নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চেতনায় মুক্তিযোদ্ধা

সায়েমুজজ্জামান

কাজী সায়েমুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে কিউং হি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড ট্রেড পলিসি বিষয়ে মাস্টার্স। জন্ম ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম শহরের দামপাড়ায়। তার পূর্বপুরুষ ছিলেন দক্ষিণাঞ্চলের বাউফলের ঐতিহ্যবাহী জমিদার কাজী পরিবার। ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখিতে হাতে খড়ি। তবে ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তিনি সাংবাদিকতার সঙ্গে জড়িত হন। তিনি যুগান্তর স্বজন সমাবেশের প্রতিষ্ঠাতা যুগ্ম আহবায়ক। ২০০৪ সালে তিনি দৈনিক মানবজমিন পত্রিকায় স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেন। পরে ইংরেজী দৈনিক নিউ এজ এ সিনিয়র প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে ২৮ তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের একজন সদস্য হিসেবে সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, সহকারী কমিশনার (ভূমি), সিনিয়র সহকারী কমিশনার, সিনিয়র সহকারী সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ লোক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেক্টর (সচিব) এর একান্ত সচিব হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনডিপিতে লিয়েনে চাকরি করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রোগ্রামে ন্যাশনাল কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। শিল্প সচিবের একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷বর্তমানে সরকারের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলা ছাড়াও ইংরেজী, আরবী, উর্দ্দু ও হিন্দী ভাষা জানেন। ছোটবেলা থেকেই কমার্শিয়াল আর্টিস্ট হিসেবে পরিচিত ছিলেন। যেকোনো প্রয়োজনে ইমেইল করতে পারেন। [email protected]

সায়েমুজজ্জামান › বিস্তারিত পোস্টঃ

গল্প : জাতে জাতে মিলে

২১ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১০:২৩

কাজী সায়েমুজ্জামান



এক.

মানুষের জীবনে দ্বিতীয় প্রেম আসে অনেক প্রবল গতিতে। সেটা শুরুতেই প্রথম প্রেমকে জলোচ্ছ্বাসের মতো ছাপিয়ে যায়। এটা না হলে কারো জীবনে দ্বিতীয়বার আর প্রেম আসার সম্ভাবনা ছিলনা। এ কারণেই মানুষ জীবনে বারবার প্রেমে পড়ে। এই কথাটাই প্রতিদিন মনে হয় আমার মানবীর চোখের দিকে তাকিয়ে। এখনও তাকিয়ে আছি সেই অন্তহীন চোখের মায়াবী আকর্ষণ দেখার নেশায়। আজি জানি, কিভাবে এই আকর্ষণ আমার পূর্বের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।

মানবির ওই চোখে আমার জন্য ভালবাসা আছে। শংকা অভিমান কি নেই! সেখানে বৃষ্টি আসে। না বলা জমে থাকা অনেক কথা নিরবতার আলোতে আমি পড়তে পারি। বৃষ্টি হওয়ার আগে আকাশে যেমন মেঘ জমে, কিছু বলার আগেই মানবীর দুচোখেই তার পূর্বাভাস পাই। আজও পেলাম। তবে হলফ করে বলতে পারি, আজও বলবে ওর প্রথম প্রেমের কথা। কোন শব্দের পর পর কোন শব্দ আসবে কবির মতো তা অবলীলায় বলে দিতে পারি। তবুও সেই কথা।

-জানো ওর আরেকটা কথা বলা হয়নি।

-তোমার সেই প্রথম প্রেমের কথা তো। আমি জানি সেই প্রেম প্লাবনের মতো উপচে দিয়েই তোমার জীবনে আমাকে নিয়ে নতুন প্রেম বাসা বেঁধেছে। এ কারণেই আমি ওই বিষয়টি নিয়ে কখনোই ঈর্ষান্বিত নই। তোমার সেই প্রেম দড়জা খুলে দিয়েছিল, আর আমি সেই দড়জা দিয়েই তোমার ভেতরে ঢুকে পড়েছি। মানুষ ঘরে ঢুকে পড়ে বসে গেলে দড়জা কে খুলে দিয়েছিল তা মনে রাখেনা।

