুর ছবির কথা জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, তাদের কাছে শুভঙ্করবাবুর কোনো ছবি নেই।
ছবিটা না পাওয়াতে রঘুদাকে একটুখানি হতাশ দেখাল। যিনি গেছেন তিনি তো গেছেনই, তার ছবিকে রঘুদা কেন যে এত গুরুত্ব দিচ্ছেন অনিমেষ তা বুঝতেই পারছে না। রঘুদাকে তো এখানে আনা হয়েছে চন্দ্রশেখরবাবু নির্দোষ কি না সেটা প্রমাণ করার জন্য।
ভাড়াটে ফ্যামিলিগুলোকে জিজ্ঞাসাবাদ করে চন্দ্রশেখরবাবুর বিল্ডিংয়ের দিকে যেতে যেতেই রঘুদা আর কামনাদেবী কথা বললেন। অনিমেষ মনোযোগ সহকারে কথাগুলো শুনতে লাগল। রঘুদা বললেন, “শুভঙ্করবাবুর মৃত্যুর পর উনার পরিবারের সাথে আপনারা কোনো সাক্ষাৎ করেন নি?”
“দেখুন আমার স্বামীকে জেলে নেওয়ার পর আমি নিজে মানসিকভাবে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়ি। কিন্তু এই হতাশা সত্ত্বেও আমি চাচ্ছিলাম শুভঙ্করবাবুর মৃত্যুর খবরটা যাতে তার ফ্যামিলির কাছে যায়। কিন্তু পারিনি।”
“কেন?”
“আমি শুধু জানতাম উনার বাড়ি রংপুরে। কিন্তু রংপুরের কোথায় সেটা জানতাম না। ভাবলাম, শতদল কোম্পানিতে যোগাযোগ করলে হয়তো উনার বাড়ির ঠিকানাটা পাওয়া যাবে। সেজন্য দেবরঞ্জনবাবুকে দিয়ে শতদল কোম্পানিতে খোঁজ নিই। দেরবঞ্জনবাবু খোঁজ নিয়ে এসে বললেন, সেখানে শুভঙ্কর দত্ত নামে কোনো ব্যক্তি কাজ করেন না, এমনকি আগেও করতেন না।”
“বলছেন কী!”
“হ্যাঁ রঘুবাবু, সেজন্যই তো উনার বাড়ির লোকদেরকে মৃত্যুর খবরটা দিতে পারিনি।”
“অর্থাৎ এখনো শুভঙ্করবাবুর ফ্যামিলি উনার মৃত্যুর খবর জানতে পারেনি।”
“এক রকম সেটাই।”
“হু.....।”
চন্দ্রশেখরবাবুর বিল্ডিংয়ের দু’তলায় রঘুদা আর অনিমেষের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব থাকাথাকির ব্যাপারে রঘুদা আবার একটু উদাসীন। এখানে থাকার জায়গা না থাকলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে রাত কাটাতেও রঘুদার কোনো আপত্তি নেই! অনিমেষ কিন্তু এই ব্যাপারে রঘুদার ঠিক বিপরীত। সে একটু পরে পরেই রঘুদাকে বলছে, “দেখছ রঘুদা, কী সুন্দর একটা ঘরে আমাদের থাকতে দিয়েছে। আসলে ওরা বেশ অতিথিপরায়ণ, কি বলো?”
রঘুদা এক পর্যায়ে গম্ভীর মুখে বললেন, “অনিমেষ আমরা এখানে কী জন্য এসেছি? আরামসে থাকার জন্য নাকি একটা কেসের তদন্তের জন্য?”
অনিমেষ বুঝে গেল রঘুদা তার কথায় সন্তুষ্ট হননি। তাই সে রঘুদার সাথে কেসের বিষয়েই কথা বলা শুরু করল। অনিমেষ রঘুদাকে বলল, “রঘুদা কেসটা এখন কোন পর্যায়ে আছে?”
