নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

দ্বন্দ্ব

১৫ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০২

পাশের বাসা থেকে গাঁক গাঁক চিৎকার আসছে একটু সময় পর পর। চিকন মহিলা কণ্ঠ। কণ্ঠটি ক্রমাগত ক্ষীণ থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মহিলার কণ্ঠটির পাশাপাশি আরেকটি পুরুষের কণ্ঠ বেশ স্পষ্ট। তবে মহিলার গলা যতটুকু না খসখসে আর তীব্র, পুরুষটি ততটাই তোষামোদী। এই মহিলা এবং পুরুষের ঝগড়ার ঝাপটে চোখ কান বন্ধ হবার জোগার। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে গলগলিয়ে। এই বৃষ্টির শব্দকে ভেদ করে আনিসের কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে এই নব দম্পতির ঝগড়া। এই নব দম্পতিকে দেখে বড্ড মায়া হয় আনিসের। কত সাধ করেই না এরা ঘর বেঁধেছিলো। অথচ কেউ কারো মন বুঝত চেষ্টা করে না। দু জন সব সময় দুজনকে এক জটিল সন্দেহের জালে আটকে রাখে। বিধায় প্রতিদিন ঝগড়া অনিবার্য। ঝগড়া শেষ করে মহিলা হাই ভলিউমে ইংলিশ গান শুনে আর পুরুষটি বেলকোনিতে বসে এক নেশায় গাঁজা টানে।
দিনের পর দিন যায় কিন্তু স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিবাদ ততোই প্রকট হয়। পরিবেশটা ক্রমশ বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে আনিসের জন্য। এই দুই প্রাণীর এই ভ্যাজরং ভ্যাজরং ঝগড়া আনিসের পড়াশুনার পাট অনেক আগেই শেষ করে দিয়েছে। ইদানিং ল্যাপটপে বসে একটা ভালো মুভি দেখাও বেশ কষ্ট কর হয়ে পড়েছে। তাই হেড ফোনটা কানে গুঁজে ল্যাপটপে বসে আনিস। গতকাল রাতে একটা লেখা শেষ করেছে। সেটা টাইপ করবে এখন।
ল্যাপটপ খুলেই বিশাল হোঁচট খেল আনিস। তার চোখের সামনে আজ কেমন করে জানি ভেসে উঠলো তার ডেস্কটপ পিকচার। পিকচারটি কিষেনজির। বড়ই বীভৎস সে ছবিটি! কিষেনজির গলাটা কেটে দেয়া হয়েছে নৃশংসভাবে। সেখানে লাল রক্ত জমাট বেঁধে আছে। দেহের প্রতিটি জায়গা ক্ষত বিক্ষত হয়ে আছে। হাতের আঙুলগুলো দেখে সে আরো শিউড়ে উঠে। তার পুরো দেহের শিরা উপশিরা জুড়ে প্রবাহিত হয় প্রতিশোধের উত্তাপ। এই উত্তাপ যাতে কখনোই না নিভে এজন্য কিষেনজির এই ছবিটা আনিস ডেস্কটপ পিকচার হিসেবে সেট করে রেখেছে। এই ছবিটার দিকে যতবারই চোখ যায় আনিসের শরীরের অনুভূতিগুলো অগ্নি স্ফুলিঙ্গের মতো ছিটকাতে থাকে এদিক সেদিক। আনিসের দু হাত তার নিজের অজান্তেই মুষ্টিবদ্ধ হয়ে যায়। দাঁতের সাথে দাঁতের ঘর্ষলে শব্দ হয় কটকট। শরীরের প্রতিটি রোম খাড়া হয়ে যায় মুহূর্তে।
আচমকা আনিস তার ডান পাশে তাকিয়ে সমি¦ৎ ফিরে পেলো। তার পাশে অনেকক্ষণ ধরে বসে আছেন তার খুব ঘনিষ্ট বড় ভাই- আশরাফুল আলম। আনিসকে তিনি ভ্রƒ কুঁচকে পর্যবেক্ষণ করছেন অনেকক্ষণ ধরে। আশরাফুল ভাই টেরচা চোখে আনিসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার আনিস? খারাপ লাগছে? তুমি কি অসুস্থ?”
“ন-ন-না আ-আ-আশরাফ ভাই। কখন আসলেন আপনি?” উত্তরটা দিতে গিয়ে তোতলা হয়ে গেলো আনিস।
“আসলাম কিছুক্ষণ হলো। দেখলাম তুমি অস্বাভাবিকভাবে বসে আছো চেয়ারে।”