-পুরুষ মানুষ আমার ঢের চেনা আছে। এদের ভদ্রতা আর উদারতা উপরে উপরে। আমার এক খালাতো বোনের জীবনেই এটা দেখেছি। তার প্রথম স্বামী একটি সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। সে পণ করেছিল আর বিয়ে করবে না। কিন্তু আরেকজন এসে তার শোকতুর পণকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আমি তাকে দেখেছিলাম। খুব উদার আর ভদ্র। অমায়িক ব্যবহার। তার উদারতায় আর প্রেমের বন্যায় আমার বোন পূর্বের সব ভুলে গিয়েছিল। তাকে বিয়ে করলেও সেটা অবশ্য টিকেনি। ওই শিক্ষিত ভদ্র লোকটার মুখোশ উন্মোচন হতো রাতে। বিছানায়। স্ত্রীর সঙ্গে সিঙ্গারের সময়। তার উত্তেজনা শুরু হতেই মানুষটা পাল্টে যেতো। শুরুটা হতো তার আগের স্বামী তাকে কিভাবে উত্তেজিত করতো- এই প্রশ্নের মধ্য দিয়ে। এরপর কোন আসনে পরিতৃপ্ত হতো এইসব। প্রথম প্রথম আমার বোন ভেবেছিলো, হয়ত সে ঈর্ষান্বিত হতে চাইছে। তার কামনার বারুদকে স্ফূলিঙ্গে রূপ দিতে সে এটা করছে। এটা হয়ত তার যৌনতা প্রকাশের একটি নিজস্ব ভঙ্গি। কিন্তু এক পর্যায়ে খিস্তি খেউড় বেড়ে যায়। মিলনের ওই সময়টায় সে পশুর মতো আচরণ করে। এই থেকেই আমার পুরুষ মানুষকে নিয়ে যত ভয়।

পুরুষের প্রতি নারীর এ অভিযোগ অনেক প্রাচীন। নারী-পুরুষ সৃষ্টি থেকে। আমি নারী পুরুষ বিষয়ক তর্কে কখনো নিজেকে জড়াই না। পুরুষের বিরুদ্ধে একজন নারী যখন অভিযোগ করে তখন একজন পুরুষের নূন্যতম ভদ্রতা হলো- তাকে সমর্থন করা। আমিও সমর্থন করে জানিয়ে দিলাম আমি অভদ্র নই।

প্রতিদিন মানবীর প্রথম প্রেমের কথা শুনে গেলেও আমার নিজের জীবনের কথা তাকে বলা হয়নি। আমার গত ৩২ বসন্তের জীবনকে ছুঁয়ে যাওয়া নিজস্ব কিছু গল্প আছে। মানবী এসে আমার জীবনের আগের সব কিছু ঢেকে ফেলেছে। ঠিক পেইন্ট করার মতো। একটি রং অন্যটাকে ঢেকে ফেললে আগের রঙয়ের অস্তিত্ত্ব চিরদিনের মতো ঢাকা পড়ে। মানবী প্রমাণ করেছে- এক সময়ের বিষন্নতা কখনো কখেনো সময়ের ব্যবধানে আনন্দ হয়ে বাজে। এখন ওর জীবন আর আমার জীবন নীলনদের মতো। দুটি ধারা একটি নদীতে এসে মিলে গিয়ে একটি নাম ধারণ করেছে। ওর একান্ত ইচ্ছা আমাদের বিয়ের কার্ডে ওর একটি হাত পাশাপাশি আমার হাতকে ছুঁয়ে যাওয়ার ছবি থাকবে। যেন দুটি হাত একসাথে মিলে গিয়ে এক ধারায় এসে মিলে গেছে এক জনমের জন্য। ভাবতে গিয়ে এক পর্যায়ে মনের অজান্তেই আমি বলে উঠলাম, জাতে জাতে মিলে।

-এর মানে কি!

