নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শুভঙ্করের ফাঁকি-২ (ডিটেকটিভ গল্প)

০৬ ই মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৩:৪৩


.......চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে এসে অনিমেষ একের পর এক প্রশ্নের বানে রঘুদাকে নিক্ষেপ করতে লাগল। সাধারণত রঘুদা যখন তাঁর কেসের তদন্তের ব্যাপারে অন্য কারো সাথে কথা বলেন তখন অনিমেষ সর্বাত্মক চেষ্টা করে চুপ থাকার। সে জানে, এসময় কথা বললে রঘুদার তদন্তে অসুবিধে হবে। তারপরও মাঝে মাঝে ভুল করে দু’একটা কথা মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়। কিন্তু তা মাঝে মাঝে, সবসময় নয়। অনিমেষ রঘুদাকে বলল, “রঘুদা আমি একটা বিষয় লক্ষ্য করছি, তুমি অন্যদিকে নজর দিতে দিতে আসল বিষয়টাই ভুলে যাচ্ছ।”
“আসল বিষয় মানে?”
“চন্দ্রশেখরবাবু যে খুনি সে বিষয়টা তুমি ভুলে যাচ্ছ।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ সত্যি, আমি আজ সকাল থেকেই দেখছি তুমি আসল খুনিকে রেখে আলতু ফালতু লোকজনকে সন্দেহ করছ। একটা বিষয় বুঝতে পারছ না কেন, পুলিশ তো প্রমাণ সহই চন্দ্রশেখরবাবুকে গ্রেফতার করেছে।”
“তা অবশ্য ভুল বলিস নি।”
“সত্যিই যদি ভুল না বলি তবে সবাইকে বলে দিচ্ছ না কেন, চন্দ্রশেখরবাবুই খুনি। আর পুলিশের সিদ্ধান্তই ঠিক।”
“বলব, বলব। তার আগে ঢাকা শহরটাকে একটু এনজয় করে নিই। ফ্রি থাকছি, ফ্রি খাচ্ছি আর নিজের পকেটের টাকা খরচ করে যদি একটু না বেড়াই তাহলে তো ঢাকায় আসাটাই বৃথা।”
“তুমি বেড়াবে?”
“হ্যাঁ, আর যে কয়দিন আছি প্রতিদিন বিকেলে একটু বেড়ানোর চেষ্টা করব।”
“আর যে কয়দিন আছি মানে? তুমি আর কয়দিন এখানে থাকবে?”
“কেন রে, ঢাকার প্রতি বিরক্তি ধরে গেছে?”
“বিরক্তির প্রশ্ন নয় রঘুদা। তুমি একটিবারও চন্দ্রশেখরবাবুর স্ত্রীর কথা ভাবছ না। আমি নিজের চোখে দেখেছি উনি একা একা বসে কাঁদেন। কিন্তু তোমার সামনে সবসময়ই হাসিমুখে থাকার চেষ্টা করেন যাতে তুমি আনন্দের সাথে তদন্তের কাজটা করতে পারো। আর তুমি উনাকে একটা মানসিক চাপে রেখে এভাবে এনজয় করতে পারো না।”
“আমি তোকে একটা কথা বলি অনিমেষ। তোর মতো নরম মন নিয়ে আমি গোয়েন্দা হইনি। স্ত্রীলোকের অশ্র“ দেখে গলে যাব সেরকম মানুষ আমি মোটেই নই। আমি আমার মতো চলছি আর আমার মতোই চলব।”
অনিমেষ রঘুদার সাথে আর কোনো তর্ক করল না। আর করেও কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না। তাই অনিমেষ রঘুদার প্রতি কিছুটা বিরক্ত হয়েই বসে রইল।
দুপুরের দিকে কামনাদেবী রঘুদার ঘরে একবার আসলেন। ভদ্রমহিলার চেহারাটা একটু বিষণœ দেখাচ্ছে। তারপরেও বিষণœ মুখে হাসি ফুটিয়ে তিনি রঘুদাকে বললেন, “রঘুবাবু আপনাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না তো।”
“না, না, অসুবিধের তো প্রশ্নই আসে না। আমরা বেশ আরামে আছি।” বললেন রঘুদা।
“তো দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে কী কথা হল?”
“তেমন কিছু নয়। কিছু গল্পগুজব করলাম আর উনার একটা ছবির অ্যালবামও দেখলাম।”
“হ্যাঁ, উনার বাড়িতে কোনো অতিথি গেলেই উনি সেটা দেখান। নিজের পুরনো স্মৃতিগুলো সংরক্ষণ করে রাখা উনার এক প্রকার হবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
“আচ্ছা আপনাকে একটা কথা বলে নিই” বললেন রঘুদা, “আমি আর অনিমেষ আজ বিকেলেই একটু বেরুতে পারি। সারাদিন এই ঘরে পুরো একঘেয়ে লাগে।”
কামনাদেবী বললেন, “রঘুবাবু আমাকে ওসব বলার কোনো দরকার নেই। আপনার যখন ইচ্ছে যাবেন, যখন ইচ্ছে আসবেন। কোনো অসুবিধে নেই।”
বিকেল ৪টায় রঘুদা অনিমেষকে নিয়ে ধানমণ্ডির দিকে রওয়ানা দিলেন। অনিমেষের অবশ্য যাবার কোনো ইচ্ছে ছিল না। রঘুদার প্রতি সে এখনো বিরক্ত। তারপরেও রঘুদা তাকে জোর করে নিয়ে চললেন। রঘুদার ইচ্ছে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের সেই ঐতিহাসিক বাড়িটা একবার দেখে আসবেন। যেখানে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। অনিমেষেরও যে ইচ্ছে নেই সেটা কিন্তু বলা যাবেনা। তবে রঘুদার শক্ত শক্ত কথা মাঝে মধ্যে সে সিরিয়াসলি নিয়ে নেয়। এখানেই সমস্যা। তাই ধানমণ্ডি যাওয়ার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও অনিমেষ তা প্রকাশ করতে পারছে না।
গুলশান-১ এর স্পেক্ট্রা কনভেনশন সেন্টারের সামনে আসতেই তারা একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেলেন। সেই ট্যক্সিতে উঠতে যাবেন তক্ষুণি হঠাৎ একটা লোক রঘুদা ও অনিমেষের পেছন থেকে এসে “ঠাস ঠাস” শব্দে ভারী কিছু একটা দিয়ে তাদের মাথায় জোরে সোরে একটা বাড়ি দিল। তারা দু’জনে সাথে সাথেই অজ্ঞান হয়ে রাস্তার একপাশে পড়ে রইলেন। আর ট্যাক্সি ড্রাইভার মুহূর্তের মধ্যে তার ট্যাক্সি নিয়ে উধাও হয়ে গেল। এই অপরিচিত জায়গায় রঘুদার উপর এরকম সন্ত্রাসী হামলা একেবারেই অনাকাক্সিক্ষত। কিন্তু কে এই আক্রমণ চালাল?