আনিস একটু অকারণে হাসলো। তারপর বললো, “না আনিস ভাই। কিছু না। অন্য একটা বিষয় মাথায় চক্কর দিচ্ছিলো। কেমন আছেন আপনি?”
“আছি মোটামুটি। বর্তমান বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী আগ্রাসনের মুখে ভালো থাকাটা বেশ দুরূহ হয়ে উঠেছে। এক এক করে জলন্ত প্রতিভাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে। আজ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে কুপিয়ে মেরেছে কিছুক্ষণ আগে।”
“বলেন কী!”
অবাক হয়ে গেলো আনিস। ক্রমাগত দেশের প্রগতিশীল মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়া বিশাল এক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ইদানিং। জঙ্গিবাদ আজ জাঁকিয়ে আস্তানা গেড়েছে কোণায় কোণায়। রাষ্ট্রও দেখা যাচ্ছে এ ব্যাপারে বেশ সচেতনভাবে উদাসীন। মন্ত্রী এমপিদের কথাবার্তার সাথে জঙ্গিদের কথাবার্তার পরোক্ষ এক মিল পাওয়া যায়। প্রগতিশীলদের লাশের উপর দাঁড়িয়ে তারা বলে, “উনি কী লিখতেন, কী করতেন তা আমরা খতিয়ে দেখছি।” কিন্তু কারা খুন করলো, তাদের কী ব্যবস্থা নেয়া যায় এ প্রশ্নে উনাদের গা টা কেমন যেনো ম্যাজম্যাজ করে। যখন মৌলবাদী সরকার ক্ষমতায় থাকে তখন এ ধরনের হামলার যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়, কিন্তু যখন একটি সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার ধোঁয়া উড়িয়ে এক হাতে মৌলবাদ- জঙ্গিবাদ, অন্যহাতে পুঁজিবাদ সা¤্রাজ্যবাদকে ব্যবহার করে চলে তখন এর চেয়ে নিষ্ঠুর প্রতারণা আর কিছু হতে পারে না।
আনিস আশরাফ ভাইকে জিজ্ঞেস করলো, “কী ভাবছেন এখন?”
“ভাবা তো যায় অনেক কিছুই। এবার কিছু করা দরকার।”
“কী করবেন?”
“তোমার কী মনে হয় আনিস? কী করা উচিত হবে এখন?”
“দেখেন আনিস ভাই, আমাদের বক্তব্য এসব ক্ষেত্রে একেবারে ক্লিয়ার। বাংলাদেশের প্রগতিশীলরা জঙ্গিদের থেকে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের স্বীকার। যা কিছু করতে হয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অ্যাটাক করে করতে হবে।”
“সবকিছুতে ভাই তুমি এত ‘রাষ্ট্র’‘রাষ্ট্র’ করো কেন? তুমি জানো, আনসারউল্লাহ বাংলা টিম টুইট করে এসব হত্যাকান্ডের দায় স্বীকার করেছে একের পর এক। এখানে রাষ্ট্রটা এত মুখ্য হিসেবে আসছে কেনো?”
“যে রাষ্ট্র হেফাজতে ইসলামকে আধা ঘন্টার মধ্যে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে সে রাষ্ট্রের কাছে এক দুইটা জঙ্গি সংগঠনকে দেশ থেকে উপড়ে ফেলা কোনো সমস্যা নয় যদি তার জঙ্গি দমনের আদৌ কোনো আগ্রহ থাকে। আমাদের টার্গেটটা আগে ঠিক করতে হবে আশরাফ ভাই। কে আসলে এই সমাজের প্রগতিশীল অংশকে ধ্বংস করছে। এদেশের কোনো সরকারই এখন পর্যন্ত চায় নি এদেশে প্রগতির বিকাশ ঘটুক। তাই তারা কখনো মৌলবাদ, কখনো পুঁজিবাদ, কখনো সা¤্রাজ্যবাদীদের হাতে হাত মিলিয়ে এদেশের প্রগতিশীল অংশকে ধ্বংস করে যাচ্ছে। এরা বড্ড বেশি ভয়ংকর আশরাফ ভাই!”