- আমার জীবনেও তোমার মতো একটি গল্প আছে। তার আগে আজকে অন্য একটি গল্প শুনো। গল্প শুরু করার আগে চেয়ে দেখলাম, মানবী গালে হাত দিয়ে রাজ্যের অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।



দুই.

আমি গল্প বলা শুরু করলাম।

বরিশালে একজন ব্যারিস্টারের জন্ম হয়েছিল সেই ইংরেজ আমলে। তিনি কলকাতায় স্থায়ী হয়ে গিয়েছিলেন। আর একটি কারণ তার জন্ম হয়েছিল একটি মুচি সম্প্রদায়ে। নিম্ন বর্ণের হওয়ার কারণে শিক্ষিত হওয়ার পরও তথাকথিত জমিদারীর প্রভাব, আধিপত্য আর গোড়ামীর কারণে ভদ্র সমাজে তাকে স্থান দেয়া হয়নি। যাই হোক, ধরি- তার নাম শ্যামল দাস। ছোটবেলা থেকে পন্ডিতের ডেরায় যেতে পেরেছিলেন পন্ডিতের মহাত্ম্য আর ভাগ্যের জোরে। এরপরই তিনি মেধার স্বাক্ষর রাখতে পেরেছিলেন। অন্যের ঘরে জায়গির থেকে আর ধনাঢ্যদের সহমর্মিতায় একসময় বিলাত গিয়ে ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরলেন। পরিবার ভাবল তাকে তো বিয়ে করানো দরকার। কিন্তু মুচি সম্প্রদায়ে তার সহধর্মিনি হতে পারে এমন মেয়ে নেই। ঘটকরা চেষ্টা করতে লাগলেন যাতে অন্য জাতের একটি মেয়েকে তারা এনে দিতে পারেন। কিন্তু ছেলে শিক্ষিত হলেও মুচির ছেলেকে পাত্র হিসেবে মেনে নিতে রাজি নয় কোন কনের পরিবার। কারণ শ্রেণীপ্রথা। শুদ্ররা আলাদা জাত। এটা হিন্দু ধর্মের মুল বিশ্বাস জন্মান্তরবাদেরই একটি অংশ। এক জন্মে পাপ করলে পরের জন্মে সে মানুষ হলে তার জন্ম হবে নিম্নবংশে। এটা পাপেরই যে শাস্তি। শ্যামল দাস লক্ষ্য করলেন- এদেশটি এখনও জাত শ্রেণী পেশার বেড়াজাল থেকে বের হতে পারেনি। ব্রাহ্মণ এসে বললেন, বিয়ে হতে হলে জাতের সঙ্গে জাতের মিল হতে হয়। এছাড়া বিয়ে হয়না। শোকে দু:খে শ্যামল দাস পূর্ব বাংলা ছেড়ে কলকাতা গেলেন। শুরু করলেন আইন ব্যবসা। নিজের পদবী পাল্টে রায় চৌধুরী জুড়ে দিলেন। এখনও কলকাতায় যারা এসব উচ্চ পদবী যারা ব্যবহার করেন, তাদের এদেশে মুল খোঁজ করলেই অন্য কিছু ধরা পড়বে। যাই হোক সেই সময়ও তার প্রেম হয়ে গেলো এক জমিদারের কন্যার সংগে। জমিদার বাবুও এদেশ থেকেই গেছেন। উচ্চ শিক্ষিত ছেলে আর আইন ব্যবসায় একটি অবস্থান থাকার ফলে তিনি আর না করেন নি। অবশেষে শ্যামল রায় চৌধুরীর জীবনে বিয়ের সানাই বেজে উঠলো।