আক্রমণকারী রঘুদার পকেট থেকে কোনো টাকা পয়সাও নেয় নি। তাহলে এই আক্রমণের উদ্দেশ্য কী?
অনিমেষ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ার আগে লোকটার পেছন সাইড দেখতে পেয়েছিল। মনে হচ্ছিল চন্দ্রশেখরবাবুর সেই কাজের লোক কল্যাণ! বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করার আগেই অনিমেষ অজ্ঞান হয়ে পড়ে। রঘুদা লোকটাকে দেখেছেন কি না অনিমেষ তা বুঝতে পারেনি।

জ্ঞান ফিরলে অনিমেষ দেখল সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। রঘুদা তার পাশে দাঁড়িয়ে। রঘুদার পেছনে একজন ডাক্তার দেবরঞ্জনবাবু, বিনয় বোস, কামনাদেবী, উনার মেয়ে সুবর্ণা মিত্র, কল্যাণ, একজন পুলিশ ইন্সপেক্টরও রয়েছেন। কল্যাণকে দেখেই অনিমেষ চোখ লাল করে একবার তার দিকে তাকাল। কিন্তু কল্যাণ এরকম তাকানোর কোনো অর্থই বুঝতে পারেনি।
অনিমেষ এখন মোটামুটি নিশ্চিত, রঘুদা বিনয় বোসকে যে গোপন কথাটা বলেছিলেন সেটাই পুরোপুরি সত্য। চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসানোর জন্য কল্যাণই দায়ী। কল্যাণই খুন করেছে শুভঙ্করবাবুকে! আর কৌশলে সেই খুনের দায় চাপিয়ে দিয়েছে চন্দ্রশেখরবাবুর উপর।
অনিমেষ অবশ্য কল্যাণকে কিছু বলছে না। আর বলার মতো অবস্থাও এখন নেই। তাছাড়া তার মাথায়ও একটা ব্যান্ডেজ বাধা, মাথাটা খুব ভারী ভারী লাগছে।
রঘুদার মাথায় ব্যান্ডেজ থাকলেও তিনি এখন স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারছেন। কিন্তু তারা দু’জন হাসপাতালে আসলেন কিভাবে? সেটাই তো ভাবছেন, তাই না? বলছি।
অনিমেষের মাথায় আঘাত করার পর অনিমেষ সত্যি সত্যি অজ্ঞান হয়ে গেলেও রঘুদা কিন্তু অজ্ঞান হওয়ার ভান করছিলেন। রঘুদা মাথায় খুব চোট পেয়েছেন বটে, কিন্তু দাঁতে দাঁত চেপে হাজারো যন্ত্রণা সহ্য করে আঘাতকারী লোকটাকে ফলো করছিলেন। লোকটা চলে গেলে রঘুদাই অনিমেষকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন এবং কামনাদেবীকে ফোন করে সবকিছু জানান।
তারপর দেবরঞ্জনবাবুসহ অন্যান্যদের নিয়ে কামনাদেবী হাসাপাতালে আসেন। দেবরঞ্জনবাবু গুলশান থানায় ফোন করলে গুলশান থানার ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মাও হাসপাতালে এসে উপস্থিত হন। চন্দ্রশেখরবাবুকে গ্রেফতার করলেও শীর্ষেন্দু শর্মার প্রতি দেবরঞ্জনবাবুর কোনো আক্রোশ কিংবা ক্ষোভ কিছুই নেই। তিনি মনে করছেন, পুলিশ পুলিশের কাজই করেছে। এখন চন্দ্রশেখরবাবু সত্যিই খুনি কি না সেটা আগে রঘুদার তদন্তে প্রমাণিত হোক। সেটার উপরই নির্ভর করছে কাশ্মীর গ্র“পের সাথে পুলিশের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের সম্পর্ক। যেহেতু রঘুদা এখনো তদন্তের ব্যাপারে চূড়ান্ত কিছু জানান নি, সেহেতু কোনো কারণ ছাড়া শীর্ষেন্দু শর্মার প্রতি একটা অবিশ্বাসের সম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো মানেই হয় না।
হাসপাতালে এসে ইতোমধ্যে ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মাও জেনে গেছেন রঘুদা পেশায় একজন প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। আর চন্দ্রশেখরবাবুর ভাড়াটে শুভঙ্কর দত্তের খুন হওয়ার বিষয়টি তিনি তদন্ত করছেন। শীর্ষেন্দু শর্মা রঘুদাকে বললেন, “আপনি কতদূর এগুলেন রঘুবাবু?”
“সবকিছু এখন আমার কাছে পরিষ্কার। আপনি কাল ফ্রি আছেন?” শীর্ষেন্দু শর্মাকে জিজ্ঞেস করলেন রঘুদা।
“হ্যাঁ, আছি।”
“তাহলে সকালের দিকে একবার চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে চলে আসবেন। তখন তদন্তের ফলাফল জানতে পারবেন।”
শীর্ষেন্দু শর্মা হ্যাঁ সূচক ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনি কী মনে করেন আপনাদের উপর এই হামলাটা কেসের সাথে রিলেটেড?”
“এক রকম সেটাই মনে করছি।”
ঠিক এই সময় রঘুদার দৃষ্টি গেল অনিমেষের দিকে। অনিমেষ চোখ খোলার পর এখন আস্তে আস্তে কথা বলার চেষ্টা করছে। সে রঘুদাকে ডাকল, “রঘুদা!”
