নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

অনুকূল চন্দ্রের মনের ভেতর ইষ্রার ছাপ!

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:১৮


অনেক অনেক আগের কথা। ইতিহাসের পাতায় ইষ্রা নামক এক ইহুদী ধর্মাচার্যের নাম পাওয়া যায়। “বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব” নামক বীভৎস বিধান প্রণয়নকারী হিসেবে এই ধর্মাচার্যের নাম ইতিহাস আজো স্মরণ করে রেখেছে। নেবুচাদনেজার জেরুজালেম ধ্বংসের ১৪৩ বছর পর পারসিক সম্রাট সাইরাসের দয়ায় ইহুদীরা পুনরায় জেরুজালেমে ফিরে যায়। এই ফিরে যাওয়ার সময় ইষ্রা তার “বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্বের” বিধান প্রণয়ণ করেন। এই বিধান অনুযায়ী এতদিন মেসোপটেমিয়ায় থাকা অবস্থায় বিবাহ কিংবা বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ঐখানকার রক্তের সাথে ইহুদি রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেছে। এর মাধ্যমে ইহুদী রক্ত বিনষ্ট হয়েছে। সুতরাং ঐ বিনষ্ট রক্ত পরিত্যাগ করে একেবারে খাঁটি ইহুদী রক্তধারীরাই কেবল জেরুজালেমে প্রবেশের যোগ্য। অর্থাৎ যেসব ইহুদী পুরুষ পরজাতীয় মেয়ে বিয়ে করেছে সেই মেয়েসুদ্ধ মেয়ের সন্তানটি পর্যন্ত পাপিষ্ট। সে যদি জেরুজালেমে প্রবেশ করতে চায় তবে তাকে তার বিবাহিত স্ত্রীসহ সন্তানকে পরিত্যাগ করে আসতে হবে। (ওল্ড টেস্টামেন্ট : ইষ্রা:১০:১১ – যে সব ইহুদী পুরুষরা পরজাতীয় মেয়েদের স্ত্রী করেছে, সেই সব স্ত্রীদের এবং তাদের র্গভজাত পুত্র-কন্যাদের ত্যাগ করতে হবে।)

এ বিধান শুনে কান্নার রোল পড়ে যায় অসংখ্য পরিবারে। অনেক স্বামী তার স্ত্রী সন্ত্রানকে, অনেক স্ত্রী তার স্বামী সন্ত্রানকে পরিত্যাগ করে পাড়ি জমায় জেরুজালেমে। সন্তানগুলোর ক্রন্দন ধ্বনি ইষ্রাকে বিন্দুমাত্র টলালো না। ঐ সন্তানগুলো নাকি পাপের সন্তান।

এই ইতিহাসটা একারণেই টানলাম কারণ বাংলার (অনেকের মতে পুরো ভারতবর্ষের, কারো কারো মতে পুরো বিশ্বের, কারো মত অনুযায়ী স্বয়ং সৃষ্টি কর্তা) সাধক পুরুষ অনুকূল চন্দ্রের মধ্যে ইষ্রার একটা ছাপ পাওয়া যায়। ছাপটিও বেশ সুস্পষ্ট। অনুকূল চন্দ্র কর্তৃক প্রদত্ত নিম্নোক্ত বাণীগুলো একটু নজর দিই-

বর্ণ ও শ্রেণী ভাঙলি যেই
সংহতিটা টুটলো
শিষ্ট আচার, বৈশিষ্ট্য আর
সম্বন্ধটাও ঘুচলো।

বংশ ধারা শুদ্ধ রাখিস
সদৃশ ঘরে করে বিয়ে
বিশুদ্ধতা রাখলে বজায়
বৃদ্ধি পাবে ক্রমান্বয়ে

এরকম আরো অসংখ্য বাণীর প্রবক্তা হিসেবে এদেশের মানুষের অন্ধ মনে ঈশ্বর হিসেবে স্থান করে নিয়েছেন অনুকূল চন্দ্র। এসব বাণীর মাধ্যমে এই “বিশুদ্ধ জাতিতত্বের” বিষয়টি অনুকূল চন্দ্র যথা সম্ভব ভারতবর্ষে প্রচার করে গেছেন নির্দ্বিধায়। পার্থক্য শুধু এক জায়গাতেই। ইষ্রা ছিলেন একজন ধর্মাচার্য, উনার বিধান মানতে সকলে বাধ্য ছিলো। কিন্তু অনুকূল চন্দ্র ছিলেন একজন সাধক কিংবা আধ্যাত্যিক পুরুষ। পুরো ইহুদী জাতি ইষ্রার বিধান মানতে বাধ্য ছিলো। কিন্তু বাংলার মানুষ বাধ্য ছিলো না। কারণ রাষ্ট্রীয় কলকাটি থেকে অনেক দূরে তিনি অবস্থান করেছিলেন।