“কোন পর্যায়ে আছে সেটা বলা কঠিন। এটুকু বলতে পারব আমার তদন্ত এখনো চলছে। তবে নতুন কিছু বিষয় আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে।”
“যেমন-”
“প্রথমত, শুভঙ্করবাবু শতদল কোম্পানিতে চাকরি করতেন বলে সবাইকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু কামনাদেবী খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ঐ কোম্পানিতে শুভঙ্কর দত্ত নামে কোনো ব্যক্তি কাজ করেন না, এমনকি আগেও করতেন না। দ্বিতীয়, এই বাড়িতে এমন কী মধু আছে যার জন্য একজন মানুষ দুইটা বেডরুম থাকা সত্ত্বেও এখানে থাকতে রাজি হন। তাছাড়া কামনাদেবী তো নিজেই বললেন, শুভঙ্করবাবুর ভাবটা এমন ছিল যে এই বাড়িতে থাকার জন্য প্রয়োজনে দ্বিগুন ভাড়া দিতে তিনি রাজি ছিলেন। এর পেছনে মূল রহস্যটা কী? তৃতীয়ত, এই বাড়ির কারো কাছে উনার কোনো ছবি নেই, এর কারণ কী? হয়তো তিনি মানুষ হিসেবে স্বল্পভাষী ছিলেন, তাই বলে নিজের চেহারা লুকানোর কী দরকার?”
রঘুদার প্রতিটি প্রশ্নই যে যুক্তিসঙ্গত এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রঘুদা কিভাবে এসব প্রশ্নের মধ্যে লুকায়িত সত্য ঘটনাকে টেনে আনতে পারেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।








৩...

রঘুদা আর অনিমেষের সারাটা দিন কাটল খাওয়া দাওয়া আর টিভি দেখার মধ্যে। রঘুদা অবশ্য কেসটা নিয়ে মাঝে মধ্যে চিন্তাও করছিলেন। কামনাদেবী রঘুদা ও অনিমেষের দেখাশুনা করার জন্য বাড়ির কাজের লোক কল্যাণকেও বলে রেখেছেন। কল্যাণ ছেলেটা দেখতে খুব হাসি-খুশি, বয়স বাইশ তেইশের বেশি নয়। সে সর্বদাই তাদের ভালোমন্দ প্রয়োজনের খোঁজ খবর নিচ্ছিল।
সন্ধ্যার দিকে আসলেন কাশ্মীর গ্র“পের সহ-সভাপতি দেবরঞ্জনবাবু। রঘুদাকে যে কামনাদেবী এই কেসের তদন্তের ভার দিয়েছেন সেটা দেবরঞ্জনবাবু আগেই জানতেন। কামনাদেবী উনার সাথে আলাপ-আলোচনা করেই রঘুদাকে এই কেসের তদন্তের জন্য চিঠি দুটো দিয়েছিলেন।
কামনাদেবী কল্যাণকে দিয়ে খবর পাঠালে অনিমেষ আর রঘুদা দু’জনেই নিচে আসলেন। তারা দেবরঞ্জনবাবুকে নমস্কার করে সোফায় বসলেন। কামনাদেবী রঘুদা আর অনিমেষকে দেবরঞ্জনবাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। রঘুদা বললেন, “তদন্তের কাজে আপনাকে জড়ানোর জন্য আমি দুঃখিত দেবরঞ্জনবাবু।”
দেবরঞ্জনবাবু বললেন, “না রঘুবাবু, এখানে দুঃখিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। বরং আমরাই আপনার কাছে দুঃখিত আপনাকে এতদূর আনার জন্য। তাছাড়া চন্দ্রশেখরবাবু ফিরে আসুন এটা চন্দ্রশেখরবাবুর ফ্যামিলিসহ পুরো কাশ্মীর গ্র“পই চায়। কারণ কাশ্মীর গ্র“পের আজ এই শক্তিশালী অবস্থানে আসার পেছনে পুরো কৃতিত্বই চন্দ্রশেখরবাবুর।”
রঘুদা বললেন, “আপনাদের একটা কথা বলে রাখছি। আমি এখানে এসেছি স্রেফ কেসটার তদন্তের জন্য। কিন্তু তদন্তের ফলাফলে যদি দেখা যায় চন্দ্রশেখরবাবু সত্যিই খুনটা করেছেন তখন বিষয়টা কিন্তু আপনাদের মেনে নিতে হবে। আর মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে একজন মানুষকে ফোকাস করে তদন্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“আপনি তো মশাই আপনার মতোই তদন্ত করবেন। আমরা কেউই আপনাকে বাধা দেব না। তবে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি চন্দ্রশেখরবাবু এরকম কাজ করার মানুষ নন।”
কামনাদেবীও এই কথায় সায় দিলেন।
রঘুদা দেবরঞ্জনবাবুকে বললেন, “আমি আপনার সম্পর্কে যতদূর জেনেছি আপনি চন্দ্রশেখরবাবুর খুব ঘনিষ্ঠ একজন মানুষ। তাই আপনার কাছ থেকে দু’ একটা বিষয় জানতে চাই, যদি আপনার আপত্তি না থাকে।”
“আরে বলুন, বলুন, আপত্তির প্রশ্ন উঠছে কেন?”