রঘুদা অনিমেষের কাছে আসলেন, “অনিমেষ, কেমন লাগছে?”
“মাথাটা একটু ভারী ভারী লাগছে রঘুদা।” কাঁপা কাঁপা গলায় বলল অনিমেষ।
অনিমেষ এবার উঠে বসতে চাইল। কিন্তু ডাক্তারবাবু তাকে বাধা দিয়ে বললেন, “না না অনিমেষ, এখন উঠলে চলবে না। আপাতত কয়েক ঘন্টা তোমাকে শুয়েই থাকতে হবে।”
অনিমেষ আর উঠার চেষ্টা করল না। সে শুয়ে পড়ল। রঘুদা তার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন।
“ভাবিস না অনিমেষ, সব ঠিক হয়ে যাবে।” অনিমেষকে সান্তনা দিয়ে বললেন রঘুদা।
রঘুদার কথা মনে হয় অনিমেষ শুনতে পায়নি। সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে যেতে থাকে। ডাক্তারবাবু রঘুদাকে বললেন, “ওকে একটু ঘুমুতে দিন। ঘণ্টা চারেক পর আশা করছি বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবেন। সেখানে ওর প্রতি আলাদা কেয়ার নিতে হবে কিন্তু।”
দেবরঞ্জনবাবু, বিনয় বোস, কামনাদেবীসহ মোটামুটি অন্যান্যরা এই চার ঘন্টা সময় রঘুদার সাথেই হাসপাতালে থাকলেন। থাকলেন না শুধু ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মা। উনার কী একটা কাজ থাকার কারণে চলে গেলেন।
ঘন্টা চারেক পর ডাক্তারবাবু একটা প্রেসক্রিপশনে কিছু ঔষুধ লিখে রঘুদার হাতে দিয়ে বললেন, “এই ঔষুধগুলো আপাতত ওকে খেতে দিবেন। আর আপনার জন্য এই মুহুর্তে তেমন কোনো ঔষধ দিচ্ছি না। শুধুমাত্র এই প্রেসক্রিপশনের শেষের ঔষধটা তিনবেলা খেলেই হবে।”
রঘুদা সবকিছু বুঝে নিলেন।


৬....
চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে আসার পর অনিমেষকে মোটামুটি স্বাভাবিক লাগছে। তাকে অসুস্থ বুঝা যায় শুধুমাত্র তার মাথার ব্যান্ডেজ দেখে। অন্যথায় সে আস্তে আস্তে হাঁটতে পারছে, কথা বলছে অনেকটা আগের মতোই। গলায় কোনো কাঁপা কাঁপা ভাবও নেই।
এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় কামনাদেবী বারবার রঘুদার কাছে দুঃখ প্রকাশ করছেন। ভদ্রমহিলা নিজেকেই এর জন্য অনেকটা দায়ী করছেন। উনার বক্তব্য-উনি যদি রঘুদাকে এখানে আসার জন্য জোর না করতেন তাহলে কখনোই এরকম ঘটনা ঘটত না। রঘুদা বললেন, “দেখুন যা ঘটার তা ঘটে গেছে। এখন তার জন্য তো আর আক্ষেপ করে লাভ নেই।”
“আক্ষেপের প্রশ্ন নয় রঘুবাবু। আমি বলছি অনিমেষের মতো একটা ছেলের উপর এ ধরণের হামলা আসল কেন?”
“হামলা অনিমেষের উপর আসেনি, এসেছিল আমার উপর। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনিমেষ আমার থেকে অনেক বেশি আঘাত পেয়েছে। যেটা আমি হাসপাতালে শীর্ষেন্দু শর্মাকে বলেছিলাম সেটা এখন আপনাকেও বলছি- আমার আর অনিমেষের উপর হামলা এই কেসের সাথে রিলেটেড।”
“কিন্তু কে এই হামলা চালাল?”
“কে চালিয়েছে সেটা আমি কাল সকালের আগে কাউকে বলতে চাচ্ছি না। তবে মনে রাখুন এটা আমাদের মারার জন্য করা হয় নি। আমাদের সন্দেহের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানোর জন্যই এই হামলা করা হয়েছে।”
“সাবধানে থাকবেন রঘুবাবু। আর অনিমেষ, তোমার যা যা দরকার কল্যাণকে বলো। কেমন?”
অনিমেষ তখন বিছানায় ছিল। কল্যাণের নামটা শুনেই তার মাথাটা গরম হতে লাগল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে সে হাসিমুখে জবাব দিল, “আচ্ছা বলব।”
রাতে ঘুমানোর পূর্বে রঘুদার সাথে অনিমেষের কিছু কথা হল। অনিমেষ রঘুদাকে বলল, “রঘুদা আমি কিন্তু একশ পার্সেন্ট নিশ্চিত, কল্যাণই চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসিয়েছে।”
অনিমেষের কথায় রঘুদা খানিকটা অবাক হলেন-বললেন, “কী বলছিস! তুই তো সকালেই বলছিলি চন্দ্রশেখরবাবুই আসল খুনি। আমাকে তাগদাও দিচ্ছিলি আমি কেন সেটা সবাইকে বলছি না। আর এখন তুই-ই বলছিস কল্যাণ চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসিয়েছে?”
“হ্যাঁ বলছি” বলল অনিমেষ, “কারণ আমি এখন সবকিছু জেনে গেছি।”
“কী জানলি তুই?”
“যে লোকটা আমাদের মেরেছে তাকে আমি একটু হলেও দেখতে পেরেছিলাম।”
“চিনতে পারলি?”
“পুরোপুরি পারিনি। আমি শুধু পেছনটা দেখেছি। আন্দাজ করতে অসুবিধা হয়নি যে, ঐ লোকটাই এই বাড়ির কাজের লোক কল্যাণ। অর্থাৎ বিনয় বোসকে তুমি কথাটা বলেছিলে সেটাই ঠিক।”
“হু........” বললেন রঘুদা, “লোকটাকে আমিও কিছুটা চিনেছি, কিন্তু.......”
