নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌরভ দাস

সৌরভ দাস ১৯৯৫

চলুন, সবাই কথা বলি

সৌরভ দাস ১৯৯৫ › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৪ই ফেব্রুয়ারি: শহীদের রক্তের উপর ভালোবাসার ফ্যান্টাসি

০৭ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৯:৫৯


আমরা যখন বিভিন্ন দিবস পালন করি তখন সে দিবসগুলো আমাদের একেকটি ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দেয়। ইতিহাসটি হতে পারে দুঃখ কিংবা আনন্দের। কিন্তু দিবসগুলো পালন ঐ ইতিহাসগুলো পুনরায় উদ্ভাসিত করে তুলে। এজন্যই হয়তো ২৬ মার্চ শব্দটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে সিনেমা হলের পর্দার মতো ভেসে ওঠে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম অত্যাচারের দৃশ্য। আমাদের কান দিয়ে প্রবেশ করে গোলাগুলির ঠাস ঠাস শব্দ। ১৬ ডিসেম্বর শব্দটা শুনলেই স্বাধীন বাংলাদেশের পত পত উড়ন্ত পতাকা দৃশ্যমান হয়। ২১ শে ফেব্রুয়ারি শুনলে আমরা দেখতে পাই বাংলা বর্ণমালা সম্বলিত প্ল্যাকার্ড হাতে একদল তরুণ যুবার মিছিল। চোখ দুটি যাদের জ্বল জ্বল করে জ্বলছে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মনে সেই ঐতিহাসিক দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দিতে এই দিবস পালন গুরুত্বপূর্ণ একটি ভূমিকা পালন করে থাকে।
১৪ই ফেব্রুয়ারি এমনই একটি দিবস। দিবসটির কথা স্মরণ করতে গেলে একটু পেছন থেকে আসতে হবে। এটা আমরা সবাই জানি যে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এবং পুরোপুরি স্বৈরাচারী কায়দায় দেশ শাসন করা শুরু করে। রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে এরশাদ সবচেয়ে বাজে যে কাজটি করে তা হলো শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে গুরুত্বহীন, পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক করে তোলা। বলা হয়ে থাকে এরশাদের শাসনামলে বাংলাদেশে যত দুর্নীতি হয়েছে তা অতীত সব রেকর্ড ভেঙে দেয়। এজন্য একটি বিদেশী পত্রিকার শিরোনামে বেশ বড় করে নিউজ আসে- Ershad, richest president from the poorest country. কিন্তু তৎকালীন দারিদ্র পীড়িত বাংলাদেশে যদি বলা হয় শিক্ষার ব্যয়ভার ৫০% বহন করবে রাষ্ট্র এবং বাকী ৫০% শিক্ষার্থী তাহলে এর চেয়ে রড় দুর্নীতি আর বেইমানী কী হতে পারে?
এরশাদ শাসনামলে মজিদ খান যে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন তা যে কেবলই বাণিজ্যিক ছিলো তা নয়। ছিলো অতিমাত্রায় সাম্প্রদায়িক। আরবি ভাষাকে শুধু মাত্র এদেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাসকে নিয়ে খেলবার জন্য ঐ শিক্ষানীতিতে সুস্পষ্টভাবে বাধ্যতামূলক ভাষা হিসেবে উল্লেখ করা হয় এবং তা প্রথম শ্রেণী থেকেই কার্যকর করার কথা বলা হয়। এরকম একটি বাণিজ্যিক এবং সাম্প্রদায়িক শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজ জেগে ওঠে। প্রতিবাদের ঝড় ওঠে বিভিন্ন মহল থেকে। শুরু হয় তুমুল আন্দোলন। স্বাধীনতার পর এই প্রথম মোটামুটি সকল ছাত্র সংগঠনের অংশগ্রহণে রাষ্ট্র ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো একটি আন্দোলন গড়ে উঠে। স্লোগান আর মিছিলে প্রকম্পিত হতে শুরু করলো রাজধানী ঢাকাসহ পুরো বাংলাদেশ। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছিলো সেই গড়ে উঠা আন্দোলন রাষ্ট্রীয় পেটুয়া বাহিনী কর্তৃক হিংস্রভাবে দমনের অপচেষ্টার দিন। এদিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে স্মারকলিপি পেশ করতে সচিবালয়ের দিকে যাচ্ছিলো। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মিছিল হাইকোর্ট এলাকায় পৌঁছতেই পুলিশ হিংস্রের মতো মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় এলোপাথারি গুলি, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ। নিরস্ত্র ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই রকম বর্বর আক্রমণের জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। পুলিশের এ আক্রমণে প্রাণ হারায় জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহা সহ আরো ৭ জন। আহত হয় অসংখ্য ছাত্র- জনতা। গ্রেফতার করা হয় ১ হাজার ৩৩১ জনকে। পরে ১৮ ফেব্রুয়ারি মজিদ খান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্থগিত রাখতে বাধ্য হয় সরকার।