“একজন রাজনৈতিক জগতের মানুষ হিসেবে চন্দ্রশেখরবাবু কেমন ছিলেন?”
“আমি নিজের এই ৪২ বছরের জীবনে যাদের সাথে চলেছি তাদের মধ্যে যদি ভালো একজন পলিটিশিয়ানের কথা বলি তাহলে চন্দ্রশেখরবাবুর কথাই বলব। এই গুলশান-১ এ কাশ্মীর গ্র“প ছাড়াও অনেক গ্র“প রয়েছে। তাদের কেউই বলতে পারবে না তাদের সাথে আমাদের কোনো সংঘর্ষ কিংবা কথা কাটাকাটি হয়েছে। এসবই মূলত চন্দ্রশেখরবাবুর আদর্শের কারণে। উনি কখনোই সংঘাতের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। একজন কাউন্সিলর হিসেবে এই এলাকায় তিনি যে বন্ধুত্বের রাজনীতি গড়ে তুলেছেন তা ৪ বছর আগেও কল্পনার বাইরে ছিল। কিন্তু এই খুনের ঘটনায় এলাকাবাসীর মনে কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় সেটাই একটু লক্ষণীয় বিষয়। তবে যে প্রতিক্রিয়াই দেখা যাক না কেন সেটা যে কাশ্মীর গ্র“পের উপর একটা নেগেটিভ প্রভাব ফেলবে এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”
“আপনি বলতে চাইছেন আপনাদের প্রতিপক্ষ গ্র“পগুলো চন্দ্রশেখরবাবুকে খুনি বানিয়ে জেলে পাঠানোর ব্যাপারে একটা ভূমিকা পালন করেছে।”
“নো নো রঘুবাবু, আমি কখনোই একথা বলব না। চন্দ্রশেখরবাবুর একজন ভাড়াটে খুন হয়েছে। খুন হওয়া লাশটাও গুম হয়েছে। আর সবচেয়ে বড় কথা চন্দ্রশেখরবাবু খুনের আগে ঐ ভাড়াটের ঘরে গিয়েছিলেন। স্বভাবতই দোষটা উনার উপর গিয়ে পড়ে। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে অনেক বড় কিছু ঘটেছে।”
“সে যাই বলুন দেবরঞ্জনবাবু, চন্দ্রশেখরবাবুর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ দেখছি। তারপরেও আমি আমার তদন্তের কাজ চালিয়ে যাব, সে ব্যাপারে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন।”
রঘুদার কথায় কামনাদেবীসহ দেবরঞ্জনবাবু নিজেও কিছুটা হতাশ হলেন। রঘুদা বললেন, “আসলে আপনাদের হতাশ হওয়াটা অতি স্বাভাবিক। কিন্তু তারপরেও বলব আপনারা আপাতত দু’একদিন একটু ধৈর্য্য ধরুন। উনি যদি সত্যিই খুনটা না করে থাকেন তবে তা আমার তদন্তে অবশ্যই বেরিয়ে আসবে।”
এরপর কেসের বিষয়ে আর কোনো কথাবার্তা হয় নি। দেবরঞ্জনবাবুও মিনিট পাঁচেক পর নিজের বাড়িতে চলে যান। যাবার সময় রঘুদাকে বললেন, “আপনাকে কিন্তু কাল আমার বাসায় একবার আসতে হবে।”
“কেন?”
“এমনিতেই। হালকা চা পান করে করে আসবেন। কিছু গল্প গুজবও হবে। আপনার এই ভাইটাকেও নিয়ে আসবেন।”
“কখন আসবো?”
“সকাল বেলাটাই বেস্ট। এই পাশের বাড়িতেই আমি থাকি। দেরি করবেন না কিন্তু।”
এই বলেই দেবরঞ্জনবাবু চলে গেলেন।
রাত্রি তখন ৯টা মতো হবে। রঘুদা কেসটা নিয়ে এখনো ভাবছেন। কিন্তু খুনের মোটিভটা এখনো বের করতে পারছেন না।
এমন সময় কামনাদেবী উনার মেয়েকে নিয়ে বেশ হাসিমুখে রঘুদার ঘরে প্রবেশ করলেন। অনিমেষ তখন টিভি দেখছিল। কামনাদেবী বললেন, “একটা খুশির খবর আছে রঘুবাবু।”
“কী?”