“কিন্তু কী?”
“না, কিছু না। তবে আমার সন্দেহটা এবার দেবরঞ্জনবাবুর উপর।”
“কেন? উনি তো খুব ভালো মানুষ। কাশ্মীর গ্র“পের স্বার্থে উনি তো সভাপতির পদটাও নেবেন না বলেছেন।”
“সেটাই তো প্রশ্ন। মানুষ কী এত ভালো হয়? আমার মনে হচ্ছে উনি একদম ভালো নন, ভালো সাজার চেষ্টা করছেন।”
“কী বলছ?”
“ঠিকই বলেছি। কথায় বলে না, অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ। তেমনি খুব বেশি ভালো থাকাটাও খারাপের লক্ষণ।”
“কিন্তু রঘুদা কল্যাণকে তোÑ”
“আর কোনো কিন্তু নয়। শুয়ে পড়।” বলে রঘুদা অনিমেষকে ঘুমানোর আদেশ দিলেন।
রঘুদার আদেশ ছাড়াই অনিমেষ ঘুমিয়ে পড়ত, যদিনা এই কথাবার্তাগুলো হত। এই একটুক্ষণ আগেই ঘুমে তার চোখ দুটো অবশ হয়ে আসছিল। তারপরেও শুধুমাত্র নিজের মনের প্রশ্নের ক্ষুধা মেটাতে অনিমেষ তার চোখ দুটোকে সজাগ রেখে রঘুদার সাথে এতক্ষণ কথা বলল।
অন্যদিকে কামনাদেবীর মেয়ে সুবর্ণা মিত্র কামনাদেবীর কাছে অভিযোগ করছে, “মা, আমাকে আমার স্কুলের বন্ধুরা যখন বাবার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে তখন আমার খুব খারাপ লাগে। আজ দেখলাম আমার দু’জন বন্ধু নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে আমার বাবা নাকি খুনি!” বলে সুবর্ণা কাঁদতে শুরু করে দেয়।
কামনাদেবী তাকে সান্তনা দিয়ে বললেন, “কাঁদিস না মা, কাল দেখবি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস তোর বাবা নির্দোষ, সম্পূর্ণ নির্দোষ। হে ভগবান তুমি জানো।”
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মানুষ কুপথে গেলে তার ফ্যামিলির লোকদের জানিয়ে যায় না। সেটা হয় ফ্যামিলির অগোচরে। আর সেই পথে একটা পজিশনে চলে গেলে সমাজ তথা ফ্যামিলির নজরে তা আসে। তখন করার মতোও কিছু থাকে না। কামনাদেবী উনার বিবাহিত জীবনে হয়তো চন্দ্রশেখরবাবুকে অনেক বিশ্বাস করেছেন। কিন্তু উনাকে না জানিয়ে একটা কিলার গ্র“পের সাথে যুক্ত হয়ে যাওয়া তো কয়েক মিনিটের ব্যাপার। হতে পারে চন্দ্রশেখরবাবু সেরকম একটা পজিশনে যাওয়ার আগেই শ্রীঘরে চলে গেছেন। তাই বলে চন্দ্রশেখরবাবুর উপর কামনাদেবীর বিশ্বাসকে পুঁজি করে সত্য বিষয়টা কিন্তু ফুটে উঠছে না। তা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
রঘুদার তদন্তে আগামীকাল কী ফলাফল দাঁড়াবে সেটা নিয়ে চিন্তিত দেবরঞ্জনবাবুও। চন্দ্রশেখরবাবুর যদি সত্যিই দোষী প্রমাণিত হন তা হলে কাশ্মীর গ্র“পের ভার বিনয় বোসের হাতে দেওয়া যাবে ঠিকই, কিন্তু সে এই গ্র“পকে কতদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে সেটা একটা সন্দেহের বিষয়। বিনয় বোস কাশ্মীর গ্র“পে খুব জনপ্রিয় এ বিষয়ে দেবরঞ্জনবাবুর কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু একটা রাজনৈতিক গ্র“প চালাতে যে সুতীক্ষè বুদ্ধি, সেই সাথে ধৈর্যের প্রয়োজন তা বিনয় বোসের মধ্যে অনেকখানি অনুপস্থিত।
বিনয় বোস কী ভাবছেন কে জানে। তবে তিনি যে কাশ্মীর গ্র“পের অমঙ্গল কখনোই কামনা করবেন না একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
রাতে ঘুমানোর পূর্বে রঘুদা দেবরঞ্জনবাবুকে ফোন করলেন।
“হ্যাঁলো।”
“হ্যাঁ রঘুবাবু, বলুন।”
“আপনাকে যে একজন আর্টিস্টের কথা বলেছিলাম সেটা মনে আছে তো?”
“হ্যাঁ, আমি অলরেডি একজনকে ম্যানেজ করে ফেলেছি।”
“খুব ভালো হয়েছে। উনাকে বলবেন, উনি যেন কাল সকালে আর্টের সরঞ্জাম নিয়ে চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে চলে আসেন।”
“উনাকে কী সেখানে কোনো ছবি আঁকতে হবে?”
“তা তো অবশ্যই। নইলে এই কেসে আর্টিস্টের তো প্রয়োজনই ছিল না।”
“আপনি চিন্তা করবেন না রঘুবাবু। আমি আসার সময়ই উনাকে নিয়ে আসব।”


৭....