আনিস আর আশরাফ ভাইয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে অবিরাম সময় ধরে। দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই এই দুইটা মানুষ আপনা আপনিই একত্রিত হয়। দুইজন দুই দিক থেকে যুক্তি দিয়ে ভাঙতে থাকে ঘটনার মারপ্যাঁচ। কিন্তু কেউ কারো পান্ডিত্যের নিকট হার স¦ীকার করতে নারাজ। দুজনেরই ভান্ডারে অসংখ্য জ্ঞানের সমাহার। আশরাফ ভাই চলে যাওয়ার মুহূর্তে আনিসকে বললেন, “ও আনিস, একটা প্রশ্ন করতে তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তোমার ডেস্কটপের এই ছবিটা কার যাকে দেখে তোমার মুখটা আগে ওরকম বাঁকা হয়ে যাচ্ছিলো।”
বলে আনিসের ডেস্কটপের দিকে ইঙ্গিত করলেন আশরাফ ভাই।
আনিস একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি জানেন না?”
“জানার মতো কেউ কি?”
“অবশ্যই। ভারতের মাওবাদী নেতা কিষেণজি। ভারত রাষ্ট্রের ফ্যাসিবাদী আক্রমণের স্বীকার।”
“মাওবাদী!” আশরাফ ভাইয়ের মুখে শ্লেষ।
আনিস একটু শক্ত মুখে বললো, “কিষেণজি ভারতের মেহনতি মানুষের মুক্তি চেয়েছিলেন!”
“তাহলে এর চেয়ে ভালো শাস্তি আর কি হতে পারে?”
“মানে?”
“শোনো আনিস, আই জাস্ট হেট অ্যানি কাইন্ড অফ টেরোরিস্ট। সে মাওবাদী হোক আর যাই হোক।”
একটু রেগে গেলো আনিস, “হোয়াট! কিষেণজি টেরোরিস্ট! তাহলে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এনেছিলো তাদের সব কয়টা টেরোরিস্ট?”
“এক সূত্র দিয়ে সব অংক মেলানোর চেষ্টা করো না আনিস। তুমি জানো, এই সব মার্ক্সবাদ আর মাওবাদের হাতেই পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা গেছে।”
“মার্ক্সবাদ মাওবাদের হাতে মানুষ মারা গেছে এটা সত্য, তবে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে এটা একেবারে বানোয়াট আশরাফ ভাই। আর মার্ক্সবাদ মাওবাদ যাদের মেরেছে তাদের সব কয়টা ছিলো সমাজের বিষ ফোঁড়া! যদি পাঁচ ভাগ মানুষ পঁচানব্বই ভাগ মানুষের সকল সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তবে এই পাঁচ ভাগকে খতম করা শুধু এই মার্ক্সবাদ মাওবাদ না, বিশ্ব মানবতার কথা বিবেচনা করলেও একটা ফরজ কাজ।”
“ফরজ কাজ! হাউ ফানি স্টেটমেন্ট ম্যান, এটা কখনোই সঠিক হতে পারে না। তুমি মানুষ মেরে সেটাকে ফরজ কাজ বলে চালিয়ে দিবে? তো চালিয়ে লাভটা কি হলো? রাশিয়ার সমাজতন্ত্র টিকেছে? বরং বিজ্ঞানের বিকাশ বারবার পর্যুদস্ত হয়েছে সেখানে।”
“বিজ্ঞান পর্যুদস্ত ছিলো? না আশরাফ ভাই, আপনাকে আর কিছু বলার নেই। আপনি এবার আসতে পারেন।”
এভাবেই কোনো না কোনো অনাকাঙ্খিত কথার মধ্য দিয়ে দুজনের কথা বলা শেষ হয়।
তবে আজ আনিস অবাক হচ্ছে একটু বেশি। আশরাফ চলে যাওয়ার পর উনার কথাগুলো বার বার তার কানে বাজছে- কিষেণজিকে আশরাফ ভাই টেরোরিস্ট বলতে পারলো! মাওবাদ নিয়ে আনিস ভাইয়ের আপত্তি থাকতে পারে, তাই বলে যে মানুষটা মানুষের মুক্তি সংগ্রামে নিজের পুরো জীবন বিসর্জন দিয়ে দিলো তাকে টেরোরিস্ট বলাটা সে মানতে পারলো না। আনিস স্পষ্ট দেখলে পেলো এদেশের প্রগতিশীলদের মধ্যেকার চিন্তাগত এক বিরাট দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বই উৎসাহ উদ্দীপনা দেয় রাষ্ট্রকে। রাষ্ট্র এ দ্বন্দ্বে পুলকিত হয়। তার উদ্দেশ্যগুলো সে বাস্তবায়ন করে নেয় অতি সহজেই।