“শুভঙ্করবাবুর একটা ছবি পেয়েছি। এই নিন।”
বলে কামনাদেবী রঘুদার হাতে ছবিটা দিলেন। অনিমেষও উঁকি ঝুঁকি মেরে ছবিটা দেখল। রঘুদা বললেন, “বাহ! অনেক ভালো হয়েছে। তা ছবিটা পেলেন কিভাবে? আপনি তো বলছিলেন এ বাড়িতে উনার কোন ছবি পাওয়া যাবেনা।”
“সে তো বলেছিলাম। কিন্তু এই ছবি পাওয়ার সব কৃতিত্ব আমার মেয়ের। ও-ই গত স্বরস্বতী পুজোর সময় শুভঙ্করবাবুর অজান্তেই ছবিটা তুলেছিল।”
ছবিটা পেয়ে রঘুদা যেন অন্ধকারের মধ্যে আলোর আভাস পেতে শুরু করলেন। তবে কামনাদেবীর মেয়ের প্রশংসা করতে ও কিন্তু তিনি ভুলেননি। রঘুদা তাকে জিজ্ঞেস করলেন,“কী নাম তোমার?”
“সুবর্ণা মিত্র।” মিষ্টি গলায় মেয়েটি জবাব দিল।
“কোন ক্লাসে জানি পড়?”
“ক্লাস এইটে।”
“ও তোমার মা তো আমায় বলেই ছিলেন। যাই হোক। তুমি হয়তো শখের বশে শুভঙ্করবাবুর ছবিটা তুলেছিলে। কিন্তু এই ছবিটা যে এই কেসের ফিনিশিং দেওয়ার জন্য কত জরুরি তা তুমি কেসটা শেষ হওয়ার পর বুঝতে পারবে।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, তাই।” রঘুদার হাসোজ্জল জবাব।
কামনাদেবী রঘুদাকে বললেন, “রঘুবাবু, আপনাদের খাওয়াদাওয়া শেষ?”
“হ্যাঁ শেষ।”
“তাহলে রেস্ট নিন। আমরা এবার আসছি।”
কামনাদেবী উনার মেয়েকে নিয়ে চলে গেলে অনিমেষ মনভরে ছবিটা দেখল। মুখ ভর্তি দাড়ি, গায়ের রং শ্যামলা, মুখটা দেখেই বুঝা যায় উনি একজন স্বল্পভাষী মানুষ।
রঘুদাও ছবিটা ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। কিন্তু কেসটা নিয়ে আজ আর চিন্তা করলেন না। এমনিতেই কাল সকালে দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে যেতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ঘুমিয়ে পড়াই মঙ্গল।






৪...

রঘুদা দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে গেলেন সকাল দশটায়। সাথে অনিমেষও রয়েছে। দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িটা চন্দ্রশেখবাবুর বাড়ির মতো এত বড় না হলেও খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। জাঁকজমকটা অনেকখানি চন্দ্রশেখবাবুর বাড়ির মতোই। তবে ব্যতিক্রমধর্মী বিষয়টা হল ফুলের বাগানের পাশে খালি একট জায়গায় বড় একটা টেবিল আর টেবিলের চারপাশে চেয়ার রয়েছে। রঘুদা গিয়ে দেবরঞ্জনবাবুকে এই স্থানটায়ই পেলেন। ভদ্রলোক তখন পত্রিকা পড়ছিলেন। রঘুদা আর অনিমেষ দেবরঞ্জনবাবুর কাছে গেলে ভদ্রলোকের মুখে বেশ উৎফুল্লভাব ফুটে উঠল।
“আরে, এসে গেছেন?” বললেন দেবরঞ্জনবাবু “চলুন, ভেতরে চলুন।”
দেবরঞ্জনবাবু রঘুদা আর অনিমেষকে উনার ড্রয়িংরুমে নিয়ে চললেন। সেখানে মিনিট পাঁচেক গল্প গুজব করার পর দেবরঞ্জনবাবু একটা ছবির অ্যালবাম নিয়ে আসলেন।