পরদিন সকালে একে একে সবাই আসতে শুরু করলেন। প্রথমে আসলেন দেবরঞ্জনবাবু। দেবরঞ্জনবাবুর সাথে একজন আর্টিস্ট। সচরাচর আমরা যেরকম আর্টিস্টের চেহারা কল্পনা করি উনিই মোটেই সেরকম নন। একটু স্টাইলিশ, তেমন বয়স্কও নন, মাথার চুলগুলো সুন্দর করে আঁচরানো, মুখে ছাপ দাঁড়ি। আর্টিস্টের হাতে ছবি আঁকার সরঞ্জামও রয়েছে।
দেবরঞ্জনবাবুর আসার খবর পেয়ে রঘুদাও অনিমেষকে নিয়ে ড্রয়িংরুমে চলে আসলেন। অনিমেষ এখন অনেকটাই সুস্থ। তার মাথার ভারী ভারী ভাবটা পুরোপুরিই চলে গেছে। মাথায় অবশ্য এখনো ব্যান্ডেজ রয়েছে। সেটা অন্তত তিন-চার দিন আগে খোলা যাবে না। রঘুদার ব্যান্ডেজের ক্ষেত্রেও তাই।
রঘুদা ও অনিমেষ আসার পর আসলেন বিনয় বোস, বিনয় বোসের পর দু’জন কনস্টেবল সমেত ইন্সপক্টের শীর্ষেন্দু শর্মা। শীর্ষেন্দু শর্মা এসেই একগাল হেসে রঘুদাকে বললেন, ‘‘জানেন তো রঘুবাবু, এই পুলিশ মহলকে সবসময়ই উভয় সঙ্কটে থাকতে হয়।’’
‘‘কেন?’’ জিজ্ঞেস করলেন রঘুদা।
‘‘এই চন্দ্রশেখরবাবুর কথাই ধরুন না, আমরা যদি এই এলাকার কাউন্সিলর বিবেচনা করে উনাকে গ্রেফতার না করতাম তাহলে পুলিশ মহলকে পাবলিকের তুমুল সমালোচনা সইতে হত। আমরা ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, সরকারের দালাল ইত্যাদি। আর গ্রেফতার করার ফলে আপনার মতো গোয়েন্দার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।”
“তা অবশ্য ভুল বলেননি। তবে আপনি যে উভয় সঙ্কটের কথা বললেন সেটা একদম ঘটত না যদি আপনারা খুনের আসল মোটিভটা বের করতে সক্ষম হতেন। আমি দেখেছি অনেক ক্ষেত্রেই পুলিশ মহল সত্য জিনিসটা মিসিং করে ফেলে।’’
রঘুদা আর ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মার এই কথাবার্তার মধ্যেই চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়ির লোকেরা ড্রয়িং রুমে এসে হাজির হলেন।
রঘুদা এবারে তাঁর পকেট থেকে একটা ব্লেড বের করে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘আমার হাতে একটা ব্লেড রয়েছে। এটা দিয়ে যদি আমার হাতের উপর চাপ দেই তাহলে অবশ্যই রক্ত বেরুবে। তাই না?’’ বলে রঘুদা সত্যিসত্যিই ব্লেডটা নিজের হাতের উপর বসিয়ে দিলেন। মুহূর্তের মধ্যে সেখান থেকে রক্ত বেরিয়ে আসল। বেরিয়ে আসা রক্ত হাত বেয়ে ফ্লোরেও ছড়িয়ে পড়ছে।
রঘুদা যে তাঁর কথার শুরুতেই এরকম একটা কান্ড ঘটিয়ে ফেলবেন সেটা কেউ-ই ভাবতে পারে নি। শুধু তাই নয়, যে অনিমেষ রঘুদার সাথে সবসময় থাকে এটা তাকেও অবাক করে দিয়েছে। সে বলল, ‘‘রঘুদা, এটা কী করলে!’’
কামনাদেবীও বসা থেকে উঠে পড়লেন রঘুদার হাতে কিছু লাগিয়ে দেবার জন্য। কিন্তু রঘুদা হাত উঁচিয়ে বললেন, ‘‘কেউ উঠবেন না প্লিজ। স্রেফ দেখে যান।’’
রঘুদা তাঁর প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে হাতটা বেঁধে নিলেন। তারপর ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘ধরুন এই ঘরে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। আমার হাত থেকে কোনো একটা কারণে কিছু রক্ত পড়ল। রক্ত পড়ার পর এই রক্তটা রেখেই আমি এই ঘর ছেড়ে চলে গেলাম। তারপর হঠাৎ আপনি আসলেন। দেখলেন, ঘরে আমি নেই, ফ্লোরে এই রক্ত। তখন এটাকে কিভাবে নেবেন?’’
‘‘এটাকে তোÑ’’
‘‘খুন হিসেবেই নেবেন। তাই না?’’
‘‘হ্যাঁ, কিন্তুÑ’’
‘‘কিন্তু আমাকে তো আসলে কেউ খুনই করেনি।’’
‘‘আপনি কী বলতে চাচ্ছেন এর সাথে চন্দ্রশেখরবাবুর ভাড়াটে শুভঙ্করবাবুর মিল আছে?’’
‘‘ইগজ্যাক্টলি, এইতো আপনি আসল বিষয়টা বুঝে গেলেন।’’
‘‘তার মানে শুভঙ্করবাবু ইজ নট মার্র্ডাড?’’
‘‘ইয়েস, শুভঙ্করবাবু ইজ নট মার্র্ডাড।’’
কথাটা শুনে সকলেই চমকে উঠলেন। এটা কিভাবে সম্ভব? যেখানে একজন মানুষকে খুন করার অভিযোগে চন্দ্রশেখরবাবুকে গ্রেফতার করা হয়েছে, সেখানে তাহলে খুনই হয়নি!