স্বৈরাচারী এরশাদ শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এদেশের ছাত্র সমাজ যে ১৪ই ফেব্রুয়ারীতে জীবন দান করতে পিছপা হয়নি সেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি আজ যেনো হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাঝ থেকে। আমরা যেনো ভুলে যাচ্ছি আমাদের দেশের ছাত্র আন্দোলনের লড়াকু একটি সময়কে।
আজ আমাদের তরুণ সমাজের কাছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি এক মহা আনন্দের দিন। উজ্জল ইতিহাসকে পদাবনত করে আজ ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হিসেবে এদেশের তরণ সমাজের মনে শক্ত জায়গা করে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। এ দিনে আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরাও পশ্চিমা ধাঁচে তাদের ভালোবাসার মানুষটিকে বিবাহ করে অন্য রকম একটা প্রেমের রস আস্বাদন করতে চান। তারা ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ান শহরে বন্দরে। যাদের সেই মুরোদ নেই তারা র্যালি করে বেড়ান চিরকুমার সংঘের ব্যানারে। কেউ আবার মানববন্ধন পর্যন্ত আয়োজন করে বসেন।
সর্বোপরি তরুণ সমাজকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবসের চেতনা ভুলিয়ে ভালোবাসা নামক পশ্চিমা ফ্যান্টাসিতে ভাসাতে শফিক রেহমান পুরোপুরি না হলেও অনেকাংশে সফল হয়েছেন। শফিক রেহমানের নামটা এ কারণেই আসলো, কারণ তিনি এ দিবসটির আমদানি করতে ব্যাপক আত্মত্যাগ করেছেন। শফিক রেহমান তৎকালীন যায় যায় দিন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। ১৯৯৩ সালেই সর্বপ্রথম এই যায় যায় দিন পত্রিকার মাধ্যমে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে পদার্পণ করে। ১৯৯৩ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বের হয় যায় যায় দিন থেকে। সেটা স্রেফ ভালোবাসা দিবসের জন্য। পাশ্চাত্যের মতো বাংলাদেশেও যাতে ভালোবাসা দিবস পালন করা হয় সেই দাবি তুলে তিনি ঐ বিশেষ সংখ্যার পুরোটাই ভালোবাসার তরে বিলিয়ে দেন। যার ফলাফলস্বরূপ শফিক রেহমান হয়ে যান বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের জনক। শহীদের রক্তের উপর ভালোবাসা দিবসটিকে প্রতিষ্ঠা করে উনি আজো বাংলাদেশের বুকে হেসে যাচ্ছেন পরিতৃপ্তির হাসি। এখন কতিপয় সচেতন মানুষ ছাড়া আর কেউ এ দিনটিকে স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে জানেন না।
তবে দিবস নিয়ে এরকম চক্রান্ত কেবল ১৪ই ফেব্রুয়ারিকেই ঘিরে নয়। এরকম ইতিহাসের কুখ্যাত ব্যাক্তিদের কালো ইতিহাসগুলোকে ধামাচাপা দিতে নানা চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ আগেও দেখা গেছে। এক্ষেত্রে কখনো সেই কুখ্যাত ব্যাক্তি কিংবা কখনো সেই কুখ্যাত ব্যাক্তিদের ধূসর এসব চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভূমিকা পালন করে থাকে। একারণেই হিরোশিসা দিবসের আগ মুহূর্তে বিশ্ব বন্ধু দিবস বেশ ধুমের সাথে পালন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক বোমা ফেলার নৃশংস দিনটিকে আড়ালে ফেলে দেয়া হয় বিশ্বের কাছ থেকে। পুরো বিশ্বের তরুণ সমাজ বন্ধুত্বের ফ্যান্টাসিতে অন্ধ হয়ে পরে ভুলে যায় হিরোশিমা দিবসটির কথা। বন্ধু দিবসের ঝাঁকজমক আর হৈ হুল্লোরের চাপে পরে হিরোশিমা দিবসটি আর কারো চোখে ভাসে না।
এসব চক্রান্তের কারণে ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দিবসের। জয়ী হয়েছে শফিক রেহমানের মতো চক্রান্তকারী কিংবা আন্তর্জাতিক বিভিন্ন চক্রান্তকারী গোষ্ঠী কিংবা তাদের এজেন্ট। আমাদের ১৪ই ফেব্রুয়ারি যেনো এভাবে হারিয়ে না যায়। শফিক রেহমানের প্রবর্তিত “ভালোবাসা দিবস” এর চাপে যেনো “স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস”টি পিষ্ট না হয়। দেশের তরুণ বন্ধুদের এই দিনটিকে ভালোবাসার ফ্যান্টাসিতে নয়, স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহার রক্তের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর আহ্বান করছি।



সৌরভ দাস
সাধারণ সম্পাদক
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট,
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।




মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.