“আসলে রঘুবাবু, এটা আমার এত দিনের রাজনৈতিক জীবনের সারমর্ম। বাড়িতে কোনো বিশেষ অতিথি আসলে তাদের দেখানোর চেষ্টা করি। অনেকে দেখে আনন্দ পায়, অনেকে দেখে কৌতুহল বোধ করেন। অনেকে আবার আমার মন ভরানোর জন্য দেখে। আশা করছি আপনি এর মূল্য বুঝবেন।” রঘুদার হাতে ছবির অ্যালবাম তুলে দিয়ে বললেন দেবরঞ্জনবাবু।
অনিমেষ আর রঘুদা ছবিগুলো দেখতে লাগলেন। অনিমেষ দেখল, এই অ্যালবামে যত ছবি আছে তার সংখ্যা পাঁচশ’র নিচে হবে না। সেখানে দেবরঞ্জনবাবুর সেই কলেজ লাইফ থেকে এই পর্যন্ত রাজনৈতিক ফিল্ডে উঠা সবকটি ছবিই রয়েছে। বেশির ভাগ ছবিতেই উনার সাথে চন্দ্রশেখরবাবুর ছবিটা রয়েছে।
রঘুদা এর আগে চন্দ্রশেখরবাবুর চেহারাটা দেখেন নি। এই সুযোগে উনার ফেইসটাও চিনে নিলেন। এই ছবি দেখার মাঝেই দেবরঞ্জনবাবুর কাজের লোক খাবার নিয়ে আসল। চা, বিস্কুট, সেমাই, নুডলস কিছুই বাদ যায় নি খাবারের তালিকা থেকে। এক কথায় ফাটাফাটি খাবার।
রঘুদা খেতে খেতেই ছবিগুলো দেখেছিলেন। হঠাৎ একটা ছবি দেখে রঘুদা বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। তিনি দেবরঞ্জনবাবুকে বললেন, “এই ছবিটা কার দেবরঞ্জনবাবু?”
“কেন?”
“দরকার আছে বলুন।” বলে দেবরঞ্জনবাবুকে তাগিদ দিলেন রঘুদা।
দেবরঞ্জনবাবু ছবিটা হাতে নিয়ে বললেন, “এটা তো আমাদের বিনয়ের ছবি।”
“বিনয়?”
“হ্যাঁ, পুরো নাম বিনয় বোস। কাশ্মীর গ্র“পের সাংগঠনিক সম্পাদক। খুব অ্যাকটিভ। ভগবান যদি চন্দ্রশেখরবাবুকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে না দেন তাহলে ওকেই সম্ভবত সভাপতির দায়িত্বটা দেয়া হবে।”
“আপনি সহ-সভাপতি থাকতে একজন সাংগঠনিক সম্পাদক সভাপতি হতে যাবেন কেন?”
“এরকম প্রশ্ন আসাটাই স্বাভাবিক। দেখুন আমি কখনোই ব্যক্তিস্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেই না। আমি আজ আছি, কাল হয়তো মরেও যেতে পারি। কিন্তু কাশ্মীর গ্র“প সবসময় থাকবে। তাই এই গ্র“পের ভালোর জন্য আমি যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।”
“কিন্তু সভাপতির দায়িত্বটা আপনি নেবেন না কেন?”
“এখানে নেওয়াটা বড় কথা নয় রঘুবাবু, দেওয়াটাই বড় কথা। কাশ্মীর গ্র“পের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিনয় খুবই জনপ্রিয়। তাই বলে তার জনপ্রিয়তায় আমি ঈর্ষা করছি সেটাও বলব না। আমি চাই এরকম নতুন কেউ এই গ্র“পের হাল ধরুক। হয়তো সহ-সভাপতি হিসেবে সকলেই চাইবে আমি এই গ্র“পের হাল ধরি। কিন্তু আমি চাই বিনয়ই এই গ্র“পের হাল ধরুক।”
“আচ্ছা উনার সাথে কি দেখা করা যাবে?”
“বিনয়ের সাথে দেখা করে কি করবেন?”
“এতটুকু বলতে পারব, এটা আমার তদন্তের একটা অংশ।”
“তদন্ত?”
“হ্য্াঁ, তদন্ত।”
“আপনি কী বলতে চাইছেন চন্দ্রশেখরবাবুর ভাড়াটেকে বিনয় খুন করেছে?”