গুরুপূজা বলি আর ব্যক্তি পূজাই বলি দুটি জিনিসই সমাজের জন্য ক্ষতিকর। গুরুপূজা ধর্মকে ব্যবহার করে বেশি আর ব্যক্তি পূজা ক্ষমতাকে। এই ক্ষমতার জোরে আমরা দেখি পুর নগর ধ্বংসকারী আর্য ইন্দ্র দেবতা হিসেবে প্রতিষ্টিত হয়ে যান। তৎকালীন বৃহৎ বারোটি আর্য গোষ্ঠীর প্রধান নেতা ভরতের নামে “ভারত” নামকরণটি হয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে এরাই পূজার দেবতা হিসেবে সমাজে প্রতিষ্টিত হয়ে গেলেন। আর এই সুযোগটা করে দিয়েছিলো মাঝখানের লুটেরা ব্রাহ্মণ শ্রেণী। তারাই হিন্দু সমাজকে সব সময় দাবড়ানির উপর রেখেছিলো এবং রাখছে। অনুকূল চন্দ্র সরাসরি সেই শ্রেণীরই একজন প্রতিনিধি। নিজে আগাগোঁড়া একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে হ্যাঁ, মানবতাবাদী ব্রাহ্মণ। এজন্য নিজের পকেটে টাকার সংকট সত্ত্বেও বন্ধু পরিক্ষার ফি দিতে পারছে না বলে সেই টাকাটি দিয়ে দেন। উনার বাবাও একজন গোঁড়া ব্রাহ্মণ ছিলেন। কিন্তু নিজের এই ব্রাহ্মণ পরিচয় ছেড়ে সবাইকে মানুষ এবং বৈষম্যহীন দৃষ্টিতে অনুকূল চন্দ্র কখনোই দেখেন নি। এজন্য হিন্দু ধর্মের এই “ঐতিহাসিক সমস্যাটিকে” তিনি জিইয়ে রেখেছেন খুব সুন্দর করে। হিন্দুধর্মের মহাপুরুষদের জীবনী ঘাঁটলে বর্ণবাদের পক্ষের একটা বলিষ্ট কণ্ঠস্বর হিসেবে অনুকূল চন্দ্রের নাম উচ্চারিত হয়। বর্ণবাদ অনুকূল চন্দ্রের বেশ পছন্দের ছিলো এবং মানুষকে বর্ণবাদের ব্যাপারে আরো মনোনিবেশ করার ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট ভূমিকা পালন করেছিলেন। কারণ তাতে তার ব্রাহ্মণ গোত্রটি সংরক্ষিত হয়। শক্তিশালী হয় শোষণের হাতিয়ার।

গুরুর সেবা করবি যত
কায়মনোবাক- বোধবিজ্ঞানে,
শিষ্ট হয়ে বোধগুলি তোর
মানসপটে উঠবে ধ্যানে।

গুরুর সেবা না করলে কিন্তু
কোন দেবতার হয় না পূজা
সব দেবতার সিদ্ধ আসন
গুরুই কিন্তু তাদের ধ্বজা

উপরের মহান বাণী দুটির মাধ্যমে অনুকূল চন্দ্র পরোক্ষ ভাবেই বলে দিচ্ছেন- ওরে হতভাগারা আমাকে পূজা কর, সেবা কর। নইলে তোদের মুক্তি নাই। আমাদের দেশের ভক্তরাও আবার বেশ চালাক। গুরুর মনের এই সুপ্ত বাসনাগুলো তারা বেশ সহজেই বুঝতে পারেন। তারাও তাই তার জীবনাবস্থায় তো বটেই, মৃত্যুর এতটি বছর পরেও ছবিখানা ঝুলিয়ে দেবতার আসন, কেউ কেউ আবার ঈশ্বরের আসন দিতে বিন্দু মাত্র কার্পন্য করেন নি। গৌতমবুদ্ধ এক সময় এই ধারাটি ভাঙতে চেয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণ্যবাদীদের হাতে ক্ষমতা চলে যাওয়ায় সেই রাস্তাটি বন্ধ হয়ে যায়। সেই সাথে তার তৈরি করা মানুষগুলো দেখা গেলো তাকে নিয়েই দেবতা পূজার পসরা সাজিয়ে বসলো। ফলে হারিয়ে গেলো দেবতা পূজার আড়ালে মনুষ্যপূজা বন্ধের আবেদন। এদিক দিয়ে অনুকূল চন্দ্র তার পূর্ববর্তী সমাজে তান্ডব চালানো ব্রাহ্মণ লিডারদের সুযোগ্য উত্তরসুরিই বটে। ইষ্রার বিশুদ্ধ জাতিতত্ত্ব আর ব্রাহ্মণ্যবাদের এক অপূর্ব সমন্বয় ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।



