![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বই পড়ার অভ্যেস ছিল ছোটবেলা থেকেই। হিফজ খানায় পড়াকালীন মাঝামাঝি সময়ে এসে মনের ভেতর অদ্ভূত কথাবার্তারা উঁকিঝুকি মারতে লাগলো। গোপন কুঠুরিতে কিসের বেদনা যেন। তরুণ হৃদয়ের এ মধুর যাতনা আমাকে কিছুটা অশান্ত করে তুললো। টের পেলাম ভেতরে ভেতরে কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে। জানি না তবে অতি উচ্চাঙ্গ-টাইপের অনেক কথা-বার্তা লিখে ফেলার জন্য আঁকুপাকু করতে লাগলাম। অতি উন্নত কিছু, অতি আধ্যাত্মিক। সে বয়সে হৃদয় নদীর তীরে অর্থহীন মধুময় উচ্ছ্বাসের যে বিপুল ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে, লেখার প্রতি আমার এ টান তারই প্রতিক্রিয়া।
একদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয় হয় ভাব। ক্লাসে বসে বৈকালিক তেলাওয়াত করছি। চারপাশের গ্রামের প্রকৃতি কেমন ঝিমিয়ে এসেছে। নিঃসঙ্গতায় হা হা করছে। সে সময়টিতে আমি পরম এক আবেগে বিদ্ধ হলাম। পকেট থেকে কলম বের করে হাতে লিখলাম—‘মজলুমের আর্তনাদে খুলে খুলে যাচ্ছে মানবতার বদ্ধ দুয়ার’। বাক্যটা বিব্রতকর এবং চলমান পরিস্থিতির বিচারে ভাবগতভাবে অত্যন্ত দুর্বল, অশুদ্ধই বলা যায়। লেখার পর আমি খুবই লজ্জিত হয়ে পড়লাম। হাতটা লুকিয়ে ফেললাম সাথে সাথে। একটু পর। পাশে বসা বন্ধু সোহেলকে পড়ে শোনালাম বাক্যটা। সোহেল কী বুঝলো কে জান। স্বভাবসুলভ একটা হাসি দিল। যদ্দুর মনে পড়ে এটাই আমার প্রথম রচনা। দেয়ালে প্রকাশ করলে যদি হয় দেয়ালিকা, তাহলে হাতে প্রকাশ করলে হস্তিকা হওয়া উচিত। আমার প্রথম এই বিব্রতকর রচনাটি আমি হস্তিকায় প্রকাশ করলাম।
এর প্রায় তিন বছর পর, এক ছুটিতে সাদা কাগজের চার পৃষ্ঠা জুড়ে একটা ছোট্ট দেয়ালিকা তৈরী করলাম। পাঁচ-দশ লাইনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রচনা। সম্পাদকীয়, প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা, কৌতুক ইত্যাদি প্রায় সকল আয়োজনই ছিল। লেখা শেষ করারর পর এবার এর নাম দেওয়ার পালা। কেন যেন খুব একটা ভাবতে হয় নি। শুরুতেই মাথায় এল এর নাম হবে ‘আওয়াজ’। নিচে শ্লোগান হিসেবে ছোট্ট করে থাকবে ‘হৃদয়ের প্রতিধ্বনি’। আওয়াজ! এ কেমন নাম! কিন্তু কথা এটাই যে, ‘প্রথম দেখায় প্রেম’- এর মত কিছু একটা হয়ে গেছে। ফলে এ নামটিকে আমি কখনো ছাড়তে পারিনি। পরবর্তীতে অবশ্য অন্যের প্ররোচনায়-চাপে শিশির, ভোরের শিশির ইত্যাদি কোমল নামগুলো নিতে হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আওয়াজকে ফিরিয়ে এনেছি। একদিন কোন পত্রিকায় যেন পড়লাম আওয়াজ নামে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুররীও একটা পত্রিকা করতেন। যাই হোক। প্রিয় সেজো ভাইয়া সবুজ কালিতে বাঙলা ও ইংরেজিতে আওয়াজ নামটি দু জায়গায় এঁকে দিলেন। সাথে লেখাগুলো কিছুটা সম্পাদনাও করে দিলেন।