“একদম নয়। আর আপনি নিশ্চিত থাকুন বিনয় বোস এসব খুন টুন কিছু করেন নি। কাশ্মীর গ্র“পের জনপ্রিয় নেতা হিসেবে আমি উনার সাথে দু’একটা কথা বলতে চাই।”
হঠাৎ বিনয় বোসকে নিয়ে আলোচনা উঠা এবং হঠাৎ করেই তাকে তদন্তের অংশ বানানোর মর্মার্থ অনিমেষ একদম বুঝতে পারেনি। কিন্তু বড় বড় দু’জন মানুষের আলোচনার মাঝে সেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারছে না। তাই সবকিছু হজম করে চুপচাপ বসে রয়েছে। দেবরঞ্জনবাবু রঘুদাকে বললেন, “আপনি কি এখনই বিনয়ের সাথে দেখা করতে চান?
“হ্যাঁ।” বলে জবাব দিলেন রঘুদা।
“ও তো গত বেশ কয়দিন ধরে দেশের বাইরে রয়েছে। দাঁড়ান, একটু জিজ্ঞেস করে নিই, ও এখন ঢাকায় আছে কি না।”
“কোথায় আছেন তিনি?”
“সিঙ্গাপুরে। ওর এক আত্মীয়কে নিয়ে গিয়েছিল। খুব অসুস্থ ছিলেন বোধ হয়।”
“কয়দিন আগে গিয়েছিলেন একটু আন্দাজ করতে পারেন?”
“প্রায় দুই মাস হবে।”
“দুই মাস!” বলে রঘুদা তাঁর হাতের আঙ্গুল মটকালেন। তারপর দেরবঞ্জনবাবুকে বললেন, “আমার মনে হচ্ছে উনি এখন ঢাকায়-ই আছেন। আপনি ফোন করে বলে দিন এখানে আসতে। তবে এখানে যে একজন গোয়েন্দা আছেন সেটা ভুলেও বলবেন না।”
“ঠিক আছে মশাই, বলব না।”
একথা বলে দেবরঞ্জনবাবু ফোন করলেন কাশ্মীর গ্র“পের সাংগঠনিক সম্পাদক বিনয় বোসকে। বিনয় বোসের মোবাইলে ফোনও গেল। তার মানে আর যাই হোক তিনি এখন বাংলাদেশেই আছেন।
“হ্যাঁলো।”
“নমস্কার দাদা, কেমন আছেন?”
“এই তো, ভালোই আছি। তোমার কী অবস্থা?”
“ভালো দাদা।”
“তোমার আত্মীয় সুস্থ হয়েছেন?”
“হ্যাঁ, পুরোপুরি।”
“আচ্ছা তুমি একবার আমার বাড়িতে আসতে পারবে?”
“এখনই?”
“হ্যাঁ এখনই।”
“কোনো দরকার?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, জরুরি দরকার আছে। তাড়াতাড়ি চলে এসো।”
দেবরঞ্জনবাবু ফোনটা কেটে দিলেন।
এরপর দেবরঞ্জনবাবুর ফ্যামিলির লোকদের সাথে অনিমেষ ও রঘুদার আলাপ হল। ফ্যামিলির লোক বলতে দেরবঞ্জনবাবুর স্ত্রী আর উনার ক্লাস ফাইভে পড়–য়া এক ছেলে। ভদ্রলোকের ছেলেটা খুব পাজি টাইপের। এই ঘর থেকে ওই ঘরে সার্বক্ষণিক দৌড়াদৌড়ি করছে। তাকে নিয়ে রঘুদা আর দেবরঞ্জনবাবু কিছু হাসিঠাট্টাও করছেন।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে দেবরঞ্জনবাবুর স্ত্রী চন্দ্রশেখরবাবুকে জেলে নেওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “চন্দ্রশেখরবাবুর ফ্যামিলির সাথে আমাদের এক প্রকার আত্মার বন্ধন। কোনো পূজা করলে আমরা একসাথে করি, কোথাও যেতে হলে আমি চন্দ্রশেখরবাবুর স্ত্রীকে নিয়ে যাই। চন্দ্রশেখরবাবুকে আমাদের ফ্যামিলি যতটা কাছ থেকে দেখেছে, আর কোনো ফ্যামিলি সেরকম দেখেছে বলে মনে হয় না। সেই অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, চন্দ্রশেখরবাবু একটা ষড়যন্ত্রের স্বীকার। উনার মতো লোক এরকম কাজ কখনোই করতে পারে না।”