বিয়ের দিন সকাল থেকেই শ্যামল বাবুর নিজেকে অপরাধি মনে হচ্ছে। নিজের জাত লুকিয়ে বিয়ে করতে গিয়ে একটি কথা বারবার মনে কাটা হয়ে বিধছে। ঘটকের কথা মনে পড়ছে, জাতে জাতে মিলে। উনবিংশ শতাব্দীর মানুষ এখনও এই গাজাখুড়ি গল্প বিশ্বাস করে ভেবে অবাক হলেন। এটা হয় কি করে? আর হলেও আজ যা ঘটতে চলছে তা কি! এটা তো বাস্তব আজ ভবানী রায় চৌধুরীর একমাত্র কন্যা অবন্তিকা রায় চৌধুরী আমার অর্ধাঙ্গিনি হতে চলছে। কেমন যেন একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন শ্যামল।

ঘোরটা কেটে যায় বাসর রাতে। অনেক আবেগের মধ্যে তিনি নতুন স্ত্রীকে একটি প্রশ্ন করে ফেলেন। আসলেই কি তুমি ভবানী বায় চৌধুরীর কন্যা। অবন্তিকার কাছে কথাটা শুল হয়ে বিধেঁ যায়। প্রত্যেক মানুষের জন্ম প্রক্রিয়া এক। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে দেখলে- পুরুষের যৌনাঙ্গ নারীর যৌনাঙ্গে প্রবেশ করাতে হবে। পুরুষের বীর্য নারীর গর্ভাশয়ে ঢেলে দিতে হবে। একবারের বীর্যে থাকে ৫০০ কোটিরও বেশি শুক্রকীট থাকে। নারীর যোনিতে থাকে ডিম্বানু। এই ডিম্বানুর সঙ্গে একটি শুক্রকীটের মিলন হলেই তারপর সন্তানের জন্মদান। এজন্য ৫০০ কোটি শুক্রকীটের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। একটি ভাগ্যবান কীট ডিম্বানুর মিলন পেতে সফল হয়। তার মানে পুরুষের একবারের বীর্যপাতের শুক্রকীট দিয়ে দুনিয়ার তাবৎ নারীদের সন্তান ধারণ সম্ভব। উদারতা, জ্ঞান আর তথ্যের দৃষ্টিতে দেখলে এটি খুবই একটি সহজ জৈবিক প্রক্রিয়া যা প্রতিটি প্রাণির মধ্যেই ঘটে থাকে। কিন্তু সমাজ আর ধর্ম বিষয়টিকে জটিল করে ফেলেছে। ইসলামে এর একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। একদিন একজন মহিলা এসে প্রিয় নবী দ: এর কাছে অভিযোগ করলেন, কেন তিনি পুরুষকে একই সঙ্গে চারজন নারী সম্ভোগের অনুমতি দিলেন অথচ নারীর জন্য শুধু একজন পুরুষ নির্ধারিত করলেন। নবী তাকে চারটি পাত্র ও চারটি উটের দুধ নিয়ে আসতে বললেন। এবার তিনি একটি উটের দুধ চারটি খালি পাত্রে ঢেলে বললেন, এবার বলা সহজ চারটি পাত্রেই কোন উটের দুধ রয়েছে। পরে চারটি উটের দুধ একটি পাত্রে ঢেলে বললেন, এবার বলো এ পাত্রে কোন উটের দুধ রয়েছে। মহিলা বললেন, চারটি উটের দুধ মিশে গেছে। আলাদা করা সম্ভব নয়। এর প্রেক্ষিতে নবী বললেন, একজন পুরুষ একাধিক নারী সঙ্গ লাভ করলেও তার সন্তানের পিতৃত্ব নির্ধারণ করা যায়। কিন্তু একজন নারীর চারজন স্বামী থাকলে সন্তানের পিতা নির্ধারণ করা অনেক জটিল ব্যাপার। এ কারণেই পুরুষের জন্য এমন সুযোগ। তবে বেহেশতে যেহেতু সন্তান নির্ধারণের কোন ব্যাপার নেই তাই সেখানে নারী পুরুষের স্বভাবিক সম্পর্ক থাকবে। মৃত্যুর মধ্য দিয়েই বিয়ের বন্ধন শেষ হয়ে যায়। এসব কারণেই দুনিয়ায় মানুষ জন্মের ব্যাপারে অনেক সংবেদনশীল। বিশষে করে কেউ কারও জন্মদাতা নিয়ে প্রশ্ন তুললে তা সহ্য করতে পারেনা। বাবার আদরের মেয়ে অবন্তিও সহ্য করেনি। সেই রাত থেকেই কাদঁতে শুরু করে। শ্যামল তার কান্না থামানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কোন কাজে আসেনি। সকালে অবশ্য অবন্তি তার মাকে জামাই বাবুর কান্ড বলে দিয়েছিল। মা কন্যাকে বুঝিয়েছিলেন। আর বুঝিয়েছিলেন বলেই বিয়েটা ভেঙ্গে যায়নি। মা এতবড় দায়িত্ব কেন নিয়েছিলেন, অবন্তীর মতো এখন পর্যন্ত আমরাও জানিনা। গাছের পাতা একসময় ঝড়ে যায়। আবার নতুন করে গজায়। জীবনের এ চক্রে অবন্তি আর শ্যামল দম্পত্তিও ভুলে গিয়েছিল জীবনের প্রথম রাতের ঝড়ো হাওয়ার কথা। তারা এখন সুখি। এক সন্তানের মা বাবা।