জিনিসটি তৈরী হওয়ার পর আমার ভাই-বোনেরা মুগ্ধতা প্রকাশ করলো। এতে আমি খুবই উৎসাহিত হলাম। আমার এক ফুফা ছিলেন, চাচীর সূত্রে আমরা তাকে মামা বলে ডাকতাম। শেষ দিকে এসে তিনি অসুস্থ হয়ে সব সময় বিছানায় শুয়ে-বসে জীবন পার করছিলেন। জীবনের প্রথম দিনগুলোতে ফুফুর কাছে নিয়েছিলাম পানের দীক্ষা। সেই সুবাদে পান খাওয়ার জন্য পত্রিকাটি হাতে করে ফুফুর বাড়িতে গেলাম। ফুফা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন : হাতে কী? আমি কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে মিনমিন করে বললাম—দেয়ালিকা। তিনি বললেন : বাহ্, পড়ে শুনাও তো দেখি। আমি বিপুল আগ্রহে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে শোনালাম। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনি বিভিন্ন ধ্বনির মাধ্যমে মুগ্ধতা প্রকাশ করলেন। একেবারে শুরুতেই আওয়াজের জন্য এরকম মনোযোগী সমঝদার একজন পাঠক পেয়ে যাওয়া সত্যিই সৌভাগ্যের ব্যাপার। ঘরে ফিরে আসার পর আম্মা আমার হাত থেকে পত্রিকাটি নিয়ে সোজা আব্বার কাছে চলে গেলেন। এরপর আব্বাকে জোরে জোরে পড়ে শোনাতে লাগলেন। দুজনের সেকি আনন্দ। আমি লজ্জায় আনদ্দে ফুলে ফুলে উঠে বাতাসে ভাসতে লাগলাম।
আজ আওয়াজ তার জন্মের প্রায় দশ-এগারো বছর পার করতে চললো। এ দীর্ঘ সময়ে ছুটি-ছাটায় বছরে এক দুটো করে প্রায় নিয়মিত বের হচ্ছে। মনের মাধুরী মিশিয়ে বলে বাঙলায় একটা কথা আছে, আওয়াজের কাজটি আমরা আক্ষরিক অর্থেই মনের সবটুকু মধু ঢেলে উৎসব করে করতাম। এ উল্লেখযোগ্য তেমন বড় বা গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ নয়। কিন্তু এতে যে আনন্দ ও তৃপ্তি লাভ করেছি, তার তুলনা পাওয়া মুশকিল।
ঘরের বাচ্চাদের মধ্যে আওয়াজ এর সুস্পপষ্ট একটা প্রভাব লক্ষ্য করি। এর মাধ্যমে তাদের ভেতর লেখালেখি করা বই পত্তর পড়া ইত্যাদির প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষণ ও উদ্দিপনা তৈরী হয়েছে। কিছুদিন আগে দেখলাম তারা নিজেদের হাতে তৈরী ছোট ছোট খাতা আর কলম নিযে দলবেধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর কে কী পেল এই নিয়ে তুমুল হইচই করছে। জিজ্ঞেস করলাম, ঘটনা কী? তোমরা কী করছো? সবাই মিলে সমস্বরে জবাব দিল, আমরা বই লিখছি। দুএকটি খাতা হাতে নিয়ে দেখলাম সেখানে নিজেদের মধ্যে প্রচলিত কিছু স্থানীয় ব্যাঙ্গাত্মক ছড়া ও শ্লোক লিখে রেখেছে। বয়স আর কতই হবে—কারো ছয়, কারো আট। ঘটনা দেখে আমি যুগপৎ আানন্দিত ও বিস্মিত হলা।