রঘুদা বললেন, ‘‘কথাটা সবার কাছে একটু অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু আপনারা নিশ্চিত থাকুন, চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে কোনো খুন হয়নি।’’ বলে রঘুদা তাঁর শার্টের পকেট থেকে শুভঙ্করবাবুর ছবিটা বের করলেন। তারপর বললেন, ‘‘এই হচ্ছে সেই ভাড়াটে শুভঙ্কর দত্তের ছবি। আমি আর্টিস্ট মশাইকে এই ছবিটা দাঁড়ি গোঁফ ছাড়া আঁকার জন্য অনুরোধ করছি।’’
আর্টিস্ট রঘুদার হাত থেকে ছবিটা নিয়ে আলাদা একটা পেইজে আঁকতে শুরু করলেন।
ঘরের ভেতর উপস্থিত সবাই নীরব হয়ে বসে রয়েছেন। কামনাদেবী ও সুবর্ণা মিত্রের মুখে একটু স্বস্তির ভাব দেখা যাচ্ছে। যেহেতু রঘুদা একটু আভাস দিয়ে দিয়েছেন যে, এই বাড়িতে কোনো খুন হয়নি সেহেতু চন্দ্রশেখরবাবু নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেকখানি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে।
অনিমেষ রঘুদাকে গতকাল রাতেই একশো পার্সেন্ট নিশ্চয়তা দিয়ে বলেছিল এ বাড়ির কাজের লোক কল্যাণই চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসিয়েছে।
কিন্তু রঘুদা ‘‘খুন হয়নি’’ কথাটা বলে অনিমেষের চিন্তায় অনেকখানি ফাঁটল ধরিয়ে দিয়েছেন। রঘুদার কথামতো সত্যিই যদি কোনো খুন না হয়ে থাকে তাহলে রঘুদা ও অনিমেষের উপর হামলা ঘটল কেন? আর রঘুদা তো নিজের মুখেই বলেছিলেন, হামলাটা তদন্তের সাথে জড়িত। এই বিষয়টা বিবেচনা করে অনিমেষ এখনো আত্মবিশ্বাসী, কল্যাণই চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসিয়েছে।
দাঁড়ি গোঁফহীন শুভঙ্করবাবুর ছবি আঁকতে আর্টিস্টের বিশ মিনিটের মতো লাগল। আঁকা ছবিটা দেখে ঘরে উপস্থিত সবাই হতবাক বনে গেল। এ যে কাশ্মীর গ্র“পের সাংগঠনিক সম্পাদক বিনয় বোস!
বিনয় বোস ছবিটা দেখেই দৌঁড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রঘুদা ‘‘অ্যারেস্ট হিম’’ বলে চিৎকার দিতেই কনস্টেবল দু’জন বিনয় বোসকে ধরে ফেলল। শীর্ষেন্দু শর্মা বললেন, ‘‘তাহলে রঘুবাবু যেটা দাঁড়াচ্ছে এই বিনয় বোসই শুভঙ্কর দত্ত সেজে এ বাড়িতে উঠেছিল। কিন্তু কেন?’’
‘‘বলছি’’ বললেন রঘুদা, ‘‘আমি যখন তদন্ত করতে আসি তখন এ বাড়ির ভাড়াটে শুভঙ্কর দত্ত ওরফে বিনয় বোস সম্পর্কে অদ্ভুত কিছু তথ্য আমি লক্ষ্য করি। প্রথমত তিনি এ বাড়িতে একা থাকতেন। কিন্তু একজন মানুষের থাকার জন্য দুইটা বেড রুমের কী প্রয়োজন? উনি চাইলে তো অন্য কোথাও সিঙ্গেল রুমে থাকতে পারতেন। এই বিষয়ে চন্দ্রশেখরবাবুর স্ত্রী কামনাদেবী বলেন, ‘শুভঙ্করবাবুর ভাব-টাব দেখে উনার মনে হচ্ছিল, প্রয়োজনে ডাবল ভাড়া দিবেন কিন্তু এ বাড়িতেই থাকবেন।’
‘‘এ থেকে আমি সহজেই অনুমান করতে পারি এই বাড়িতে থাকার চেয়ে এই বাড়িটাই উনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল । কিন্তু কেন? এই বাড়িটাকে ব্যবহার করে তিনি কার ক্ষতি করার চেষ্টা করছেন? উত্তরটা অতি সহজ-চন্দ্রশেখরবাবু।’’
দেবরঞ্জনবাবু এতক্ষণ রাগে ফুঁসফুঁস করছিলেন। তিনি বিনয় বোসকে বললেন “বিনয়, তুমি এই কাজ করতে পারলে? কাশ্মীর গ্র“পের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়ে এই কাজ করতে তোমার বিবেকে বাঁধলো না?’’
বিনয় বোস কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। রঘুদা দেবরঞ্জনবাবুকে বললেন, ‘‘এই মুহুর্তে আপনার বিনয় বোসের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারবেন না। কারণ বলার মতো মুখ উনার আর নেই। আপনি বলছিলেন না বিনয় বোস কাশ্মীর গ্র“পে খুব জনপ্রিয়। এখন আমি বলব, বিনয় বোস কাশ্মীর গ্র“পের একজন কলঙ্কিত নেতা! কাশ্মীর গ্র“পের অভিশাপ!’’
দুই থেকে তিন সেকেন্ড স্পেস দিয়ে রঘুদা বললেন, ‘‘আপাতত মূল ঘটনায় যাচ্ছি। বিনয় বোস ওরফে শুভঙ্কর দত্ত শতদল কোম্পানিতে চাকরি করেন বলে এ বাড়ির সবাইকে বলেছিলেন। কিন্তু কামনাদেবী দেবরঞ্জনবাবুকে দিয়ে শতদল কোম্পানিতে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন সেখানে শুভঙ্কর দত্ত নামে কোনো ব্যক্তি কাজ করেন না, এমনকি আগেও করতেন না। এসব বিষয় জানার পর সবার চোখে মৃত এই ব্যক্তিটি আমার সন্দেহের তালিকায় চলে আসেন।
‘‘তাছাড়া বিনয় বোস চেহারা পাল্টিয়ে শুভঙ্কর দত্ত সেজে সবার চোখে ধুলা দিলেও আমার চোখে কিন্তু পারেন নি। আমি উনার ছবিটা পেয়েই দাঁড়ি গোঁফহীন চেহারাটা একবার কল্পনা করে নিই। তারপর দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে গিয়ে উনার ছবির অ্যালবামে যখন বিনয় বোসের ছবিটা দেখি তখন আর বুঝতে বাকি রইল না এই বিনয় বোসই শুভঙ্কর দত্ত সেজে চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়িতে ঘাপটি মেরেছিল। বিষয়টা আরো পরিস্কার হলো, যখন দেবরঞ্জনবাবু বললেন বিনয় বোস গত দু’মাস ধরে উনার এক আত্মীয়ের চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে রয়েছেন। অন্যদিকে কামনাদেবীর সাথে কথা বলে আমি জানতে পারি শুভঙ্কর দত্ত এ বাড়িতে (মৃত্যুর আগ পর্যন্ত!) দু’মাস থেকেছেন। এই ‘‘দু’ মাস’’ শব্দটাকে গুরুত্ব দিলে অতি সহজেই বুঝা যায় বিনয় বোসই চন্দ্রশেখরবাবুর ভাড়াটে শুভঙ্কর দত্ত। অর্থাৎ বিনয় বোসের সিঙ্গাপুর হচ্ছে চন্দ্রশেখরবাবুর বাড়ি!