তিন.

১২ বছর পর। অবন্তি শ্যামলকে তার জীবনের গল্প বলছে। যা সে জীবনের এই প্রান্তে এসে আজকেই জেনেছে। রোগে শয্যাশায়ী তার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। দেখে মনে হচ্ছে তিনি আর নি:শ্বাস নিতে পারবেন না। অবন্তি কাছে গিয়ে মায়ের কপালে হাত রাখে। মা দু হাত দিয়ে তাকে ধরে হু হু করে কাদতেঁ লাগলেন। বললেন, অবন্তী বিয়ের পরদিন তোমাকে কাঁদতে দেখে যখন জানতে পেরেছি তোমার বাবা কে সেটাই জানতে চেয়েছে শ্যামল তখনই বুঝেছিলাম-তোমার জন্মরহস্য গোপন করার দিন শেষ। সেদিনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম মরণের আগে হলেও তোমাকে সবকিছু জানিয়ে যাবো। অবন্তি মা, আজ মানুষ হিসেবে নিজেকে পূর্ণ করার পূণ্যলাভ করতে চাই।

অবন্তির মা উমা দেবী ৩০ বছর পেছনে ফিরে গেলেন। তিনি ফরিদপুরের জমিদার ভাবনী রায় চৌধুরীর স্ত্রী। বাড়ি ভর্তি কাজের মানুষ। যেকোন জিনিস চাইতে দেরী তার সামনে সেই জিনিসটির আসতে দেরী নেই। কিন্তু তার অন্তরের আসলে যে চাওয়াটা তা মনে হয় ভবানী রায় চৌধুরী শুনতে পারেন নি। বিয়ের ১৫ বছর হয়ে গেলো। এখনও তাদের কোলে কোন সন্তান আসেনি। তিনি এই ঘেরাটোপ থেকে কিছুদিনের জন্য বেড়িয়ে আসতে চাইলেন। শেষে বাপের বাড়িতে গেলেন। ভাবলেন কিছু দিন থেকে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে। হয়েছিলোও তাই। কিন্তু দুপুরের নাগাদ স্বামীর বাড়িতে ফিরে শুনলেন তাদের আদরের গাভীটির মৃত্যু হয়েছে। সন্তান হারানোর শোক পেলেন যেন। ধর্মীয় কারণেই হোক আর একটি অবলা প্রাণীর সঙ্গে দীর্ঘদিন থাকার কারণেই হোক গাভীটি তার অনেক প্রিয় ছিল। তুলশী গাছের গোড়া এই গাভীর গোবরে লেপে দিয়েই তিনি পুজো দিতেন। ঘরে ছিটাতেন। উমা জানতে চাইলেন, গাভীটি কোথায়? তাকে বলা হলো, গতরাতেই মারা গেছে তাই বাইরে ফেলে দিয়ে আসা হয়েছে। তিনি শেষবারের মতো দেখতে যেতে চাইলেন। জমিদারের স্ত্রী বাড়ির অন্ত:পুরে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক। ফলে কেউ তাকে গরুটির মৃতদেহের কাছে নিয়ে যাবে- ইচ্ছা প্রকাশের পরও কারো কাছ থেকে এমন সায় পেলেন না। কাজের মহিলা তার বিশ্বস্ত। তার কাছেই তিনি জানলেন, বাড়ির পেছনে দেয়ালের বাইরে ফেলে দেয়া হয়েছে ধবল গাভিটিকে। কেমন যেন এক টান অনুভব করলেন তিনি। ওই সময় জমিদার বাড়িগুলো দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল। তারপর পরিখার মতো। বাইরে অনেক জঙ্গল। সেখানে দিনে দুপুরেই শিয়ালের ডাক শোনা যায়। আপত্য স্নেহের কাছে ভয় হার মানলো। উমা দেবী আদরের গাভীটিকে শেষবারের মতো দেখার জন্য একাই চলে গেলেন সেখানে।