রঘুদা কিছু বলতে যাবেন এমন সময়ই দেবরঞ্জনবাবুর ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করলেন কাশ্মীর গ্র“পের সাংগঠনিক সম্পাদক বিনয় বোস। গোলগাল চোহারা, মুখটা ক্লিন শেভ করা পরনে জিন্সের প্যান্ট আর ফুলহাতা চেকশার্ট, গায়ের রং শ্যামলা, চুলগুলো একটু অগোছালো করে আঁচড়ানো। বিনয় বোস আসার পরই দেবরঞ্জনবাবুর স্ত্রী চলে গেলেন।
বিনয় বোস দেবরঞ্জনবাবুকে নমস্কার করে একটা সোফায় বসে পড়লেন। সোফাতে বসেই তিনি আড়চোখে রঘুদা ও অনিমেষের দিকে একবার তাকালেন। কিন্তু কথা বলার কোনো আগ্রহ দেখালেন না। দেবরঞ্জনবাবু বিনয় বোসকে বললেন, “বিনয়, তোমাকে হঠাৎ করে আমার বাড়িতে ডাকার জন্য আমি দুঃখিত। আসলে উনার নাম রঘুনাথ দাস। চন্দ্রশেখরবাবুুর জেলে যাওয়ার বিষয়টা তদন্ত করতে এসেছেন।” বলে রঘুদাকে চিনিয়ে দিলেন দেবরঞ্জনবাবু।
“আর উনার পাশের জন?” বলে অনিমেষকে ইঙ্গিত করলেন বিনয় বোস।
দেবরঞ্জনবাবু বললেন, “রঘুবাবুর ছোট ভাই, নাম অনিমেষ দাস।”
“তা এখানে আমাকে ডাকার কারণÑ”
দেবরঞ্জনবাবু মনে হয় এর উত্তরে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু রঘুদা সাথেসাথেই বললেন, “আসলে দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে এসে উনার মুখে আপনার খুব প্রশংসা শুনি। এই অ্যালবামে আপনার ছবিও দেখি।” বলে অ্যালবামটা দেখিয়ে বললেন রঘুদা, “দেবরঞ্জনবাবু বলছিলেন কাশ্মীর গ্র“পের জনপ্রিয় নেতাদের মধ্যে আপনি একজন। তাই ভাবছিলাম ঢাকায় যখন এসেছি তখন আপনার সাথে একবার দেখা করেই যাই।”
“ঢাকায় এসেছেন মানে? আপনি ঢাকায় থাকেন না?” রঘুদাকে জিজ্ঞেস করলেন বিনয় বোস।
রঘুদা বললেন, “না, আমি সিলেটে থাকি।”
“ও আচ্ছা, তো তদন্ত এগুলো কতদূর?”
“প্রায় শেষের দিকেই আছি।”
এমন সময় দেবরঞ্জনবাবুর মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। তিনি সোফা থেকে উঠে একটু দূরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। হয়তো কোনো পার্সোনাল ফোন।
“তো আপনি কাকে সন্দেহ করছেন?” দেবরঞ্জনবাবু উঠে গেলে রঘুদাকে জিজ্ঞেস করলেন বিনয় বোস।
রঘুদা বললেন, “আমার তো সন্দেহ হচ্ছে একজনকেই।”
“কাকে?”
“কল্যাণকে।”
“কল্যাণ! মানে চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়ির ঐ কাজের লোকটা?”