‘‘তবে এজন্য আমি চন্দ্রশেখরবাবুর মেয়ে সুবর্ণা মিত্রকে একটা থ্যাংক্স দিতে চাই। তদন্তের সময় শুভঙ্কর দত্তের ছবিটা আমার খুব দরকার ছিল। কিন্তু উনি খুব কৌশলে এগুচ্ছিলেন বলে এ বাড়ির কারো কাছে উনার কোনো ছবি পাইনি। তবে এই মেয়েটা শুভঙ্কর দত্তের অজান্তেই ছবিটা তুলেছিল। যার কারণে বিনয় বোসকে সনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।’’
‘‘সে না হয় বুঝলাম’’ বললেন ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মা, ‘‘তবে চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসানোর ব্যাপারটা যদি একটু ক্লিয়ার করতেন।’’
রঘুদা বললেন, ‘‘বিনয় বোস এ বাড়িতে আসার পরই চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসাতে পারতেন। কিন্তু আমি একটু আগেই বলেছি উনি খুব কৌশলে এগুচ্ছিলেন। চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসানোর পরেও সন্দেহের তীর যাতে উনার দিকে না যায় সেজন্য তিনি নিজেকে ভাড়াটে হিসেবে সকলের কাছে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেন এবং সফলও হন। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৪ তারিখ রাতে তিনি তার ফাইনাল খেলাটা খেলেন।
‘‘ প্রথমে চন্দ্রশেখরবাবুকে পার্সোনাল কথা আছে বলে নিজের ঘরে নিয়ে যান। চন্দ্রশেখরবাবু একদম বুঝতে পারেন নি এই পার্সোনাল কথার পেছনে অনেক বড় একটা খেলা লুকিয়ে ছিল। তিনি সরল মনে বিনয় বোস ওরফে শুভঙ্কর দত্তের ঘরে যান। সেখানে চন্দ্রশেখরবাবু ও শুভঙ্কর দত্তের কথোপকথন অতি সহজেই পাশের ঘরের ভাড়াটেরা শুনতে পেয়েছিল। কথোপকথনের বিষয়বস্তু ছিল শুভঙ্কর দত্ত এই মাসেই বাড়িটা ছেড়ে দিবেন। কিন্তু এই কথাটা বলা শুভঙ্কর দত্তের মূল উদ্দেশ্য ছিল না। মূল উদ্দেশ্য ছিল চন্দ্রশেখরবাবুকে তার ঘরে এসেছেন সেটা অন্যসব ভাড়াটেদের নজরে আনা।
‘‘চন্দ্রশেখরবাবু চলে গেলে শুভঙ্কর দত্ত হাত কেটে রক্ত বের করে তা ফ্লোরে ছড়িয়ে দেন। অতঃপর এই বাড়ি থেকে গোপনে পালিয়ে যান। যেটাকে আপনারা সবাই খুন হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। আর সাক্ষী হিসেবে ছিল ঐ ভাড়াটেরা। তাই আপাত দৃষ্টিতে চন্দ্রশেখরবাবুকে খুনি ভাবাটা অতি সহজ ছিল। যদিও এখানে কোনো খুন হয়নি।’’ বলে রঘুদা বিনয় বোসের দিকে এগিয়ে গেলেন।
বিনয় বোস আজও ফুল হাতা শার্ট পড়েছেন। রঘুদা আচমকা শার্টের হাতা দুটো উপরে তুলতেই দেখা গেল বিনয় বোসের বাম হাতটা অনেকখানি ব্যান্ডেজ করা!
রঘুদা ব্যান্ডেজটা দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই হাত কেটেই সেদিন বিনয় বোস রক্ত বের করেছিলেন।’’
সবাই অবাক দৃষ্টিতে হাতটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এমন সময় ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মা রঘুদাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তাহলে আপনাদের উপর গতকাল যে হামলা হয়েছিল তার অর্থ কী দাঁড়াচ্ছে?’’
রঘুদা বললেন, ‘‘বিনয় বোসের সাথে আমার দেখা হয় দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে। উনার ছবিটা সনাক্ত করার পর মূলত দেবরঞ্জনবাবুকে দিয়ে আমিই উনাকে দেবরঞ্জনবাবুর বাড়িতে ডেকেছিলাম। উনি আমাকে টেক্কা দিতে যাতে নতুন কোনো খেলা খেলতে না পারেন সেজন্য উনাকে একটু গোপনে বলেছিলাম চন্দ্রশেখরবাবুর কাজের লোক কল্যাণকেই আমার সন্দেহ হচ্ছে। কিন্তু আমার এই সন্দেহটাকে আরো গাঢ় করার জন্য তিনি কল্যাণের মতো সাজিয়ে একটা ভাড়াটে গুণ্ডাকে পাঠান আমার উপর হামলা করার জন্য। যাতে আমি বুঝতে পারি কল্যাণ নিজে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে আমাকে মেরেছে। তবে আমাকে নিহত করার উদ্দেশ্যে কিন্তু বিনয় বোস ঐ গুণ্ডাকে পাঠান নি। পাঠিয়েছিলেন আহত করার জন্য। নিহত হলে তো কেসটা আবার ঝুলে যেত। তখন বিনয় বোসের মানসিক চাপটাও দীর্ঘায়িত হতো।’’
‘‘তাহলে রঘুদা ঐ লোকটা কল্যাণ নয়?’’ রঘুদাকে জিজ্ঞেস করল অনিমেষ।
রঘুদা বললেন, ‘‘নারে অনিমেষ, আমি ভালো করেই দেখেছি। আমাদের উপর হামলা করে কিছুদূর গিয়েই গুণ্ডাটা তার ছদ্মবেশ রূপে ব্যবহার করা টি-শার্ট, কোমরে প্যাঁচানো গামছা খুলে ফেলে। তখন তার চেহারাটা পুরোপুরি আমার নজরে আসে। দেখে স্পষ্টভাবেই বুঝতে পেরেছিলাম লোকটা কল্যাণ নয়।’’
অনিমেষ এতক্ষণে বুঝতে পারল তার ধারণাটা ছিল সম্পূর্ণ ভুল। সে কল্যাণকে সন্দেহ করেছিল, কিন্তু রঘুদার কথাবার্তায় একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কল্যাণ চন্দ্রশেখরবাবুকে ফাঁসানোর ব্যাপারে বিন্দুমাত্র জড়িত নয়। তাছাড়া কল্যাণ ভুলেও ভাবেনি সে এই কেসে জড়িয়ে পড়বে। তাই সেও অনেকখানি কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দেবরঞ্জনবাবু বললেন, ‘‘রঘুবাবু, বিনয় আমাদের কাশ্মীর গ্র“পের অন্যতম জনপ্রিয় একজন নেতা ছিল। কিন্তু সে কাশ্মীর গ্র“পের এত বড় ক্ষতির চেষ্টা করল কেন?’’