-বুঝলি মা, সেই দিনটি আমার জন্য সৌভাগ্যের না দুর্ভাগ্যের ছিল আমি এখনো জানি না। কোন দিন এই সিদ্ধান্তে আসেতও পারবোনা। আমি ওখানে যাওয়ার আগে কাউকে বলিনি। একা একা কোনমতে একটি পুরাতন গেট পার হয়ে সেখানে পৌছে গেলাম। গিয়ে একটি অদ্ভুত দৃশ্য দেখলাম। ধবল গাইয়ের গায়ের চামড়া প্রায় ছাড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একজন পুরুষ নিবিষ্ট মনে খুব সন্তপর্ণে তার চামড়া ছাড়িয়ে নিচ্ছে। আমার চোখ গাভীটি ছেড়ে সেই পুরুষটির দিকে গিয়ে পড়লো। উদোম গায়ে সুঠাম দেহকাঠামো চোখে পড়লো। আলাদা আলাদা মাংসপেশী শরীর ঠিকরে বের হয়ে যেতে চাইছে। দরদর করে ঘার্মাক্ত ওই শরীরটায় একটি অজাগতিক কামনার দ্যূতি ছাড়িয়ে পড়েছে। একটি মাত্র ধুতি তার পরনে। সেটি উরুর শেষ স্থানে এক জায়গায় জায়গায় গিয়ে জড়ো হয়ে আছে। ঝোপের আড়ালে দাড়িয়ে তাকে অনেকক্ষণ দেখতে থাকি। বুনো ফুলগুলো যেন মাদকতা ছড়িয়ে দিয়েছে সবখানে। আমি এগিয়ে গেলাম তার কাছে। আমাকে দেখে সে কাচুমাচু হয়ে সমীহ দেখালো। একটু পরেই বুঝতে পারলো, আমি একা। আমি তার সঙ্গে কথা বলতে থাকলাম। জিজ্ঞাসা করলাম, তার নাম কি? সে বললো, সুরেশ। এই নির্জনে আমি আর আমার সামনে অর্ধ উলঙ্গ একজন পুরুষ। কিছুক্ষণ পর দুজনের মাঝে আরেকটি সত্ত্বার অস্তিত্ত্ব অনুভব করলাম। সেটি তার উত্থিত শিশ্ন। একজন পুরুষের এই অঙ্গটি এত বিশালাকার হতে পারে তা আমার ধারনারও বাইরে। ধুতির বেড়াজাল ছাড়িয়ে তার পৌরুষত্ব প্রকাশের স্পর্ধা জমিদার পরিবারের আভিজাত্য আর ক্ষমতাকে তুচ্ছজ্ঞান করে দিল। আমার তাকে সমীহ না করার উপায় কি? রক্ত আর ঘর্মাক্ত শরীরে পেটানো পেশীর বজ্র আটুনি আমাকে টেনে নিল। কিভাবে শুরু হয়েছিল তা বলতে পারবোনা। ভবানী রায় চৌধুরীর কাছ থেকে আমি এটা কখনো পাইনি। এত স্বর্গসুখ নারী পুরুষের মিলনে তা আমার আগে জানা ছিলনা। এমন সুখ পরেও কখনো পাইনি। বুনো আদিম পরিবেশে সে আমাকে পাচঁবার স্বর্গে পাঠিয়ে দিয়েছিল। প্রতিবারেই আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে তার পেশীগুলো কামড়ে ধরেছিলাম। কিন্তু সেই চিৎকার জমিদার বাড়ির অন্দরে গিয়ে পৌঁছেনি।