শুরুর দিকে লেখার সংকট হত খুব। সবগুলো লেখা নিজেই লেখতাম। মাঝে মাঝে জাবের ভাইয়ার ডাইরী থেকে অনেকটা চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে কিচু লেখা সংগ্রহ করতাম। আমার পুরে পরিবার দেয়ালিকার কাজে আমাকে শতভাগ সমর্থন ও উৎসাহ জুগিয়েছে। এমনকি পিচ্চিরা পর্যন্ত আশপাশে ঘুরাফিরা করে, জিনিসপত্তর নষ্ট করে আমাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। শুরু থেকে আওয়াজের পিঠ লালন-পালন করে আসছেন আমার বড় ভাইয়া মাও. নূরুল হুদা চৌধুরী। সবসময় খোঁজ-খবর রেখে প্রশংসা করে উৎসাহ দিয়ে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছেন মেজো ভাই মাও. নাজমুল হুদা চোধুরী। আওয়াজের একজন বড় পাঠক হলেন আমাদের প্রিয় বাবা। আওয়াজ দেয়ালে লাগানোর পর আব্বা গোসল থেকে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে পড়েন। তাঁর এ নিরব সমর্থন আমাদের অনেক বড় পাওয়া। আরেকজনের কথা না বললে আমার এ গল্পটি অপূর্ণ থেকে যাবে। সে আমার ছোট বোন। আওয়াজ নিযে তার আগ্রহের কোন সীমা ছিল না। কাজ করার সময় দীর্ঘ রাত পর্যন্ত পাশে বসে থেকে সঙ্গ দিয়েছে। বোনটি আমার এখন অস্ট্রেলিয়া থাকে। সে দূর দেশ থেকেও ফোনে প্রায়ই খোঁজ-খবর রাখে। আজ এ গল্পের ভেতর দিয়ে তাকে মমতা মাখানো গভীর কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
এ পর্যন্ত আরবি ইংরেজী বাঙলা— এ তিন ভাষায় কাজ হয়েছে। সামনে উর্দু ও ফারসীতে কয়েকটি সংখ্যা করার ইচ্ছে রইলো। ‘প্রতিবর্ণ’ ও ‘দি সেকেন্ড ভয়েস’ নামে ছবি নির্ভর কয়েকটি ব্যতিক্রমী সংখ্যা হয়েছে। কয়েক বছর হল আওয়অজের দায়িত্ব নিয়েছে আমার প্রিয় শিশুর দল— আবু তালহা, হুজাইফা মাহমুদ ও আনাস চৌধুরী। বর্তমানে তারা আমাকে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে রেখেছে।
মানুষ যেমন জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসে অতীত রোমন্থন করে প্রগলভ হয়ে যায়, আমারও হয়েছে এমন। আমার কৌতুহলপূর্ণ রহস্যময় কৈশর আর তুমুল যৌবনের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে এ আওয়াজের গাঢ় নিবিড় ছায়া। আজ স্মৃতি চারণ করতে গিয়ে শুরুর দিনগুলোর কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে শুরুর সংখ্যাগুলোর কথা। ওহ, সে এক সময় ছিল বটে। এখন অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। আওয়াজের জন্য সময় বের করা হয়ে ওঠে না। কিন্তু টানটা রয়ে গেছে আগের মতোই। সময়, সময় বড় নিষ্ঠুর। জানি, যে অতীত পাখির পালকে লেগে থাকা শিশিরের মত হারিয়ে গেছে রোদের মায়ায়, সে আর ফিরিবার নয়। সে ফিরবে না ঠিক, কিন্তু তার সুরটি যে রয়ে গেছে। কে যেন কথা কয় প্রাণে প্রাণে। সচকিত হয়ে পেছন ফিরে তাকাই। একটা সময়ে গিয়ে হয়তো সবাই ভুলে যাবে আমাদের একটি আওয়াজ ছিল। আমাদের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি ছিল। সবকিছু শূন্য হবে। নিরব নিশ্চুপ হবে। আর এই আমি এর অম্লমধুর স্মৃতির ভেতর একাকি বসবাস করব। আমার কাছে যে এর মূল্য অনেক। প্রিয় নজরুল কি সাধে বলেছেন—আপনার মনে পুড়িব একাকি, গন্ধ-বিধুর ধুপ!
©somewhere in net ltd.