“হ্যাঁ মশাই, কাউকে বলবেন না প্লিজ।”
“না না, এত বড় বোকা আমাকে ভাববেন না। তাছাড়া ঐ কাজের লোকটাকে আমরা নিজের কাছেও একটু কেমন জানি লাগত। আগে যখন চন্দ্রশেখরদার বাড়িতে যেতাম তখন লক্ষ্য করতাম ওর চোহারায় একটু চোর চোর ভাব রয়েছে। কিন্তু আমি মশাই ওসব বিষয়ে তেমন পাত্তা দিতাম না। রাজনৈতিক জগতের মানুষ তো, তাই চন্দ্রশেখরদার বাড়িতে গেলে কাশ্মীর গ্র“প ছাড়া আর কিছু নিয়ে আলাপ হত না, আর করতেও ইচ্ছে করত না।”
“আমি ভাবছি ওকে সপ্তাহখানেকের ভেতরেই পুলিশের হাতে তুলে দেব।”
“এক সপ্তাহ কেন মশাই? ওকে আজই পুলিশে সোপর্দ করুন। কাশ্মীর গ্র“প আপনার সাথে আছে।”
“সে তো আছেই। কিন্তু আমি চাচ্ছি কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ যোগাড় করতে। সাক্ষ্য প্রমাণ ছাড়া তো আর পুলিশের হাতে সোপর্দ করে কোনো লাভ নেই। দেখবেন মাস দু’মাস পর এমনিতেই ছাড়া পেয়ে গেছে।”
“তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন।”
বিনয় বোস কথাটা শেষ করার পরপরই দেবরঞ্জনবাবু সোফায় এসে বসলেন। উনার অনুপস্থিতিতে যে বিনয় বোসকে অনেক বড় একটা কথা বলে ফেলা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই তিনি কল্পনাই করতে পারছেন না।
রঘুদা আর বিনয় বোসের মধ্যকার কথাবার্তা শুনে অনিমেষ চিন্তা করার শক্তিটাই যেন হারিয়ে ফেলেছে। যে কল্যাণ তাদের ঢাকায় আমার পর থেকেই তাদের দেখাশুনা করছে সেই হাসিখুশি মানুষটা কিভাবে এত বড় জঘণ্য কাজ করতে পারে? চন্দ্রশেখরবাবুর সাথে তার কিসের এত শত্র“তা? অনিমেষ কিছুই বুঝতে পারছে না।
দেবরঞ্জনবাবু চলে আসায় রঘুদা ও বিনয় বোস তাদের মধ্যকার গোপন কথাবার্তা ছেড়ে দিয়ে সাধারণ কথাবার্তায় আসলেন। বিনয় বোস রঘুদাকে বললেন, “আমার সাথে আর কোনো দরকার আছে রঘুবাবু?”
রঘুদা বললেন, “এই মূহুর্তে আর নেই। তবে যেদিন কেসের ফিনিশিং দেব আশা করছি আপনি থাকবেন।”
“সে আপনি না বললেনও আমি আসব। আফটার অল, চন্দ্রশেখরদা আমাদের কাশ্মীর গ্র“পের সভাপতি।”
তারপর দেবরঞ্জনবাবুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিনয় বোস চলে গেলেন।
বিনয় বোস চলে গেলে দেবরঞ্জনবাবু রঘুদাকে বললেন, “কী রঘুবাবু, বিনয়ের সাথে তো দুই মিনিটও কথা বললেন না। তাহলে ওকে ডাকার কী দরকার ছিল?”
“এই দুই মিনিটে যেটুকু বলেছি সেটুকু বলার জন্যই উনাকে ডেকেছিলাম।”
“আপনার কথাবার্তা বড় অদ্ভুত লাগছে মশাই। কিছুই আমার মাথায় ঢুকছে না।”
রঘুদা হাসলেনÑবললেন, “আমরা তাহলে এবার উঠি?”
“এখনই উঠবেন?”/
“হ্যাঁ, আর শুনুন, আপনার পরিচিত কোনো আর্টিস্ট আছে?”
“পরিচিত নেই তবে ম্যানেজ করে দিতে পারব।”
“আজকের ভেতরেই ম্যানেজ করে রাখুন। যেকোনো মুহুর্তে দরকার লাগতে পারে।”
“এটাও কী তদন্তের অংশ?”
“অবভিয়াসলি।” জোর গলায় বললেন রঘুদা।
দেবরঞ্জনবাবু বললেন, “কী বলছেন? একটা কেসের সাথে একজন আর্টিস্টের সম্পর্কÑ”
“আছে আছে, সবই বুঝতে পারবেন। বউদিকে আমার নমস্কার দিবেন। এবার আসছি। ”
দেবরঞ্জনবাবু কিছু না বুঝে মাথা চুলকাতে লাগলেন। রঘুদার অদ্ভুত সব কথাবার্তার সাথে অদ্ভুত এই চাহিদার কথা শুনে ভদ্রলোক যে পড়ে যান নি সেটাই সবচেয়ে বড় কথ

চলবে..........

লেখক
সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী, বাংলাদশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
ময়মনসিংহ ।

মন্তব্য ১ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (১) মন্তব্য লিখুন

১| ০২ রা মার্চ, ২০১৬ রাত ১১:৪৩

বিজন রয় বলেছেন: এক সঙ্গে এত লেখার দরকার কি?

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.