অবন্তী মা, পাপ পূণ্যের নির্ধারণ হয় কিসের ভিত্তিতে? যেখানে পাপ থাকে সেখানে জড়তা বা ইতস্ততা থাকে। স্বর্গ সুখ থাকেনা। স্বর্গ সুখ যেখানে পেয়েছিলাম, যেখানে নারী জীবন পূর্ণ করেছিলাম, আমার মন বলেনি এটা পাপ, সেটাকে আমি কেন পাপ বলবো। আমি কোন পাপ করিনি। সেটা ছিল আমার নারীত্ব পূর্ণ করার পূণ্য। শেষ দুপুরে আমি বাড়ি ফিরে গেলাম। সারা শরীরে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসলো। দুই মাস বিছানায় পড়ে ছিলাম। আর একদিন সকালে হঠাৎ বমি করতে গিয়েই টের পেলাম-আমার অস্তিত্ত্ব জুড়ে অন্য আরও কেউ আছে। আমি ছাড়া পৃথিবীর কেউ জানতে পারেনি- এ অস্তিত্বের সৃষ্টি কোথা থেকে। নারীত্ব পূর্ণ করার মতো পূণ্য আমি করেছিলাম বলেই আমি তোমাকে আমার কোলজুড়ে পেয়েছিলাম। আমি জানতাম, সুরেশ প্রতিদিন জমিদার বাড়ির পেছনে সেই ঝোপের আড়ালে আমার অপেক্ষায় থাকতো। তার সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি। ইচ্ছা যে ছিলনা তা নয়। পোয়াতি স্ত্রীর প্রতি জমিদারের আরো যত্ন বেড়ে গেলো। ঘর থেকে বেরিয়ে বাড়ির পেছনটায় যে যাবো- তার সুযোগ ছিলনা। একদিন শুনলাম, দেশটা ভাগ করে দেয়া হয়েছে। এদেশ এখন আর হিন্দুদের নয়। সিদ্ধান্ত হলো- সবাই কলকাতায় চলে যাবো। যেদিন বাড়ি ছেড়ে কলকাতার দিকে রওয়ানা করলাম, সুরেশের সঙ্গে দেখা করার আকুতি এই জমিদার বাড়িতে জীবনের একটি অংশ কাটানোর মায়াবী বন্ধনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ছেড়ে যাওয়া বাড়িটার দিকে আমি ফিরে তাকাতে পারিনি। ইচ্ছা ছিল আমার স্বর্গারোহনের জায়গাটা একটু দেখে যাবো। সবাই ভেবেছে, আমি কেদেঁছি বাড়ির মায়ায়, দেশের মায়ায়। আমি তোমাকে হলফ করে বলতে পারি, জীবন কাটিয়ে দেয়ার পরও যখন সবাই বলে দিল –এ দেশ, এ বাড়ি তোমার নয়, তখন তার প্রতি আর মায়া দেখিয়ে কি হবে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, একটি শোক আরেকটি শোককে এভাবে ভুলিয়ে দেয়। তবে আমি কেঁদেছিলাম সুরেশের জন্য। তোমার জন্মদাতার জন্য।