নারীদের ব্যাপারেও অনুকূল চন্দ্র বেশ কট্টোর অবস্থান নিয়েছিলেন । নারী জাতিটিকে নারী না বানিয়ে পুতুল কিংবা রোবট আকারে দেখতে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তার কাছে ক্ষমতা থাকলে হয়তো এরকম একটা কিছু বানিয়ে নিজের সুপ্ত ইচ্ছের প্রকাশ ঘটাতেন। নারীদের ব্যাপারে অনুকূল চন্দ্রের মতো এত কট্টোর মানুষ ইতিহাস ঘেঁটে খুব কম পাওয়া যায়। মেয়ের চাকরি, বৈবাহিক ব্যাপার, সামাজিক নিয়ম সবকিছুতে তিনি উদ্ভট এবং হাস্যকর কিছু নিয়মের সংযোজন করেছেন। অনুকূল চন্দ্রের নিম্নোক্ত বাণীগুলোতে তা স্পষ্ট ধরা পড়ে।

যে মেয়েরা চাকরি করে
জনন জাতি তারাই হরে

মেয়ের চাকরি মহাপাপ
বিপর্যস্ত শ্বশুর বাপ

মেয়ে পুরুষের এক সাথে চলা
কিংবা মিশে দঙ্গল করা
এসব কিন্তু সর্বনাশা
বিপাকেরই পায়ে ধরা।


এই বাণীগুলো বর্তমান বাস্তবতার সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক। এটি আমাদের দেশের বেগম রোকেয়ার মতো নারী জাগরণের পথিকৃতদের অপমান করে। অপমান করে তাদের স্বপ্নকে। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নারী বিভিন্ন কল কারখানা, অফিস, গার্মেন্টেস এ চাকুরিরত আছে। তাদের শ্রমে ঘামে অর্জিত টাকায় ঘোরে আমাদের অর্থনীতির চাকা। অনুকূল চন্দ্রের এই বাণীগুলো সেই নারীদের অবদানকেও অর্থহীন করে তোলে। তাদেরকে আবারো ঘরে ফিরে যাওয়ার মতো মধ্যযুগীয় আওয়াজ পাওয়া যায় তার বাণী থেকে। তারা ঘরে ফিরে গেলে দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে পথে ঘাটে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াবে, সৃষ্টি হবে অর্থনৈতিক সংকট, দুর্ভিক্ষ। সেই দৃশ্যটি দেখার শখ আশা করি কোনো মানুষের জাগার কথা না। অথচ অনুকূল চন্দ্রের ফর্মুলার ভবিষ্যত গন্তব্য সেই দিককেই।

অত্যন্ত দুঃখের সাথে লক্ষ্য করতে হয়, এই বাণীগুলো দিয়েই অনুকূল অনুসারীরা আজ সমাজের মানুষদের টানছে। এখনও বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে তাদের সংগঠনের। মানুষকে ধর্ম বুঝাচ্ছে। বুঝাচ্ছে বর্ণবাদ, গুরুবাদ, পুরুষতন্ত্রের একচ্ছত্র আধিপত্যের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা। অথচ এগুলোর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ব্যতীত একটি সমাজ কখনোই সামনের দিকে এগুতে পারবে না। আমাদের সমাজ আজো এসব মধ্যযুগীয় জঞ্জালে পরিপূর্ণ। ইষ্রার বিধান ইহুদীদের অমানবিক, পাষাণ এবং কট্টোর জাতি হিসেবে পৃথিবীতে স্থান দিয়েছেন। আমরা যেন নিজের দেশটাকে এরকম বীভৎস বিধানমুক্ত রাখতে পারি।


সৌরভ দাস
শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ সকাল ১১:৪৩

শিখণ্ডী বলেছেন: মানুষের সীমাবদ্ধতা থাকবেই। থাকে বলেই অন্যজন বাকিটুকু করার চেষ্টা করে। এভাবে আমরা সমাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি।

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৪০

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: হুমম

৩| ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৮:৪০

প্রণব দেবনাথ বলেছেন: ওদের ওসব নিয়ম এর যুগ শেষ। প্রায় সব মানুষ এখন বুদ্ধিতে আগেকার গুরুদের ও গুরু।

৪| ২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:৪১

সৌরভ দাস ১৯৯৫ বলেছেন: পুরাতনকে অন্ধ ভাবে আঁকড়ে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.