রঘুদা বললেন, ‘‘বিনয় বোস এটা করেছেন ব্যক্তিস্বার্থে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে। আপনি তো আমায় বলেছিলেন যে চন্দ্রশেখরবাবু ফিরে না আসলে বিনয় বোসকেই কাশ্মীর গ্র“পের হাল ধরতে হবে। অর্থাৎ বিনয় বোসই হবেন কাশ্মীর গ্র“পের সভাপতি। তাই তো?’’
‘‘হ্যাঁ।’’
‘‘বিনয় বোস কাশ্মীর গ্র“পে উনার জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে চন্দ্রশেখরবাবুকে হঠিয়ে এই গ্র“পের সর্বেসর্বা হতে চেয়েছিলেন। যার কারণে এই নাটকটা করলেন।”
‘‘কী বলছেন!’’
‘‘আমার কথা বিশ্বাস না হলে উনাকে জিজ্ঞেস করেই দেখুন।’’
দেবরঞ্জনবাবু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বিনয় বোসের দিকে তাকালেন। বিনয় বোস মাথাটা আরো নিচু করে কনস্টেবল দু’জনের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। যার অর্থ রঘুদা যা যা বলেছেন সবই ঠিক।
দেবরঞ্জনবাবু বিনয় বোসের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে রঘুদাকে বললেন, ‘‘রঘুবাবু, এই বিনয়কে আমি অনেক বিশ্বাস করতাম। অনেক, অনেক। কিন্তু সেই বিশ্বাসের মূল্যে এ আমি কী পেলাম!’’ বলে দেবরঞ্জনবাবু হতাশা প্রকাশ করলেন।
রঘুদা বললেন, ‘‘আপনি ভুল করেছিলেন দেবরঞ্জনবাবু। বিনয় বোসকে বিশ্বাস করে আপনি চরম ভুল করেছিলেন। এখন বুঝতে পারছেন তো কাশ্মীর গ্র“প কোন কসাইয়ের হাতে পড়তে যাচ্ছিল।’’
‘‘আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ রঘুবাবু। অনেক বড় একটা বিপদের হাত থেকে আমাদের বাঁচালেন।’’
‘‘তাহলে চন্দ্রশেখরবাবুকে আমরা ছেড়ে দিই, কী বলেন রঘুবাবু?’’ রঘুদাকে জিজ্ঞেস করলেন ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মা।
রঘুদা বললেন, ‘‘আরে! এখানে প্রশ্ন করার কী আছে? যেখানে খুনই হয়নি সেখানে খুনির প্রশ্ন আসছে কেন?’’
‘‘তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন’’ বললেন ইন্সপেক্টর শীর্ষেন্দু শর্মা, “তবে পুলিশের তরফ থেকে আমি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি একটা মারাত্মক ভুলের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করার জন্য।’’
রঘুদা বললেন, ‘‘ইট্স ওকে, তো চন্দ্রশেখরবাবুকে আপনারা ছাড়ছেন কখন?’’
‘‘আজই। আপনাদের কারো সেখানে যেতে হবে না। আমি সসম্মানে উনাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসব।’’
‘‘সম্মানের কথা তুলবেন না শীর্ষেন্দুবাবু। আপনি চন্দ্রশেখরবাবুকে গ্রেফতার করে সামনের ইলেকশনে উনার যে ইমেজ তৈরি করে দিয়েছেন সেটা একবার ভেবেছেন?’’
‘‘আর লজ্জা দিবেন না রঘুবাবু। উই আর রিয়েলি ভেরি সরি।’’
এরপর শীর্ষেন্দু শর্মা চলে গেলেন। সাথে নিয়ে গেলেন এই কেসের মূল হোতা বিনয় বোসকে।
অর্থাৎ শুভঙ্কর দত্ত খুন হয়েছেন কথাটিকে সামনে রেখে রঘুদা উনার তদন্ত শুরু করেছিলেন। শেষমেষ দেখা গেল সেই শুভঙ্কর দত্তের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব আছে বিনয় বোসের, যিনি শুভঙ্কর দত্তকে সৃষ্টি করেছিলেন। আর খুন হওয়ার বিষয়টা পুরো ভাঁওতাবাজি।

মনে আছে তো, রঘুদা অনিমেষকে গতকাল রাতে বলেছিলেন উনার সন্দেহটা দেবরঞ্জনবাবুর উপর। আমার মনে হয় রঘুদা অনিমেষকে একটু চিন্তায় রাখার জন্যই কথাটা বলেছিলেন। দোষীর তালিকায় তো দেবরঞ্জনবাবুর নাম গন্ধই পাওয়া গেল না।
না, এটা কিন্তু রঘুদার ঠিক হয় নি। অনিমেষ অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও রঘুদা তাকে মিথ্যে বলেছেন, তাকে চিন্তার মধ্যে রেখেছেন। ভেরি ব্যাড! ভেরি ব্যাড!
.........সমাপ্ত

সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়,
ময়মনসিংহ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.