শ্যামল রায় চৌধুরীর জীবনে এত আনন্দ আর কখনো আসেনি। এই প্রথমবারের মতো স্ত্রীর সামনে শ্যামল দাস হলেন। স্ত্রীর জীবনকে দিয়ে তিনি নিজেকে আবার চিনলেন। সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজেকে জানো। এটা সবচেয়ে বড় জ্ঞান। অথচ মানুষ নিজের পরিচয় না জেনেই জীবন পার করে দেয়। শ্যামল আর অবন্তীর এই আনন্দ নিজেকে চেনার সঙ্গে আরেকজনকে চেনার আনন্দে। ১২ বছর এক সঙ্গে থাকার পর আজকে তারা নিজেদেরকে চিনতে পারলেন। অবন্তীর মুখ দুহাত ধরে তুলে শ্যামল বললেন, আমার বাবাও একজন মুচি ছিলেন। আমাদের জাতে জাতে আগেই মিলে গিয়েছিল, স্বর্গে এ বন্ধন রচিত হলেও আজ আমরা জানতে পারলাম।



পাঁচ.

একজন লেখক হিসেবে শ্যামল আর অবন্তীর সুখের জীবনে ঢুকে পড়ার আর কোন অধিকার আমার আছে বলে মনে করিনা। তারা সুখে থাক। আমি এখন মানবীর দিকেই মনযোগ দিচ্ছি। পাঠকদের আগেই বলেছিলাম, আমার মানবীর চোখে মেঘ জমে, বর্ষা নামে শ্রাবণের ধারা হয়ে। অনেক কান্না আসলে দেখলে ভালো লাগে। মানবীকে কান্নায় অপরূপা লাগে। আমি দেখতে থাকি। শুধু দুহাত দিয়ে তার কপালের উপর ঝুলে পড়া অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিলাম। মানবী আমার কাধেঁ মাথা রাখলো। কাধেঁ চোখের পানির অনুভব পেলাম। এত পবিত্র এ অনুভূতি। বললাম, শুধু তোমার জীবনেই প্রথম প্রেম আসেনি। আমার জীবনেও এসেছিল। সাধে কি আর বলেছি, জাতে জাতে মিলে। আসো আজকের চোখের জলের প্লাবনেই সেই প্রেমকে ছাপিয়ে ধুয়ে মুছে দেই। আল্লাহ তো কুরআনের সুরা আন নুর এর ২৬ নং আয়াতে বলেই দিয়েছেন, “দুশ্চরিত্রা নারীরা দুশ্চরিত্র পুরুষদের জন্য ও দুশ্চরিত্র পুরুষরা দুশ্চরিত্রা নারীদের জন্য ... ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী নারী বা মুশরিকা নারীকেই বিবাহ করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী বা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করে।” আরও বলেছেন, আমি মানুষকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি। আমাদের জোড়া তিনি বহু আগেই নির্ধারণ করে রেখেছেন। মানবী আমার ডান হাতটিকে টেনে এনে টেবিলের ওপর রাখলো। এরপর তার হাতটা পাশাপশি এনে দিল। ক্যামেরায় ফ্লাশ জ্বলে উঠলো- ক্লিক।



(রচনাকাল : ১৯৯৬)

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২১ শে এপ্রিল, ২০১৩ সকাল ১১:০৬

s r jony বলেছেন: অনেক বড় গল্প। অর্ধেক পরছি। বাকিটা পরে মন্তব্য দিব

১২ ই মে, ২০১৩ সকাল ১০:০৭

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: ধন্যবাদ।

২| ২৬ শে এপ্রিল, ২০১৩ রাত ১০:২৫

salopa বলেছেন: আপনি ঠিক বলেছেন , জাতে জাতে মিলে । যে যেমন , সৃষ্টিকর্তা তার সাথে তেমনই মেলান । আমারাই শুধু বুঝতে ভুল করি বা দেরি করি ।

১৪ ই মে, ২০১৩ রাত ১০:১৮

সায়েমুজজ্জামান বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.