মাস ছয়েক পরের ঘটনা। আনিসের ঘুম ভাঙলো তার রুম মেটের ধাক্কায়। ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে তন্ময় হয়ে ঘুমাচ্ছিলো আনিস। অনেক কষ্টে চোখ মেলে তাকালো তার রুম মেটের দিকে। চোখ দুটি লাল হয়ে আছে। সারা রাত পড়াশুনা করেছে। তার উপর একেবারে কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভেতরে ফুঁস ফুঁস করছে আনিস।
রুম মেট বললো, “তোর কাছে একটা ভাইয়া আসতো না মাঝে মাঝে? কী যেনো নাম?”
“এটা জানার জন্য আমাকে ডেকেছেন?”
“আরে না, একটা লোক এসে খবর দিলো এই মাত্র। উনাকে নাকি কারা খুন করেছে!”
“হোয়াট!”
তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আনিস।
“কখন এসেছিলো লোকটা?”
“এই একটু আগে।”
“লাশটা কোথায় আছে?”
“উনার বাসায়।”
আনিস হুড়মুড়িয়ে শার্ট প্যান্ট পড়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলো।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আশরাফ ভাইয়ের বাড়িতেও পৌঁছে গেলো। বাড়ির সামনে অসংখ্য মানুষের ভিড়। পুলিশ, সংবাদ কর্মীর সংখ্যাই বেশি মনে হচ্ছে। আনিস ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। আশরাফ ভাইয়ের বিছানায় পড়ে আছে উনার মরদেহ। গলাটা কেটে দেয়া হয়েছে নৃশংসভাবে। সেখানে জমাট বেঁধে আছে লাল রক্ত। হঠাৎ করে চমকে উঠে আনিস- আরে, কিষেণজিকেও তো এভাবেই মারা হয়েছিলো। আশরাফ ভাই বুঝতে পারলেন না এই রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য। রাষ্ট্র শব্দটা উনি শুনতে পারতেন না। অবশেষে এই রাষ্ট্রের হাতেই বলি হতে হলো আশরাফ ভাইকে। খুনিরা কত সুন্দর ঐক্যবদ্ধ! কোন দিকে যাচ্ছে সমাজ? নষ্টদের অধিকারে?


লেখক
শিক্ষার্থী,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৫ ই জুন, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫৮

বিদ্রোহী ভৃগু বলেছেন: সেনসিটিভ ইস্যুতে গল্প!

মন্তব্য করতেও ভয় হয়!!!!!

ঐ যে আপনার গল্পের মূল বক্তব্যই বড় কারণ ;)

+++++++

১৬ ই জুন, ২০১৬ দুপুর ১:১৪

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: হুমম, ঠিক ধরেছেন।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.